মৌর্য শাসনব্যবস্থার সংগঠন ও প্রকৃতি

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্য শাসনব্যবস্থার সংগঠন ও প্রকৃতি” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্য শাসনব্যবস্থার সংগঠন ও প্রকৃতি

ভারতে মৌর্যবংশের শাসন চলেছিল প্রায় ১৩৭ বছর (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪-১৮৭ অব্দ)। এর মধ্যে প্রথম একশো বছর সময়কাল ছিল ক্রমোন্নতি ও গৌরবময়তার যুগ। অশোকের মৃত্যু (খ্রিঃপূঃ ২৩২ অব্দ) সেই ধারায় ছেদ ঘটায়। অতঃপর দুর্বল শাসকদের অধীনে মৌর্য শাসন কোনক্রমে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল মাত্র। সাম্রাজ্যের বিস্তার, প্রশাসনিক সংস্কার বা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কোন সম্ভাবনা পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায় নি। প্রথম পর্বেই মৌর্য শাসন কাঠামো রূপায়িত হয়েছিল। এর মুখ্য রূপকার ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। দ্বিতীয় পর্যায়ে অশোক পূর্বেকার কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে সামান্য কিছু সংযোজন করেছিলেন।

মৌর্য শাসনব্যবস্থার সংগঠন

মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এবং অশোকের নেতৃত্বেই ভারতে সর্বপ্রথম বৃহদাকার সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। দক্ষিণে অন্ধ্রের পেনার নদী থেকে উত্তর / উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বত এবং পূর্ব-পশ্চিমে সাগর থেকে সাগর (বঙ্গোপসাগর-আরবসাগর) পর্যন্ত সুবিশাল সাম্রাজ্য গঠনের প্রধান রূপকার ছিলেন এঁরা দু’জনেই। সেই সাম্রাজ্যকে সুগ্রথিত করে রাখার বিষয়েও তাঁরা যত্নবান ছিলেন। ভারতে সাম্রাজ্য গঠনের সূচনা পর্বে এই কাজটি ছিল রাজ্যজয়ের থেকেও কঠিন। কারণ ভারতের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য, ভাষা, ধর্ম, জাতি-বর্ণগত বিভেদ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজে সাফল্য অর্জনের জন্য গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বিচক্ষণ দূরদৃষ্টির প্রয়োজন। চন্দ্রগুপ্ত এবং অশোক উভয়েই সেই গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন, সহনশীলভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রাদেশিক শাসনযন্ত্র এবং উপজাতীয় অঞ্চলসমূহের সাথে আনুগত্যমূলক স্বাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা তাঁদের দূরদর্শিতার পরিচায়ক।

মৌর্য শাসনব্যবস্থার প্রধান উপাদানগুলি হল কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’, মেগাস্থিনিসের বিবরণ ‘ইণ্ডিকা’ এবং সম্রাট অশোকের অসংখ্য লেখমালা। কৌটিল্য বা চাণক্য সরাসরি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ক্ষমতা লাভ ও রাজ্য চালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ফলে তাঁর রচনা একদিকে যেমন মৌর্যদের রাষ্ট্রনীতির নির্দেশিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অন্যদিকে এই গ্রন্থে মৌর্য রাষ্ট্রনীতিকে বাস্তবের থেকেও বেশী মহান রূপে প্রতিভাত করার প্রয়াস থাকা অসম্ভব নয়। ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থের মূল অংশ পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালের লেখক এ্যারিয়ান, স্ট্রাবো, ডায়োডোরাস প্রমুখ গ্রীক লেখকদের উদ্ধৃতি থেকে মৌর্য প্রশাসন বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। অশোকের অনুশাসনগুলির (লেখ) ঐতিহাসিকতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বক্তব্যের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতভেদ আছে। সাহিত্যসূত্র এবং লেখমালার ভিত্তিতে মৌর্যশাসন ব্যবস্থার স্বরূপ ও প্রকৃতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি হল রাজার ক্ষমতা, কেন্দ্রীকরণ প্রবণতা কিংবা বিকেন্দ্রীকৃত শাসন ধারা, আমলাতান্ত্রিক ঝোঁক এবং রাজার স্বৈরাচারিতা নিরঙ্কুশ বা সীমাহীন ছিল কিনা।

মেগাস্থিনিস এবং অর্থশাস্ত্র উভয়সূত্রেই মৌর্য রাজাকে চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী বলা হয়েছে। মেগাস্থিনিসের মতে, চন্দ্রগুপ্ত সারাদিন রাজসভায় থাকতেন। বিচার ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হলে দেহচর্চা, খাদ্যগ্রহণ জাতীয় ব্যক্তিগত কাজ বাতিল করে দিতেন। অশোকের লেখতেও এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে। অশোক ষষ্ঠ গিরি অনুশাসনে প্রশাসনিক কাজে রাজা ও রাজকর্মচারীদের বিশেষত প্রতিবেদকদের, সদা সচেতন ও সক্রিয় থাকার কথা বলা হয়েছে। এই বিরামহীন প্রশাসনিক সক্রিয়তাকেই অশোকের অনুশাসনে ‘পকম’ বলা হয়েছে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তা কার্যকরী করা, কর্মচারীদের নিয়োগ-পদচ্যুতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই রাজার নির্দেশ ছিল চূড়ান্ত। অর্থশাস্ত্রে রাজাকে অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী বলা হয়েছে। তিনি ছিলেন উদ্যমী ও সদাজাগ্রত, রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক কর্মব্যস্ত মানুষ। মৌর্যদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাজধানী পাটলিপুত্র। এখানে রাজা অসম সাহসী নারী দেহরক্ষী বৃন্দ পরিবৃত হয়ে থাকতেন। স্ট্রাবো লিখেছেন যে, রাষ্ট্রীয় কাজে যেমন বিচার, যজ্ঞে আহুতি দান, মৃগয়া ইত্যাদির সময় চন্দ্রগুপ্ত প্রাসাদের বাইরে বেরোতেন। তবে জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা তাঁকে সদা সন্ত্রস্ত রাখত। অশোক সম্পর্কে এমন ধারণা অমূলক। কারণ তিনি নানা প্রয়োজনে জনগণের মুখোমুখি হতেন। তবে রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে চন্দ্রগুপ্তের সাফল্য থেকে অনুমিত হয় যে, স্ট্রাবোর ব্যাখ্যার মধ্যে কিছু কল্পনা আছে। উপজাতীয় বা মহাজনপদ জাতীয় ব্যবস্থা থেকে মৌর্যদের আমলে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুগে রাজার কর্তৃত্বকে অস্থির করার উপযোগী উপাদান না থাকাই স্বাভাবিক। স্বভাবতই মৌর্য রাজারা যে প্রশ্নহীন ও সীমাহীন কর্তৃত্ব ভোগ করতেন এ বিষয়ে সংশয় নেই।

শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি আইন, বিচার ও সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবেও মৌর্য রাজা চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। নীতিগতভাবে নয় কার্যত রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। বিচার বিভাগীয় কর্তব্য সম্পাদনের জন্য চন্দ্রগুপ্ত প্রতিদিন প্রাসাদের বাইরে এসে বিচারসভায় বসতেন। অর্থশাস্ত্রে রাজাকে ন্যায় বিচারের উৎস ও যন্ত্র বলা হয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত, অশোক প্রমুখ গুরুত্ব সহকারে বিচারকের দায়িত্ব সম্পাদন করতেন। সাধারণভাবে আইনের উৎস ছিল প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য। রাজা সামাজিক রীতিনীতির রক্ষক ও বাহক ছিলেন। তাই রাজা সরাসরি আইনের উৎস ছিলেন না। কিন্তু বাস্তবে মৌর্য রাজারা আইন সংশোধন করার অধিকারী ছিলেন। কৌটিল্য ‘রাজশাসন’ বা রাজকীয় অনুশাসনকে আইনের মর্যাদা দিয়েছেন। অশোকের অনুশাসনগুলিতে নানাপ্রকার প্রশাসনিক নির্দেশ জারী করা হয়েছে। বর্তমানের অর্ডিন্যান্স-এর সমতূল্য এই সকল অনুশাসনে ফৌজদারী আইনের ব্যাপক সংশোধন দেখা যায়। অর্থাৎ মৌর্য রাজারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে প্রথাগত আইনের (পুরাণা প্রকৃতি) সংশোধন, পরিবর্তন বা নাকচ করার বৈধ অধিকারী ছিলেন। একইভাবে রাজা ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, প্রধান সেনাপতি। প্রয়োজনে রাজা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন। অশোক ব্যক্তিগতভাবে কলিঙ্গ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বিশাল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণে রাজা শেষ সিদ্ধান্ত নিতেন।

সুবিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল মগধ। কেন্দ্রীয় শাসনের উৎসকেন্দ্র হিসেবে মগধ এবং পাটলিপুত্র প্রাসাদ বিশেষ মর্যাদা পেত। তবে মৌর্য শাসন ‘একশৈলিক’ ব্যবস্থা নিশ্চয় ছিল না। ড. রোমিলা থাপার মনে করেন যে, মৌর্য শাসন ব্যবস্থার মর্যাদার কেন্দ্র ছিল মগধ। কোশাল, অবত্তি, গন্ধার ইত্যাদি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জনপদগুলি ‘মূল এলাকা’ (core area) রূপে শাসিত হত। এর বাইরে ছিল ‘প্রান্তিক এলাকা’ (peripheral area)। পাটলিপুত্র কেন্দ্র থেকে মৌর্য সম্রাটের পক্ষে প্রান্তিক এলাকা পর্যন্ত সুশাসন কায়েম রাখা সম্ভব ছিল না। স্বভাবতই সুশাসনের প্রয়োজনে দক্ষ প্রশাসকবৃন্দের সাহায্য নেওয়া হত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রাজা শাসন পরিচালনার কাজে অমাত্য (সচিব), মন্ত্রিপরিষদ এবং অধ্যক্ষ নামক কর্মী পরিষদের সহায়তা গ্রহণ করতেন।

অর্থশাস্ত্রে রাজার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত অধিকারিকদের অমাত্য বা সচিব বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজা অমাত্যদের নিয়োগ করবেন এবং তাদের মতামত শুনবেন। মেগাস্থিনিস এদেরই ‘পরামর্শদাতা ও রাজস্ব নির্ধারক’ (councill and assessor) বলেছেন। অমাত্যপদে নিয়োগের অন্যতম শর্ত ছিল চারিত্রিক শুদ্ধতা, ধর্মপ্রাণতা, সৎ সাহস ইত্যাদি। ছলনাভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে কাম, অর্থ, ভয় ও ধর্ম বিষয়ে বিশুদ্ধতা নির্ধারণের মাধ্যমে অমাত্যদের নিয়োগ করা হত। চারটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের উচ্চতর মন্ত্রিপদ দেওয়া হত। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, অমাত্যদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের বলা হত ‘মন্ত্রিণ’। অর্থশাস্ত্রে ‘মন্ত্রিণঃ’ শব্দটি থেকে অনুমিত হয় যে, একাধিক মন্ত্রিণ থাকতেন। অশোকের আমলে নিযুক্ত ‘মহামাত্র’রা এই মন্ত্রিণদের সমতূল্য ছিলেন। এঁরা সর্বোচ্চ বেতনের অর্থাৎ বার্ষিক ৪৮,০০০ পন (রৌপ্য মুদ্রা) অধিকারী ছিলেন। শাসন ব্যবস্থার নানা বিষয়ে রাজা মন্ত্রিণদের সাথে সর্বদা আলোচনা করতেন। সম্ভবত কৌটিল্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ‘মন্ত্রিণ’ ছিলেন।

মন্ত্রিণদের পরেই ছিল মন্ত্রিপরিষদের স্থান। মন্ত্রিপরিষদের অস্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ বা তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিবরণ বিশেষ নেই। কৌটিল্য লিখেছেন, ‘মন্ত্রিপরিষদম দ্বাদশ মাত্যান কুর্বিতা’। অশোকের তৃতীয় ও ষষ্ঠ গিরিশাসনে ‘পরিষা’ শব্দের ব্যবহার আছে। পণ্ডিতদের অনুমান মন্ত্রিণ পদবাচ্য কর্মী এবং সাধারণ অমাত্য ও অধ্যক্ষদের মধ্যবর্তী স্থানে একটি উপদেষ্টা পরিষদের অস্তিত্ব ছিল, যাকে মন্ত্রিপরিষদ-এর সমতূল্য মনে করা যায়। রাজা কেবল জরুরী অবস্থাকালে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ডাকতেন।

এখানে মন্ত্রিণরাও উপস্থিত থাকতেন। সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মন্ত্রিপরিষদের সামনে উপস্থাপন করা হত। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতকে মান্যতা দেবার ইঙ্গিত অর্থশাস্ত্রে আছে। এর ভিত্তিতে কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল বলেছেন যে, মন্ত্রিপরিষদ যথেষ্ট ক্ষমতাবান ছিল। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, মৌর্য রাজা মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ শুনতেন, তবে গ্রহণ বা বর্জন করা ছিল তাঁর ইচ্ছাধীন। কারণ কৌটিল্য বলেছেন যে, রাজা গরিষ্ঠের মতামতের পরিবর্তে রাষ্ট্রের ‘কার্যসিদ্ধি’ করার প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।

মন্ত্রিণ ও মন্ত্রিপরিষদ ছাড়াও তৃতীয় এক ধরনের অমাত্য ছিলেন। যোগ্যতা ও দক্ষতার পরীক্ষা দিয়ে এঁরা শাসন ও বিচার বিভাগের উচ্চপদে নিযুক্ত হতেন। এইসব পরীক্ষাকে অর্থপদাশুদ্ধ, ধর্মোপদাশুদ্ধ ও ভয়োপদাশুদ্ধ ইত্যাদি কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। এই তিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের যথাক্রমে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে, ধর্মীয় বা বিচার বিষয়ে এবং সাহসিকতার কাজে নিয়োগ করা হত। সমাহর্তা ও সন্নিধাতৃগণ ছিলেন অর্থপদাশুদ্ধ অমাত্য। সমাহর্তারা রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে দেখাশোনা করতেন।

সান্নিধাতৃগণকে দেওয়া হত রাজকোষের দায়িত্ব। ধর্মপদাশুদ্ধ অমাত্য বলতে বোঝাত আদালতের কর্মীদের। ভয়োপদাশুদ্ধগণকে সেইসব কাজে নিযুক্ত করা হত, যেসব কাজে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সাহসিকতার প্রয়োজন হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে, সেইসব ব্যক্তিকে অপেক্ষাকৃত নিচুপদে নিযুক্ত করা হত। রাজাকে ধর্মীয় বিষয়ে সাহায্য ও পরামর্শদান করতেন পুরোহিত। রাজকীয় যাজযজ্ঞ সম্পাদনের দায়িত্বও ছিল তাঁর উপর। সুতরাং মৌর্য শাসনব্যবস্থায় পুরোহিতদের মর্যাদা ছিল যথেষ্ট উচ্চ। ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের জন্য তাঁর বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা লাভ করতেন। অর্থশাস্ত্রে অধ্যক্ষ নামক আর এক শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রের একটি অংশের নামই অধ্যক্ষপ্রচার।

সেখানে ৩২ প্রকার অধ্যক্ষের উল্লেখ আছে। এঁদের মধ্যে নগরাধ্যক্ষ, বলাধ্যক্ষ, রথাধ্যক্ষ, অশ্বাধ্যক্ষ, ক্ষুদ্রাধ্যক্ষ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মেগাস্থেনিস বর্ণিত ‘এ্যাগ্রোনময়’ ও ‘অস্টিনময়’ নামক কর্মচারীগণের সাথে যথাক্রমে নগরাধ্যক্ষ ও কৃষি-অধ্যক্ষের সাদৃশ্য রয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, মেগাস্থেনিস বর্ণিত ওভারসিয়রগণই অর্থশাস্ত্রের অধ্যক্ষ। যাইহোক্, অধ্যক্ষ ছাড়াও করণিক, কুলিক, প্রতিবেদক, প্রতিহার প্রভৃতি ব্যক্তিরা শাসনকার্যে যুক্ত থাকতেন।

মৌর্য প্রশাসনের ভিত্তি ছিলেন ‘পুলিসা’ অর্থাৎ রাজপুরুষগণ। অর্থশাস্ত্রে এই কর্মীগোষ্ঠীর পদমর্যাদা ভিত্তিক স্তর বিন্যস্ত বেতন কাঠামোর উল্লেখ আছে। সর্বোচ্চ পদাধিকারী মন্ত্রিণদের বার্ষিক বেতন ছিল ৪৮,০০০ পন। প্রধান সেনাপতি, রাজমহিষী, পুরোহিত, রাজমাতা প্রমুখ সর্বোচ্চ বেতনের অধিকারী ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা পেতেন বার্ষিক ১২,০০০ পন। সর্বনিম্ন বেতনভূক শ্রেণী ছিলেন শ্রমজীবিরা, বার্ষিক ৬০ পন। মধ্যবর্তী স্তরে দক্ষ কারিগর, স্থপতি, খনি বিশেষজ্ঞ, সেনাবাহিনীর সদস্য প্রমুখ নানা পরিমাণের বেতন পেতেন। এই স্তর বিন্যস্ত ব্যবস্থা মৌর্য প্রশাসনকে একটা আমলাতান্ত্রিক চরিত্র দিয়েছিল। মৌর্য যুগের অমাত্যগণ সরকারী কর্মচারী হিসেবে সর্বপ্রথম একটি স্বতন্ত্র জাতি রূপে গণ্য হতেন। মেগাস্থিনিস তাঁর ‘সপ্তজাতিতত্ত্বে’ অমাত্যদের একটি পৃথক জাতি বলেই অভিহিত করেছেন।

মৌর্যকালীন ভারতে সামরিক সংগঠনের বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। মৌর্যরাজাদের সাম্রাজ্য বিস্তার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির আবশ্যিক শর্ত ছিল একটি সুশৃঙ্খল, দক্ষ ও বিশাল সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব। গ্রিক বিবরণীতে মৌর্যদের ৬০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট সেনাবাহিনীর উল্লেখ আছে। এই বর্ণনা কিছুটা অতিরঞ্জিত হলেও, মৌর্য আমলে বিশাল সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দেহ নেই। চন্দ্রগুপ্তের সামরিক সাফল্য এবং অশোকের কলিঙ্গ বিজয়ের পশ্চাদপটে অবশ্যই অতিকায় সমর বিভাগের ভূমিকা ছিল। গ্রিক বিবরণ অনুযায়ী পাঁচজন করে সদস্য বিশিষ্ট ছয়টি সমিতি মৌর্যযুগে সামরিক প্রশাসন পরিচালনা করত। এই ছয়টি সমিতির অধীন বিভাগগুলি ছিল ; (ক) নৌবাহিনী, (খ) রসদ পরিবহণ, (গ) পদাতিক বাহিনী, (ঘ) অশ্বারোহী সেনা, (ঙ) রথবাহিনী এবং (চ) হস্তীবাহিনী। অর্থশাস্ত্রে নাবধ্যক্ষ, পুত্যুধ্যক্ষ, অশ্বাধ্যক্ষ, রথাধ্যক্ষ, হস্তাধ্যক্ষ ইত্যাদি অভিধা থেকে সেনাবাহিনীর প্রধানদের অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। প্রধান সেনাপতি ‘মন্ত্রিণ’ দের সমতূল্য মর্যাদা ও বেতন পেতেন।

সুদক্ষ আমলাতন্ত্র, শক্তিশালী সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মৌর্য প্রশাসনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটি ছিল গুপ্তচরবাহিনী। মৌর্য রাজারা মগধ থেকে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত এক সুবিশাল গুপ্তচর বাহিনীর সাহায্যে রাজকীয় কর্তৃত্ব রক্ষা করতেন। যুবরাজ থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রামবাসী কৃষকের ওপরে নজরদারী করত এই বাহিনী। কৌটিল্য এদের বলেছেন রাজার চক্ষু ও কর্ণ। সম্ভবত সেকারণে অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারী এমন কি রাজমহিষীর থেকেও গুপ্তচরের সংবাদকে রাজা বেশী গুরুত্ব দিতেন। গ্রীক লেখকদের রচনা ও মেগাস্থিনিসের বিবরণে এই শ্রেণীর কর্মচারীদের নাম ও কাজের বিবরণ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রেও গুপ্তচরদের সাম্রাজ্যের অপরিহার্য অংশ বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রাজা ‘গুঢ়পুরুষ’-দের মাধ্যমে দেশের তথ্যাদি অবগত হতেন। কৌটিল্য গূঢ়পুরুষদের দু’টি ভাগে বিভক্ত করেছেন—’সমস্থা’ ও ‘সঞ্জারা’। যে সব গুপ্তচর নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতেন তাদের বলা হত ‘সমস্থা’।

অন্যদিকে সঞ্জারা গণ ছিলেন। ভ্রাম্যমান তথ্য সংগ্রহকারী কর্মী। কৌটিল্য গূঢ়পুরুষদের কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিদেশী শত্ৰু, সন্দেহভাজন ব্যক্তি, এমনকি যুবরাজ সহ অন্যান্য রাজপুরুষদের ওপর গোপন নজরদারীর দায়িত্ব গূঢ়পুরুষরা পালন করতেন। গ্রীক লেখক এ্যারিয়ান ‘তত্ত্বাবধায়ক’ নামক একশ্রেণীর কর্মচারীর উল্লেখ করেছেন। এঁরা গোটা সাম্রাজ্যের খুঁটিনাটি সংবাদ সংগ্রহ করে রাজাকে অবহিত করতেন। দেশের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে রাজার কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব প্রাপ্ত ‘পরিদর্শক’ (Ephor) নামক কর্মচারী উল্লেখ গ্রীক লেখক স্ট্যাবোর রচনাতে পাওয়া যায়। মেগাস্থিনিস ‘এপিসকপয়’ নামক একশ্রেণীর কর্মচারীর উল্লেখ করেছেন, যারা নজরদারীর কাজ করতেন। সম্ভবত অশোকের আমলে ‘প্রতিবেদক’ নামক যে কর্মীগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, এপিসকপয়গণ তাদের সমতুল্য ছিলেন। এঁরা আক্ষরিক অর্থে গুপ্তচর ছিলেন না, কিন্তু গোপন তথ্য সংগ্রহ ও সে বিষয়ে রাজাকে অবহিত করার যে কাজ এঁরা করতেন, তা গুপ্তচর বৃত্তির সমতূল্যই ছিল বলে ডি. এন. ঝা মনে করেন।

স্ট্যাবো এবং কৌটিল্য উভয়েই গুপ্তচরের কাছে বহুসংখ্যক মহিলা নিয়োগের উল্লেখ করেছেন। ভিক্ষুণী, পরিব্রাজিকা এমনকি গণিকাদেরও গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা হত। অশোকের গিরনার লেখ (ষষ্ঠ প্রধান গিরিশাসন) থেকে গুপ্তচরদের প্রশাসনিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তিনি লিখেছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ গোপন সংবাদ সহ গুপ্তচর যে-কোন সময় রাজার সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে পারতেন। এমনকি রাজার আহার গ্রহণের মাঝেও প্রতিবেদক অবাধে রাজার সকাশে উপস্থিত হতে পারতেন।

মৌর্যযুগে বিচারব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট উন্নত। বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও অমাত্যদের সাহায্যে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে প্রত্যেক জেলা নগরেও বিচারালয় স্থাপন করা হয়েছিল। অর্থশাস্ত্রে পৌর-ব্যবহারিকদের উল্লেখ আছে, যাঁরা নগরের বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। অশোকের লেখতে সম্ভবত এঁদেরই ‘নগর ব্যবহারিক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে ধর্মস্থীর ও কণ্টকশোধন এই দু’ধরনের বিচারালয়ের উল্লেখ আছে। সম্ভবত প্রথমটিতে দেওয়ানী ও পরেরটিতে ফৌজদারী মামলার বিচার হত। এছাড়া তিন ধরনের নিম্ন বিচারালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল—স্থানীয়, দ্রোণমুখ ও সংগ্রহণ। বিদেশীদের বিচার করার জন্য বিশেষ একশ্রেণীর বিচারক ছিলেন বলে গ্রীক লেখকদের রচনা থেকে জানা যায়। মৌর্যযুগে দণ্ডবিধির কঠোরতা ছিল। জরিমানা, অঙ্গচ্ছেদ ও শিরচ্ছেদ শাস্তি হিসেবে দেওয়া হত। মৌর্যশাসনে গুপ্তচরদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। অর্থশাস্ত্র ও সাম্রাজ্যের বিশালতা এবং সু-যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবহেতু মৌর্য যুগে সম্ভবত প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা গুরুত্ব পেত। অশোকের ধৌলি, জৌগড়া, ব্রহ্মগিরি প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত গিরিশাসন থেকে প্রদেশগুলির নাম অনুমান করা সম্ভব। তবে মৌর্য প্রশাসনে প্রদেশের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে সংশয় আছে। চন্দ্রগুপ্তের আমলে কলিঙ্গ মৌর্য অধিকারের বাইরে ছিল।

সুতরাং অশোকের গিরিশাসন থেকে প্রাথমিকভাবে যে পাঁচটি প্রদেশের অস্তিত্ব জানা যায়, তার মধ্যে কলিঙ্গ প্রদেশ চন্দ্রগুপ্তের সময়ে ছিল না। তাঁর আমলে চারটি প্রদেশ ছিল উত্তরাপথ, অবত্তিপথ বা অবন্তি রট্ট, দক্ষিণাপথ এবং প্রাচ্য। এদের রাজধানী ছিল যথাক্রমে তক্ষশিলা, উজ্জয়িনী, সুবর্ণগিরি (জোনাগিরি) এবং পাটলিপুত্র। অশোকের আমলে তোসালিকে রাজধানী করে কলিঙ্গ প্রদেশের সংযোজন ঘটেছিল। পাটলিপুত্র কেন্দ্র থেকে প্রদেশগুলির দূরত্ব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবের কারণে প্রাদেশিক শাসনের ওপর সম্রাটের দৈনন্দিন নজরদারি সম্ভব হত না। অর্থাৎ প্রাদেশিক শাসনকর্তারা নানা বিষয়ে স্বাধীনভাবে এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। এই কারণে প্রাদেশিক শাসক পদে সাধারণত সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা মনোনীত হতেন। এক্ষেত্রে কুমার বা রাজ পরিবারভুক্ত রাজপুত্ররা অগ্রাধিকার পেতেন।

প্রাদেশিক শাসকরা রাজপরিবারভুক্ত হলেও, সম্ভবত সবাই সমক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। তাঁদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার তারতম্য ছিল। অশোকের ক্ষুদ্র গিরিশাসনে (ব্রত্নগিরি, সিদ্দাপুর) থেকে জানা যায় যে, সুবর্ণগিরি প্রদেশের দায়িত্বে ছিলেন জনৈক আর্যপুত্র (অয়ঃপুত)। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, আর্যপুত্র অর্থে রাজপুত্রকে বোঝালেও তিনি সাধারণ কোন রাজপুত্র ছিলেন না। অর্থাৎ ‘কুমার’ অভিহিত রাজপরিবারের সন্তানের সাথে ‘আর্যপুত্র’ নামাঙ্কিত রাজ-সন্তানের প্রভেদ ছিল। এখানে ‘আর্যপুত্র’ বলতে সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী যুবরাজকে বোঝানো হয়েছে। সম্ভবত ইনি কুমারের তুলনায় অধিকতর ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। সম্ভবত পাটলিপুত্র থেকে দক্ষিণী এই প্রদেশের দূরত্ব এবং ঐ অঞ্চলের খনিজ সম্পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে উচ্চতর মর্যাদা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রাদেশিক শাসকদের ক্ষমতার বৈষম্যের অন্য দৃষ্টান্তও আছে। উত্তরাপথ, অবত্তি পথ এবং কলিঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত কুমারদের ক্ষমতাও সম্ভবত এক ছিল না। অশোকের অনুশাসন অনুসারে তক্ষশিলা এবং উজ্জয়িনিতে কর্মরত কুমারগণ প্রতি তিন বছর অন্তর রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্ম তত্ত্ববধানের জন্য ‘মহামাত্র’ পদমর্যাদার আধিকারিকদের রাজ্য ভ্রমণে পাঠাতেন। এজন্য সম্রাটের অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তোসালির বন্দোবস্ত ছিল স্বতন্ত্র্য। এক্ষেত্রে স্বয়ং সম্রাট অশোক প্রতি পাঁচবছর অন্তর মহামাত্র ও নগর ব্যবহারিকদের কাছে রাজ্য পরিভ্রমণের নির্দেশ সরাসরি প্রেরণ করতেন। সম্ভবত সদ্য দখল করা কলিঙ্গ রাজ্যের প্রশাসনের ওপর সম্রাট প্রত্যক্ষ নজরদারি রাখতে আগ্রহী ছিলেন। ডি. আর. ভান্ডারকর মনে করেন যে, তক্ষশিলা ও উজ্জয়িনীর প্রাদেশিক শাসকরা প্রায় স্বাধীন শাসকের মর্যাদাভোগ করতেন। কিন্তু হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রোমিলা থাপার প্রমুখ এই মত সমর্থন করেন না।

পাটলিপুত্র কেন্দ্র এবং চারটি মূখ্য প্রদেশ ছাড়াও কোন প্রদেশের অস্তিত্ব মৌর্য আমলে ছিল কিনা, বিষয়টি পরিষ্কার নয়। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার মধ্যপ্রদেশে (পানগুডারিয়া) প্রাপ্ত অশোকের একটি গৌণ গিরিশাসনের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এখানে সম্রাট অশোক ‘মনেন দেশ অভিমুখে যাত্রা কালে জনৈক কুমার শাম্বকে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন। ঐতিহাসিকদের অনুমান এই কুমার কোন একটি প্রদেশের সম্ভবত মনেন দেশ (মধ্যদেশ)-এর প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। একইভাবে ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লামঘানে প্রাপ্ত অশোকের একটি আরামীয় লেখর ভিত্তিতে ‘বন্ধু’ নামক জনৈক উচ্চপদস্থ শাসকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। সম্ভবত অ-মৌর্য এবং অ-ভারতীয় এই প্রশাসক সীমান্ত অঞ্চলে মৌর্য সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন। অর্থাৎ চারটি বা পাঁচটি নয়, সম্ভবত মৌর্য আমলে প্রদেশের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আরো কিছু শাসনতান্ত্রিক একক ছিল। মৌর্য বংশের সাথে সম্পর্ক নেই, এমন কিছু ব্যক্তিও প্রাদেশিক শাসক পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন, অবশ্য এগুলি ছিল মূলত সীমান্ত দেশ। রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় যে, জনৈক পুষ্যগুপ্ত কাথিয়াবাড় অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। তাঁর পদমর্যাদা ছিল ‘রাষ্ট্রীয়’। অশোকের আমলে ঐ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক ছিলেন যবনরাজ তুসাস্ক। অশোকের লেখ বা অর্থশাস্ত্রে ‘রাষ্ট্রীয়’ পদের উল্লেখ নেই। ড. রায়চৌধুরীর মতে, ‘রাষ্ট্রীয়’ ও ‘রাষ্ট্রপাল’ সম্ভবত সমার্থক ছিল। চন্দ্রগুপ্ত ‘ক্ষমতা বিভাজন ও শাসন’ নীতি দ্বারা প্রদেশগুলির উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখতেন। প্রদেশ পাল ছাড়াও একাধিক মহামাত্র প্রদেশে প্রদেশে কর্মরত থাকতেন। সম্রাট এদের কাছ থেকে প্রাদেশিক শাসনসংক্রান্ত খবরাখবর সংগ্রহ করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। এছাড়া বিশাল ও দক্ষ গুপ্তচর বাহিনীতো ছিলই।

প্রদেশগুলির নিম্নস্তরে ছিল জেলা। এগুলি ‘আহর’ এবং ‘বিষয়’ নামেও অভিহিত হত। কখনো কখনো এগুলিকে ‘জনপদ’ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত সীমান্তবর্তী জেলাগুলিকে ‘প্রদেশ’ নামেও অভিহিত করা হত। এই জেলা বা জনপদগুলি ছিল মৌর্য শাসনধারার প্রাথমিক ভিত্তি। চন্দ্রগুপ্তের আমলে মহামাত্র নামক কর্মচারীরা জেলা প্রশাসনে মুখ্য ভূমিকা নিতেন। অশোকের অনুশাসনে এঁদের রাজুক নামে উল্লেখ করা হয়েছে। মহামাত্রদের তুলনায় অশোকের আমলের রাজুকদের প্রশাসনিক স্বাধীনতা বেশী ছিল। অশোক এঁদের হাতে স্থানীয় প্রশাসন, জমিজরিপ, বিচার পরিচালনা এবং অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’-এর আদর্শ প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। মেগাস্থিনিস কথিত ‘এ্যাগ্রোনময়’ নামাঙ্কিত কর্মচারী এবং রাজুকরা অভিন্ন ছিলেন। এ্যাগ্রোনময়রা গ্রামীণ রাজস্ব সংগ্রহ, সেচের তদারকি, দণ্ডদান ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করতেন। অর্থাৎ রাজুকদের কাজের সাথে এ্যাগ্রোনময়দের কর্তব্যকর্মের প্রভেদ ছিল না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মহামাত্রদের উল্লেখ আছে। এঁরা প্রধানত জেলাস্তরের কর্মচারী ছিলেন। স্বভাবতই এঁদের স্থান ছিল প্রাদেশিক শাসক ও তাঁর পরিষদের নিচে। বয়োজ্যেষ্ঠ মহামাত্রগণ এই পরিষদে মনোনীত হতে পারতেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শিলালেখ অনুসারে মহামাত্র যে পরিষদ গঠন করতেন, তা সরাসরি সম্রাটের কাছ থেকে নির্দেশ পেতেন এবং তাঁর কাছেই দায়বদ্ধ থাকতেন। মহামাত্রদের মধ্যে প্রকারভেদ ছিল। যেমন—ইতিঝক মহামাত্র, ব্রজভূমিক মহামাত্র, অস্তমহামাত্র, নগর ব্যবহারিক মহামাত্র, ধর্ম মহামাত্র ইত্যাদি। ইতিঝক মহামাত্র বা স্ত্রীঅধ্যক্ষ মহামাত্র অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের স্বার্থরক্ষা করতেন। ব্রজভূমিকগণ ‘ব্রজ’ অর্থাৎ গোচারণভূমির ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। দ্বাদশ গিরিশাসন অনুসারে অশোক এদের ধর্মপ্রচার ও প্রজাকল্যাণের কাজেও ব্যবহার করতেন। অত্তমহামাত্রগণ সম্ভবত সীমান্ত অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন যে সীমান্তদেশে অবস্থানকারী উপজাতীয় গোষ্ঠী বা রাজ্যগুলিকে এরা নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু অশোকের লেখতে ‘অন্ত’ অর্থে সীমান্ত-পরবর্তী প্রতিবেশী দেশ ও জনগণকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এঁরা সীমান্তপারের দেশগুলিতে অশোকের ধর্মভাবনা ও কল্যাণমূলক আদর্শ প্রচার করে বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজ করতেন। নগর ব্যবহারিকগণ সম্ভবত পৌর প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। কারও কারও মতে, এরা জেলাস্তরে বিচার নিষ্পত্তির কাজও করতেন। যাইহোক, এঁরা ‘বহু সহস্র ব্যক্তির তত্ত্বাবধায়ক (কলিঙ্গ লেখ) হিসেবে ‘বহু শত সহস্র ব্যক্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজুকদের নিম্নস্তরের কর্মী ছিলেন। ব্যাসাম-এর মতে, অশোক তাঁর সামাজিক সংস্কারগুলিকে কার্যকর করার জন্য ‘ধর্মমহামাত্র’ পদের সংযোজন করেছিলেন। এঁরা অশোকের কেন্দ্রীকরণ নীতির হাতিয়ার ছিলেন। ড. রায়চৌধুরীর মতে, জেলাস্তরে অনেক প্রশাসক ‘রাজা’ উপাধি ব্যবহার করতেন। এমন ঘটনা সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতার সূচনা নির্দেশ করে। তাছাড়া এই পরিবর্তন চন্দ্রগুপ্তের আমলের কঠোর কেন্দ্রীকরণ নীতির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন রীতির সম্ভাবনা তৈরী করেছিল।

মৌর্য শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ‘গ্রাম’। বৈদিক যুগের শেষে মহাজনপদ গড়ে ওঠার যুগে স্বাধীন গ্রামগুলির ওপর রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। জাতক গ্রন্থে গ্রামাঞ্চলের ওপর রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়াস দেখা যায়। তবে কৌটিল্য নীতিগতভাবে গ্রামাঞ্চলের ওপর কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ মঙ্গলজনক মনে করতেন না। স্বভাবতই মৌর্য প্রশাসনে গ্রামগুলিকে কিছুটা শাসনতান্ত্রিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীকার দেওয়া হয়েছিল। গ্রাম শাসনের ক্ষেত্রেও কর্মচারীদের ক্ষমতা ও দায়িত্বের বৈচিত্র্য ও বিভাজন ছিল। সর্বনিম্নস্তরে, সম্ভবত প্রতিটি গ্রামের, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী ছিলেন ‘গ্রামিক’। কৌটিল্য মৌর্য প্রশাসনে যুক্ত যে কর্মীমণ্ডলীর নাম দিয়েছেন, তাতে গ্রামিক-এর উল্লেখ নেই। মনুস্মৃতিতেও গ্রাম-শাসকদের নিয়োগের উল্লেখ আছে, যদিও ‘গ্রামিক’ নামক কোন কর্মচারী নিয়োগের কথা মনু বলেন নি। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ মনে করেন যে, ‘গ্রামিক’ নামক কর্মীরা রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হতেন না, জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। গ্রামিকের কাজ ছিল গ্রামবাসীর ধন-সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা। এজন্য তিনি গ্রামীণ রাজস্বের একাংশ ভোগ করতে পারতেন। তবে তাঁর ক্ষমতা একক বা নিরঙ্কুশ ছিল না। গ্রামবৃদ্ধগণ গ্রামিককে সাহায্য করতেন। ছোট ছোট গ্রামসভা গঠন করে শিক্ষা, নিরাপত্তা, বিরোধের মীমাংসা, জমির সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ, দেবস্থান পরিচালনা, নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হত।

পাঁচ থেকে দশটি গ্রামের সমন্বয়ে ‘গ্রাম মণ্ডল’ গঠিত হত। গ্রামিকের ওপরের স্তরে ‘গোপ’ নামক কর্মচারী এই গ্রাম-মণ্ডলের তত্ত্বাবধান করতেন। গোপের উচ্চ পর্যায়ে গ্রামীণ আধিকারিক ছিলেন ‘স্থানিক’। একাধিক গ্রাম-মণ্ডলের তত্বাবধান করার দায়িত্ব স্থানিকের হাতে ন্যস্ত থাকত। গ্রাম পর্যায়ে সর্বোচ্চস্তরের কর্মী ছিলেন ‘সমাহর্ত্রী’। ‘প্রদেস্ট্রি’ নামক কর্মচারী সমাহর্ত্রীর ভ্রাম্যমান সহকারী হিসেবে নানা এলাকা পরিভ্রমণ করে প্রশাসনিক তথ্যাদি সংগ্রহ করতেন। গ্রামীণ নিরাপত্তা বিধান ও আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি এই সকল স্থানীয় কর্মচারী গ্রামের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ যেমন, পথ-ঘাট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষালয় নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, ধর্মস্থানের সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন। মেগাস্থিনিস গ্রামীণ এলাকার রাজকর্মচারীকে ‘অ্যাগ্রোনময়’ নামে চিহ্নিত করেছেন। সম্ভবত এঁরা সরকারী কর্মী হিসেবে গ্রামের রাজস্ব, স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ অনুসারে, সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতেন।

মৌর্যকালীন ভারতের প্রসিদ্ধ নগরী ছিল রাজধানী পাটলিপুত্র। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস ‘পালিবোথরা’ অর্থাৎ‍ পাটলিপুত্র নগরের পৌরপ্রশাসনের বিবরণ দিয়েছেন। পাটলিপুত্র পৌরপ্রশাসনে যুক্ত কর্মীদের তিনি ‘অস্টিনোময়’ নামে অভিহিত করেছেন। প্রতিটিতে পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট ছয়টি সমিতি পৌর প্রশাসন পরিচালনা করত। সমিতিগুলি যথাক্রমে, (১) কারিগরি শিল্পোৎপাদন তদারকি, (২) নগরের জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা, (৩) নগরে আগত বিদেশীদের ওপর নজরদারী, (৪) বাণিজ্যিক লেনদেনের তত্ত্বাবধান, (৫) ব্যবসায়ীদের পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ এবং (৬) বিক্রয়লব্ধ অর্থের এক-দশমাংশ কর হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। মেগাস্থিনিস নগর-প্রশাসনের অনুরূপ সামরিক বিভাগেও ছয়টি পরিষদের উল্লেখ করেছেন। এক-একটি বিভাগ এক-একটি বিষয় তত্ত্বাবধান করত – যেমন, (১) পদাতিক, (২) অশ্ববাহিনী, (৩) হস্তিবাহিনী, (৪) যুদ্ধরথবাহিনী, (৫) নৌ-বহর এবং (৬) রসদ ও যানবাহিনী। কৌটিল্য এই ধরনের পরিষদের উল্লেখ করেননি।

মৌর্য শাসনব্যবস্থায় সম্রাট অশোকের সংযোজন

চন্দ্রগুপ্তের শাসন কাঠামোর মূল কাঠামো বজায় রেখে অশোক কিছু কিছু নৈতিক ও ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য সংযোজিত করেছিলেন। নীতিগতভাবে অশোক তাঁর রাজতান্ত্রিক আদর্শে পিতৃতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ পালনের অঙ্গীকার করেছিলেন। দ্বিতীয় কলিঙ্গ লেখতে তিনি বলেছেন যে, ‘সকল মানুষই (প্রজা) আমার সন্তান। পিতা যেমন সন্তানের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল বিধানে আন্তরিক থাকেন, আমিও তেমনি প্রজাদের সার্বিক মঙ্গলের জন্য নিবেদিত প্রাণ।’ এই নৈতিক দায়িত্ববোধ তিনি কর্মচারীদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেন। চতুর্থ স্তম্ভলেখতে তিনি কর্মচারীদের দক্ষ ধাত্রীর সাথে তুলনা করে বলেছেন যে, ধাত্রী যেমন মাতৃস্নেহে শিশুদের পরিচর্যা করেন, কর্মচারীরাও তেমনি প্রজাদের তত্ত্বাবধান করবেন। ষষ্ঠ শিলালেখর বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায় যে, অশোক নিজেকে রাষ্ট্রের সেবক মনে করতেন এবং তাঁর কর্মপ্রেরণার মৌলিক ভিত্তি হল প্রজাসাধারণের কাছে তাঁর ঋণ পরিশোধের ঐকান্তিক বাসনা। তাই অশোকের আমলে রাজতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা উপরের দিকে স্বৈরাচারী হলেও, নিচের দিকে তা ছিল না। ডি. ডি. কোশান্তির মতে, অশোকের অনুশাসনগুলিকে রাজশক্তির উপর সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক আভাস বলা যায়। অর্থশাস্ত্রের রাজা যুদ্ধ বা মৃগয়ার জন্য প্রাসাদের বাইরে বের হতেন। কিন্তু অশোক রাষ্ট্রের মূখ্য সেবক হিসেবে রাজ্য প্রদক্ষিণ করতেন এবং যুত, রাজুক প্রমুখ কর্মচারীদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজ্য প্রদক্ষিণে বের হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই ‘অনুসংযান’ কর্মসূচী প্রজাহিতৈষী শাসনরীতির আভাস দেয়।

নৈতিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বাদ দিলে অশোকের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক দেখা যায়। রোমিলা থাপারের মতে, অশোক পুরোহিততন্ত্রকে উপেক্ষা করে দৈবশক্তির সাথে রাজশক্তির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, যা রাজশক্তির প্রাধান্যকে নিরঙ্কুশ করার পক্ষে সহায়ক ছিল। অশোকের তৃতীয় ও ষষ্ঠ শিলালেখতে ‘পরিয়’ নামক সংগঠনের উল্লেখ আছে। ড. রায়চৌধুরী এটিকে ‘কার্য-নির্বাহী পরিষদ’ বলে মনে করেন। কিন্তু যষ্ঠ লেখতে এই সংস্থার কাজের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা ড. রায়চৌধুরীর দাবিকে সমর্থন করে না। বলা হয়েছে যে, রাজাজ্ঞা কিংবা মহামাত্রদের কর্তব্য কর্ম সম্পর্কে পরিষ-এর সদস্যদের মতভেদ ঘটলে প্রতিবেদকগণ তা তৎক্ষণাৎ রাজাকে জ্ঞাত করবেন। কার্যত ‘পরিষ’ কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী ছিল না। সদস্যরা ছিলেন রাজার মনোনীত, নির্বাচিত নয়। রাজাজ্ঞা বাস্তবায়িত করাই ছিল পরিয-এর মূল কাজ। অর্থাৎ এটি ছিল পরামর্শদাতা পরিষদ। মৌলিক ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী ছিলেন রাজা স্বয়ং।

অশোক তৃতীয় শিলালেখতে যুত্ (যুক্ত), রাজুক ও প্রাদেশিক এই তিন শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের উল্লেখ করেছেন। যুগণ মহামাত্র পরিষদের বিভিন্ন নিয়ম ও নির্দেশ লিপিবদ্ধ করতেন বলে অশোক উল্লেখ করেছেন। ড. ভাণ্ডারকরের মতে, রাজস্ব ও রাজকীয় সম্পত্তি দখলের কাজেও যুতদের নিয়োগ করা হত। অশোক সংযোজিত কর্মচারীদের মধ্যে বিশেষ দায়িত্ব ও ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন রাজুকগণ। এঁরা ছিলেন জেলাস্তরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী। ‘রাজুক’ শব্দটি সম্ভবত পালি সাহিত্যে উল্লেখিত ‘রজ্জুগ্রাহক অমচ্চ’ অর্থাৎ রজ্জু (দড়ি) ধারী অমাত্য ছিলেন। অর্থাৎ এঁরা রজ্জু দ্বারা জমি জরিপ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করতেন। জনপদবাসীর (জনং জানপাদং) কল্যাণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে লক্ষ্য রাখাও এঁদের কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিচার এবং দণ্ড (শাস্তি) দানের দায়িত্বও রাজুকদের উপর ন্যস্ত হয়েছিল। অর্থাৎ অশোকের জেলা প্রশাসনের মেরুদণ্ডস্বরূপ ছিলেন ‘রাজুক’ নামক কর্মীবৃন্দ। ড. রায়চৌধুরী মনে করেন, অশোক নগর ব্যবহারক ও প্রাদেশিকদের বিচার বিষয়ক ক্ষমতা হরণ করে রাজুকদের হাতে অর্পণ করেছিলেন। কিন্তু এমন ধারণা সঠিক নয়। সম্ভবত দেওয়ানি মামলার অতিরিক্ত চাপ সামাল দেবার প্রয়োজনে অশোক রাজুকদের হাতেও বিচার নিষ্পত্তির দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছিলেন। অবশ্য প্রবল ক্ষমতাবান রাজুকদের পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। অশোক এ-বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং রাজুকদের স্বেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ব্যবস্থা রেখেছিলেন।

মৌর্য শাসনব্যবস্থায় অশোকের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজক ছিল ‘ধর্মমহামাত্র’ নামক পদের সৃষ্টি। ধৰ্ম্ম-ভাবনার প্রচার, মানুষকে ধর্মমুখী করা, তাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান ইত্যাদি ছিল ধর্ম-মহামাত্রদের প্রাথমিক কর্তব্য। পঞ্চম গিরিশাসন থেকে জানা যায় যে, শাসন বিষয়ক কিছু দায়িত্বও এঁদের পালন করতে হত। বৃদ্ধ, অক্ষম, দুঃস্থ ইত্যাদি মানুষকে সংকটমুক্ত করার বিষয়ে এঁদের সচেতন থাকতে হত। রাজপরিবারের দানকার্য পরিচালনার কাজে ধর্ম মহামাত্ররা উৎসাহ প্রদান করতেন এবং দানকার্য পরিচালনায় সাহায্য করতেন। সপ্তম স্তম্ভলেখতে অশোক এঁদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, ধর্মমহামাত্রগণ সংঘ, ব্রাহ্মণ, আজীবক, জৈন ও অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি যেন সমদৃষ্টি অনুসরণ করেন।

মৌর্য শাসনের প্রকৃতি

মৌর্য বংশের আমলে রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং মৌর্য শাসনব্যবস্থার চরিত্র নিরূপণ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আপাত বিচারে রাজতান্ত্রিক আদর্শ, বিশেষত অর্থশাস্ত্রের ব্যাখ্যা এবং রাজক্ষমতার প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্থাৎ শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষিতে মৌর্য রাষ্ট্র এবং শাসনব্যবস্থাকে ‘কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মনে হওয়া স্বাভাবিক। ভারতে ক্রম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে রাজকীয় স্বেচ্ছাতন্ত্র সাংগঠনিক রূপ পেয়েছে। উপজাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতিতে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের রীতি ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ পর্বে উপজাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভাঙ্গন এলে জনসাধারণের রাজনৈতিক ভূমিকা শিথিল হতে থাকে। বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা কার্যত ‘গোষ্ঠীসংহতি’কে ভেঙ্গে ফেলতে উদ্যত হয়। সর্বজনীন ধর্মের আদর্শ ‘গোষ্ঠীবাদের’ ধারণাকে দুর্বল করতে থাকে। মানুষ রাজনীতির পরিবর্তে নতুন নতুন ধর্মাদর্শের প্রতি অধিক মনযোগী হলে, রাজনীতি থেকে সাধারণ মানুষ সরে যেতে থাকে।

এই সামাজিক রূপান্তরের মুহূর্তে অর্থশাস্ত্রের ভাষ্য স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের উত্থানের সহায়ক হয়েছিল। অর্থশাস্ত্র রাজশক্তিকে ক্ষমতায়নের বৈধ ব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরে এবং রাজ ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে অনৈতিক শক্তি প্রয়োগ, প্রতারণা ইত্যাদি কর্মসূচী বৈধতার ছাপ দিয়ে দেয়। অর্থশাস্ত্রের মতে, রাজা হলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তেজোদীপ্ত এবং সর্বময় ক্ষমতার আধার। রাজার হাতে ন্যস্ত ছিল আইন, বিচার ও প্রশাসনের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রাজা কেবল আইনের রক্ষক নয়, স্বয়ং একজন আইন প্রণেতা। অর্থাৎ প্রথাগত আইন সংশোধন, নাকচ এবং নতুন আইন প্রণয়নের সমূহ ক্ষমতা রাজার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৌর্য রাজারা অর্থশাস্ত্রের বিধান অগ্রাহ্য করেন নি। স্বভাবতই এককেন্দ্রিক স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমূহ সুযোগ মৌর্য রাজাদের করায়ত্ব ছিল।

মন্ত্রিপরিষদ বা মহামাত্র পরিষদের অস্তিত্ব থেকে মনে করা যেতে পারে যে এই পরিষদ রাজার নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকস্বরূপ ছিল। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে রাজা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করতেন। এখন প্রশ্ন হল, রাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করতে বাধ্য ছিলেন কিনা। এর উত্তর হল—না। মৌর্য যুগে রাজা পরিষদের মতামত শ্রবণ করতেন, কিন্তু গ্রহণ বা বর্জন করা ছিল একান্তভাবে রাজার ইচ্ছাধীন। এমনকি অর্থশাস্ত্রেও বলা হয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের পরিবর্তে ‘কার্যসিদ্ধি’র উপযোগী যে কোন পন্থা রাজা গ্রহণ করতে পারতেন। তাছাড়া মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা কোন সংগঠন, দল বা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না। তাঁদের নিয়োগ ও পদচ্যুতি ছিল সম্পূর্ণভাবে রাজার ইচ্ছাধীন। স্বভাবতই এই পরিষদ রাজার নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সক্ষম ছিল না।

গুপ্তচর ব্যবস্থার ব্যাপকতা মৌর্য রাজাদের নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার অন্যতম হাতিয়ার ছিল। গুপ্তচরদের সংখ্যাধিক্য, বহুমুখী সামাজিক চরিত্র (সন্ন্যাসী, গণিকা ইত্যাদি) প্রশাসনিক গুরুত্ব ইত্যাদি গোটা রাজ্যকে এমনভাবে রাজতন্ত্রের নজরদারির জালে ঘিরে রেখেছিল যে, প্রজাদের স্বাধীন ক্রিয়া, গতিবিধি ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা সদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছিল। সর্বোপরি ছিল বিশাল সেনাবাহিনী এবং কঠোর ফৌজদারি আইনবিধি। রাজার নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার পক্ষে ছিল খুবই কার্যকরী হাতিয়ার।

রাজকীয় অধিকার, সেনাশক্তি, কঠোর দণ্ডবিধি ইত্যাদি মৌর্য সাম্রাজ্যকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সত্য, কিন্তু তা ‘নিরঙ্কুশ’ ছিল না বলেই অনেকে মনে করেন।

প্রথমত, ভারতে রাজকীয় কর্তৃত্ব সৃষ্টির আগে থেকেই দেশাচার, সামাজিক বিধি-বিধান ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। এদের বলা হত ‘পোরান পকিতি বা প্রাচীন দেশাচার। ক্ষমতাসীন রাজার পক্ষেও এগুলিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা সম্ভব হত না। এগুলি রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পথে নীরব বাধাস্বরূপ সক্রিয় ছিল।

দ্বিতীয়ত, রাজা মন্ত্রিপরিষদ সহ একগুচ্ছ কর্মচারীর মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করতেন। কর্মচারীদের একাধিক স্তরবিন্যাস এবং নির্দিষ্ট কর্তব্যকর্ম সমকালীন শাসনব্যবস্থাকে উদার স্বেচ্ছাতন্ত্র’ রূপে গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।

তৃতীয়ত, মৌর্য সম্রাটগণ প্রজাদের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা স্বীকার করতেন না, একথা অন্তত মৌর্য সম্রাট অশোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ অশোকের শাসনব্যবস্থাই ছিল পিতৃত্ববোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তাঁর যাবতীয় জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রজাদের কাছে তাঁর যে ঋণ, তা পরিশোধ করা। তাছাড়া তিনি যেসব কর্মচারীদের নিযুক্ত করতেন তারা যাতে জনগণের স্বার্থরক্ষা করে চলে সে নির্দেশও তাদের দেওয়া হত।

চতুর্থত, মন্ত্রিপরিষদের মতামত গ্রহণ করা রাজার পক্ষে বাধ্যতামূলক ছিল না সত্য কিন্তু তিনি প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের মতামত সর্বদা উপেক্ষাও করতে পারতেন না। কৌটিল্য, রাধাগুপ্ত প্রমুখ বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মন্ত্রীদের মতামতকে উপেক্ষা করা মৌর্য সম্রাটদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল বলে মনে হয় না। তাছাড়া অশোকের ষষ্ঠ শিলালেখতে বলা হয়েছে যে, রাজার অনুপস্থিতিতে মন্ত্রীগণ জরুরী প্রয়োজনে মিলিত হতে পারতেন, এমনকি রাজ আদেশের সঙ্গে তাঁদের মতের মিল না হলে সেকথা তাঁরা রাজাকে জানাতেও পারতেন। অশোক মন্ত্রিপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে যে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন, তার প্রমাণ তিনি প্রতিবেদকের এই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, তারা যেন মন্ত্রিপরিষদের মতামত তাঁকে সর্বদা জানায়।

পঞ্চমত, প্রজাগণের অবস্থা, রাজকর্মচারীদের কার্যকলাপ ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হবার জন্যই গুপ্তচরদের নিয়োগ করা হত। যে-কোন সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ ছিল অনিবার্য। প্রাচীন ভারতে মৌর্যযুগ থেকেই গুপ্তচর নিয়োগের প্রথা চলে আসছে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেও গুপ্তচর বিভাগের অস্তিত্ব থাকে। সুতরাং গুপ্তচর নিয়োগের ফলেই কোন শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচারী চরিত্র গ্রহণ করে একথা বলা চলে না।

ষষ্ঠত, মৌর্য শাসনব্যবস্থায় দণ্ডবিধির কঠোরতা যেমন ছিল তেমনি বিচার-বিভাগের দক্ষতা ও সততা ছিল প্রশ্নাতীত। প্রতিটি বিচারপ্রার্থী যাতে সুবিচার পায়, সে সম্পর্কে মৌর্য সম্রাটরা ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। মেগাস্থেনিসের বিবরণ অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত সারাদিন ব্যক্তিগতভাবে রাজসভায় উপস্থিত থেকে বিচারপ্রার্থীদের আর্জি শুনতেন ও তাদের অভিযোগের প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন। অশোক ‘ব্যবহার সমতা’ ও ‘দণ্ড-সমতা’ নীতি প্রয়োগ করে বিচারব্যবস্থাকে আরো ন্যায়পরায়ণ করে তোলেন।

সপ্তমত, মৌর্য শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত ছিল। তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলা যায় যে, শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে স্বায়ত্তশাসনের অস্তিত্ব ছিল। যেমন মৌর্য শাসনাধীনে নগর ও গ্রামগুলি বহু পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভোগ করত। অশোক রাজুকদের বিচার ও শাসন বিষয় অনেকটাই স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন, যা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সুতরাং শাসন-ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ উভয় নীতিরই সমন্বয়ে মৌর্য শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনস্থ বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত উপজাতির উল্লেখও এ্যারিয়ানের বর্ণনায় পাওয়া যায়।

অষ্টমত, শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচারী চরিত্র নেবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে শাসকের মানসিকতার ওপর। মৌর্য রাজাদের শাসকসত্তার বিকাশে অর্থশাস্ত্র ও প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজা হবেন কর্তব্যপরায়ণ ও গুণবান। শাসক হিসেবে তিনি সর্বদা তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। চন্দ্রগুপ্ত ও বিন্দুসারের সুশাসক হিসেবে খ্যাতি প্রমাণ করে যে, তাঁরা উপরোক্ত আদর্শকে উপেক্ষা করেননি। আর সম্রাট অশোকের শাসনব্যবস্থার ভিত্তিই ছিল পিতৃত্ববোধ, আদর্শ ছিল প্রজাকল্যাণ, লক্ষ্য ছিল প্রজাদের তথ্য জগতের সব মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলসাধন। সামগ্রিক বিচারে মৌর্য শাসনব্যবস্থা নিরঙ্কুশ রাজকীয় স্বৈরাচার কিংবা রাজার স্বেছাচারী শাসন বলা সঠিক নয়। তবে মৌর্য শাসনরীতির কিছু সহজাত ত্রুটী বা সীমাবদ্ধতা চূড়ান্ত পরিণামে সাম্রাজ্যের ভিত্তিকেই দুর্বল করেছিল। কর্মীমণ্ডলীর আনুগত্য ছিল কেবল রাজার প্রতি। অশোকের মৃত্যুর পর ঘন ঘন রাজা পরিবর্তনের ফলে কেন্দ্রীয় শাসনের বন্ধন শিথিল হয়েছিল। শাসনের কেন্দ্রীকরণ প্রবণতার সাফল্য নির্ভর করে শাসকের (রাজার) দক্ষতার ওপর। অশোকের পরবর্তী দুর্বল বংশধরদের আমলে এই কেন্দ্রীভূত শাসনকাঠামো যথেষ্ট কার্যকরী হতে পারেনি। প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠনের অভাব একটা শূন্যতা অনিবার্য করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত বা অশোক এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখান। ফলে দক্ষ শাসকের অবর্তমানে সাম্রাজ্যের অবক্ষয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মৌর্য সম্রাটদের বৈদেশিক সম্পর্ক:

মৌর্য সম্রাটদের প্রত্যেকেই, অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার ও অশোক – বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার ব‍্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। এই যুগে বিদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। প্রধানত আলেকজান্ডার ও সেলুকাসের অভিযানের মাধ্যমে পশ্চিমের দেশগুলির সাথে ভারতের যোগাযোগ নিবিড় হয়েছিল। অবশ্য এর আগেও উত্তর-পশ্চিম ভারতের সাথে পারস্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যাইহোক্, সেলুকাসের অভিযানের সময় পর্যন্ত ভারতের সাথে গ্রীক দেশগুলির সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। এমনকি সেলুকাসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। উভয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শুরু হয় দূত বিনিময়। এরই ফলশ্রুতি মেগাস্থেনিস আসেন পাটলিপুত্রের রাজদরবারে। তাছাড়া সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে কাবুল, কান্দাহার, হীরাট ও বেলুচিস্তানের অংশবিশেষ দান করার ফলে উত্তর-পশ্চিমে মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমা বহুদূর বিস্তৃত হয় এবং মিশর ও সংলগ্ন দেশগুলির সাথে ভারতের যোগাযোগ সহজ হয়। বিন্দুসারও পিতার নীতি অনুসরণ করে পশ্চিমের গ্রীক রাজ্যগুলির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। স্ট্র্যাবোর রচনা থেকে জানা যায়, সিরিয়ার রাজা ডেইমেক্‌সকে দূত হিসেবে বিন্দুসারের রাজসভায় প্রেরণ করেছিলেন।

মিশরের রাজা টলেমী ফিলাডেলফস ডায়োনিসিয়স নামক এক দূতকে পাটলিপুত্রের রাজদরবারে প্রেরণ করেছিলেন। বিনিময়ে বিন্দুসারও সিরিয়া ও মিশরে দূত প্রেরণ করেন। অশোকের সময় মৌর্য বৈদেশিক সম্পর্ক আরো বিস্তৃত হয় ও এক নতুন মাত্রা পায়। কারণ অশোক তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ প্রচারের জন্য বিভিন্ন দেশে দূত প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীও সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে পর্যন্ত প্রসারিত করেন। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে গ্রীকগণকে প্রশাসনিক উচ্চপদ দিতেও তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাঁর সময়ে গিরনারের শাসনকর্তা ছিলেন যবন তুষাস্ফ। ত্রয়োদশ শিলালেখ থেকে অশোকের বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে বিশদ জানা যায়। ঐ লেখতে মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজ্যের রাজা হিসেবে অভিয়োকের নাম রয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, এরপরে ছিল তুরমায়া, মক, অত্তিকিন ও অলিকসুন্দরের রাজ্য। এদের আক্রমণে সিরিয়ারাজ দ্বিতীয় এ্যান্টিওকাস (আত্তিয়োক), মিশররা দ্বিতীয় টলেমী ফিলাডেলফস (তরুমায়া), ম্যাসিডন রাজা এ্যান্টিগোনাস (অস্তিকিন), সাইরিক রাজ ম্যাগাস (মক) ও এপিরাস বাকরিন্থের রাজা আলেকজান্ডারের সাথে সনাক্ত করা হয়েছে। অশোক দাবি করেছেন এইসব দেশে তিনি ধর্মদূত পাঠিয়েছিলেন। অন্তত সিরিয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দাবির যথার্থতা ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন। অশোকের সাথে খোটান ও চীন দেশের সম্পর্কের ব্যাপারটি প্রশ্নাতীত না হলেও নেপালের সাথে যে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বস্তুত নেপালের একাংশ তাঁর রাজ্যভুক্তই ছিল। সুদূর দক্ষিণের চোল, পাণ্ড্য, সত্যপুত্র, কেরলপুত্র প্রভৃতি রাজ্যের সাথেও তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। সিংহলে তিনি দূত হিসেবে নিজ পুত্র মহেন্দ্রকে পাঠান। দুই দেশের মধ্যে দূত বিনিময়ও ছিল নিয়মিত। এইভাবে মৌর্য সম্রাটরা বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment