মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন [আনুঃ খ্রিঃ পূঃ ৩২৪-১৮৭]

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন [আনুঃ খ্রিঃ পূঃ ৩২৪-১৮৭]” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন [আনুঃ খ্রিঃ পূঃ ৩২৪-১৮৭]

ভারত ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে মৌর্য বংশের শাসন (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫-১৮৫ অব্দ) পর্বটি চিহ্নিত হয়। ভিনসেন্ট স্মিথ মৌর্যকালীন ভারতকে ‘অন্ধকার থেকে আলোকে’ (darkness to light) উত্তরণের কাল বলে উল্লেখ করেছেন। মৌর্য সাম্রাজ্যই ছিল ভারতে প্রথম ‘সর্বব্যাপী রাজতন্ত্র। চন্দ্রগুপ্ত থেকে শুরু করে মৌর্য সম্রাটের সংখ্যা দশ। তবে শেষ দিকের সম্রাটদের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। পরবর্তীকালেও স্থানীয়ভাবে নিজেদের সম্ভ্রান্ত বংশীয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক কোন কোন শাসক মৌর্য বংশীয় বলে দাবি করতেন। যাই হোক প্রায় একশ চল্লিশ বছর ধরে মৌর্য শাসকরা ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ভারতীয় রাজন্যদের আঞ্চলিক কর্তৃত্ববাদের প্রবণতা বিনাশ করার পাশাপাশি তাঁর কার্যকরভাবে বিদেশী শত্রুদের মোকাবিলা করেন। ভারতের গণ্ডী ছাড়িয়ে বহির্জগতের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ যোগ স্থাপনের কাজেও মৌর্য শাসকদের কৃতিত্ব প্রশসংনীয়। সিরিয়ার সেলুকাস ও এ্যান্টিওকস, মিশরের টলেমি, ম্যাসিডোনিয়ার অস্টিনোগস, নেপাল ও সিংহল প্রভৃতি দেশের শাসকদের সাথে মৌর্যদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ‘সাংস্কৃতি দূত ( cultural ambassador) হিসেবে তাঁরা বিশ্বের নানা প্রান্তে ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন।

প্রাক্ মৌর্য ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সাহিত্যমূলক উপাদানের অপ্রতুলতা মৌর্যযুগে কিছুটা কম। দেশীয় ও বৈদেশিক নানা সাহিত্য ও বিবরণী থেকে মৌর্যকালীন ভারতের নানা তথ্য পাওয়া যায়। উপরন্তু এগুলির অনেকটাই মৌর্যদের সময়কালে বা নিকটবর্তী সময়ে লিখিত হবার কারণে এদের নির্ভরযোগ্যতাও তুলনামূলকভাবে বেশি। সাহিত্যমূলক উপাদানগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য, ধর্মীয় সাহিত্য এবং বৈদেশিক বিবরণ।

ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যগত উপাদানের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র এবং বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস। কৌটিল্য ছিলেন সম্ভবত মৌর্য শাসনের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী ও গুরু। তিনি চাণক্য ও বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রায় ছয় হাজার শ্লোক সমৃদ্ধ অর্থশাস্ত্র পনেরটি অধিকরণ (section) ও একশো আশিটি প্রকরণে (sub-divisions) বিভক্ত। এই গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বিষয়টি হল রাজনীতির আদর্শ ও রাজার কর্তব্য। এখানে রাজাকে ‘প্রজার সুখে সুখী’ হবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সামরিক ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা, কর নীতি ইত্যাদি প্রশাসনিক নীতি ও কর্তব্যের বিস্তারিত আলোচনা সন্নিবিষ্ট আছে। তাই মৌর্য শাসনের একটি অতি-নির্ভরযোগ্য সূত্র হয়ে ওঠার সকল গুণ এই গ্রন্থের আছে। তবে ঐতিহাবাদী ঐতিহাসিকদের অভিমত বর্তমানের সংশোধনবাদী ইতিহাস চর্চায় কিছুটা দুর্বল প্রতিপন্ন হয়েছে। ট্রাউটম্যান (T. R. Troutman) তাঁর কৌটিল্য এন্ড দা অর্থশাস্ত্র শীর্ষক গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে, অর্থশাস্ত্র কোনও একক ব্যক্তির রচনা নয়। তাই এটির নির্দিষ্ট রচনাকাল স্থির করা সম্ভব নয়। মোটামুটিভাবে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের আগে এর রচনা সম্পূর্ণ হয়নি। তাই অর্থশাস্ত্রের ইতিহাসগত নির্ভরযোগ্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। তবে অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের রচনাকাল খুব প্রাচীন, সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের। তাই এই অংশটিকে মৌর্যকালীন ভারতের ইতিহাস-সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায়। বিশাখদত্তের ঐতিহাসিক নাটক মুদ্রারাক্ষস একইভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সংস্কৃত ভাষায় লেখা শ্রেষ্ঠ নাটক মুদ্রারাক্ষস-এর বিষয়বস্তু হল ধননন্দের অনুগত মন্ত্রী মুদ্রারাক্ষস-এর মন পরিবর্তন করে চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে আনার ক্ষেত্রে চাণক্যের কৃতিত্বের নাট্যরূপ। আর্থ-সামাজিক সূত্র হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে মুদ্রারাক্ষসও মৌর্যদের সমকালীন রচনা নয়। এর রচনাকাল আনুমানিক সপ্তম শতক। তাই এর মধ্যেও কল্পনার আধিক্য থাকা স্বাভাবিক।

ধর্মীয় সাহিত্য-সূত্র হিসেবে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য চন্দ্রগুপ্তের জীবন ও সময়কে অনেকটা আলোকিত করে। বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল সিংহলীয় দীপবংশ ও মহাবংশ। এছাড়া দীপবংশটীকা ও মহাবোধিবংশ থেকেও নানা তথ্য পাওয়া যায়। সম্রাট অশোক স্বয়ং বৌদ্ধধর্মের অনুগামী ও প্রচারক ছিলেন। তাই বিভিন্ন বৌদ্ধ কাহিনীতে এবং বিশেষ করে নিবেদন সাহিত্য সমূহে অশোক প্রসঙ্গে আলোচনা স্থান পেয়েছে। জৈন গ্রন্থের মধ্যে পরিশিষ্টপার্বন-এর নাম উল্লেখ্য। জৈন ধর্মের প্রতি চন্দ্রগুপ্তের অনুরাগের প্রেক্ষাপট এখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। কিছু পুরাণ গ্রন্থ যেমন বিষ্ণুপুরাণ, মৎসপুরাণ, বায়ুপুরাণ মৌর্যদের সম্পর্কে নানা তথ্য প্রদান করে। অশোক পরবর্তী শাসকদের পরিচয় জানার জন্য পুরাণের বিবরণের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে এগুলিও পরবর্তীকালের রচনা, তাই এদের ইতিহাসগত মূল্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। বৈয়াকরণ পতঞ্জলি মৌর্যশাসনকালের শেষ দিকের মানুষ ছিলেন। তাই তাঁর মহাভায্য থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া সম্ভব। তামিল লেখক মামুলনারের রচনাতেও মৌর্যদের প্রসঙ্গ বার বার উল্লেখিত হয়েছে।

তুলনামূলকভাবে বহিরাগত গ্রীক লেখকদের রচনাগুলি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। জনৈক গ্রীক স্যান্ড্রাকোট্রাস বা এ্যান্ডাক্রোট্রাম এবং ভারতীয় চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে বার্তা বিনিময়ের দলিলের নিরিখে স্যার উইলিয়াম জোস চন্দ্রগুপ্তকে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের সমসাময়িক বলে গ্রহণ করেছেন। এখান থেকেই মৌর্যশাসনের কালানুক্রম সম্পর্কে ধারণা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। আলেকজান্ডারের সেনাপতি নিয়ারকস। নিয়ারকসের নৌ-অভিযানের সহকারী ওনে সিক্রিটাস এবং গ্রীক সাহিত্যকার এ্যারিস্টোবুলাস তাঁদের বিবরণীগুলিতে ভারত সংক্রান্ত নানা বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা মৌর্য শাসনের প্রথম পর্বের ইতিহাস সূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ-বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল। গ্রীকদূত মেগাস্থিনিসের বিবরণ। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে তিনি চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলিপুত্রে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক ইন্ডিকা গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। তবে ইন্ডিকা গ্রন্থটি পাওয়া যায় নি। পরবর্তীকালে স্ট্র্যাবো, ডায়োডোরাস, প্লিনী, এ্যারিয়ান, প্লুটার্ক ও জাস্টিন-এর রচনা থেকে ইন্ডিকার কিছু বিষয়বস্তু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে ইন্ডিকার বিষয়বস্তুও হুবহু গ্রহণ করা সঠিক নয়। কারণ এর বক্তব্যের নানাস্থানে স্ববিরোধীতা আছে। তিনি এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যা বাস্তবসম্মত নয়। সম্ভবত প্রাচীন উপাখ্যান এবং জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করার কারণে এই বিপত্তি ঘটেছে। তবে সাবধানতার সাথে গ্রহণ করলে ইন্ডিকা নিঃসন্দেহে মৌর্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

মৌর্য-ইতিহাসের উপাদানগুলির মধ্যে সর্বাধিক প্রামাণ্য হল অশোকের অনুশাসনগুলি। অশোকের অনুশাসনের সংখ্যা অনেক এবং এগুলির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রনীতি, রাজাদর্শ, জনগণের কর্তব্য ইত্যাদি প্রশাসনিক ও নীতিগত বিষয়ক অনুশাসনের সংখ্যা পঁয়ত্রিশটি। এর মতে চৌদ্দটি মুখ্য গিরিশাসন, সাতটি মুখ্য স্তম্ভশাসন, দুটি গৌণ গিরিশাসন, চারটি গৌণ স্তম্ভশাসন, দুটি পৃথক গিরিশাসন এবং অন্যান্য সমজাতীয় অনুশাসন গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া অশোকের পৌত্র দশরথের নাগার্জুনী গুহা লেখ এবং সৌরাষ্ট্রের রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখ মৌর্যকালীন ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অংক চিহ্নিত রৌপ্যমুদ্রাসমূহ এবং উৎখনন থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রীও মৌর্যযুগের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment