আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো
ছোটোগল্প ও উপন্যাসের মধ্যে যে প্রভেদ, তা কেবল আকারগত নয়, অনেকটা প্রকৃতিগত। ছোটোগল্পের আয়তন ক্ষুদ্র, সেইজন্য এর আর্টও স্বতন্ত্র। মাত্র দু-চারটি চরিত্র ও জীবনের কোনো খণ্ডাংশ নিয়ে ছোটোগল্প রচিত হয়। রবীন্দ্রসাহিত্যে মানুষ একা কখন সম্পূর্ণ নয়,—তার প্রতিবেশ, বিশেষ করে নিসর্গ মনুষ্যচরিত্রকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ একটি এমনই গল্প যার সঙ্গে মিশে রয়েছে অটুট প্রকৃতি। তার বেদনা নিসর্গে স্পন্দিত।
নামকরণের ব্যাপারে লেখকের একটা অভিপ্রায় থেকেই থাকে, হতে পারে সে চরিত্রধর্মী বা ঘটনাধর্মী। নামকরণের মধ্যে তাঁর একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে, যা পাঠক গল্পটি পড়ে সহজেই রসগ্রহণ করতে পারে। আমাদের আলোচ্য ‘সুভা’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথের একটি চরিত্রধর্মী নামকরণ। একেবারে সাদামাঠা ভাবে কোনো ইঙ্গিত বা অস্পষ্টতার ছাপ না রেখে তিনি গল্পের নামকরণ করেছেন। এখানে সরাসরি তিনি কাহিনিবৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। গল্পের প্রধানতম চরিত্রটিকে বেষ্টন করে গল্পকে পল্লবিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রধানত কয়েকটি উপায়েই তিনি আমাদের প্রাত্যহিক সাধারণ জীবনের উপর রোমান্সের অসাধারণ দীপ্তি এনে দিয়েছেন— (১) প্রেম (২) সামাজিক জীবনে সম্পর্কবৈচিত্র্য (৩) প্রকৃতির সহিত মানবমনের নিগূঢ় অন্তর যোগ (৪) অতিপ্রাকৃতির স্পর্শ। ‘সুভা’ গল্পটি তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সুভা গল্পটি ছুটি গল্পের পরবর্তী মাসে লিখিত। পিঠোপিঠি গল্প দুটি যেন একই ভাবের এপিঠ-ওপিঠ। মূঢ় ফটিক পল্লিজননীর কোল ছেড়ে এসে কেমন যেন অসহায় ও বিব্রত হয়ে পড়েছিল। এটা ঠিক তার মৃত্যুর কারণ না হলেও তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত ও নিষ্ঠুর করে তুলেছিল। বাবা বালিকা সুভা পল্লির গাছপালা পশুপাখির সঙ্গে মিলে একরকম সুখেই ছিল, অন্তত দুঃখ কাকে বলে ঠিক জানত না। এমন সময় বিবাহোপলক্ষ্যে শহরে আনীত করে বোবা বালিকা সুভা একেবারে সত্যসত্যই মূঢ় হয়ে পড়ল। ওইখানেই তার মৃত্যু ঘটল—ইহার পরে কায়িক মৃত্যু ঘটানো বাহুল্য মাত্র।
‘সুভা’ গল্পটিতে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে সুভাকে অঙ্কন করে প্রকৃতির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। প্রকৃতি ও সুভা যেন অদ্বৈত সত্তা। তাকে কেন্দ্র করে সমস্ত চরিত্র সমগ্র প্রতিবেশ, কাহিনি বিভিন্ন অংশ আবর্তিত হয়েছে, প্রকৃতির সঙ্গে তাকে সমার্থক দেখাবার জন্য তার মনোজগতের ভাষার পূর্ণতা দিয়েছেন প্রকৃতির সাযুজ্যে। রবীন্দ্রনাথের এখানে মূলত কবিপ্রতিভা ও কবিসুলভ সুক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি ঔপন্যাসিকের সহায়তা বিধানে অগ্রসর করেছে। তিনি স্বভাবসিদ্ধ কবিত্ব শক্তির বলে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার সহিত বিশাল বহিঃপ্রকৃতির একটি নিগূঢ় সম্বন্ধ স্থাপন করে অতি সাধারণ তুচ্ছ ঘটনাকে আশ্চর্যরূপে রূপান্তর সাধন করেছেন।
সুভ ও তার প্রকৃতির অনুষঙ্গে যে সমস্ত পার্শ্ববর্তী চরিত্রগুলি এসেছে তা নেহাতই অনুম্বল। কেননা তাদের উপস্থিতি মূল চরিত্রটিকে স্ফুটতর করার উদ্দেশ্যেই, সেই সব চরিত্রেরা তাঁদের কর্তব্যকর্ম সাধন করেছে সুভাতে সম্পূর্ণত দেখাবার মধ্যে দিয়ে। চরিত্রের পাশাপাশি ঘটনাপ্রবাহ বিস্তৃত হয়েছে সুভার পরিণাম-অভিমুখী। এমন কোনো বিষয় ঘটনার অন্তর্ভূক্ত হয়নি, যা সুভার জীবনবৃত্তান্তকে আরও স্পষ্ট ; আরও উজ্জ্বল করে তুলতে সাহায্য না করেছে। সুভাকে শীর্ষে তুলে ধরার বস্তুত কারণ তাই। সুভা নামকরণ দিয়ে লেখক গল্পটি শুরু করেছেন প্রসঙ্গত সুকেশিনী ও সুহাসিনী—ভগ্নিদ্বয়ের নামোল্লেখের একমাত্র কারণ এ পৃথিবীতে সুভার আগমনবার্তা জানানো, সুভাষিণী নামের বিদ্রুপাত্মক বিবরণ দানও তাঁর উদ্দেশ্য—সুভা সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখের অপরাপর ভগ্নির কথা তুলেছেন লেখক। নতুবা এরা গল্পের পক্ষে বাহুল্যই। এখান থেকেই সুভার যাত্রা শুরু অর্থাৎ গোটা কাহিনিটির বাহক সেই।
তাকে আশ্রয় করেই একটি উপাখ্যান বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ হতে চলেছে। ধীরে অথচ নিশ্চিত লক্ষ্যে। বিধাতার অভিশাপরূপে বাণীকণ্ঠবাবুর গৃহে তার জন্ম হয়েছিল। তাকে সাধারণ কৌতূহলের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব মাতা-পিতার ওপর বর্তেছিল, তারা যে সমাজের কাছে কতখানি অসহায় এবং ভারস্বরূপ কাহিনি শেষে তার পরিচয় মেলে। বাকহীন কন্যাকে মা জন্ম দিয়ে নিজেকে কলঙ্কের ভার হিসেবে মনে করে নিজে প্রসন্ন ছিলেন না। এইসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল সুভা, সে-ই যে পরিবারের সমগ্র অশান্তির মূলে এ-কথা ভুলে যাওয়া একটা মুক মেয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রতিবাদের জন্য লাগে ভাষা, সেটিই তার ছিল না সমাজে যে, সে একেবারে অচল নয় একথাটি বোঝাতে পারছিল না। তার মতো মেয়েরও যে সমাজে প্রয়োজন আছে একথাটি সমাজের আর অন্য সবাই ভুলে ছিল।
এই ব্যাখ্যার পরেই লেখক সুভার গ্রাম চণ্ডীপুর, তার ভৌগোলিক অবস্থান, বাণীকণ্ঠবাবুর গৃহ, তার বাঁখারি বেড়া, আটচালা, গোয়ালঘর, ঢেঁকিশাল, খড়ের স্তূপ, তেতুঁল তলা, আম কাঁঠাল-কলার বাগানে প্রভৃতির বর্ণনা একারণে দিয়েছেন। এতসব আয়োজনের মধ্যে সুভা কোনো অর্থে দৃষ্টি আকর্ষক ছিল না। বহুকর্মের অবসরে তার নদীতীরের এসে বসা, সেই নদীতীর কাহিনিতে উজ্জ্বলতাপ্রাপ্ত হয়েছে সুভার সঙ্গে তাঁর সখ্যের কারণে, তার জীবনের অঙ্গীভূত বলেই। প্রকৃতির যে বর্ণনা চণ্ডীপুর প্রসঙ্গে এসেছে তা-ও সুভার অনুষঙ্গে। সুভার পরেই গল্পে বিশিষ্টতা লাভ করেছে চণ্ডীপুরস্থ প্রকৃতি—মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান, দুয়ে মিলে সম্পূর্ণতা গল্পে সেটাও উল্লেখ্য। গাভীদ্বয়ের নামোল্লেখ সঙ্গীহীন সুভার সঙ্গীরূপেই এমন যে অকর্মণ্য প্রতাপ, যার কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই নেই—সেও সুভার নীরব সঙ্গীরূপে গল্পে স্থান পেয়েছে। এমনিভাবে গল্প জুড়ে সুভা, সুভাকে জুড়েই গল্পের যা কিন্তু আবর্তন বিবর্তন কালের অমোঘ নিয়মে তার বয়স বাড়ে, পল্লিসমাজের নিয়মানুযায়ী সে বয়সেই পাত্রের সন্ধান, ‘সময়মতো’ বিবাহ না হওয়ার কারণে এক ঘরে হওয়ার আশঙ্কা। তারপর তাকে নিয়ে কলকাতা গমন এবং স্বামীর পুনর্বিবাহ—এভাবে সুভা কেন্দ্রিক গল্পের বৃত্ত সম্পূর্ণ। এরপরে নামকরণের ক্ষেত্রে অন্য কিছুর কথা লেখকের মনে উদয় হয়নি। ব্যক্তি ছেড়ে, বিষয় হোক, যাকে কেন্দ্রীয় সংস্থাপন বলা থাক না কেন, তার উৎস সুভা ভিন্ন আর কিছু হওয়ার কোনো কারণ নেই। এসব দিকে লক্ষ্য রাখলে নামকরণের যাথার্থ্য বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ থাকে না।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।