সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যে পালি-প্রাকৃত ভাষা সাহিত্য ও তামিল সাহিত্য

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যে পালি-প্রাকৃত ভাষা সাহিত্য ও তামিল সাহিত্য” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যে পালি-প্রাকৃত ভাষা সাহিত্য

সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের বিচারে পালি ও প্রাকৃত ভাষা ও সাহিত্যের অবস্থান রাতের আকাশে চন্দ্র ও নক্ষত্রদের মত। তবে ধর্ম গ্রন্থের মাধ্যম হিসেবে পালি ভাষার ব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজকীয় নির্দেশনামা পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে পালি ও প্রাকৃত ভাষার অবদান স্মরণীয়। পালি সাহিত্য বলতে প্রধানত ধর্মগ্রন্থ বোঝায়। বিশেষ করে পালি সাহিত্য বৌদ্ধধর্ম পুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পালিতে অঙ্ক, জ্যোতিবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, নাটক বা উপন্যাস নেই বললেই চলে। সিংহলী ইতিবৃত্তের অন্যতম গ্রন্থ ‘মহাবংশ’ পালি ভাষায় লেখা বিবরণমূলক কবিতার অন্যতম দৃষ্টান্ত। বৌদ্ধ ধর্মপুস্তকের মূলগ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’। ‘পিটক’ শব্দের অর্থ ঝুড়ি বা পেটিকা। ত্রিপিটক হল তিনটি পেটিকা—বিনয় পিটক, সুত্ত পিটক ও অভিধম্ম পিটক। বিনয় পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের পালনীয় নিয়ম কানুন লিখিত আছে। সুত্ত পিটকের বিষয় বুদ্ধের ধর্মমত এবং অভিধৰ্ম্ম পিটকে আছে বুদ্ধের ধর্ম মতের দার্শনিক ব্যাখ্যা। সুত্ত পিটকের পাঁচভাগ। এগুলি হল, দিঘনিকয়, মজঝিমনিকয়, সমযুক্তনিকয়, অঙ্গুত্তরনিকয় এবং ক্ষুদ্দকনিকয়। দিঘনিকয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘মহাপরিনিব্বান সুত্তে’ বুদ্ধের শেষ জীবনের করুন বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। মজঝিম নিকয়ের বিষয় বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের জীবনযাপন পদ্ধতির পরামর্শ। সমযুক্তনিকয় মূলত দার্শনিক আলোচনা। অঙ্গুত্তরনিকয় ব্যবহারিক জীবনের পরামর্শ। ক্ষুদ্দকনিকয় বেশিরভাগ পদ্যে লেখা। ‘ক্ষুদ্দকনিকয়’ নামক এক ভাগের অন্তর্ভুক্ত দ্বিতীয় পুস্তক ‘ধম্মপদ’-এ বুদ্ধের অতিমহান উপদেশগুলি সংকলিত আছে। উইনটারনিজের মতে ত্রিপিটক সংগৃহীত হয়ে প্রথমে মুখে মুখে এক থেকে অন্যজনের কাছে যেত। পরে সিংহলের রাজা ভট্টগামনীর সময় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে লিপিবদ্ধ হয়। এইভাবে পালি ত্রিপিটকের সৃষ্টি হয়েছিল। সিংহলীয় ঐতিহ্যের সত্যতা প্রমাণিত নয়। তবে মৌর্য সম্রাট অশোকের লেখমালা এবং সাঁচি ও ভারহূত স্তূপের লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম তিন শতকে পালি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের অস্তিত্ব ছিল। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে যাঁরা জ্ঞানে ও সদ্গুণে সমৃদ্ধ তাঁদের ‘থেরা’ (বৃদ্ধ) ও ‘থেরী’ (বৃদ্ধা) বলা হত। তাঁদের লেখা উচ্চাঙ্গের ভক্তিভাবে সমৃদ্ধ পুস্তক ‘থেরা-থেরী গাথা’ নামে খ্যাত। উচ্চ ধর্মভাবের পাশাপাশি এই সব রচনার কাব্যরসও মনোমুগ্ধকর (দৃষ্টান্তঃ ফুলেরে না করি ক্ষত, না নাশি বরণ / না হরি সুবাস তার / ভ্রমর যেমন / ফুল হতে ফুলে করে মধু আহরণ / সুধা তথা ধরা মাঝে / কর বিচরণ।)

বুদ্ধের জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা ‘জাতক’ গ্রন্থগুলি পালি ভাষা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। গল্প ছন্দে লেখা জাতকগুলি থেকে সমাজ ও অর্থনৈতিক অবস্থারও আভাস পাওয়া যায়। জাতকের রচনাকাল স্পষ্ট নয়। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে এগুলি সংকলিত হয়েছিল। পালি ভাষায় আর একটি বৌদ্ধ গ্রন্থ হল ‘মিলিন্দ পঞহো’ বা ‘মিলিন্দের প্রশ্ন’। বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগসেনের সাথে রাজা মিনান্দারের কথোপকথন এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এটিও খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে সংকলিত হয়েছিল। পালি ভাষায় লেখা আরো দুটি টিকা ভাষ্যমূলক গ্রন্থ হল ‘নেত্তিপকরণ’ ও ‘পেতোকপদেশ’। প্রাকৃত ভাষায় সাহিত্য বিশেষ রচিত হয়নি। জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতদের আনুকূলে কিছু কাজ হয়েছিল মাত্র। রাজা হাল রচিত ‘গাথাসপ্তশতি’, এবং গুণাঢ্য রচিত ‘বৃহৎকথা’ ব্যতিক্রমীরূপে উন্নত মানের ছিল। এগুলিতে দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনের সুখদুঃখ, ভালবাসা-বিরহ, দারিদ্র্য ইত্যাদি সুন্দরভাবে তুলে ধরার চেষ্টা আছে। ‘গাথাসপ্তশতি’তে পূজাপার্বন, ভৌগোলিক বিবরণ, দেশাচার, শিল্পকর্ম, নৃত্য, নাটক ইত্যাদি যে দক্ষতার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সমকালের উন্নত সংস্কৃতি মনস্কতার সাক্ষ্য দেয়। গুণাঢ্যের ‘বৃহৎকথা’ নানা কাহিনীর সমাবেশ। মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে এটির সংস্কৃতে অনুবাদ পাওয়া যায়।

সম্রাট অশোকের লেখর ভাষা প্রাকৃত। সাধারণ মানুষের সহজ বোধগম্যতার জন্য তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের লেখগুলিতে কথ্যভাষা বা প্রাকৃত ব্যবহার করেছিলেন। এগুলি সরকারী নির্দেশমূলক বক্তব্য কিংবা সম্রাটের তরফে প্রজাসাধারণের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক বক্তব্য ছিল। তাই সাধারণের কথ্য ভাষা ব্যবহারে অশোক জোর দিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ শতকে ভারতের অভ্যন্তরে প্রায় দেড় হাজার প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ণ লেখ পাওয়া গেছে। তুলনায় সংস্কৃতভাষার লেখ খুবই কম। দ্বিতীয় শতক থেকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ব্যাপকতার কারণে এই সব ধর্মমতের পুঁথিগুলিতেও প্রাকৃতভাষা ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছিল।

গুপ্তযুগে পালি-প্রাকৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চা মূলত জৈন ও বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জৈন সাহিত্যে মূলত জৈন তীর্থঙ্কর, ধর্মস্থান, জৈন ভিক্ষু, জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক রাজা বা বণিকদের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি হল পালি ভাষায় লেখা টিকাসমূহ। তবে কোনো পালি সাহিত্যই আকর্ষণীয় ছিল না। পালি ভাষায় লেখা একটু স্বতন্ত্র ধরনের বিষয় পাওয়া যায় ধর্মদাস ও সংঘদাস রচিত বাসুদেব কাহিনীতে। এমনই আর একটি পালি রচনা ‘তরঙ্গবতীকথা। এটির লেখক ছিলেন পাদলিপ্ত। এছাড়া জৈন ন্যায় ও দর্শন বিষয়ে প্রাকৃত ভাষায় লেখা গ্রন্থ ‘সম্মতিতর্ক সূত্র’ গুরুত্বপূর্ণ। এর লেখক ছিলেন সিদ্ধসেন।

প্রাকৃত ভাষায় কাব্য রচনার প্রয়াসও সেকালে দেখা যায়। এমন দুটি কাব্যগ্রন্থ হল প্রবরসেন-এর ‘সেতুবন্ধ’ এবং বাকপতিরাজ এর ‘গৌড়বহো’। প্রবরসেন কাশ্মীরের রাজা ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। আবার কারো কারো মতে, তিনি ছিলেন বাকাটক বংশের বিখ্যাত রাজা প্রবরসেন। সেতুবন্ধ কাব্যের কাহিনী রামায়ণকে ভিত্তি করে গড়া হয়েছে। ‘গৌড় বহো’ রচিত হয়েছিল আনুমানিক ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে। এতে রাজা যশোবর্মনের কীর্তি কথা আলোচিত হয়েছে। তাই কাব্যগুণের থেকে এর ইতিহাসগত চরিত্র জোরালো। তবে প্রাকৃতিক বর্ণনার অপরূপ মুন্সিয়ানা এই কাব্যের অন্যতম বিশেষত্ব ৷ পালি-প্রাকৃত ভাষায় সাহিত্য চর্চার ধারা অনিবার্যভাবে ব্যাকরণ রচনাতেও দেখা যায়। ‘বররুচি’ লিখিত ‘প্রাকৃত প্রকাশ’ এবং চন্দ্রনোমিনের ‘প্রাকৃত লক্ষ্মণ’ প্রাকৃত ভাষায় দুটি আদি ব্যাকরণ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। সম্ভবত কাত্যায়ন পালি ভাষায় ‘কাত্যায়ন প্রকরণ’ নামে একটি ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। স্বয়ম্ভু রচিত ছন্দ বিষয়ক গীতি কবিতা সেকালের পালিভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত হয়।

সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যে তামিল সাহিত্য :

খ্রিষ্টপূর্ব কালের শেষ দিক থেকে সুদূর দক্ষিণ ভারত প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ শুরু করেছিল। অশোকের শিলালেখ থেকে প্রাচীন দাক্ষিণাত্যে চের, চোল, পাণ্ড্য বংশীয় তামিল রাজাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুদূর দক্ষিণের প্রাচীনকাল ‘সঙ্গম যুগ’ নামে পরিচিত। প্রাচীন তামিল সাহিত্যের সূচনা খ্রিষ্টীয় শতকের গোড়ার দিকে হয়েছিল মনে করা হয়। প্রাচীনতম তামিল সাহিত্য ‘সঙ্গম সাহিত্য’ নামে পরিচিত। মাদুরাইকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাণ্ড্য রাজ্যে আদি তামিল সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। ‘সঙ্গম’ কথার অর্থ তামিল কবিদের সম্মেলন বা সভা। তামিল ঐতিহ্য অনুসারে মাদুরাই নগরীতে তিনটি সাহিত্য সঙ্গমের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম অধিবেশনে দেবতাগণ উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনের সাথে যুক্ত সকল কবিতা ধ্বংস হয়ে গেছে। দ্বিতীয় অধিবেশনের সৃষ্টি একটি প্রাচীন তামিল ব্যাকরণ ‘তোলকাপ্পিয়ম’টিকে আছে মাত্র। তৃতীয় সংগমের কয়েকটি সংকলন গ্রন্থ ও মহাকাব্য পাওয়া যায়। এদের অন্যতম হল ‘এটুটোগাই’বা ‘আট সংকলন’। একে প্রাচীন তামিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মনে করা হয়।

খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে রচিত সঙ্গম সাহিত্য-বিষয়ক একটি টিকায় বলা হয়েছে যে, তিনটি সঙ্গমের মোট সময়কাল ছিল নিরানব্বই হাজার ন’শো নব্বই বছর। একশো সাতানব্বই জন পাণ্ড্যরাজা এই দীর্ঘ সঙ্গমের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এখানে সমবেত হয়েছিলেন সর্বমোট আট হাজার আটশো আটানব্বই জন তামিল কবি। এই বিবরণের সত্যতা ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন না। পাণ্ড্যরাজ্যের শাসনসীমার সাথে এই বক্তব্যের আদৌ মিল নাই। তবে এটি স্বীকৃত যে, পাণ্ড্যরাজাদের আনুকূল্যেই সঙ্গমগুলি আয়োজিত হয়েছিল। আনুমানিক ৩০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অধিকাংশ তামিল সাহিত্য সংকলিত হয়েছিল। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকেও তামিল সাহিত্যের কিছু অংশ সংকলিত হয়েছিল। দীর্ঘ সময় ব্যাপী সঙ্গম অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ধরে নেওয়া যায় যে, তামিল সাহিত্যগুলি পর্যায়ক্রমে সংকলিত হয়েছিল। সাহিত্যগুলির রচনাশৈলী, বিষয়বস্তু ও প্রত্নতাত্ত্বিক সাজুয্যের ভিত্তিতে পণ্ডিতেরা সঙ্গম সাহিত্যের সংকলনের স্তর নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন।

সঙ্গম সাহিত্যগুলিকে মোটামুটি দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়—আখ্যানমূলক ও উপদেশাত্মক। আখ্যান গ্রন্থগুলিকে বলা হয় ‘মেল্কনক্কু’। এই ভাগের মধ্যে আছে প্রধান আঠারোটি গ্রন্থ। উপদেশমূলক গ্রন্থগুলিকে বলা হয় ‘কিল্কনক্কু’। এর মধ্যে আছে আঠারোটি লঘু গ্রন্থ। এই দু’টি বিভাগের মধ্যে আছে ব্যাকরণ গ্রন্থ, কবিতা সংকলন ও মহাকাব্য। বালাবাহুল্য, সঙ্গম সাহিত্যের অধিকাংশ নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

‘এট্টুটোগাই’ কবিতা সংকলন প্রাচীন তামিল সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রতীক। তবে এর ভাষা বিন্যাস সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। তামিল অঞ্চলের বাইরের মানুষ এই সংকলনের সাথে বিশেষ পরিচিত নয়। এগুলির রচনাশৈলীতে ‘তোল কাপ্পিয়ম’ ব্যাকরণের নির্দেশ মানা হয়েছে ঠিকই, তথাপি বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়া আধুনিককালের শিক্ষিত তামিলরাও ‘এট্টুটোগাই’এর ভাষা পড়তে পারেন না। প্রকৃতিগতভাবে ‘আটসংকলন’ কবিতামালা দরবারী সংস্কৃত সাহিত্যের তুলনায় লোকসাহিত্যের নিকটতর। এখানে শাসক-অভিজাতদের পরিবর্তে গ্রামীণ কৃষক, তাদের জীবনধারা, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ইতিবাচক রূপে বর্ণিত হয়েছে। একই সাথে শহরের কলরব, যুদ্ধের নির্মমতা ইত্যাদি নিন্দিত হয়েছে। ‘এট্টুটোগাই’ নিঃসন্দেহে প্রাচীন তামিল কাব্য সাহিত্যের একটি স্মরণীয় নিদর্শন। এতে দুশতেরও বেশি কবির লেখা দু’হাজারের বেশি কবিতা সংকলিত হয়েছে।

‘পক্ষপাত্তু’ দশটি আখ্যানমূলক কবিতার সংকলন। এর কবিতাগুলি কিছুটা পরবর্তীকালের এবং তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ। তবে অষ্টাদশ শতকে শেষভাগের আগে পর্যন্ত তামিল জনগণের কাছে এই কবিতা সংকলনও অজানা ছিল। প্রাচীন তামিল কবিতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে নতুনও আছে। প্রাচীন তামিল কবিতায় দুটি প্রকৃতিগত বৈচিত্র্য ছিল। এক ধরনের কবিতাকে বলা হত ‘অগম’ বা অন্তরঙ্গ। এই শ্রেণীর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল প্রেম-বিরহ-মিলন ইত্যাদি। দ্বিতীয় শ্রেণীর কবিতাকে বলা হত ‘পুরম’ বা বহিরঙ্গ। এই শ্রেণীর কবিতা মূলত রাজপ্রশস্তি। লক্ষণীয় যে, তামিলনাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে কবিতাগুলির উৎস স্থল বা প্রয়োগ ক্ষেত্র বিচার করা হত। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে তামিল অঞ্চলকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়—পাহাড় অঞ্চল, বনভূমি, চাষযোগ্য সমভূমি, উপকূল অঞ্চল এবং শুষ্কভূমি। পাহাড়ের পটভূমিতে প্রাক্‌-বিবাহ প্রেমের কবিতা লেখা হত। বনভূমির পটভূমি ছিল বিরহ, বিচ্ছেদ ও মিলনের কবিতার উৎস। বিবাহ পরবর্তী প্রেমের পটভূমি ছিল সমভূমি অঞ্চল। উপকূল অঞ্চল ছিল মূলত মৎস্যজীবিদের জীবন কাহিনী কিংবা যুদ্ধের দৃশ্যপট। শুষ্কভূমি প্রেমিক-প্রেমিকার দীর্ঘ বিচ্ছেদ এবং গ্রামীণ জীবন ও সমাজ ভেঙে পড়ার কবিতার পটভূমি। ‘আট সংকলনের’ প্রতিটি কবিতা এই পাঁচটি বিভাগের যে কোন একটির সাথে জড়িত ছিল। তামিল কবিতার চার বা তার বেশি পংক্তির সূচনায় স্বরবর্ণের ধ্বনিসাদৃশ্য রাখা হত, যা সংস্কৃত ও সাহিত্যে ছিল না।

আদি তামিল সাহিত্যে আর্যদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কিছু প্রভাব অবশ্যই ছিল, তবে তা খুব নগন্য ও মার্জিত। পরবর্তীকালের তামিল সাহিত্যে আর্য সংস্কৃতি ও জৈন-বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মমতের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। আঠারোটি উপদেশ সম্বলিত ছোট ছোট কবিতার সংকলন গ্রন্থ ‘পদিনেনকীলকনক্লু’তে এই প্রভাব দেখা যায়। নীতিমূলক এই কবিতাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুটি হল ‘তিরুক-কুড়ল’ এবং ‘নালদিয়ার’। ‘কুড়ল’ রচনায় জীবন ও ধর্ম সম্পর্কে নানা উপদেশ পাওয়া যায়। যেমন—“সেই রাজ্য বৃথা, যেখানে সবকিছুই ভাল, কিন্তু শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রেম নেই।” কিংবা “ভালবাসার আনন্দ সমুদ্র সমান, কিন্তু বিচ্ছেদের বেদনা বিস্তৃততর”। নালদিয়ার তুলনামূলকভাবে অধিক কাব্যগুণসম্পন্ন। এর কবিতাগুলিতে উচ্চতর নৈতিক জ্ঞানের সমাবেশ দেখা যায়। যেমন, ‘প্রকৃত গৃহী তার খাদ্য বন্ধু ও শত্রুর সঙ্গে সমানভাবে ভাগ করে খায়। নির্গুণ ব্যক্তি যে একা খাদ্যগ্রহণ করে, সে কখনও স্বর্গের দরজা পার হতে পারে না’।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে তামিলভূমিতে আর্য সংস্কৃতির বিশেষ প্রসার ঘটলে, তামিল সংস্কৃতির উপর তার প্রভাব পড়ে। তামিল শাসকদের অনেকেই বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ছোট ছোট তামিল কবিতা রচনার ধারা পরিবর্তিত হয়। দীর্ঘ কবিতা লেখার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এইভাবে তামিল মহাকাব্যের সৃষ্টি হয়। তামিল মহাকাব্যের সংখ্যা দশ। এদের মধ্যে সাতটি পাওয়া গেছে। দু’টি বিখ্যাত তামিল মহাকাব্য হল— –‘শিলপদিকরম্’ এবং ‘মনিমেকলাই’। এগুলিকে সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের সাথে তুলনা করা হয়। ‘শিলপদিকরম্’(মনিভূষিত নূপুর) মহাকাব্য হল প্রতিকূল অবস্থায় বিপন্ন দুইজন সাধারণ মানুষের কাহিনী। অলংকার বর্জিত সহজ ভাষ্যে এটি রচিত। ভাগ্যবিড়ম্বিত দুই নরনারী কোবলন ও কন্নগির জীবন সংগ্রাম ও বিপন্নতার কাহিনী অতি বাস্তবসম্মত রূপে এখানে পরিবেশিত হয়েছে। এই কাব্য থেকে রাজপদ সম্পর্কে তামিলদের ধারণার আভাস পাওয়া যায়। রাজপ্রহরীরা অন্যায়ভাবে কোবলনকে হত্যা করলে, রাজার অনুশোচনা ও মানসিক যন্ত্রণার প্রকাশ রাজপদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে তামিলদের উচ্চধারণার প্রমাণ দেয়। ‘মনিমেকলাই’ মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য দার্শনিক বিতর্ক। নর্তকী মাদরির গর্ভজাত কোবলনের ঔরসজাত কন্যা মনিমেকলাই এই কাব্যের নায়িকা। দীর্ঘ ভাগ্য বিপর্যয়ের পর সেও মায়ের মত বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে ভিক্ষুণীর জীবন বেছে নিয়েছিল। নানাক্ষেত্রে বৌদ্ধদর্শন, নৈতিকতা ইত্যাদি আলোচনার মধ্য দিয়ে এই মহাকাব্যের ঘটনাবলী অগ্রসর হয়েছে। প্রাচীন তামিল মহাকাব্যের আর একটি জনপ্রিয় নাম হল ‘শিবগ-সিন্দামনি’। সংস্কৃত সাহিত্যের মতই এই কাব্যের রচনা অলংকারবহুল। কাহিনী বিন্যাস অনেকটাই অবাস্তব ও কল্পধর্মী।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment