মৌর্য শাসনে সম্রাট অশোক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্য শাসনে সম্রাট অশোক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্য শাসনে সম্রাট অশোক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

ভারতীয় শাসকদের মধ্যে এক অতিবিশিষ্ট নাম হল সম্রাট অশোক। মৌর্য বংশের এই মহান সন্তান রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যে অভিনব নীতি অনুসরণ করেছিলেন, তা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর শাসনতান্ত্রিক আদর্শের রূপায়ণে সহায়ক উপাদান হিসেবে আলোচিত হয়ে চলেছে। ঐতিহাসিক এইচ. জি. ওয়েলস তাঁকে ‘সমস্ত শাসকদের মধ্যে মহত্তম’ বলে বর্ণনা করেছেন। বৃহৎ সাম্রাজ্যের অধিকার হিসেবে নয়, একজন প্রজাকল্যাণকামী শাসক হিসেবেই তিনি অশোককে এই মর্যাদাপূর্ণ অভিধায় ভূষিত করেছেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উভয় প্রকার উপাদান থেকে অশোকের রাজত্বকাল সম্পর্কিত তথ্যাদি পাওয়া যায়। সাহিত্যিক উপাদানের মধ্যে প্রধান দিব্যবদান ও সিংহলী ইতিবৃত্ত। দিব্যবদানের একটি অংশের নামই অশোকাবদান। এই অংশে অশোকের জীবনী বিবৃত রয়েছে। সিংহলী ইতিবৃত্ত বলতে বোঝায় দীপবংশ ও মহাবংশকে। এতেও অশোকের জীবনী রয়েছে। তবে এগুলির সবকটিই অনেক পরবর্তীকালের রচনা হওয়ায় এদের ঐতিহাসিক মূল্য কিছু কম। সে তুলনায় অশোকের লেখগুলির অবদান অনেক ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে অশোক সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞানের ভিত্তিই হচ্ছে এই লেখগুলি। তাই সম্রাট অশোকের জীবনী ও কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনার প্রারম্ভে লেখগুলি সম্পর্কে ধারণালাভ করা বাঞ্ছনীয়।

অশোকের লেখসমূহ :

অশোকের রাজত্বকালের সব থেকে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদান হল তাঁর শিলালিপিসমূহ। এমনও বলা হয় যে, কান পাতলে এই লেখগুলির মধ্যে অশোকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়। অবশ্য কেউ কেউ এগুলির গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেমন রিস্ ডেভিস বলেছেন, শ্রমসাধ্য, অদ্ভুত, জটিল ও পুনরাবৃত্তিতে পূর্ণ। কিন্তু এ বক্তব্য সঠিক নয়। লেখগুলি থেকে যেমন একদিকে অশোকের ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে বহু তথ্য জানা যায়, অন্যদিকে তেমনি এগুলি তাঁর রাজ্যসীমা নির্ধারণ, প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক, সেকালে শিক্ষাদীক্ষার বিস্তার প্রভৃতি নানা বিষয়ে জানতে সাহায্য করে।

অশোকের লেখগুলি প্রধানত গিরিগাত্রে, স্তম্ভের উপর ও গুহাগাত্রে উৎকীর্ণ ছিল। তাই এগুলিকে মূল তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যথা—শিলালেখ (Rock edict), স্তম্ভলেখ (Piller edict) ও গুহালেখ (Cave edict)। শিলালেখ ও স্তম্ভলেখগুলি আবার প্রধান ও অপ্রধান এই দু’ভাগে বিভক্ত। অশোকের শিলালিপিগুলি পাওয়া গেছে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে জনবসতিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহে। লেখগুলি সাধারণত মানুষের বোধগম্য মাগধী নামক প্রাকৃত ভাষায় রচিত। তবে এগুলি খোদিত হয়েছে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী অক্ষরে। আবার উত্তর-পশ্চিম ভারতের কয়েকটি লেখ গ্রীক ও ইরানের এ্যারামাইক লিপিতে খোদিত আছে। সম্ভবত ঐ অঞ্চলে একদা গ্রীক প্রাধান্যের কথা বিবেচনা করে এই লিপিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাতে তা অধিকাংশের বোধগম্য হয়। ১৮৩৭ সালে কলিকাতা মিন্টের কর্মচারী ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য জেমস্ প্রিন্সেপ সর্বপ্রথম অশোক লেখর পাঠোদ্ধার করেন। এ ব্যাপারে প্রিন্সেপের সহযোগী ছিলেন ল্যাসেন, কানিংহাম প্রমুখ পণ্ডিত।

অশোকের প্রধান শিলালেখর সংখ্যা ১৪। এই প্রধান শিলালেখ নয়টি স্থানে পাওয়া গেছে। যেসব স্থানে এগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে সেইসব স্থানগুলি হল পেশোয়ার জেলার অন্তর্গত শাহবাজগড়ি, হাজারা জেলার মানসেরা, বর্তমান দেরাদুনের নিকটবর্তী কালসী, থানা জেলার সোপারা, গুজরাটের জুনাড়ের নিকটবর্তী গিরনার, অন্ধ্রপ্রদেশের কুরনুল জেলার অন্তর্গত এড়াগুড়ি, গঞ্জাম জেলার জৌগড়, পুরী জেলার ধৌলী ও কান্দাহার। এর মধ্যে এড়াগুড়ি কালসী, শাহবাজগাড়ী, মানসেরা ও গিরনারে ১৪টি অনুশাসনই পাওয়া গেছে। কান্দাহারে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অনুশাসনের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। সোপারাতে পাওয়া গেছে অষ্টম ও নবম মুখ্য অনুশাসনের অংশ। ধৌলী ও জৌগড়ে প্রাপ্ত শিলালেখ দুটিতে একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অনুশাসনগুলি নেই। তার পরিবর্তে দুটি বিশেষ অনুশাসন উৎকীর্ণ রয়েছে। এ দুটিতে অশোকের কলিঙ্গযুদ্ধ-সংক্রান্ত ও পরবর্তীকালে কর্মচারীদের অনুসরণীয় একাধিক নির্দেশ লিপিবদ্ধ আছে। কলিঙ্গযুদ্ধের পর এ দুটি খোদিত হয়েছিল। তাই এই দুটি ‘কলিঙ্গ-লেখ’ নামে পরিচিত। অপ্রধান লেখর দুটি অনুশাসন রয়েছে। তার প্রথমটি পাওয়া গেছে মোট দশটি স্থানে। এই স্থানগুলি হল উত্তরপ্রদেশের মীর্জাপুর জেলার আহরৌরা, কর্ণাটকের রায়চূড় জেলার গবীমঠ, মাশকি, পালকিকুণ্ড, রাজস্থানের জয়পুর জেলার বৈরাট, মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর জেলার রূপনাথ প্রভৃতি। প্রথম অনুশাসনের সঙ্গে যুক্ত অবস্থান দ্বিতীয় অনুশাসনটি পাওয়া গেছে আরো সাতটি স্থানে। এগুলি হল অন্ধ্রের কুরনুল জেলার এড়াগুড়ি, কর্ণাটকের বেলারি জেলার উড়েগোলাম ও নিট্রর, কর্ণাটকের চিতলদ্রুগ জেলার ব্রহ্মগিরি, সিন্ধপুরা ও জটিঙ্গ, রামেশ্বর প্রভৃতি। এই অপ্রধান শিলালেখগুলি প্রধান শিলালেখগুলির মত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত নয়। এর নির্দেশগুলিও সংক্ষিপ্ত। 

অশোকের প্রধান স্তম্ভলেখটি পাওয়া গেছে দিল্লীতে। সম্ভবত সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক নিকটবর্তী তোপরা গ্রাম থেকে এটি এনেছিলেন। এতে সাতটি অনুশাসন লিপিবদ্ধ আছে। একই ধরনের ছয়টি অনুশাসন সম্বলিত আর একটি ফলক দিল্লীতে পাওয়া গেছে। ফিরোজ তুঘলক এটি মিরাট থেকে দিল্লীতে এনেছেন বলে অনুমান করা হয়। এলাহাবাদে অনুরূপ আর একটি স্তম্ভলেখ পাওয়া গেছে। এটি সম্ভবত আকবর কোশাম্বী থেকে এনেছিলেন। এছাড়া প্রথম ছয়টি লেখর ভাষান্তর বিহারের চম্পারণ জেলার অন্তর্গত লৌরিয়া-আরারাজ, লৌরিয়া-নন্দনগড় এবং রামপূর্বীতে পাওয়া গেছে। অশোকের অপ্রধান স্তম্ভলেখগুলি চারটি অনুশাসন সম্বলিত। এই ধরনের স্তম্ভলেখ পাওয়া গেছে বারাণসীর নিকটবর্তী সারনাথে, ভূপালের অন্তর্গত সাঁচীতে, বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীতে ও নিগালিভ নামক গ্রামে নিগালিসাগর নামক পুষ্করিণীর তীরে। সম্ভবত অশোক গৌতমবুদ্ধের পুণ্য জন্মস্থান লুম্বিনী পরিদর্শনে এই পথ ধরে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সেই যাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে এই স্তম্ভগুলি স্থাপন করেছিলেন। অশোকের গুহা লেখ পাওয়া গেছে বিহারের গয়া জেলার অন্তর্গত বারাবার পাহাড়ে। এর চারটি গুহার তিনটিতে অশোকের অনুশাসন উৎকীর্ণ আছে। আজীবিকদের জন্য অশোকের দানের কথা এই গুহালিপি থেকে জানা যায়।

বেশিরভাগ লেখতে অশোক নিজের নামের পরিবর্তে ‘দেবানাং-প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা—এই অভিধা ব্যবহার করেছেন। এর সংক্ষিপ্তসার হিসেবে দেবানাং-প্রিয় প্রিয়দর্শী, প্রিয়দর্শী রাজা, দেবানাং প্রিয় রাজা, এমনকি ‘দেবানাং প্রিয়’ কথাটিও ব্যবহৃত হয়েছে বহুস্থানে। লেখগুলি শুরু হয়েছে ‘দেবানাং প্রিয় প্রিয়দর্শী এবম্ আহ’—এই কথাগুলি দ্বারা। জেমস্ প্রিন্সেপ যখন প্রথম লেখগুলির পাঠোদ্ধার করেন তখন এই প্রিয়দর্শী নামটি যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। প্রিয়দর্শী কোন্ বংশের বা কোন্ যুগের রাজা ছিলেন তা তিনি স্থির করতে পারেননি। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই সিংহলী ইতিবৃত্ত দীপবংশ থেকে জানা যায় যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র অশোকের অপর নামই প্রিয়দর্শী। এরপর মাসকী লেখ আবিষ্কৃত হতে এ সম্পর্কে সকল সন্দেহের অবসান ঘটেছে। ঐ লেখতে ‘দেবানাং প্রিয় অশোক’ কথাটি উৎকীর্ণ রয়েছে। এই লেখই ‘প্রিয়দর্শী’-সংক্রান্ত সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছে।

সম্রাট অশোকের রাজনৈতিক কৃতিত্ব :

বিন্দুসারের রাজত্বকালে অশোক ছিলেন উজ্জ্বয়িনীর শাসনকর্তা। তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমনের কাজেও তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি যখন উজ্জয়িনীতে ছিলেন, তখন বিন্দুসারের মৃত্যু ঘটে (২৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে)। সুতরাং ঐ বছরই তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে। দীপবংশ অনুযায়ী বুদ্ধদেবের মহাপরি-নির্বানের ২১৪ বছর পর অশোক সিংহাসনে বসেন। প্রচলিত মতানুযায়ী ৪৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বুদ্ধের জীবনাবসান হয়। সুতরাং ৪৮৭ – ২১৪ = ২৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দকেই অশোকের সিংহাসনারোহণের বছর ধরা যায়। আবার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনারোহণের তারিখ হিসেবে ৩২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দকে ধরা হয়। চন্দ্রগুপ্ত ২৪ বছর এবং বিন্দুসার ২৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায়। সেক্ষেত্রেও অশোকের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ হওয়া উচিত ৩২৪ – (২৪ + ২৭) = ২৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। কিন্তু তাঁর অভিষেক হয় আরো চার বছর পর অর্থাৎ ২৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। অশোক তাঁর লেখগুলিতে যখনই কোন তারিখের উল্লেখ করেছেন তখনই তা ধরা হয়েছে এই রাজ্যাভিষেকের বর্ষ থেকে। সিংহাসনে আরোহণ ও অভিষেক ক্রিয়ার মধ্যেই এই চার বছর ব্যবধানের কারণ সঠিকভাবে জানা যায় না। ‘দিব্যবদান’ ও ‘মহাবংশ’ অনুসারে অশোক ও তাঁর ৯৯জন ভ্রাতার মধ্যে এক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধে অশোক তাঁর ৯৯ জন (মতান্তরে ৯৮ জন) ভাইকে হত্যা করে নিজ সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন। সম্ভবত এইজন্য তাঁর অভিষেক চার বৎসর বিলম্বে হয়েছিল। অনেকের মতে, এ কাহিনী অতিরঞ্জিত। কারণ অশোকের লিপি থেকে তাঁর ভ্রাতা ও ভগিনীর জীবিত থাকার কারণ জানা যায়। তাই স্মিথ-এর মতে, এই চার বৎসর ভারত ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় (One of the dark space in the spectrum of Indian History, – V. Smith)। যাইহোক্, অশোকের রাজত্বকালের প্রথম কয়েক বৎসরের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। লেখতে বলা হয়েছে, আগে তিনি বিহার যাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন, যা এখন ধর্মবিজয়ে পরিবর্তিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিহার যাত্রা বলতে মৃগয়া ও আনুষাঙ্গিক আমোদ-প্রমোদকেই বোঝায়। তাই বলা যায়, রাজপুত্র ও রাজা হিসেবে প্রথম জীবনে তিনি রাজকীয় বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত ছিলেন। সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষাও ছিল তাঁর সহজাত। দিব্যবদান অনুযায়ী তিনি স্বল্প দেশ জয় করেন। কিন্তু তাঁর লেখ বা অন্যান্য উপাদান থেকে এ এ তথ্য প্রসঙ্গে একমাত্র কলিঙ্গ জয়েরই উল্লেখ পাওয়া যায়।

পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নীতি অনুসরণ করে অশোকও সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয়েছিলেন। রাজ্যাভিষেকের নবম বৎসরে তিনি কলিঙ্গ জয়ে প্রবৃত্ত হন। বর্তমান কটক, পুরী ও গঞ্জাম জেলা নিয়ে কলিঙ্গরাজ্য গঠিত ছিল। তাঁর ত্রয়োদশ শিলালিপি, কলিঙ্গলিপি, প্লিনির বর্ণনা ইত্যাদি থেকে কলিঙ্গ যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে কলিঙ্গ জয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল কেন, সে বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রকার মত পোষণ করেন। প্লিনির রচনা উদ্ধৃত করে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন যে, কলিঙ্গ একসময় নন্দ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে কলিঙ্গ রাজ্য স্বাধীন হয়ে যায় এবং কালক্রমে সচ্ছল ও শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়। মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমান্তে কলিঙ্গরাজ্যের অবস্থান সেই রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে বিবেচনা করে অশোক সেই রাজ্য আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। আবার ড. ভাণ্ডারকরের মতে, বিন্দুসারের সঙ্গে চোলগণের যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে কলিঙ্গ চোল পক্ষে যোগ দিয়েছিল। ফলে বিন্দুসার ঐ যুদ্ধ জয়ে অকৃতকার্য হন। এরপর অশোক ঐ সিংহাসনে বসে পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার মানসে কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। অশোকের কলিঙ্গ জয়ের পিছনে অর্থনৈতিক কারণ প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে কোশাম্বি, রোমিলা থাপার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মনে করে থাকেন। তাঁদের এইরূপ ধারণার প্রধান ভিত্তি তিব্বতীয় বিবরণ। রোমিলা থাপারের মতে, দক্ষিণ-ভারতের সঙ্গে যোগাযোগকারী স্থল ও জলপথগুলি ছিল কলিঙ্গের নিয়ন্ত্রণে। এগুলিকে নিজ নিয়ন্ত্রণে এনে মগধের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা করাই ছিল অশোকের কলিঙ্গজয়ের প্রধান উদ্দেশ্য।

ড. রায়চৌধুরীর মতে, কলিঙ্গযুদ্ধ মগধ তথা ভারতের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। (The conquest of Kalinga was a great land-mark in the history of Magadha and of India)। বিম্বিসার কর্তৃক অঙ্গরাজ্য জয়ের মাধ্যমে যে মগধ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ঘটেছিল, কলিঙ্গজয়ের মাধ্যমে তা পূর্ণতা পেয়েছিল। অতঃপর কোন মৌর্যসম্রাট রাজ্যজয়ে উদ্যোগী হননি। ত্রয়োদশ শিলালিপি থেকে কলিঙ্গযুদ্ধের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। ঐ লেখ অনুযায়ী কলিঙ্গ যুদ্ধে দেড় লক্ষ মানুষ বন্দী হয়, এক লক্ষ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয় এবং অনেক বেশি লোক বিভিন্নভাবে প্রাণ দেয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে প্লিনি কলিঙ্গের যে পরিমাণ সেনার উল্লেখ করেছেন, আলোচ্য যুদ্ধে আহত ও নিহত সেনার সংখ্যা তার অনেক বেশি ছিল। সম্ভবত মধ্যবর্তী সময়ে কলিঙ্গ তার লোকবল বৃদ্ধি করেছিল। আবার ড. ভাণ্ডারকর মনে করেন, এই যুদ্ধে চোল ও পাণ্ড্যগণও কলিঙ্গের পক্ষে যোগদান করায় হতাহতের সংখ্যা এরূপ বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাইহোক্, যুদ্ধে কলিঙ্গ সেনা সম্পূর্ণ পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে কলিঙ্গ একটি প্রদেশ হিসেবে গণ্য হতে থাকে, যার রাজধানী হয় তোযালী।

ব্যক্তি-অশোকের উপর কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ত্রয়োদশ শিলালেখর বক্তব্য থেকে এ তথ্য পরিস্ফুট হয়। এখানে বলা হয়েছে—কলিঙ্গ রাজ্য বিজিত হবার পর রাজার মনে শোক ও সন্তাপ জাগ্রত হয়। একটি অবিজিত দেশ বিজিত হবার সময় সে বন্দীকরণ, হত্যা ও মৃত্যু অনুষ্ঠিত হয়, তা তাঁকে গুরুতরভাবে আহত করে। সর্বত্রই ব্রাহ্মণ, শ্রমণ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসীগণ এবং গৃহস্থগণ বাস করেন। এঁদের মধ্যে মানবিক গুণসম্পন্ন (পিতামাতার প্রতি ভক্তি, মিত্র পরিচিত, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি সদয় আচরণ) বহু ব্যক্তিও থাকেন যুদ্ধজনিত কারণে যাঁদের স্বজনবিয়োগ, নির্বাসন ইত্যাদি আঘাত সহ্য করতে হয়। সকলের এই দুর্ভাগ্য রাজা গুরুতরভাবে অনুভব করেছিলেন। সুতরাং আহত, নিহত, মৃত ও বন্দীকৃত মানুষের সংখ্যা যাইহোক্ না কেন তার শত বা সহস্রভাগের একভাগ মানুষও যদি অনুরূপ দুঃখ ভোগ করে তবে রাজা মর্মাহত হবেন। লেখটিতে আরো বলা হয়েছে যে, কলিঙ্গ রাজ্য বিজিত হবার পর ধর্মের অনুশীলন, ধর্মপ্রাণতা ও ধর্মাচরণের নীতি রাজার দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। অর্থাৎ কলিঙ্গ যুদ্ধের বীভৎসতা অশোকের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল ও অনুতপ্ত অশান্তহৃদয় রাজাকে ধর্মানুশীলনের পথে প্রবৃত্ত করেছিল। তাঁকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমাশীল ও মানবদরদী করে তুলেছিল। মানসিক শান্তিলাভের আশায় তিনি বুদ্ধের অহিংসা ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের রাষ্ট্রনীতির উপরেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। অতঃপর তিনি রাজনীতি হিসেবে যে তত্ত্ব প্রচার ও অনুসরণ করেন, তা এককথায় অভিনব। এই পরিবর্তিত নীতির প্রধান অঙ্গ হিসেবে তিনি জনগণের কাছে রাজার ঋণ স্বীকার করেন ও সুষ্ঠুভাবে রাজকর্তব্য পালনের মাধ্যমে সেই ঋণ পরিশোধের প্রচেষ্টায় রত হন। যুদ্ধ দ্বারা রাজ্যজয়ের নীতি পরিত্যক্ত হয়। পরহিত ও ধর্মানুশীলনের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করার নীতি গৃহীত হয়। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই পরিবর্তিত নীতির মধ্যেই অশোকের মহত্ত্ব নিহিত আছে। এ. কে. মজুমদারও এই কারণে কলিঙ্গ যুদ্ধকে ভারতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন বলে মন্তব্য করেছেন। কলিঙ্গ যুদ্ধ পরবর্তী পরিবর্তিত রাষ্ট্রনীতি অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। অহিংস বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের ফলে অশোকের ব্যক্তিগত অভ্যাস বা রাজকীয় প্রথাগুলিও নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। বিহারযাত্র (প্রমোদ ভ্রমণ) পরিবর্তিত হয়েছিল ধর্মযাত্রায়। দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি নিষিদ্ধ হয়েছিল। আগে রাজকীয় রন্ধনশালায় যে বিপুল পরিমাণ প্রাণিহত্যা করা হত, তাও একেবারে কমিয়ে আনা হয়েছিল। ভেরীঘোষ (যুদ্ধের দামামা) পরিবর্তিত হয়েছিল ধর্মঘোষে। অশোক অনুভব করেছিলেন যে, রাজার প্রধান কর্তব্য প্রজাদের ও জীবকুলের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলসাধন করা। ইহলৌকিক মঙ্গলসাধনের জন্য তিনি ব্যাপক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। কূপখনন, বৃক্ষরোপণ, মানুষ ও পশুদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন, জীবহত্যা নিষিদ্ধকরণ, বন্দীদের মুক্তিদান, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তিনদিনের অবসরদান ইত্যাদি ছিল এই কর্মসূচীর অন্তর্গত। শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রেও তিনি বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। রাজুক, যু প্রমুখ কর্মচারীদের পাঁচ বৎসর অন্তর রাজ্য পরিক্রমায় বের হতে নির্দেশ দেন। প্রজাদের কোনরকম অনিষ্ট হচ্ছে কিনা, তা জানার জন্য ‘প্রতিবেদক’ নামক বার্তাবহ নিযুক্ত করেন। প্রজাদের পারলৌকিক উন্নতিবিধানের দায়িত্বও তিনি গ্রহণ করেন। তাদের ধর্মানুসরণের প্রতি নজর রাখার জন্য ‘ধর্মমহামাত্র’ নামক কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। প্রচলিত উৎসব অনুষ্ঠানের পরিবর্তে এমনসব উৎসবের আয়োজন করেন, যা সাধারণের মনে ধর্মভাবনা জাগ্রত করে। অশোক শিলালিপি ও স্তম্ভলিপিতে ধর্মের বাণী খোদাই করান। বৌদ্ধ ছাড়াও ব্রাক্ষ্মণ, আজীবিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণের ব্যবস্থা করেন। এইভাবে নিজের কাজের মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রচারিত ‘সকল মানুষই আমার সন্তান’ (সব মুনিষে পজা মমা) এই বাণীকে মূর্ত করে তোলেন।

পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে, অশোক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নীতি সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন। যুদ্ধের বীভৎসতা তাঁকে এতদূর কাতর করে যে—তিনি ঘোষণা করেন, তাঁর পুত্র বা প্রপৌত্ররাও কেউ যেন আর যুদ্ধনীতি গ্রহণ না করে। যুদ্ধনীতি যে তিনি সত্যসত্যই ত্যাগ করেছিলেন, তার প্রমাণ সীমান্তবর্তী চোল, পাণ্ড্য প্রভৃতি রাজ্যগুলিকে জয় করার কোন উদ্যোগ তিনি নেননি। এমনকি তিনি ঐ রাজ্যগুলিকে এই আশ্বাসও দেন যে এখন থেকে তিনি তাদের দুঃখের কারণ হবেন না। এইভাবে দিগ্বিজয় নীতি ত্যাগ করে তিনি ধর্মবিজয়ের নীতি গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর পরিবর্তে তিনি নানা দেশে প্রেরণ করেন ধর্মপ্রচারকদের। তাঁরা নানা দেশে ছড়িয়ে দেন অশোকের অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী।

অশোকের জীবন ও নীতিতে কলিঙ্গ যুদ্ধের উপরিলিখিত প্রভাবকে কেউ কেউ অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। রোমিলা থাপারের মতে, অশোককে যতখানি শান্তিবাদী শাসক বলে মনে করা হয় তিনি তা ছিলেন না। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা যদি সত্যিই তাঁর মানসিক পরিবর্তন সাধন করত তবে তিনি কলিঙ্গের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। যুদ্ধনীতি ত্যাগ করলেও যুদ্ধবর্জনের শর্ত হিসেবে সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেননি বা সংখ্যা হ্রাস করেননি। তাই রোমিলা থাপার অশোকের যুদ্ধনীতি ত্যাগের অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, মৌর্য সাম্রাজ্যের সংহতিসাধনের যে দায়িত্ব সম্রাট হিসেবে অশোকের ছিল, তা কলিঙ্গ জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সম্পূর্ণ হয়ে যায় ও এইজন্যই অপ্রয়োজনীয় জ্ঞানে তিনি যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ করেন। রামশরণ শর্মার মতেও, কেবলমাত্র কলিঙ্গ যুদ্ধের বীভৎসতাই অশোককে অহিংসা ও শান্তির পূজারী করে গড়ে তোলেনি। বরং শান্তিনীতির দ্বারা মৌর্য সাম্রাজ্যকে সুসংহত রাখা সম্ভব হবে—এই চিন্তাই তাঁকে শান্তিবাদী করে তুলেছিল। ঐতিহাসিক দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী (D. D. Kosambi) তাঁর ‘এ্যান ইনট্রোডাকসন টু দ্য স্টাডি অফ ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রি’ শীর্ষক গ্রন্থে অশোকের কলিঙ্গনীতির বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দুটি দিক থেকে তিনি অশোকের নীতির বাস্তবতা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথমত, অশোক এই সত্য অনুধাবন করেছিলেন যে, সমাজ ও অর্থনীতির বস্তুগত ভিত্তির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বৈদিক যুগের পশুচারণভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমশ পিছু হটে কৃষি-উৎপাদন ভিত্তিক দৃঢ় ও অগ্রণী অর্থনীতিকে স্থান করে দিচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বাণিজ্যিক লেনদেনের উৎসাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে পারস্পরিক নির্ভরশীল অর্থনীতির সূচনা করেছে। এই পরিবর্তিত অবস্থায় যুদ্ধ নয়, শান্তিই ছিল আর্থিক স্থিতি ও সামাজিক সচলতার প্রধান শর্ত। তাই বিশাল সেনাবাহিনী পোষণ তাঁর কাছে অবান্তর প্রতিভাত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, অশোক বুঝতে পেরেছিলেন যে, গাঙ্গেয় পূর্ব-ভারতের অর্থব্যবস্থা দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে দীর্ঘকাল তাল রাখতে পারবে না। গাঙ্গেয় অঞ্চলের ঘনবসতি কৃষিক্ষেত্রকে দ্রুত সংকুচিত করছিল। উৎপাদনেও ঘাটতি বাড়ছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ-ভারতে ঘনবসতি না-থাকায় কৃষিক্ষেত্র সম্প্রসারিত ছিল। উর্বরতাও কম ছিল না। সর্বোপরি, অন্ধ্ৰ ও মহীশূরে নতুন লৌহখনির আবিষ্কার ঐ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে নবজীবন দিয়েছিল। তামিল অঞ্চল ছাড়া দক্ষিণ-ভারত তাঁর দখলে থাকায় দূরদর্শী অশোক অতঃপর সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে সংহতি-সাধনের কাজে লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন। এখানেই অশোকের অনন্যতা। রুশ ঐতিহাসিক বনগার্ড লেভিন অশোকের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, এক্ষেত্রেও অশোক বাস্তব বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হন। কূটনৈতিক জ্ঞানের দ্বারা তিনি অনধিকৃত রাজ্যগুলিতে নিজ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। ঐ সব দেশকে তাঁর জনকল্যাণকামী কর্মসূচীর আওতায় এনে, ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করে ও সহৃদয় আচরণ করে তিনি নিজ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। অর্থাৎ একমাত্র ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই অশোক তাঁর জনকল্যাণকামী আদর্শকে সার্থকভাবে রূপায়িত করেন। যাইহোক্, উপরিলিখিত যুক্তিগুলি স্বীকার করে নিলেও একথা সত্য যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের একটা বিরাট প্রভাব অশোকের জীবনে পড়েছিল এবং তাঁর মানসিক পরিবর্তনকে নিশ্চিত করেছিল।

অশোক কলিঙ্গজয়ের দ্বারা সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির পরিসমাপ্তি ঘটান। তাঁর পরবর্তী কোন মৌর্যরাজাও সাম্রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হননি। তাই সেই ষোড়শ মহাজনপদের যুগ থেকে মগধকে কেন্দ্র করে যে বিস্তার নীতির সূচনা হয়েছিল অশোকের রাজত্বকালেই তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এই কারণে অশোকের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি নির্ধারণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্ট। অশোকের কোন লেখ থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না, যদিও চতুর্দশ লেখতে তিনি স্বীকার করেছেন যে তাঁর সাম্রাজ্য সুবিস্তৃত। অশোকের সাম্রাজ্য নির্ধারণের সহজতর উপায় হল চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের সাথে কলিঙ্গ রাজ্যটিকে যুক্ত করা। কারণ অশোক কলিঙ্গ ছাড়া কোন রাজ্য জয় করেননি। তবে স্বাধীনভাবেও তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি নির্ধারণ করা যায় ও এজন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলির সাহায্য গ্রহণ করা হয়। যথা— (১) অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলেখগুলির ভৌগোলিক অবস্থান, (২) তৎকালীন স্থাপত্য নিদর্শনসমূহ, (৩) ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শিলালেখর বিবরণ, (৪) কল্ল্গুণের রাজতরঙ্গিনী ও হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ প্রভৃতি।

অশোকের শিলালিপিগুলি সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই ছড়িয়ে ছিল। তাই ঐ লেখগুলির প্রাপ্তিস্থান থেকে তাঁর সাম্রাজ্য উত্তরে, উত্তর-পশ্চিমে, উত্তর-পূর্বে, পশ্চিমে ও দক্ষিণে কতখানি বিস্তৃত ছিল তা নিরূপণ করা যায়। উত্তরে হরিয়ানা রাজ্যের আম্বালা জেলা পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তার প্রমাণ তোপরায় প্রাপ্ত স্তম্ভলেখ। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ ও রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীর তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কারণ রাজতরঙ্গিনীতে অশোককে ‘কাশ্মীরের রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তর-পূর্বে তরাই অঞ্চল পর্যন্ত অর্থাৎ নেপাল পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি জানা যায় নিগালীসাগর ও রুমিনদেই স্তম্ভলিপি থেকে। হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত অঞ্চল যে অশোকের অধীনস্থ ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে বর্তমান দেরাদুন জেলার অন্তর্গত কালসীতে প্রাপ্ত অশোকের একটি শিলালিপি থেকে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে আফগানিস্তানের জালালাবাদে ও তক্ষশীলায়। গ্রীক সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, মৌর্য সাম্রাজ্য হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উল্লেখিত লেখ দুটি এই সত্যকে প্রমাণ করে। অশোকের সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পূর্বে অন্তত ধৌলী ও জৌগড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কারণ ঐ দুই স্থানে তাঁর দুটি লেখ পাওয়া গেছে। ঐ স্থানসহ সমগ্র কলিঙ্গই যে তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কারণ ত্রয়োদশ লেখ থেকে তাঁর কলিঙ্গ জয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। পূর্বে বিহার তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। সম্ভবত তারও পূর্বে বাংলাতেও তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। বাংলায় তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কিত তথ্যের জন্য আমাদের মূলত হিউয়েন সাঙের বিবরণের উপর নির্ভর করতে হয়। হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ ও মেদিনীপুর জেলার তাম্রলিপ্ততে অশোক নির্মিত কয়েকটি স্তূপ দেখেছিলেন। যদিও ঐ দুই অঞ্চলে কোন স্তূপ এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। অনেক ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় লিপিকে অশোকের সময়কালীন বলে মনে করেন। তা যদি হয় তবে বঙ্গের কিছু স্থান অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। তাছাড়া সাম্প্রতিক কালে ২৪-পরগণা জেলার চন্দ্রকেতুগড়ে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত মৌর্যযুগের কিছু নিদর্শনও বঙ্গদেশে মৌর্য আধিপত্যের সাক্ষ্য বহন করে। পশ্চিমে তাঁর সাম্রাজ্য আরবসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গুজরাট ও মহারাষ্ট্র তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। কারণ গুজরাটের জুনাগড়ে ও মহারাষ্ট্রের থানা জেলার সোপারায় তাঁর শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাছাড়া শকক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখতেও মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সৌরাষ্ট্র প্রদেশের শাসনকর্তা তুসাম্ফের নাম পাওয়া যায়। মহীশূরের মাসকী শিলালিপি ও মাদ্রাজের এড়াগুণ্ডি নামক স্থানে আবিষ্কৃত শিলালিপি অশোকের দক্ষিণে রাজ্যসীমা নির্ধারণে সাহায্য করে। তাছাড়া দ্বিতীয় ও ত্রয়োদশ লিপিতে উল্লেখিত ‘প্রাপ্ত’ রাজ্যগুলির অবস্থান থেকেও বোঝা যায় যে, অশোকের রাজ্যসীমা দক্ষিণে পেন্নার নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

অশোকের উৎকীর্ণ দ্বিতীয়, পঞ্চম ও ত্রয়োদশ শিলালিপি থেকে তাঁর সাম্রাজ্যসীমা জানা যায়। এগুলিতে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কয়েকটি জাতির নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন—যবন, কম্বোজ, গান্ধার, ভোজ, রাষ্ট্রিক, অন্ধ্র প্রভৃতি। যবন বলতে সম্ভবত গ্রীকদের বোঝানো হয়েছে। এরা ছিল বর্তমান কান্দাহারের অধিবাসী। কম্বোজগণ ছিল কাশ্মীর-এর নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিবাসী। গান্ধারদের বাসস্থান ছিল তক্ষশিলার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। ভোজ ও রাষ্ট্রিকগণ ছিল মহারাষ্ট্র অঞ্চলের অধিবাসী। ত্রয়োদশ লেখর একটি অনুচ্ছেদের ভুল ব্যাখ্যার জন্য এদের দীর্ঘদিন অশোকের অধীন সামন্ত নৃপতি মনে করা হত। কিন্তু গিরণার-এ প্রাপ্ত এই লেখর একটি হৃত অংশের পুনরুদ্ধারের ফলে এই ধারণা পরিত্যক্ত হয়েছে। এখন এদেরকে ‘অশোকের সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী প্রজা’ বলে মনে করা হয়। র‍্যাপসনের মতে, এই জাতিগুলি অশোকের প্রজা ছিল না, তবে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিল। কিন্তু ভাণ্ডারকরের মতে, এরা অশোকের অধীনস্থ প্রজা ছিল। এই পরস্পরবিরোধী মতের সমন্বয়সাধন করে ড. এইচ. সি. রায়চৌধুরী বলেছেন যে, এরা অশোকের প্রজাই ছিল, তবে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। দ্বিতীয় ও ত্রয়োদশ লেখতে অশোক কয়েকটি প্রান্ত রাজ্যের নাম উল্লেখ করেছেন। এগুলি ছিল তাঁর সাম্রাজ্যসীমার পার্শ্বস্থিত স্বাধীন রাজ্যসমূহ। যেমন— চোল, পাণ্ডা, কেরলপুত্র, সত্যপুত্র প্রভৃতি। চোলরাজ্য ছিল দুটি। একটি ছিল ত্রিচিনপল্লীর নিকটে এবং অপরটি ছিল বর্তমান আর্কটে। পাণ্ড্যরাজ্যও দুটি ছিল বলে ধারণা, এগুলি ছিল যথাক্রমে মাদুরাই ও মহীশূর অঞ্চলে বিস্তৃত। কেরলপুত্রের বসবাস ছিল সম্ভবত দক্ষিণ কানাড়া, কুর্গ, মালাবার অঞ্চলে এবং সত্যপুত্রদের বসবাস ছিল উত্তর ত্রিবাঙ্কুর অঞ্চলে। এগুলি সবই ছিল ভারতীয় রাজ্য। একটি অ-ভারতীয় সীমান্ত রাষ্ট্রের উল্লেখ অশোকের লেখ থেকে জানা যায়। সেটি হল সিরিয়া। সম্ভবত অশোকের রাজ্য উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এরপরেই ছিল সিরিয়া রাজ্য।

উপরিলিখিত তথ্যপ্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় যে, অশোকের সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে মহীশূর পর্যন্ত এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র ও উত্তর পশ্চিমে পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্রের ভাষায় : “A single-writ of the Emperor ran from Peshwar to Bengal, and from Kashmir to Mysore which never happened in ancient India.” তাই বলা চলে, অশোক তাঁর পঞ্চম ও ত্রয়োদশ শিলালেখতে নিজ সাম্রাজ্যকে যথাক্রমে ‘সমগ্র পৃথিবী’ ও ‘বৃহৎ’ বলে দাবি করেছেন, তা যথার্থ।

সম্রাট অশোকের ধম্ম (ধর্ম) নীতি :

বিশ্বের ইতিহাসে অশোকই প্রথম শাসক যিনি রাজতন্ত্রের অন্যতম আদর্শ হিসেবে ‘পিতৃতান্ত্রিকতা’কে গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিলেন। রাজা ও প্রজাসাধারণের সম্পর্ককে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে অশোক কর্তব্য, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও দায়বদ্ধতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তাঁর ধৰ্ম্মনীতির মধ্যে সেই উদারতা ও সহনশীলতার নতুনতর প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। অশোকের ধৰ্ম্মনীতি সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এগুলি হল, তিনি একান্তভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন কিনা, কোন্ পরিস্থিতিতে বা কেন তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুগামী হয়েছিলেন, অশোক প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’-এর প্রকৃতি কি এবং বৌদ্ধধর্ম এবং অশোক প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’ অভিন্ন ছিল কিনা।

অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ ভাবনা ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের মুখ্য উপাদান হল অশোক প্রচারিত একাধিক লেখ। ধর্ম বিষয়ক আলোচনা সমৃদ্ধ অশোকের দুই ধরনের শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলাখণ্ডের ওপর খোদাই করা এক ধরনের লিপি রাজ্যের নানা অংশে পাওয়া গেছে, যেগুলিতে বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও বৌদ্ধসংঘ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এগুলিতে বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি এমন কথাও লিখেছেন, যেগুলি আপাতভাবে অন্যান্য ধর্মদর্শনের প্রতি সম্রাটের অসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে হতে পারে। যেমন, তিনি লিখেছেন ভিন্ন মতাবলম্বী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের মঠ থেকে বহিষ্কার করা হবে। অন্যত্র লিখেছেন যে, তালিকাভূক্ত বৌদ্ধশাস্ত্রগুলি সম্পর্কে প্রতিটি ধার্মিক বৌদ্ধের জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। দ্বিতীয় ধরনের শিলালিপিতে তিনি ‘ধৰ্ম্ম’ (Dhamma) সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা প্রচার করেছেন। এর বক্তব্য তথাকথিত ধর্ম বা Religion থেকে স্বতন্ত্র। এই ধরনের শিলালিপির সংখ্যা বেশী এবং এদের অধিকাংশই পর্বত গ্রাত্রে খোদাই করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষভাবে নির্মিত স্তম্ভের ওপর উৎকীর্ণ করা কিছু লেখ রাজ্যের ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলিতে প্রোথিত করা হয়েছিল। এগুলিতে তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যাতে ধম্মের মর্মার্থ সহজেই জনগণ অনুধাবন করতে সক্ষম হন।

বৌদ্ধধর্মের প্রতি অশোকের আস্থা এবং বৌদ্ধসংঘের সেবায় তাঁর আন্তরিকতা সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ নেই। প্রথম গৌণ গিরিশাসনে তিনি নিজেকে গৃহীবৌদ্ধ বা উাসক বলে পরিচয় দিয়েছেন। মাস্কি লেখতে স্পষ্টভাবে তাঁকে বৌদ্ধ উপাসক (বুদ্বুপাসক) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় গৌণ গিরিশাসনে অশোক বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা ও আস্থা ঘোষণা করেছেন। রুম্মিনদেই লেখ থেকে জানা যায় যে, রাজত্বের দশম বর্ষে তিনি বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি পরিদর্শন করে পুণ্য সঞ্চয় করেন। বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী গ্রাম, তাঁর বোধিলাভের ক্ষেত্র বোধগয়া (সম্বোধি) অশোক পরিদর্শন করেন। রাজত্বের চতুর্দশ বৎসর অন্তে তিনি গৌতম বুদ্ধের পূর্বসূরী বুদ্ধ কনকমুনির স্মৃতি বিজড়িত স্তূপটির সংস্কার করেন। প্রথম গৌণ গিরিশাসন থেকে জানা যায় যে, রাজ্যাভিষেকের দশমবর্ষ অতিক্রান্ত হবার পর তিনি ‘ধর্মযাত্রা’য় অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রায় আট মাসেরও অধিককাল পরিভ্রমণ করেছিলেন। সাঁচি ও সারনাথে তাঁর দুটি গৌণ স্তম্ভ অনুশাসনে বৌদ্ধসংঘের অনৈক্য রোধের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধসংঘে মতান্তর দূর করার জন্য অশোকের রাজত্বকালেই ‘বৌদ্ধ সংগীতির’ (সম্মেলন) তৃতীয় অধিবেশন আহূত হয়েছিল। সুতরাং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ এবং বৌদ্ধ সংঘের সংরক্ষণের কাজে অশোকের ঘনিষ্ট যোগ সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পাশাপাশি অশোক তাঁর অসংখ্য গিরিশাসনে ‘ধৰ্ম্ম’ সম্পর্কে নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। যা ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ‘ধৰ্ম্ম’ সংক্রান্ত তাঁর অনুশাসনগুলির বক্তব্য সাধারণভাবে বৌদ্ধ ধর্মতত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অবশ্য প্রত্যক্ষত বিরোধীও নয়। চারটি ‘আর্যসত্য’ সম্পর্কে কোন কথা ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত অনুশাসনে নেই। ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ সম্পর্কের এগুলি নীরব। এমন কি বৌদ্ধ ধর্মানুসরণের চরম লক্ষ্য ‘নির্বাণ’ অর্জন সম্পর্কেও অশোক একটি বাক্য ব্যয় করেন নি। তাহলে অশোক প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’ কি এবং এর লক্ষ্যই বা কি। ‘ধৰ্ম্ম’ শব্দটি হল সংস্কৃত ভাষার ‘ধর্ম’ (Religion) শব্দের প্রাকৃত অপভ্রংশ রূপ। সেক্ষেত্রে ‘ধৰ্ম্ম’ ও বৌদ্ধধর্ম অভিন্ন হতে পারত। কিন্তু স্বয়ং সম্রাটের লেখগুলির বক্তব্যে এমন কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অশোক গ্রীক ও আরামীয় ভাষায় কিছু অনুশাসন উৎকীর্ণ করেছেন। আরামীয় ভাষায় ‘ধৰ্ম্ম’ এর অর্থ হল সার্বজনিক নিয়ম, জাগতিক রীতি ইত্যাদি। আবার গ্রীক শব্দে ‘ধৰ্ম্ম’ হল ন্যায় ও সত্যের পথ। তবে অশোকের অনুশাসনে ‘ধৰ্ম্ম’ শব্দটি আরও ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, আরামীয় ও গ্রীক্‌ লেখগুলির বিচারে অশোক প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’কে বৌদ্ধ ধর্ম অর্থে গ্রহণ করা যায় না।

সাধারণ কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত ধার্মিকতার তুলনায় অশোকের ধৰ্ম্ম-এর ব্যঞ্জনা অনেক বেশী। ধম্মের নীতিগুলি যে-কোন ধর্মগোষ্ঠীর কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল। এর বক্তব্যে কোন বিশেষ ধর্মমতকে সমর্থন বা অন্যান্য ধর্মতত্ত্বকে খণ্ডন করার প্রয়াস নেই। কোন নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠান বা নিয়মরীতি অশোক স্থির করে দেননি। রোমিলা থাপারের মতে, এই অস্পষ্টা ইচ্ছাকৃত। অশোকের ধৰ্ম্ম ছিল কিছু নৈতিক বিধি, যার উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা জাগ্রত করা। অশোক সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন সহিষ্ণুতার আদর্শ অনুশীলনকে। এই সহিষ্ণুতা ছিল দু’ধরনের – মানুষকে সহ্য করা এবং মানুষের বিশ্বাসকে সহ্য করা। পিতামাতা ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা – ক্রীতদাস ও ভৃত্যদের প্রতি সদয় ব্যবহার, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত জন, আত্মীয়স্বজন, ব্রাহ্মণ জ্ঞাপন, ও শ্রমণদের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সপ্তম স্তম্ভ অনুশাসনে। এই সকল কর্তব্য পালনের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজজীবনে শান্তি, সহাবস্থান ও সংহতি সুনিশ্চিত করা ছিল অশোকের অন্যতম লক্ষ্য। অশোক তাঁর ত্রয়োদশ রাজ্যবর্ষে বরাবর পাহাড়ে (গয়া জেলা) আজীবিক সম্প্রদায়কে দুটি গুহাবাস দান করে তাঁর ধর্ম সহিষ্ণুতা ও সমদৃষ্টির আদর্শ স্থাপন করেছেন। ‘ধৰ্ম্ম’ অনুশীলনের অংশ হিসেবে তিনি বলেছেন যে, ঈশ্বরের প্রিয় পাত্ররা সকল গোষ্ঠির সমান উন্নতির চেয়ে যেন নিজের সম্মান বৃদ্ধিকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। নিজ গোষ্ঠীর অধিক প্রশংসা এবং অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন বাঞ্ছনীয় নয়। এক গোষ্ঠী কর্তৃক অন্য গোষ্ঠীকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে অশোক উভয় গোষ্ঠীর মঙ্গল বিধানের পরামর্শ দিয়েছেন। অশোক বিশ্বাস করতেন যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ না দিলে সামাজিক সংঘাত তীব্রতর হতে পারে। তবে সহিয়ুতার ওপর জোর দিলেও অশোক উৎসবাদি উপলক্ষ্যে জন সমাবেশ ও সভার আয়োজন নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে সৃষ্ট। সম্রাটের আশঙ্কা ছিল যে এই ধরনের সমাবেশ থেকে রাষ্ট্রনীতি ও রাজার কর্মধারা সম্পর্কে বিরোধী মত ও গোষ্ঠী শক্তি সঞ্চয়ের সম্ভাবনা ছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে অশোক ধর্ম্মের সহিদ্ৰুতা নীতিকে সংকুচিত করেছিলেন। ডি. এন. ঝা’র মতে, মৌর্যদের কঠোর কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার সাথে এই সিদ্ধান্ত সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

বৈদিক ধর্মের গভীর দার্শনিক তত্ত্ব অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ কথায় অনুপস্থিত। এমনকি বৌদ্ধধর্মের আসক্তি এবং নির্বাণ-জাতীয় সুক্ষ্ম জীবনতত্ত্বেও অশোকের আগ্রহ ছিল না। তাঁর ধৰ্ম্ম ছিল সরল ও ব্যবহারিক। তাই ধৰ্ম্ম অনুশীলনের কাজে তিনি কয়েকটি সদভ্যাস চর্চা করতে পরামর্শ দিয়েছেন। দ্বিতীয় ও সপ্তম অনুশাসনে এই গুণাবলীর উল্লেখ আছে। এগুলি হল—দয়া, দান ও সত্যনিষ্ঠা (সচে), শুচিতা (শোচয়ে), ভদ্র ব্যবহার (মাধবে), বহু সৎকর্ম করা (বহুকয়ানে), পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা (অপঅশিনবে) ইত্যাদি। পাপকর্মের প্রবণতা এবং চারিত্রিক কলুষতার সৃষ্টিকারী কয়েকটি অশুভ আবেগ বর্জন করার বিষয়ে তিনি তৃতীয় স্তম্ভলেখতে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। এগুলি হল, হিংস্রতা (চণ্ডিয়ে), নিষ্ঠুরতা (নিধুলিয়ে), ক্রোধ (কোধে), অতিরিক্ত অহংবোধ (মানে) এবং ঈর্ষা (ইস্যা)। অন্যদিকে অশোক জোর দিয়েছেন আত্মসংযম (সয়মে), শুদ্ধ মানসিকতা (ভাবসুধি) এবং কৃতজ্ঞতার (কিটনতা) ওপর। অত্যন্ত সরলভাবে অশোক তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ গ্রহণকারীদের কর্তব্যকর্ম স্থির করে দিয়েছেন। যেমন—প্রাণীহত্যা না করা (অনারম্ভ প্রামানাম), জীবিত প্রাণীকে পীড়ন না করা (অভিহিশ ভূতানাম), পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা (পিতার মাতরি শুশ্রুষা), বয়স্ক ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করা (থৈর শুশ্রুষা), গুরুকে শদ্ধা করা (গুরুনাম অপচিতি), অল্প ব্যয়, অল্প সঞ্চয় করা (অপব্যয়তা, অপভাণ্ডতা), ভৃত্য ও দাসের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা ইত্যাদি।

অশোকের ধৰ্ম্মনীতিতে অহিংসার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে তিনি হিংসাশ্রয়ী যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ করে ‘ধৰ্ম্ম বিজয়’ নীতি অনুসরণের অঙ্গীকার করেন। ‘ভেরীঘোষ’ অর্থাৎ রনদামামার পরিবর্তে ‘ধৰ্ম্মঘোষ’ অর্থাৎ ধর্মের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে তাঁর উত্তরাধিকারগণও হিংসা দ্বারা রাজ্য বিজয়ের কাছে লিপ্ত হবেন না। তবে রাজ্য রক্ষার প্রয়োজনে কখনো কখনো যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধি থেকে অশোকের উপদেশ যে তেমন ক্ষেত্রে শত্রুর সাথে ব্যবহারের সময় যেন করুণা ও ক্ষমার মনোভাব সক্রিয় থাকে। অহিংস নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি অনুশাসন জারী করে প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করে দেন। রাজকীয় রন্ধনশালায় পশুহত্যার বিষয়টিও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। অনুশাসন জারী করে বলা হয় যে, রন্ধনশালায় প্রতিদিন কেবল দুটি ময়ুর ও একটি হরিণ বধ করা যাবে। ভবিষ্যতে এটুকু প্রাণী হত্যাও বন্ধ করার পূর্ব সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। কিছুকাল পরে অবধ্য পশু-পক্ষীর একটি তালিকাও তৈরি করা হবে বলে জানানো হয়। পঞ্চম স্তম্ভ অনুশাসনে অশোক ঘোষণা করেন এক প্রাণীর আহার্য আর এক প্রাণী হতে পারে না (‘জীবেন জীবে নো পুসিত বিয়ে’)।

ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠানের অংশভূক্ত কিছু কাজকে (সমাজ) অশোক পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, এগুলি ধৰ্ম্ম সম্মত নয়, কুসংস্কার মাত্র। অসুস্থতা থেকে মুক্তি, পুত্র-কন্যার বিবাহ, সন্তানের জন্ম, কিংবা ভ্রমণকালে নানা ধরনের স্থূল ও আপত্তিজনক অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। নবম গিরিশাসনে অশোক এগুলির নিন্দা করেন এবং এর পরিবর্তে নৈতিক আচরণের (ধম্মমঙ্গল) পরামর্শ দেন। অর্থহীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তিনি চতুর্থ স্তম্ভ লেখতে মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অলৌকিক দৃশ্যাদি পরিদর্শনের উপদেশ দেন। যজ্ঞে পশু বলিদান এবং পুরোহিত শ্রেণীর ধর্মীয় একাধিপত্যের বিরুদ্ধেও অশোক সোচ্চার ছিলেন। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘ধৰ্ম্মপাদ’-এর প্রায় অনুরূপ ভাষ্য দ্বারা অশোক বলেছিলেন যে, ‘আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির উন্মোচন জরুরী’। ধম্মের অনুশীলন দ্বারাই তা অর্জন করা সম্ভব বলে অশোক প্রত্যয়ী ছিলেন। প্রজাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল সাধনকে তিনি শাসকের কর্তব্য বলেই মনে করতেন। প্রজা সাধারণকে সন্তানসম’ (‘সবে মুনিসে পজা মম’) রূপে গ্রহণ করার মধ্যে অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ চেতনার প্রকাশ খুঁজে পাওয়া যায়। পরিবারের প্রধান হিসেবেই তিনি ধৰ্ম্ম নীতিকে সর্বজনীন করে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করারও অঙ্গীকার করেন। ধৰ্ম্ম নীতিকে কার্যকর করার জন্য অশোক ধর্মমহামাত্র (পালিতে ধর্মমহামাও) নামক একশ্রেণীর নতুন রাজকর্মচারীর পদ সৃষ্টি করেন। কেবল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে নয়, সীমান্ত পরবর্তী প্রতিবেশী রাজ্যের মানুষের কাছেও ধৰ্ম্ম’র বাণী প্রচার করার কাজে এরা লিপ্ত থাকতেন। বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, আজীবক ও নির্গ্রন্থদের প্রতিও এঁরা শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার করতেন। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ, রাজ পরিবারের সদস্য, এমনকি কারাগারে বন্দীদেরও ধম্মতত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত করার কাজে ধর্মমহামাত্ররা দায়িত্ববদ্ধ ছিলেন। সম্রাট স্বয়ং ‘ধর্মযাত্রার’ মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে আপামর জনসাধারণকে ‘ধৰ্ম্ম’ বিষয়ে আগ্রহী করতে চেষ্টা করতেন। এমন কি উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করে সম্রাটের ধৰ্ম্মনীতি বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে উদ্যোগী হতেন।

কান্দাহারে প্রাপ্ত অশোকের গ্রীক অনুশাসন ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অশোকের ধর্ম্মের এক নতুনতর রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রকাশ করেছেন। গ্রীক অনুশাসনে অশোক ‘ধর্ম্ম’র (ইউসেবিয়া) অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে ‘রাজার স্বার্থের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য প্রকাশের কথা বলেছেন। ‘ধৰ্ম্ম’ অনুশীলনের শর্ত হিসেবে ‘রাজানুগত্যা’-এর ধারণাটি নিঃসন্দেহে নতুন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় প্রাকৃত ভাষায় লেখা সপ্তম ও ত্রয়োদশ গিরিশাসনে উৎকীর্ণ ‘দিঢ়ভতিতা’ শব্দটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘দিঢ়ভতিতা’ শব্দের অর্থ ‘দৃঢ়ভক্তি’। এই ভক্তি কার প্রতি, সম্ভবত রাজার প্রতি। কারণ পানিনির ‘অষ্টাধ্যয়ী’ ব্যাকরণে ‘ভক্তি’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ‘রাজার প্রতি প্রজার ভক্তি’র বা আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ কেবল নৈতিক অনুশাসন মাত্র ছিল না। এতে রাজার কর্তৃত্বের প্রতি প্রজাসাধারণের আস্থা ও আনুগত্য আদায়ের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাও সক্রিয় ছিল।

কলহন-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের সময় পর্যন্ত অশোক শৈব ধর্মের অনুগামী ছিলেন। অতঃপর তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্রায় একই সময়ে ‘ধৰ্ম্ম’ সংক্রান্ত তাঁর বক্তব্য ও উপলব্ধির তত্ত্ব জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করেছিলেন। সম্রাট অশোকের এই ধর্মান্তর গ্রহণের কারণ সম্পর্কে ইতিহাস পাঠকদের জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। ঐতিহ্যবাদী ইতিহাস চর্চায় মনে করা হয় যে, ধর্ম-বিষয়ে অশোকের নতুনতর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ। কলিঙ্গ যুদ্ধের বীভৎসতা তাঁর মানসিক রূপান্তর ঘটায়। এই যুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত, আতঙ্ক, বেদনা তাঁর মানসিক পরিবর্তন ঘটায় এবং তিনি অহিংসা ও শান্তির প্রতীক বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর ‘দিগ্বিজয়’ নীতি পরিহার করে ‘ধৰ্ম্ম বিজয়’ নীতি গ্রহণ করার বিষয়টিকে এই প্রেক্ষাপটে বিচার করা যায়। ত্রয়োদশ গিরি অনুশাসনে তিনি স্বীকার করেছেন যে, কলিঙ্গ যুদ্ধে যে সংখ্যক মানুষ আহত, বন্দী বা নিহত হয়েছিলেন তার শতভাগের, এমনকি সহস্র ভাগের এক ভাগও যদি ভবিষ্যতে অনুরূপ দূঃখ-দুর্দশার শিকার হন, তাহলে সেটি তাঁর কাছে গভীর অনুতাপের কারণ হবে। হিংসাশ্রয়ী যুদ্ধের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে অহিংস বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় গ্রহণের তত্ত্বটি স্বাভাবিক হতেই পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় ভিন্নমত প্রকাশ করা হয়েছে।

ড. রোমিলা থাপার, ডি. ডি. কোশাম্বি প্রমুখ বস্তুগত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে অশোকের ধর্ম্মনীতির উদ্ভব ও প্রচারের ব্যাখ্যা করেছেন। এঁরা দেখিয়েছেন যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের নৃসংশতা অশোককে নাড়া দিলেও, তাঁর ধর্মান্তরের ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব বিশেষ ছিল না। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিজয়ের বেশ কিছু পরে তিনি নতুন ধর্মমত গ্রহণের চিন্তা করেন। অহিংস নীতি নিলেও কিংবা ধর্মবিজয়ের তত্ত্বপ্রচার করলেও, আটবিকদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনার ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন। আসলে গভীরতর আর্থ-সামাজিক রূপান্তর অশোকের ধৰ্ম্ম নীতির পশ্চাদপটে সক্রিয় ছিল। কোশাম্বির মতে, মৌর্য আমলে বর্ণবিভক্ত সমাজ কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল। অশোকের সিংহাসনারোহণের সময় মৌর্য রাষ্ট্রের একটি সবল শ্রেণী কাঠামো গড়ে উঠেছিল। নিম্নতর দুটি বর্ণের বস্তুগত পরিবর্তন তাদের কাছাকাছি এনেছিল। স্বভাবতই উচ্চতর দুটি বর্ণের কর্তৃত্ব ও অধিকার সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। এমতাবস্থায় শ্রেণী সংঘাতের সম্ভাবনা প্রবল হয়, যা সাম্রাজ্যের সংহতি ও শান্তির পক্ষে কাম্য ছিল না। এই সম্ভাব্য শ্রেণী সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য অশোক সর্বজনগ্রাহ্য একটি ধৰ্ম্ম মত প্রচারে উদ্যোগী হন। ‘ধৰ্ম্ম’ নামাঙ্কিত এমন একটি মাধ্যমের আশ্রয় তিনি নিয়েছিলেন যা প্রজাদের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে এবং প্রজাদের সাথে রাজার সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সহায়ক হবে। ড. রোমিলা থাপারের মতে, অশোক ধৰ্ম্মকে একটা সামাজিক দায়িত্ববোধের দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছিলেন। এর পশ্চাদপটে ছিল মৌর্য যুগে পূর্ববর্তী বৈদিক আর্থ-সামাজিক জীবনচর্চার রূপান্তর। মৌর্যরা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী মতাদর্শকেই সমর্থন করতেন। তবে মৌর্যরা ব্রাহ্মণ্যবাদকে আঘাত না-করলেও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির সম্পর্কে উত্তেজনা ছিল। বর্ণবিভক্ত বৈদিক সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তন সমকালীন পরিস্থিতিকে জটিলতর করেছিল। আর্যদের পশুচারী ও যাযাবর অর্থনীতি স্থায়ী কৃষিজীবী অর্থনীতিতে উন্নীত হলে সামাজিক সম্পর্কের পুরাতন কাঠামো নাড়া খায়। নগর সভ্যতার নব-উন্মেষ বৈশ্য শ্রেণীর ক্ষমতা বৃদ্ধির পথ খুলে দেয়। সমবায় সংঘগুলি সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। বৈশ্য বা বণিকদের সামাজিক মর্যাদা উচ্চস্তরে তুলে ধরার দাবি উচ্চতর দুটি শ্রেণীর সামাজিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। অশোক উপলব্ধি করেন যে, সাম্রাজ্যের সকল স্তরের জনগণের জন্য এমন একটি ভাবাদর্শের প্রয়োজন, যা বিরোধী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হবে। এমতাবস্থায় বৌদ্ধধর্মের ব্যাপকতর সমাজ-সচেতনা এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের আদর্শ অশোককে আকৃষ্ট করেছিল। একই সাথে তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার তাগিদে ‘ধৰ্ম্ম’ নামাঙ্কিত নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন করে সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ উত্তেজনাও সংঘাত নির্মূল করার প্রয়াস নেন।

অশোকের ধম্মের প্রকৃতি কি, তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, অশোক তাঁর ধর্ম্মের অনুশাসনের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মেরই প্রচার ও প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। অর্থাৎ ধৰ্ম্ম ও বৌদ্ধধর্ম আলাদা কিছু নয়। এ মতের প্রধান সমর্থক হলেন ড. ডি. আর ভাণ্ডারকর। তিনি নিজমতের স্বপক্ষে নানা যুক্তি উত্থাপিত করেছেন। তাঁর মতে, যেসব ঐতিহাসিকরা ‘ধন্ম’ ও বৌদ্ধধর্মকে পৃথক করে দেখেন তাঁরা স্মরণ করেন না যে বৌদ্ধধর্মের অনুশাসন দুটি বিভাগে বিভক্ত। এর একটি হল বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের পালনীয় আচরণবিধি ও দ্বিতীয়টি হল গৃহী-ভক্তদের পালনীয় আচরণবিধি। অশোক যেহেতু নিজে গৃহী ছিলেন ও বিশেষ করে, যাদের মধ্যে তিনি ধৰ্ম্ম প্রচার করেছেন, তাঁর সেই প্রজারা ছিল গৃহী। সেহেতু তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুশাসনগুলিই তাঁর লেখর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বৌদ্ধধর্মে অহী উপাসকদের অবশ্য পাঠ্য হিসেবে যেসব ধর্মপুস্তকের উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল দীর্ঘনিকায়ের সিগালবাদ সুত্ত, যার অপর নামই হল ‘গিহি-বিনয়’। এই সুত্ত পাঠ করলে দেখা যায় যে, যেসব উপদেশাবলী অশোকের ধর্মের বাণী হিসেবে বিভিন্ন লেখয় উৎকীর্ণ হয়েছে (পিতামাতার প্রতি ভক্তি, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মীয় বন্ধু পরিচিতের সঙ্গে ভাল ব্যবহার ইত্যাদি) ঠিক সেই উপদেশগুলিই বুদ্ধদেব কর্তৃক সিগালের প্রতি উক্ত হয়েছে। অশোকের ধর্ম্মের অন্তর্নিহিত গুণাবলী হিসেবে দয়া, দান, সচে, সোচয়ে, মাধবে, বহুকয়ানে ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়। দীর্ঘনিকায়-এর ‘লক্ষণ সুত্ততে’ এগুলির উল্লেখ রয়েছে। অশোকের ত্রয়োদশ লেখয় উল্লেখিত ধৰ্ম্মমঙ্গলের ধারণা এসেছিল সুত্ত-নিপাতের “মহামঙ্গলম্ সুত্ত” থেকে। অশোকের ধৰ্ম্মকে যাঁরা বৌদ্ধধর্ম থেকে পৃথক করে দেখেন তাঁরা এই যুক্তি দেখান যে, উক্ত ধর্ম্মে বৌদ্ধধর্মের নির্বাণ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু অনুপস্থিত ও তার বদলে স্বর্গের উল্লেখ রয়েছে। ড. ভাণ্ডারকরের মতে, এতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বৌদ্ধধর্মে ‘নির্বাণ’ কেবলমাত্র ভিক্ষুদের জন্য সংরক্ষিত অধিকার। সাধারণ মানুষদের ধর্মপ্রাণ হবার পুরস্কার হিসেবে স্বর্গবাসের উল্লেখ স্বয়ং বুদ্ধদেবই একাধিকবার করেছেন। এইভাবে ড. ভাণ্ডারকর যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যে, অশোক প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’ ও বৌদ্ধধর্ম এক ও অভিন্ন।

যেসব ঐতিহাসিক উপরোক্ত মতের বিরেধিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রিস ডেভিস, ফ্লিট, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের নামোল্লেখ করা যায়। রিস ডেভিড্স-এর মতে, অশোকের ধৰ্ম্মকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। প্রকৃত জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যা করা উচিত অশোক তাঁর ধর্মে সেই কথাই ব্যক্ত করেছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, “অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ বলে যাকে প্রচার করা হচ্ছে, তাকে ধর্ম না বলে নৈতিক অনুশাসন বলাই যুক্তিসঙ্গত” (The aspect of Dhamma which he emphasised was a code of morality rather than system of religion.)। আবার অনেকে ধর্মকে তাঁর রাষ্ট্রনীতির অংশবিশেষ হিসেবে দেখেছেন। বিভিন্ন লেখয় অশোক যে ধর্ম্মের বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন ড. ফ্লিট তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “…not to prapagate Buddhism or any other particular religion, but to proclaim the determination of Asoka to govern his kingdom righteously and kindly is accordance with the duty of a pious king.” এঁদের মতে, অশোকের ধৰ্ম্ম ছিল তাঁর স্বকীয় আবিষ্কার। এই ধৰ্ম্ম ছিল হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধ আদর্শের সুসমন্বয়ে গঠিত একটি নৈতিক নীতি-নির্দেশিকা। এই ধৰ্ম্ম প্রচারের মাধ্যমে তিনি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কারসাধনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর ধর্ম্মের নৈতিক আদর্শ ছিল ব্যক্তির সামাজিক আচরণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এর দ্বারা তিনি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং বলবানের বিরুদ্ধে দুর্বলকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এই উদার নীতিবোধের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে তিনি সমাজে এমন এক নৈতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যাতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাস করতে পারে। সর্বোপরি তাঁর ধৰ্ম্ম যদি বৌদ্ধধর্মের অনুলিপিই হত, তাহলে তিনি তা অবশ্য উল্লেখ করতেন, কারণ বৌদ্ধধর্মের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। ড. থাপার লিখেছেন, “অতীতের ঐতিহাসিকেরা অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’কে বৌদ্ধধর্মের সাথে এক করে দেখেছিলেন এবং তাঁরা মনে করেন, অশোক বৌদ্ধধর্মকে সরকারিভাবে রাজধর্মে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অশোকের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে। ‘ধন্মের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার ও মানুষের পারস্পরিক আচরণ সম্পর্কিত একটি বিশেষ মনোভাব তৈরি করা। সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সামাজিক কাজকর্মে মানবিকভাবের সঞ্চারই ছিল তাঁর ধর্ম্মের লক্ষ্য।”

যাইহোক্, ব্যক্তিগতভাবে অশোক বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল গভীর ধর্মীয় উদারতা। অন্য ধর্মমতকে তিনি বর্জন বা অগ্রাহ্য করতেন না। Hultach-এর মতে, অন্য যে-কোন ধর্মপ্রাণ হিন্দুরাজার মত অশোক তাঁর ধর্মাচরণে উদারতা প্রদর্শন করেছেন। ষষ্ঠ স্তম্ভলেখতে অশোক ঘোষণা করেছেন, “রাজা সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।” দ্বাদশ শিলালেখতে তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি আসক্তিবশত অন্য সম্প্রদায়কে দোষারোপ করে, সে পরিণামে নিজের সম্প্রদায়েরই ক্ষতিসাধন করে।” তাই তিনি সব সম্প্রদায়ের জন্যই মৈত্রী ও বাকসংযমের নির্দেশ দিয়েছেন।

কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, অশোকের ধম্ম সাফল্যলাভ করেনি। ধর্ম্মের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য ও ভেদাভেদ দূর করা যায়নি। ধর্মপ্রচারে তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহ অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অশোক তাঁর গিরিলেখমালার ত্রয়োদশ অনুশাসনে দাবি করেছেন যে, তাঁর ধর্ম দেশ-বিদেশের বহু লোক গ্রহণ করেছিল এবং এর প্রভাবে সামাজিক কুপ্রথা ও বিভেদ দূর হয়েছিল। অশোকের দাবি সত্য হলে বলতে হবে তাঁর ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল।

ধর্মপ্রচারক সম্রাট অশোক :

বৌদ্ধধর্মের প্রেম ও অহিংসার বাণী অশোককে অভিভূত করেছিল। জীবজগতের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য তিনি ছিলেন সদা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছিলেন, ‘জগতের মঙ্গলের অধিক বড় কোন কাজ নেই। আমার সামান্য প্রচেষ্টায় একমাত্র উদ্দেশ্য জীবজগতকে আনন্দিত রাখা।’ এই আনন্দবিধানের উদ্দেশ্যে অশোক ধর্মপ্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রথম অপ্রধান শিলালেখতে তিনি বলেছেন যে, তাঁর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর আড়াই বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রথম এক বছর তিনি এই ধর্মের বিষয়ে বিশেষ কোন উদ্দীপনা বোধ করেননি। কিন্তু পরবর্তী সময়কাল তিনি এ বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী হন। রাজত্বের দশম বৎসরে, ‘ভিক্ষুগতিক’ হওয়ার পর তাঁর জীবনে সহসা পরিবর্তন দেখা দেয় এবং তিনি ধর্মপ্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই কাজে তিনি বিশেষ শ্রম দান করেন ও তার ফল হিসেবে জম্বুদ্বীপের (ভারতের) সমস্ত মানুষ ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর দিগ্বিজয়ের পরিবর্তে অশোক ধর্মবিজয়ের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৃত অর্থেই ধর্মপ্রচারক। এজন্য তিনি একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি ধর্মযাত্রার দ্বারা ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি যান বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যস্থান বুদ্ধগয়ায়। অতঃপর নিয়মিতভাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থানগুলি পরিভ্রমণ করতেন। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসতেন ও তাদের সাথে ধর্মালোচনা করতেন। রাজার ভেরীঘোষ অশোকের নেতৃত্বে ধর্মঘোষে পরিণত হয়।

দ্বিতীয়ত, অশোক অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর একক প্রচেষ্টায় ধর্মপ্রচারের কাজ সম্পূর্ণতা লাভ করবে না। এজন্য তিনি বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মপ্রচারের কাজে তিনি রাজুক, যুত ধর্মমহামাত্র নামক কর্মচারীকে নিয়োজিত করেন। এদের দ্বারা তিনি ধর্মবিষয়ক নির্দেশাবলী প্রচার (ধর্ম শ্রবণ) এবং ধর্মবিষয়ক শিক্ষা (ধর্ম অনুসথি) প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এইসব কর্মচারীবৃন্দ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দেশ পরিক্রমায় বের হয়ে সাধারণ মানুষকে ধর্ম বিষয়ে উৎসাহিত করতেন এবং তাদের কাছে ধর্মের ব্যাখ্যা করতেন। ধর্মমহামাত্রদের কাজ ছিল ধর্মের প্রতি সাম্রাজ্যের সকল সম্প্রদায়ের বিশেষত বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাদের মধ্যে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করা। ড. বড়ুয়ার মতে, অশোকের ধর্মগ্রহণকারী ও প্রচারকদের নিরাপত্তার দায়িত্বও ধর্মমহামাত্রকের হাতে ন্যস্ত ছিল। নারীদের মধ্যে ধর্মভাব জাগ্রত করার জন্য ‘স্ত্রী-অধ্যক্ষ মহামাত্রগণ নিযুক্ত হতেন।

তৃতীয়ত, ধর্মপ্রচারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে অশোক শিলা ও স্তম্ভে ধর্মীয় বক্তব্য খোদাই করে রাজ্যের জনবসতিপূর্ণ স্থানগুলিতে প্রোথিত করার ব্যবস্থা করেন। এইসব লেখ সহজ সরল প্রাকৃত ভাষায় লিখিত হত, যাতে সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। তাঁর আশা ছিল এইসব স্থায়ী লেখ পাঠ করে সাধারণ মানুষের সাথে সাথে বংশধরেরাও প্রভাবিত হবেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবজগতের মঙ্গলবিধানে সচেষ্ট হবেন।

চতুর্থত, অশোক প্রচলিত উৎসব অনুষ্ঠানের পরিবর্তে এমন কতকগুলি উৎসবের আয়োজন করেছিলেন, যা সাধারণের মনে ধর্মকামনা জাগ্রত করত। এজন্য তিনি বিমান, হস্তিদশনা, অগ্নিদশনা প্রভৃতি অলৌকিক দৃশ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন।

পঞ্চমত, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজও অশোকের ধর্মপ্রচারের অঙ্গ ছিল। সপ্তম স্তম্ভ লেখ থেকে এ বিষয়ে জানা যায়। কূপখনন, বৃক্ষরোপণ, বিশ্রামাগার ও চিকিৎসালয় স্থাপন ইত্যাদি ছিল জনকল্যাণ কর্মসূচীর অঙ্গীভূত। এর সাথে সাথে তিনি একাধিক উদার প্রশাসনিক বিধি প্রবর্তন করেন। তিনি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তিন দিন বিশ্রামের বন্দোবস্ত করেন। প্রতি বছর রাজ্যাভিষেকের দিনে তিনি কয়েদীদের মুক্তি প্রদান করতেন। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখির ক্লেশ নিবারণের জন্যেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য তিনি নির্দিষ্ট দিনে পশুহত্যা নিষিদ্ধ করেন ও পশুক্লেশ নিবারণের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও তিনি তাঁর জনহিতকর কার্যাবলী সম্প্রসারিত করেন।

ষষ্ঠত, বৌদ্ধধর্মের বিশুদ্ধতা ও বৌদ্ধসংঘের সংহতিবিধানের জন্য তিনি পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ-সংগীতের আয়োজন করেন। তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে অশোক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য দেশে-বিদেশে দূত প্রেরণ করেন। মধ্যত্তিক যান কাশ্মীর ও গান্ধারে, মহারক্ষিত যান যবনদেশে, ব্যাকট্রিয়ায় যান মহাদেব রক্ষিত, দক্ষিণ-ভারতে যান ধর্মরক্ষিত, মহাধর্মরক্ষিত যান মহারাষ্ট্রে, মঝঝিম যান হিমালয় অঞ্চলে। সিংহলে তিনি নিজ পুত্র ও কন্যাকে দূতরূপে প্রেরণ করেন। উপরোক্ত তালিকা প্রদত্ত হয়েছে মহাবংশে। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালেখর বক্তব্যও এ বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য। এই লেখতে দাবি করা হয়েছে যে, ভারতের বাইরে ছয়শ যোজন পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর ধর্মবিজয়ের এক্তিয়ারভুক্ত হয়েছিল। সিরিয়া, মিশর, ম্যাসিডন, সাইরিন ও এপিরাস—এই কটি গ্রীক রাজ্য এই ছয়শ যোজনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই লেখর বক্তব্য অনুসারে, যেসব দেশে অশোকের ধর্মপ্রচারকরা পৌঁছাননি, সেই সব দেশও তাঁর ধর্মের বাণী শুনে সে বিষয়ে আকৃষ্ট হয়েছিল ও উক্ত ধৰ্ম্মনীতি গ্রহণ করেছিল। ড. পিনডা লেভী, ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচি প্রমুখ এই বক্তব্যের সমর্থক।

ভারতের বাইরেও যে বিশাল অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করেছিলেন বলে অশোক দাবি করেছেন, সেই দাবির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশেষত গ্রীক দেশগুলিতে তাঁর ধর্মপ্রচারের দাবি পাশ্চাত্য দেশীয় পণ্ডিতগণ মানতে রাজী হননি। তাঁদের মতে, ঐ সকল দেশে অশোক ধর্মদূত পাঠিয়েছিলেন এরূপ কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই (অশোকের নিজের লেখ ছাড়া)। আর যদি পাঠিয়েও থাকেন, গ্রীকগণের মত আত্ম-অহংকারী জাতি প্রাচ্যের একজন রাজার ধর্মকে সাদরে গ্রহণ করবে, এরূপ মনে করার যুক্তি নেই। অনেক পণ্ডিত আবার অশোকের দাবির সত্যতা প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছে। হেলিওডোরাস ও ব্যাকট্রিয় গ্রীক শাসক মিনান্দারের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকে তাঁর উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সিংহলে একটি স্তূপ স্থাপনের ঘটনারও উল্লেখ করা যায়, যাতে ব্যাকট্রিয়ার ৩০ হাজার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকারী ভিক্ষু যোগদান করেন। পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ গুহা নির্মাণের সঙ্গেও গ্রীকদের নাম জড়িত রয়েছে। ব্যাকট্রিয় গ্রীকগণ বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে ব্যাকট্রিয়া থেকে চীনে গিয়েছিলেন বলে পি. সি. বাগচী অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে ইরানে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং অন্তত ব্যাকট্রিয়া ও সিরিয়াতে, অর্থাৎ পশ্চিম এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল এবং এ বিষয়ে সবটুকু কৃতিত্ব সম্রাট অশোকেরই প্রাপ্য। এইভাবে আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্রাট অশোক গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রচারিত একটি ধর্মমতকে বিশ্বজনীন ধর্মে উন্নীত করেছিলেন।

মানবতাবাদের প্রতীক হিসেবে সম্রাট অশোক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মৌর্য বংশের এই মহান সন্তান রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যে অভিনব নীতি অনুসরণ করেছিলেন তা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর শাসনতান্ত্রিক আদর্শের রূপায়ণে সহায়ক উপাদান হিসেবে আলোচিত হয়ে চলেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বিশাল সাম্রাজ্য ও ব্যাপক সামরিক শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন। ইচ্ছে করলে দিগ্বিজয়ী বীর হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। তাঁর সেই সামরিক প্রতিভা ও কূটনৈতিক জ্ঞানের অভাব যে ছিল না, তার প্রমাণ কলিঙ্গ অভিযানের সাফল্য। এই ধরনের সাফল্যে তাঁর দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এই একটি যুদ্ধের পরেই তিনি যুদ্ধনীতি চিরতরে বর্জন করেন। তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, কলিঙ্গযুদ্ধের ভয়াবহ হত্যালীলা, নারী ও শিশুদের অসহায়ত্ব ও আর্তি তাঁকে অনুতাপে দগ্ধ করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি যুদ্ধনীতি বর্জন করে শান্তিনীতি গ্রহণ করেছেন। বিহারযাত্রার পরিবর্তে ধর্মযাত্রার ব্যবস্থা করেছেন। ভেরীঘোষ রূপান্তরিত হয়েছে ধর্মঘোষে। মানসিক প্রশান্তি লাভ করার জন্য তিনি তথাগত বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের অহিংসা মন্ত্র তাঁর তাসিপত চিত্তে শান্তির বারিধারা সিঞ্চন করেছে। যুদ্ধে নয়, শান্তির পথেই যে পৃথিবীকে সংকটমুক্ত করা যেতে পারে, তা তিনি অনুভব করেন ও তাঁর পরবর্তী জীবন এই শান্তিনীতিকে বাস্তবায়িক করার কাজেই ব্যয়িত হয়।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর পরিবর্তিত মানসিকতার মাধ্যমে অশোক রাজপদ ও রাজকর্তব্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করেন। সিংহাসন তাঁর কাছে ভোগবিলাসের মাধ্যম অপেক্ষা পরিহিতের সুবিধাযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হতে থাকে। প্রজাদের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি করাকেই তিনি রাজার প্রকৃত কর্তব্য বলে মনে করেন। এমনকি মানবজাতির সার্বিক কল্যাণসাধনই তাঁর ব্রত হয়ে ওঠে। তিনি ঘোষণা করেন—’সব মুনিসে পজা মমা’। সর্বোপরি প্রজাদের কাছে তিনি রাজা হিসেবে ঋণ স্বীকার করেন ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই ঋর পরিশোধ করাকেই প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, সন্তানের সুখ যেমন পিতাকে সুখী করে বা পিতা যেমন সন্তানের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন, তিনিও তেমনি সকল প্রজা তথা সকল মানুষের জন্য মঙ্গলকামনা করেন।

প্রজাদের জন্য অশোকের এই কর্তব্যবোধ প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর জনকল্যাণকামী কর্মসূচীর মধ্যে। কূপখনন, বৃক্ষরোপণ, চিকিৎসালয় স্থাপন ইত্যাদির দ্বারা তিনি প্রজাদের পার্থিব উন্নতির ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর এই জনকল্যাণের কর্মসূচী সাম্রাজ্যের বাইরেও প্রসারিত করতে তিনি উদ্যোগী হন। সাম্রাজ্যের ভিতরে ও বাহিরে এইসব জনকল্যাণমূলক কার্যাদি রূপায়ণের ব্যাপারে অশোকের প্রধান সহায়ক ছিল তাঁর অনুগত কাজকর্মচারীবৃন্দ। তিনি এই কর্মচারীগণকে দক্ষ ধাত্রীর সমতুল্য বলে প্রশংসা করেছেন। মানুষ যেমন তার শিশুর দায়িত্ব দক্ষ ধাত্রীর হাতে অর্পণ করে নিশ্চিত্ত হয়, তিনিও তেমনি প্রজাকুলের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দায়িত্ব দক্ষ ধাত্রীস্বরূপ এই কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করেছিলেন। তবে তিনি নিজেও প্রজাদের বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজখবর রাখতেন। প্রজাগণের অবস্থা নিজে প্রত্যক্ষ করাকে তিনি কর্তব্য বলে মনে করতেন, একথা অষ্টম শিলালেখ থেকে জানা যায়। তাছাড়া প্রতিবেদকগণ প্রজাদের খবর নিয়ে যে-কোন সময়ে, এমনকি তিনি যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন তখনও, তাঁর কাছে উপস্থিত হতে পারতেন বলে জানা যায়। এইভাবে তিনি সদাসর্বদা প্রজাকল্যাণ নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।

কেবলমাত্র প্রজাদের পার্থিব উন্নতির ব্যবস্থা করেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের পারলৌকিক উন্নতিবিধানকেও তিনি নিজ কর্তব্য বলে মনে করতেন। এজন্য তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সকল স্থানে ধর্মের বাণীগুলি সহজ সরল ভাষায় পাথরে খোদাই করিয়ে স্থাপন করার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া অলৌকিক দৃশ্য প্রদর্শন, ধর্মযাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমেও তিনি তাদের মধ্যে ধর্মবোধ জাগ্রত করতে সচেষ্ট হন। এরই সঙ্গে প্রজাদের নৈতিক চরিত্রের মানোন্নয়নও ছিল তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য। বুদ্ধের অহিংসা নীতির সাথে তাঁর স্বকীয় নীতিবোধ সংকলিত করে জনসাধারণের নৈতিক মান উন্নয়নের আন্তরিক প্রয়াস নেন সম্রাট অশোক। নানা দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করে তিনি এই মানবধর্মের বাণী প্রচার করেন।

অশোক ছিলেন মৈত্রী, শান্তি ও অহিংসার মূর্ত প্রতীক। তাঁর পররাষ্ট্র নীতির মধ্যেও তাঁর এই শান্তি ও মৈত্রীর আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। এই নীতির সফল প্রয়োগ দ্বারা একদিকে তিনি যেমন নিজ সাম্রাজ্যের সংহতিকে সুদৃঢ় করেন অন্যদিকে তেমনি উত্তর-পশ্চিম এশিয়ার গ্রীক রাজ্যগুলি, সুদূর দক্ষিণের রাজ্যগুলি ও সিংহলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

অশোকের রাজত্বকালে ভাষা ও শিল্পের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছিল। তাঁর আমলেই খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন হয়। অশোক তাঁর ধর্ম্ম প্রচার করতেন সহজ সরল পালি ভাষায়। যেহেতু প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষই অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল সেহেতু পালিভাষার মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের ফলে ঐ ভাষা সর্বভারতীয় রূপে নেয়। এই ধৰ্ম্ম প্রচারের জন্যই তিনি রাজ্যের সর্বত্র বহু স্তূপ, চৈত্য, স্তম্ভ ইত্যাদি স্থাপন করান। বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্কভুক্ত সকল পুণ্যস্থানেই এগুলি স্থাপিত হয়। ফলে স্থাপত্যশিল্পের অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধিত হয়।

এই প্রসঙ্গে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের ভাবান্তর ও রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রেক্ষিতে অশোক কর্তৃক শান্তিবাদী নীতি গ্রহণের বিষয়টিকে কেউ কেউ তাঁর ‘স্বপ্ন-বিলাসিতা’ ও ‘আবেগ-সর্বস্বতার’ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অহিংস বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর আসক্তি এবং মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলবিধানের ইচ্ছা অশোকের ‘আধ্যাত্মিকতাবাদী’ চেতনা হিসেবে এঁদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। এই গোষ্ঠীর মতে, অশোক মানুষের হৃদয়বৃত্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার সাথে স্বৈরাচারী কঠোর রাজতন্ত্রের বাস্তববাদিতার বিরোধ খুবই স্পষ্ট।

পক্ষান্তরে ঐতিহাসিক এইচ. সি. রায়চৌধুরী মনে করেন যে, অশোক “নিছক স্বপ্নবিলাসী আধ্যাত্মবাদী ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ রাজা।” অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখার্জী, রোমিলা থাপার, ডি. ডি. কোশাম্বী, রুশ ঐতিহাসিক বনগার্ড লেভিন (B. Levin) প্রমুখের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ড. রায়চৌধুরীর মন্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। লেভিন-এর মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অশোককে স্বপ্নবিলাসী বা অহিংসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যথার্থ নয়। কারণ সিংহাসনে বসার পরে তিনি চিরচরিত যুদ্ধবিজয় নীতি গ্রহণ করতে কিংবা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে আদৌ দ্বিধান্বিত ছিলেন না। ড. থাপার, কোশাম্বী প্রমুখ অশোকের কলিঙ্গ বিজয়কে বাস্তব ও দূরদর্শী রাজনীতির অনন্য দৃষ্টান্ত রূপে তুলে ধরেছেন। দক্ষিণ ভারতের সাথে অবশিষ্ট ভারতের বাণিজ্যপথগুলি কলিঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করত। তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে তাম্রলিপ্ত বন্দরের বাণিজ্য যোগাযোগের উপরেও কলিঙ্গদেশের প্রভাব ছিল। তাই অশোক কলিঙ্গদেশ বিজয় করে দূরদর্শী রাজনীতিজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার বলেছেন, অশোক কোন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শান্তিবাদী নীতি গ্রহণ করেননি; পরন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের ঐতিহাসিক সাফল্যের পরই তিনি যুদ্ধ পরিহার নীতি নিয়েছিলেন। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। কোশাম্বীর বক্তব্যে এই তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘An Introduction to the Study of Idian History’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে, সমাজ ও অর্থনীতির ক্রমবিকাশের নিরিখে অশোক শাস্তিবাদী নীতির সমর্থন করেছিলেন। কারণ বৈদিক যুগের পশুচারণভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তে তখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল। এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখেই অশোক প্রকৃত বস্তুবাদীর মতই শান্তি, সংহতি ও প্রগতির স্বার্থে যুদ্ধবর্জন নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ড. আর. এস. শর্মাও অশোকের এই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, “কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের চরিত্র ও রাষ্ট্রনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তা ছিল বাস্তব ও সংগত।”

কেউ কেউ অভিযোগ করেন যে, অশোকের শাস্তিবাদী নীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ডেকে এনেছিল। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। ‘কলিঙ্গ যুদ্ধ জয় করে অশোক নিজের সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেন। কলিঙ্গ বিজয়ের পর তিনি যুদ্ধ না করলেও সেনাবাহিনী ভেঙে দেননি বা কলিঙ্গের স্বাধীনতাও ফিরিয়ে দেননি। গুপ্তচর-বাহিনীও সক্রিয় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরেও মৌর্য সাম্রাজ্য বহুকাল টিকেছিল। প্রকৃতপক্ষে অশোক সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে সাম্রাজ্যের সংহতি ও প্রজাদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিসাধনের দিকে বেশি দৃষ্টি দেন। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী লিখেছেন, “অশোকের মধ্যে ছিল চন্দ্রগুপ্তের উদ্যম, সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রতিভা ও আকবরের ঔদার্য।” স্মিথের মতে, তিনি মানবজাতির প্রথম ধর্মগুরু। নানাদেশে দূত প্রেরণ করে তিনি বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের সংস্কৃতি সমন্বয় ঘটান। তাই ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন, “আশোকের আগে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল রুধির ও লৌহ নীতির উপর। কিন্তু অশোক সেই সাম্রাজ্যকে সাংস্কৃতিক ও ভাবের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।” পৃথিবীতে নানা যুগে নানা মহান শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে। রোমসম্রাট জুলিয়াস সীজার, অগস্টাস, শার্লেম্যান, ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রমুখ সবাই ছিলেন মহান কৃতিত্বের অধিকারী। এঁরা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন মূলত বিজেতা ও প্রশাসক রূপে। কিন্তু সম্রাট অশোক রাষ্ট্রনীতির সাথে মানবজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলসাধনে রাজকীয় তত্ত্ব সংযোজিত করেছিলেন। ইতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল। তিনি ছিলেন ‘প্রতি ইঞ্চি একজন রাজা’ আবার তাঁর রাজকর্তব্য ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা পরিশীলিত হয়েছিল। তাই তিনি ছিলেন একাধারে রাজা ও ঋষি। এখানেই রাজর্ষি অশোকের অনন্যতা। এইচ. জি. ওয়েলস্ যথার্থই বলেছেন, “বিশ্ব-ইতিহাসের অসংখ্য নৃপতির মধ্যে অশোকই ছিলেন একমাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র।”

অশোকের পরবর্তী মৌর্য শাসকগণ :

সম্রাট অশোক ছিলেন মৌর্য বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য শাসক। অশোকের মৃত্যু মৌর্য-গৌরবের সূর্যের অস্তাচল পর্বের সূচনা করে। অশোকের পরবর্তী মৌর্য শাসকদের কেউই এককভাবে বৃহত্তর সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন না কিংবা কেউই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থায়ী অবদান রেখে যেতে পারেন নি। বস্তুত মৌর্য রাজরক্তের ঐতিহ্যকে ধারণ করে এঁরা স্থানীয়ভাবে এবং সাময়িক কালের জন্য ক্ষমতাসীন ছিলেন। অশোক-পরবর্তী মৌর্য রাজাদের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য উপাদান খুবই কম। মূলত বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য থেকে এঁদের কথা জানা যায়। তবে সেই বিবরণও বহুক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী ভাষ্যে কন্টকিত। বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে অশোকের প্রধানা মহিষী ছিলেন অসন্ধিমিত্র। এছাড়া তাঁর চার পত্নী ছিলেন—কারুবাকি, দেবী, পদ্মাবতি ও তিষ্যরক্ষিতা। একমাত্র এলাহাবাদ লেখতে অশোকের মহিষী কারুবাকি এবং পুত্র তিবর-এর উল্লেখ আছে। অপর স্ত্রীগণ বা পুত্রদের উল্লেখ কোন লেখতে পাওয়া যায় না। আবার তিবর-এর নাম অশোকের মৃত্যুর পর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত অশোকের জীবৎকালেই তিবর-এর মৃত্যু ঘটেছিল।

সাহিত্যসূত্র থেকে তিবর ছাড়া অশোকের তিন পুত্রের নাম পাওয়া যায়। দেবীর পুত্র মহেন্দ্র, পদ্মাবতীর পুত্র কুনাল। জলৌকা নামক এক পুত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও তার মাতৃপরিচয় অজ্ঞাত। আবার মহেন্দ্র তাঁর পুত্র ছিলেন নাকি ভ্রাতা এ বিষয়েও বিতর্ক আছে। কাশ্মীর সম্পর্কিত গ্রন্থ কলহনের রাজতরঙ্গিনীর মতে জলৌকা কাশ্মীরের শাসক ছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে কুনালকে (অন্য নাম ধর্মবিবর্ধন) পাটলিপুত্রের শাসক বলা হয়েছে। তবে কুনাল দৃষ্টিশক্তিহীন ছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে শাসন কাজ চালাতেন পুত্র সম্প্রতি। সম্ভবত পুত্র মহেন্দ্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না।

কুনালের উত্তরাধিকারীদের সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত আছে। লামা তারানাথ জনৈক বিগতাশোক-এর নাম লিখেছেন। বায়ুপুরাণে বন্ধুপালিত-এর নাম আছে। আবার বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদিতে সম্প্রতির নাম গুরুত্ব পেয়েছে। একটি লেখতে দশরথ নামক উত্তরাধিকারীর নামোল্লেখ আছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, দশরথ ও বন্ধুপালিত অভিন্ন ব্যক্তি। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, কুনালের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য দু’খণ্ডে বিভক্ত করে শাসন করা হত। সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশ শাসন করতেন দশরথ। তাঁর রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। অন্যদিকে উজ্জয়িনীকে রাজধানী করে পশ্চিমভাগে শাসন চালাতেন সম্প্রতি। তবে সম্প্রতি দশরথের ভাই এবং সমকালীন শাসক ছিলেন, নাকি তিনি দশরথের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী ছিলেন, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ড. ডি. আর. ভাণ্ডারকর। কোন কোন জৈনগ্রন্থে সম্প্রতিকে সমগ্র ভারতের অধীশ্বর বলা হয়েছে। সম্ভবত পাটলিপুত্র ছিল তাঁর প্রধান রাজধানী। উজ্জয়িনীতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল। জৈন ধর্মের অনুরাগী ও প্রচারক হিসেবে তিনি ভূয়যী প্রশংসিত হয়েছেন। সম্প্রতির মৃত্যুর পরে মৌর্য সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

‘বিষ্ণুপুরাণ’ অনুসারে সম্প্রতির পরে পাটলিপুত্রে সিংহাসনে বসেছিলেন সালিসুখ। ‘গার্গীসংহিতা’ গ্রন্থেও সালিসুখের নাম পাওয়া যায়। তিনি দুর্বল প্রকৃতির শাসক ছিলেন। ইতিমধ্যে আঞ্চলিক শাসকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা জোরালো হয়েছিল। সমকালীন সাহিত্য থেকে আঞ্চলিক শাসকদের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানা যায়। কাশ্মীরে জলৌকা, গান্ধারে বীরসেন, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে সুভগসেন প্রমুখ স্থানীয় শাসক নিজেদের স্বাধীন করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সালিসুখের পরে বৃহদ্রথ সিংহাসনে বসলেও, পাটলিপুত্রের গৌরব তখন সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে ছোট পরিসরের মধ্যে বাঁধা পড়েছিল। পুরাণ ও বানভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বৃহদ্রথের সেনাপতি পুয্যমিত্র সুঙ্গ এক ষড়যন্ত্র দ্বারা বৃহদ্রথকে হত্যা করে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭ অব্দ) মৌর্য শাসনের অবসান ঘটান এবং পাটলিপুত্রে সুঙ্গবংশের শাসন শুরু হয়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পরেও ভারতের কোন কোন অংশে মৌর্যবংশীয় শাসকদের অস্তিত্ব ছিল। হিউয়েন সাঙ অশোকের বংশধর পূর্ণবর্মনের কথা উল্লেখ করেছেন। শশাঙ্ক কর্তৃক বোধিবৃক্ষ ছেদনের পর পূর্ণবর্মন তা পুনঃস্থাপিত করেছিলেন। মগধকে কেন্দ্র করে তিনি রাজ্যপাট গড়ে তুলেছিলেন। রাজপুতানা অঞ্চলে জনৈক ধবল রাজ্য স্থাপনা করেছিলেন। ইনিও মৌর্যবংশসম্ভূত ছিলেন বলে রাজস্থান কাহিনী থেকে অনুমিত হয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment