মৌর্য শাসনে ভারত : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিঃপূঃ ৩২৪-৩০০ অব্দ)

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্য শাসনে ভারত : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিঃপূঃ ৩২৪-৩০০ অব্দ)” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্য শাসনে ভারত : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিঃপূঃ ৩২৪-৩০০ অব্দ)

মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসনারোহণের সময়কাল ও বংশ পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাছন্ন। এবিষয়ে জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যের বক্তব্য স্বতন্ত্র। আবার জৈনসূত্রগুলির বক্তব্যও অভিন্ন নয়। জৈন পরিশিষ্ট পার্বণে বলা হয়েছে যে, মহাবীরের সিদ্ধি লাভের ১৫৫ বছর পর চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু, জৈন পণ্ডিত মেরুতুঙ্গ এই মতের বিরোধিতা করে লিখেছেন যে, চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসনারোহণ ঘটেছিল মহাবীরের সিদ্ধিলাভের ৬০ বছর পরে। অন্যদিকে মহাবীরের সিদ্ধিলাভের সময়কালও সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা যায়নি। তাই জৈনসূত্র এক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। বৌদ্ধ ঐহিত্য অনুসারে বুদ্ধের পরিনির্বাণের ১৬২ বছর পর চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। সাধারণভাবে বুদ্ধের পরিনির্বাণের স্বীকৃত সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ। তাহলে চন্দ্রগুপ্তের সম্রাটপদ লাভের সময় হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ অব্দকে (৪৮৬-১৬২ = ৩২৪ অব্দ) নির্দিষ্ট করা যায়। গ্রীক, লাতিন রচনা থেকেও এই মতের সমর্থন মেলে। এই সকল বিবরণ মতে, চন্দ্রগুপ্ত যখন প্রথম গ্রীকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন (খ্রিঃপূঃ ৩২৬-২৫ অব্দ) তখনও তিনি সিংহাসনে বসেন নি এবং এই সাক্ষাতের কিছুকালের মধ্যেই তিনি রাজপদে আসীন হয়েছিলেন। অর্থাৎ‍ চন্দ্রগুপ্তের সম্রাট পদলাভের তারিখ খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫-‘২৪ অব্দের মধ্যে হওয়াই স্বাভাবিক।

অশোকের ত্রয়োদশ শিলালেখ থেকেও এ বিষয়ে সমর্থন পাওয়া যায়। সাইরিনের শাসক ম্যাগাস অশোকের সমসাময়িক ছিলেন ম্যাগাস মারা যান আনুমানিক খ্রিঃ পূঃ ২৫৯-২৫৮ অব্দে। অশোক তাঁর শিলালেখতে ম্যাগাসকে জীবিত বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এই লেখ উৎকীর্ণের সময়কে ২৫৯-২৫৮ খ্রিঃ পূর্বের পরে টানা যায় না। এখন ঐতিহ্য অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত রাজত্ব করেছিলেন ২৪ বছর। বিন্দুসারের শাসনকাল আনুমানিক ২৭/২৮ বছর। এটিও স্বীকৃত যে অশোকের সিংহাসনে বসা এবং রাজ্যাভিষেক উৎসবের মধ্যে প্রায় চার বছরের ব্যবধান ছিল। তাহলে অশোকের রাজ্যাভিষেকের অন্ততঃ ৫৫ বছর আগে (২৪ + ২৭ + ৪ = ৫৫) অশোক সিংহাসন লাভ করেছিলেন। সেক্ষেত্রে অশোকের রাজ্যাভিষেক আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০-২৬৯ অব্দে হয়েছে ধরে নিলে চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন লাভের সময় হিসেবে (২৭০/২৬৯ + ৫৫) খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫-৩২৪ অব্দকে গ্রহণ করা যায়। সিংহাসনারোহণের তারিখের মতই, চন্দ্রগুপ্তের বংশপরিচয় সম্পর্কেও বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। চন্দ্রগুপ্তের বংশের নাম ছিল মৌর্য। এই ‘মৌর্য’ কথাটি কিভাবে এসেছিল, সে সম্পর্কে নানা মত প্রচারিত আছে। মধ্যযুগের ব্রাষ্মণ টীকাকারদের মতে, ‘মৌর্য’ শব্দটি এসেছে ‘মুরা’ নামটি থেকে। এই শূদ্রাণী মুরা ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের মাতা বা পিতামহী এবং কোন নন্দরাজার উপপত্নী। ক্ষেমেন্দ্র ও সোমদেবের রচনাতে চন্দ্রগুপ্তকে ‘পূর্বনন্দ-সূত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকেও নন্দদের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্পর্কের উল্লেখ আছে। অবশ্য এটি অনেক পরবর্তীকালের রচনা।

অন্যদিকে পুরাণে কোথাও মৌর্যদের সঙ্গে নন্দদের সম্পর্কের উল্লেখ নেই। অবশ্য অনেক জায়গায় তাঁদের অধার্মিক, শুদ্রপ্রায়, এমনকি অসুর বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ সমস্ত উক্তি করা হয়েছে সম্ভবত মৌর্য রাজাদের হিন্দুধর্ম অপেক্ষা জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অধিক আসক্তিজনিত কারণে। নন্দবংশের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের যে কোন সম্পর্ক ছিল না তা গ্রীক লেখকগণও পরোক্ষ সমর্থন করেছেন। জাস্টিন চন্দ্রগুপ্তকে ‘সাধারণ বংশজাত’ বলে উল্লেখ করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত যদি নন্দবংশের সন্তান হতেন, তাহলে জাস্টিন কখনই তাঁর সম্পর্কে এরূপ উক্তি করতেন না। আর সেক্ষেত্রে চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক নন্দবংশের উচ্ছেদসাধন করে অপর একটি পৃথক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও থাকে না। চন্দ্রগুপ্ত যদি শূদ্রবংশজাত বা নন্দপরিবারভুক্ত ব্যক্তি না হন, তাহলে তাঁর বংশপরিচয় কি ছিল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এজন্য আমাদের প্রধানত বৌদ্ধ ও জৈন ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দিব্যবদান’ ও ‘মহাবংশ’ চন্দ্রগুপ্তকে ‘মোরিয়’ বংশোদ্ভূত ও ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দিব্যবদানে চন্দ্রগুপ্তের পুত্র বিন্দুসার ও পৌত্র অশোক ক্ষত্রিয় বলে বর্ণিত হয়েছেন। জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্ট পার্বণে চন্দ্রগুপ্তকে ‘ময়ূর পোষক’ বা ‘ময়ূর পালকদের গোষ্ঠীপতির দৌহিত্র’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাপরিনির্বাণ সূত্রেও বলা হয়েছে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ সংগ্রহের জন্য সমবেত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পিপ্ললীবনের ক্ষত্রিয় মোরিয়গণও ছিল। এই মোরিয়গণ কর্তৃক নির্মিত একটি যুগের অবস্থান থেকে ও ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে তাদের রাজ্যটির অবস্থান স্থির করা যায়। জানা যায় যে, এরা গোরক্ষপুরের অন্তর্গত পিপ্ললীবনের একটি গণরাজ্যের শাসক ছিল। সুতরাং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নীচবংশজাত ছিলেন না এবং ক্ষত্রিয় মোরিয়গণই ছিল তাঁর পূর্বপুরুষ, এই মতই বর্তমানে অধিকাংশ পণ্ডিত স্বীকার করেন।

চন্দ্রগুপ্তের প্রথম জীবন সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য পাওয়া যায় বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে। জানা যায় তাঁর পিতা ছিলেন মোরিয় গোষ্ঠীর এক নেতা, যিনি যুদ্ধে নিহত হলে তাঁর সহায়হীনা স্ত্রী পাটলিপুত্রে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁর এক পুত্র জন্ম নেয়। এই পুত্রই ইতিহাস বিখ্যাত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। প্রথমে একজন গো-পালক ও পরে একজন শিকারীর তত্ত্বাবধানে এই বালক বড় হতে থাকে। এক সময়ে ব্রাহ্মণ চাণক্য বা কৌটিল্যের দৃষ্টি পড়ে তাঁর উপর। কৌটিল্য তাঁর মধ্যে রাজকীয় লক্ষণসমূহ প্রত্যক্ষ করেন ও তাঁকে নিজে সঙ্গে করে তক্ষশীলায় নিয়ে যান। সেখানেই তিনি চন্দ্রগুপ্তকে নানা শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। এই সময়ে ধননন্দের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সম্ভবত এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক চন্দ্রগুপ্তকে নন্দবংশের উচ্ছেদসাধনে উৎসাহিত করে। এই উদ্দেশ্যে চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক শিবিরে গিয়ে আলেকজান্ডারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জাস্টিন ও প্লুটার্কের রচনা থেকে জানা যায়, এই সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি ঘটে ৩২৬-’২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। অবশ্য চন্দ্রগুপ্ত তাঁর প্রার্থিত সাহায্য পাননি। আলেকজান্ডার তাঁর সাহসিকতাকে ‘ঔদ্ধত্য’ বলে মনে করেন। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি চন্দ্রগুপ্তের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। ভীত চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক শিবির থেকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। তারপর বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে আশ্রয় নেন ও সেখানকার অধিবাসীদের নিয়ে সেনাদল তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেন। চন্দ্রগুপ্তের সেনাদলের সদস্যদের জাস্টিন ‘দস্যু’ বলে বর্ণনা করেছেন। খুব সম্ভব এরা ছিল কিরাত, যবন প্রভৃতি ব্যাধজাতির মানুষ, কারণ অর্থশাস্ত্রে এদের ‘আয়ুধজীবিন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

সেনাদল গঠনের পর চন্দ্রগুপ্ত রাজ্যজয়ে মন দেন। সেই সময়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল দুটি, যথা—নন্দবংশের উচ্ছেদসাধন ও উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রীকদের বিতাড়ন। দুটি কাজেই তিনি সফল হয়েছিলেন। তবে কোন্ কাজটি তিনি আগে করেছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এই মতভেদের প্রধান কারণ জাস্টিন লিখিত বিবরণের অসচ্ছতা, যা পাঠ করে এক-একজন ঐতিহাসিক এক-একপ্রকার মতপ্রকাশ করেছেন। আর. কে. মুখার্জীর মতে, চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারতকে বিদেশী শাসনমুক্ত করেন, তারপর মগধের সিংহাসন থেকে নন্দবংশকে অপসারিত করার জন্য অগ্রসর হন। অন্যদিকে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন, চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে নন্দবংশের উচ্ছেদসাধন করে মগধের সিংহাসন দখল করেন, তারপর গ্রীক-শাসনের অবসানকল্পে উত্তর-পশ্চিম ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। কারণ জাস্টিন লিখেছেন, সেনাবাহিনী গঠনের পর চন্দ্রগুপ্ত “ভারতীয়দের কাছে বর্তমান সরকারের উচ্ছেদ সাধনের ও নতুন সার্বভৌম সরকারকে সমর্থনের আহ্বান জানান” ( Instigated the Indian to over throw the existing government.)। এখানে বর্তমান সরকার বলতে নন্দবংশকে এবং নতুন সার্বভৌম সরকার বলতে চন্দ্রগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত সরকারকে বোঝানো হয়েছে মনে করা যেতে পারে। আবার জাস্টিন পরের একটি অনুচ্ছেদে এমন বর্ণনা উপস্থাপিত করেছেন, যার এরূপ ব্যাখ্যাও হতে পারে যে, গ্রীক সেনানায়কদের সঙ্গে যুদ্ধের পরে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসন অধিকার করেন। বর্তমানে রুশ গবেষক বনগার্ড লেভিন বিতর্কিত বিষয়টিকে আর একভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা এইরূপ—বৌদ্ধ ও জৈন ঐতিহ্য থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত একবারের প্রচেষ্টায় নন্দরাজকে পরাজিত করতে সক্ষম হননি। সম্ভবত প্রথমবার অসফল হবার পরে চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও নন্দশাসনের উচ্ছেদ সাধনকল্পে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। এখানে প্রত্যাশিত সাহায্য যদিও তিনি পাননি। এরপর আলেকজান্ডার ভারত ছেড়ে চলে গেলে পাঞ্জাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই অবস্থার সুযোগে চন্দ্রগুপ্ত পাঞ্জাবের অন্তর্গত কিছুটা অংশ নিজ অধিকারে আনেন। তারপর উত্তর-পশ্চিম ভারতের যুদ্ধপ্রিয় উপজাতিগুলির সহায়তায় মগধ দখল করেন। লেভিনের মতে, ‘বর্তমান সরকার’ হল পাঞ্জাবের গ্রীক শাসন, যার উচ্ছেদের জন্য চন্দ্রগুপ্ত ভারতীয়দের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। লেভিন এইভাবে জাস্টিনের বিবরণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যাই হোক্, বিষয়টি এখনো বিতর্কিত।

নন্দবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেন। ধননন্দ ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও প্রজাপীড়ক শাসক। প্রজাদের উপর চড়া হারে শুল্ক বসিয়ে ও তা আদায়ের জন্য অত্যাচার করে তিনি প্রজাদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের গ্রীক অভিযানের বিরুদ্ধেও তিনি কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেননি। ফলে শাসক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা জনসাধারণের সামনে প্রকট হয়ে ওঠে। চন্দ্রগুপ্ত এই পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে কাজে লাগান। তিনি প্রথমে সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি জয় করতে থাকেন। তারপর ক্রমশ সমগ্র সাম্রাজ্য দখল করে নেন। নন্দ সেনাপতি ভদ্রাশাল তাঁর কাছে পরাজিত হন। ‘মহাবংশটীকা’ থেকে জানা যায় নন্দরাজা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। মগধের সিংহাসন দখলের কাজে চন্দ্রগুপ্তের প্রধান সহায়ক ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ কৌটিল্য। নন্দবংশের উচ্ছেদসাধনে তাঁর কি স্বার্থ ছিল তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। প্রচলিত মতানুযায়ী ব্যক্তিগত কোন অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে তিনি নন্দবংশের উচ্ছেদসাধনে ব্রত নেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে এই কাজের যোগ্য করে গড়ে তোলেন ও শেষ পর্যন্ত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছান। পুরাণ, মুদ্রারাক্ষস, সিংহলীয় ইতিবৃত্ত এমনকি জাস্টিনের বিবরণেও চন্দ্রগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে বসানোর প্রধান কৃতিত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়েছে।

চন্দ্রগুপ্তের অপর কীর্তি হল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রীক শাসনের অবসান ঘটানো। প্রভূত সম্পদ ও বিশাল সেনাদল থাকা সত্ত্বেও ধননন্দ এই কাজে অগ্রসর হননি। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত তাঁর প্রথম কর্তব্য হিসেবে দেশকে বিদেশী শাসনমুক্ত করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। ঠিক কোন্ সময় থেকে তিনি এই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তার সমাপ্তিই বা কবে হয়েছিল, তা স্পষ্টভাবে কোথাও উল্লেখিত হয়নি। এই যুদ্ধের ধারাবাহিক বিবরণীও আমরা পাইনি। তবে বেশ কিছু পরোক্ষ প্রমাণ থেকে এ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয় ৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। জাস্টিনের বর্ণনা অনুযায়ী এর ঠিক পরেই ভারতীয়গণ ঐ অঞ্চল শাসনকারী আলেকজান্ডারের সেনাপতিদের হত্যা করে দাসত্বমুক্ত হয়। স্যানড্রাকোট্রাস অর্থাৎ‍ চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। চন্দ্রগুপ্তের সাফল্যের কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, তাঁর ছিল সুদক্ষ সেনাবাহিনী, যার সাহায্যে তিনি গ্রীক সেনাপতিদের পরাস্ত করেন। দ্বিতীয়ত, এই সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর সহায়ক ছিল। প্রকৃতপক্ষে ঐ অঞ্চলের মানুষরা কোনভাবেই গ্রীক শাসনকে মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতালাভের জন্য তারা সদা উন্মুখ ছিল ও তাদের এই আকাঙ্ক্ষা মাঝেমধ্যেই বিদ্রোহের রূপ নিচ্ছিল। এমনকি গ্রীক-শাসক নিকানোর অসসাকেনয় উপজাতির হাতে নিহতও হয়েছিলেন। এরপর ৩২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু উপত্যকার গ্রীক-ক্ষত্রপ ফিলিপ্পাসের মৃত্যু হয় এবং ৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মারা যান স্বয়ং আলেকজান্ডার। এই সংবাদ এদেশে এসে পৌঁছালে পরিস্থিতি আরো বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। চন্দ্রগুপ্ত এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি একের পর এক গ্রীক সেনাপতিদের পরাস্ত ও বিতাড়িত করে তাদের অঞ্চলগুলি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে থাকেন। তাঁর এই সংগ্রাম সম্ভবত ৩২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু হয় ৩১৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত চলে। ৩২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বা তার কিছু পূর্বেই তিনি যে এই যুদ্ধ শুরু করেছিলেন তার প্রমাণ হিসেবে ‘ত্রিপারা ডিসাস’-এর চুক্তির উল্লেখ করা যায়। ঐ চুক্তিটিও ৩২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিটিতে সিন্ধুর শকশাসক পিথনকে অপসারিত করার নির্দেশ রয়েছে, অথচ তাঁর জায়গায় ঐ প্রদেশ কে শাসন করবেন তার কোন উল্লেখ নেই। এ থেকে মনে হয় যে, ঐ সময়েই সিন্ধুর উপর গ্রীক অধিকারের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ও এই ঘটনায় চন্দ্রগুপ্তের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আবার আলোচ্য সংঘর্ষ যে ৩১৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত চলেছিল, তার স্বপক্ষেও ঐতিহাসিকরা প্রমাণ উপস্থাপিত করেছেন, যার ভিত্তি ঐ গ্রীক লেখকগণেরই প্রদত্ত বিবরণ। জানা যায় যে, ৩১৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পাঞ্জাবের গ্রীক শাসক ইউডেমাস পুরুকে হত্যা করে সেনাবাহিনীসহ স্থায়ীভাবে ভারত ত্যাগ করেন। এর সাথে সাথেই ঐ অঞ্চলে গ্রীক শাসনের অবসান ঘটে। প্লিনির রচনা থেকে জানা যায় যে, সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যের মধ্যবর্তী সীমানা ছিল সিন্ধুনদ। সুতরাং গ্রীকদের সাথে যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে পূর্ব পাঞ্জাব ও সিন্ধু চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজত্বের শেষদিকে পুনরায় গ্রীকগণের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এবারে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। সেলুকাস পান ঐ সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ যা সিরিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্বভাবতই তিনি সাম্রাজ্যের হৃত অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। ব্যাবিলন ও ব্যাকট্রিয়া জয় করে তিনি ভারত আক্রমণ করেন। এ সময়ে গ্রীক সাম্রাজ্য সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার পূর্বের অংশ চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক অধিকৃত হয়েছিল, তা আমরা আগেই দেখেছি। চন্দ্রগুপ্ত অধিকৃত ঐসব অঞ্চল পুনর্দখল করাই ছিল সেলুকাসের অভিযানের উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, সেলুকাস ৩০৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ সিন্ধুনদের তীরে পৌঁছান। চন্দ্রগুপ্তও তাঁকে বাধা দেন। অবশ্য গ্রীক লেখকদের রচনায় এই যুদ্ধের কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে উভয়ের মধ্যে বিবাহ-সম্পর্ক সংক্রান্ত এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেকথা অনেক গ্রীক লেখকের রচনা থেকেই জানা যায়। ঐ চুক্তির মাধ্যমেই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল বলে মনে করা যেতে পারে। এই সন্ধিচুক্তির উল্লেখ এ্যাপ্পিয়ানস ও জাস্টিনের রচনায় রয়েছে। জাস্টিনের মতে, সেলুকাস স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ৩০১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। তার আগেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। স্ট্রাবো লিখেছেন, সন্ধির শর্তানুযায়ী সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে এ্যারিয়া, অ্যারাকোসিয়া, গেড্রোসিয়া ও প্যারাপানিসদয় প্রদান করেন। এই স্থান চারটি হল যথাক্রমে হেরাত, কান্দাহার, বালুচিস্তানের দক্ষিণাংশ ও কাবুল। প্লুটার্কের রচনা অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০ রণহস্তী প্রদান করেন। অর্থাৎ উভয়ের মধ্যে শেষপর্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যার নিদর্শন স্বরূপ সেলুকাস মেগাস্থেনিসকে পাটলিপুত্রের রাজদরবারে প্রেরণ করেন।

উভয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি বিতর্কিত। প্রচলিত মতানুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাস কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, আলোচ্য চুক্তিতে উভয় রাজপরিবারের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে, এরূপ স্বীকৃতি জানানো হয়েছে মাত্র। এ থেকে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এরূপ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে যে চারটি প্রদেশ দান করেছিলেন সেগুলির বিষয়েও পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যাই হোক্‌, সন্ধির শর্তগুলি বিশ্লেষণ করে অনেকে মনে করেন যে, এই যুদ্ধে সেলুকাস পরাজিত হয়েছিলেন। এই সন্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে ড. স্মিথ বলেন যে, দু’হাজার বৎসর পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত যে বৈজ্ঞানিক সীমান্তের অধিকারী হয়েছিলেন, তা মোঘলগণ বা ইংরেজগণ পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়: “The first Indian emperor more than two thousand years ago, thus entered into the possession of that scientific frontier sighted in vain by English Successors … even by the Mughal.”

দুটি গ্রীক যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় চন্দ্রগুপ্ত ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে অতিবাহিত করেন। প্লুটার্ক লিখেছেন, চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে সমগ্র ভারতকে পদানত করেন। ঐ বাহিনী ৬ লক্ষ সেনা নিয়ে গঠিত ছিল। জাস্টিনও একই প্রকার মত ব্যক্ত করেছেন। তবে এর বেশি কোন তথ্য, অর্থাৎ কোন্ কোন্ রাজ্য তিনি জয় করেছিলেন, কবে সেইসব যুদ্ধের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ইত্যাদি কোন তথ্যই আমরা গ্রীক রচনা থেকে পাই না। এজন্য আমাদের অন্যান্য সূত্র, বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করতে হয়, যা থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এ বিষয়ে শোকের শিলালিপিসমূহ আমাদের বিশেষ সাহায্য করে। এগুলির মাধ্যমে আমরা মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি। দক্ষির-ভারতে মহীশূরের চিতলদুগ পর্যন্ত অঞ্চল অশোকের রাজত্বকালে মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী এই মত দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। কারণ যতদূর জানা যায়, বিন্দুসার কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করেছিলেন মাত্র, নতুন কোন রাজ্য জয় করেননি। আর সম্রাট অশোক একমাত্র কলিঙ্গ ভিন্ন অন্য কোন রাজ্যজয়ের কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না। অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্তের সময়েই মৌর্য সাম্রাজ্য মহীশূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। বৃহৎকথাকোষ, ভদ্রবাহুচরিত বা জৈনগ্রন্থাদিতেও চন্দ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত জয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তামিলনাড়ুর তিন্নেভেলী জেলাতেও অশোকের একটি শিলালেখ পাওয়া গেছে। ড. কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার তাঁর ‘Begining of the History of South India’ নামক গ্রন্থে প্রাচীন তামিল লেখক মামুলনার রচনা থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, মৌর্যগণ তাদের বিশাল সেনাবাহিনী-সহ তিন্নেভেলী জেলায় প্রবেশ করেছিল। এখানে মৌর্যদের ‘ভম্বা মোরিয়’ অর্থাৎ‍ ভুঁইফোঁড় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই অভিধাটি বিন্দুসার বা অশোকের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবার সম্ভাবনা যেহেতু নেই, সেহেতু ঐ অঞ্চলে অভিযানকারী এই ভুঁইফোঁড় রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই ছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে। সম্ভবত নন্দবংশকে পরাজয়ের সূত্রে চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ-ভারতের কিছু রাজ্যাংশ লাভ করেছিলেন ও পরে আরও কিছু রাজ্য দখল করেছিলেন। মহীশূরে প্রাপ্ত মধ্যযুগের কয়েকটি লেখতেও শিখরপুর জেলার নগরখণ্ড চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রক্ষণাধীন ছিল বলে বলা হয়েছে। লেখগুলি পরবর্তীকালের হলেও উপরোক্ত মতের সাথে এগুলির বক্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলা যায়, দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু অংশ মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত করার কৃতিত্ব চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই প্রাপ্য। পশ্চিম ভারতের অংশবিশেষও তিনি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তাঁর সৌরাষ্ট্র জয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় শকক্ষত্রপ রুদ্রদামনের ‘জুনাগড় প্রশস্তি’ থেকে। এই লেখতে চন্দ্রগুপ্তের রাষ্ট্রীয় বা উচ্চপদস্থ কর্মচারী বৈশ্য পুয্যগুপ্তের উল্লেখ আছে, বিখ্যাত সুদর্শন হ্রদের নির্মাতা হিসেবে। সুতরাং সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। আবার মধ্যবর্তী প্রদেশ মালব জয় না করে সৌরাষ্ট্র সাম্রাজ্যভুক্ত করা সম্ভব ছিল না। তাই মালব ও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল বলে মনে হয়। মগধের পার্শ্ববর্তী বাংলায় মৌর্য অধিকার বিস্তৃত ছিল কিনা তা নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত একটি লেখর ভিত্তিতে অনেকে মনে করে থাকেন ঐ অঞ্চল পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তবে এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসার মত তথ্য প্রমাণ এখনো পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। এইভাবে চন্দ্রগুপ্ত ভারতের প্রায় সকল অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার করেন।

জৈন ঐতিহ্য অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জৈনগুরু ভদ্রবাহুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি শেষ বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করেন। জৈন অনুশাসন অনুযায়ী তিনি মহীশূরের শ্রবণবেলগোলায় উপস্থিত হন ও তপস্বীর মত জীবনযাপন করতে থাকেন। পরিশেষে জৈন রীতি অনুযায়ী অনশনে দেহত্যাগ করেন (আনু. ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। মেগাস্থেনিস চন্দ্রগুপ্তের জীবনযাত্রার যেরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে তিনি প্রকৃতই জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। কারণ মেগাস্থেনিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, চন্দ্রগুপ্ত অন্তঃপুরে নারীরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠান থাকলে অন্তঃপুর ত্যাগ করে বাইরে আসতেন। তাছাড়া তাঁর প্রধানমন্ত্রী তথা প্রধান মন্ত্রণাদাতা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ কৌটিল্য। তবে এরূপ হওয়াও অসম্ভব নয় যে চন্দ্রগুপ্ত প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, কিন্তু শেষজীবনে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা ত্যাগ করে জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। জৈনগ্রন্থ ‘রাজাবলীকথে’ অনুসারে জৈন ভিক্ষু ভদ্রবাহুর সাহচর্যে দাক্ষিণাত্যে চলে যান। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে কর্ণাটকে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

মৌর্য শাসনে বিন্দুসার (৩০০-২৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

চন্দ্রগুপ্ত ও জুর্ধরার পুত্র বিন্দুসার মগধের সিংহাসনে বসেন ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বিন্দুসার ‘অমিত্রঘাত’ উপাধি নেন। স্ট্রাবো, স্যান্ড্রোকোট্টাস অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্তের পুত্র ও উত্তরাধিকারী হিসেবে এ্যালিব্রক্যাডেস বা অমিত্রঘাতের নামোল্লেখ করেছেন। পুরাণ অনুযায়ী বিন্দুসার ২৫ বছর ও বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী ২৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। বৌদ্ধ মতের উপরেই অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিন্দুসারের রাজত্বকালের বিশদ বিবরণ আমরা পাইনি। পরবর্তীকালের সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায় যে, কৌটিল্য বিন্দুসারের সময়েও কয়েকবছর মন্ত্রিপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথ চাণক্যর বিষয়ে লিখেছেন যে, মন্ত্রী থাকাকালীন চাণক্য ১৬টি শহরের রাজা ও অভিজাতদের বিনাশসাধন করেছিলেন। তাঁর এই কাজের দ্বারা বিন্দুসারের সাম্রাজ্য পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। স্মিথ তারানাথের এই বক্তব্যকে অনুসরণ করে এই মতপ্রকাশ করেছেন যে, বিন্দুসারের রাজত্বকালেই দক্ষিণ-ভারত মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। কারণ চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় দক্ষিণ ভারত জয়ের সময় পাননি, আর অশোক কেবলমাত্র কলিঙ্গ রাজ্যটি মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। অথচ অশোকের সাম্রাজ্য তামিলনাড়ুর তিন্নেভেলী জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সে প্রমাণ রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিন্দুসারই দক্ষিণ ভারত জয় করেছিলেন ও অশোক তা উত্তরাধিকার সূত্রে পান। কিন্তু ড. রায়চৌধুরী এই মত অস্বীকার করেছেন। তাঁর যুক্তি হল তারানাথের রচনা অনেক পরবর্তীকালীন। তাছাড়া বিন্দুসার কর্তৃক দক্ষিণ-ভারত জয়ের কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং তারানাথের বর্ণনার ভিত্তিতে বিন্দুসার দক্ষিণ ভারত জয় করেছিলেন, এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। সম্ভবত তারানাথ তাঁর বর্ণনার মাধ্যমে বিন্দুসারের রাজত্বকালে সংঘটিত কোন বিদ্রোহের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। দিব্যবদান থেকেও বিদ্রোহ সম্পর্কিত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায় বিন্দুসারের রাজত্বকালে তক্ষশীলায় এক বিদ্রোহ দেখা দেয়। তিনি ঐ বিদ্রোহ দমনের জন্য নিজপুত্র অশোককে সেখানে প্রেরণ করেন। বিদ্রোহীরা অবশ্য জানায় যে, অমাত্যদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ হিসেবেই তারা বিদ্রোহ করেছে, সম্রাট বিন্দুসারের বিরুদ্ধে নয়। যাইহোক্, বিন্দুসার বিদ্রোহগুলি দমন করে চন্দ্রগুপ্ত অর্জিত সাম্রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, এটাই তাঁর প্রধান কৃতিত্ব।

বৈদেশিক শক্তিগুলি অর্থাৎ গ্রীক রাজাগণের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। মেগাস্থেনিসের পর সিরিয়ার রাজা ডেইসেকসকে বিন্দুসারের রাজসভায় প্রেরণ করেন বলে স্ট্রাবোর রচনা থেকে জানা যায়। বিন্দুসার সিরিয়ার রাজা প্রথম এ্যান্টিওকাসকে এক পত্রের মাধ্যমে মিষ্ট মদ্যপানীয়, শুষ্ক ডুমুর ইত্যাদি বস্তু ও একজন গ্রীক দার্শনিককে পাটলিপুত্রের রাজসভায় প্রেরণের অনুরোধ জানান। এ্যান্টিওকাস কোন দার্শনিককে পাঠাননি, তবে অন্যান্য দ্রব্যগুলি পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মিশরের সম্রাট টলেমী ‘শিলাডেলফস ডায়োনিসিয়স’ নামক এক দূতকে পাটলিপুত্রের রাজদরবারে প্রেরণ করেন। এ তথ্য গ্লিনির রচনা থেকে জানা যায়। তবে ডায়োনিসিয়স বিন্দুসার বা অশোক, কার সময়ে পাটলিপুত্রে এসে পৌঁছান, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বিন্দুসার সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয় শাসক। দার্শনিক ও চিন্তাবিদ্গণকে তিনি যথার্থ সম্মান জানাতেন।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment