সময়চেতনার ধারায় জীবনানন্দের সুচেতনা কবিতাটি কতখানি প্রাসঙ্গিক আলোচনা করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সময়চেতনার ধারায় জীবনানন্দের সুচেতনা কবিতাটি কতখানি প্রাসঙ্গিক আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

সময়চেতনার ধারায় জীবনানন্দের সুচেতনা কবিতাটি কতখানি প্রাসঙ্গিক আলোচনা করো

কবিতা রচনায় প্রাথমিক পর্যায়ে জীবনানন্দ দাশ সময় চেতনার কোনো পরিশীলিত মননের দ্বারা আলোকিত হয়ে ওঠেননি। তাঁর নিজের কথায় ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়চেতনা’ সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাব্যে। কিন্তু কবিতা রচনার পথে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ‘এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই। জীবনানন্দের কবিতায় সময়চেতনার যথাযথ ব্যাখ্যা তার নিজস্ব অভিমতেই খুঁজে পাওয়া যায়। “সময় প্রসূতির পটভূমিকায় জীবনের সম্ভাবনাকে বিচার করে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আস্থা লাভ করতে চেষ্টা করেছি।” (কবিতাপ্রসঙ্গ/ কবিতার কথা) তবে কবি সময় ও সীমা প্রসৃতির ভিতর সাহিত্যের পটভূমি বিমুক্ত দেখতে ভালেবাসতেন। যে আবহমান মানব সমাজকে প্রকৃতি ও সময়ের শোভা ভূমিকার অনাদি বিশেষত্ব হিসাবে একসময় স্বীকার করেছিলেন তাকেই একমাত্র উৎস নিরুক্তিরূপে মেনে নিতে পারেননি কবি।

নিজস্ব এই অভিমতগুলি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, সাধারণভাবে কবিতার ভাববস্তুর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব ছিল বলেই কবি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সময়চেতনার এই অখণ্ডতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। সময়চেতনার সহজ প্রসারতায় মানবের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে অনুপুঙ্খ অভিলাষ তাও পরিপূর্ণ হতে পারে জানিয়েছেন। এছাড়া কবিতার মৌলিক ভাবনার সঙ্গে প্রকৃতি ও সময়চেতনার যে একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বন্ধন বর্তমান—সেকথাও জানিয়েছেন। তবে জীবনানন্দের সময়চেতনার স্বরূপ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সংগ্রথিত রয়েছে দার্শনিক মনন, অতীত ইতিহাস, ইতিহাসের উপাদান, লোকপুরান, নারী এবং পৌরাণিক পরিমণ্ডল। সময় চেতনার সহজ ব্যাখ্যা তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বন্ধনে আবদ্ধ জীবনের রেখায় নয়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ভেদহীন নিত্যক্রিয়াশীলতায় সদা বিবর্তনশীল। আর এই বিষয়টিকে সঠিকভাবে পরিশ্রুত করতেই ইতিহাসবেদ ও সমাজবেদকে বারবার নিয়ে এসেছেন কবিতায়। এই ইতিহাস ও সমাজবেদের সংশ্লেষণ রীতিতেই কবিতার ভিতরে ভিতরে জীবনানন্দের কাণ্ডজ্ঞান পরিশোধিত হয়ে উঠেছে। তবে এই অনন্ত ও অব্যবহিতের বিষমানুপাতিক টানে দীর্ণ যে চিরন্তন মানবচেতনা তা কিন্তু কালসন্ধির নির্ণীত সত্যের স্পর্শে বেশ পরিবর্তিত। সময়ের সেতু তারা পার করে যেতে চায়। বহু শতাব্দীর ও জীবনের প্রয়োজনে আরও অনেক বেশি শশধীকের আলোয় স্পষ্ট এক শৃঙ্খলের পথেই তারা হাঁটতে থাকে।

তবে ইতিহাসকে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান বা সময়চেতনা থেকে পৃথক করেই দেখেছেন জীবনানন্দ। কারণ তার চিন্তায় ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়চেতনা’ হল অনন্ত বা অসীমকালের ইঙ্গিতবহ। আর ইতিহাসচেতনা মানবসভ্যতার একটা নির্দিষ্ট ধারা বা ওইরূপ ধারণার প্রবহমানতা। কাজেই যা কিছু এ জীবনের অবশিষ্ট, অর্থাৎ সত্তার অস্তিত্ব বা বর্তমান, নিত্য নয়, অনিত্যকালের চেতনায় বাঁধা মানবপ্রবাহের জীবন অভিজ্ঞতা তাই ‘সময়চেতনা’ নাম নিয়ে জীবনানন্দের কাব্যে প্রবিষ্ট। অনেকক্ষেত্রেই মনে হতে পারে ইতিহাসচেতনার একটি নির্দিষ্ট অনুবর্তনে কবির কাব্যে সময়চেতনার ধারাটি অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়, সময় চেতনার গর্ভগৃহ থেকেই উদ্বর্তিত জীবনানন্দের ইতিহাসবোধ। এর কারণ অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, অতীত ও ইতিবৃত্তের শিক্ষা, আধুনিকতার গ্লানি এবং অস্তিত্বের সংবেদী যন্ত্রণার মাঝখান থেকেই কবি জেনেছিলেন, সময় মানুষের মৃত্যুহীন অন্বেষার একমাত্র সার্থক রূপকার।

জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালকে’র কবিতাগুলিতেই সময়চেতনার এক স্বচ্ছ প্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। একাব্যের কতিাগুলিতে বিরাজিত নগর জীবনের প্রতিক্রিয়ার কবির স্বাভাবিক সংক্ষোভ। সমসাময়িক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রভাব রয়েছে। সময়ভাবনার এ জাতীয় প্রকাশে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাজ করেছে কালের অপরিমেয়তার এই বোধ। ‘ঝরাপালকে’র কাব্যভাষায় প্রবহমান মানব ইতিহাসের ভ্রাম্যমাণ যাত্রিক সত্তার একটি অনির্দেশ্য ধারণা পাওয়া যায়। চিরন্তন মানবের অন্বেষণ ক্লান্ত পথিক সত্তার ভার গৌরব এ কাব্যের ‘নাবিক’, ‘মরুপ্রান্তরের বন্ধনহারা যাত্রী’, যুগ-যুগান্তের অভিসারিক প্রেমিকের চিত্রকল্পে ধরা রয়েছে। আসলে এই পর্বের কবিতাগুলিতে সময় চেতনার সামান্য উদ্ভাস লক্ষ করা গেলেও কোনো প্রজ্ঞালালিত কালজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় না।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়েও কবির সময়চেতনা বিশেষভাবে প্রতীকী হয়ে ওঠেনি, মুগ্ধ নিসর্গের আবিষ্টতায়, সময় যেন সংহারকের বেশে আবির্ভূত এখানে। মনে হয় কবি যেন অনেকটাই সমসাময়িক চেতনা বা সামজপরিস্থিতির পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা আর্ত। যা কিছু প্রিয় ও সুন্দর, সময়ের হাতে তার অনিবার্য বিনাশের বেদনা কবিচিত্তকে বেদনাহত করেছে। মর্ত্যপ্রীতি ও মৃত্যুচেতনা—এই দুই পরস্পর বিরোধী বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়া—কবিচেতনায় কাজ করছে এপর্যায়ে। এই নিরন্তন বিষাদ ও বিলয়ের মাঝখানে কবি উপলব্ধি করেছেন বাস্তবের সঙ্গে, পার্থিবের সঙ্গে স্বপ্ন বা দিব্য অস্তিত্বের ব্যবধান। তবে মৃত্যুর গাঢ়ছায়ায় পাশাপাশি এখানে প্রেম ও সৃষ্টির অবিনাশী কালজয়ী মহিমা স্বীকৃত। সময় এখানে সংহারক হলেও কালজয়ী সৌন্দর্যের স্বরূপ জীবনানন্দের কবিমনটিকে স্পর্শ করেছিল।

“সময় মুছিয়া ফেলে সব 

সময়ের হাত

সৌন্দর্যেরে করে না আঘাত 

মানুষের মনে যে সৌন্দর্য জন্ম লয়

—শুকনো পাতার মত ঝরে নাক বনে।”

‘ঝরাপালক’ ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র জগৎ অতিক্রমের পর কবি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্য পর্যায়ে এলেন। অনেক সমালোচকের মতে ‘রূপসী বাংলা’য় কবির সময় চেতনার অনুষঙ্গ তেমন বর্তমান নয়, কিন্তু যে চিরন্তর বাংলাদেশের ছবি এখানে তিনি এঁকেছেন, সময় প্রকৃতির পটভূমিকা সেখানে সর্বদাই বিদ্যমান। চতুর্দশপদী গুচ্ছের আকারে কবি এখানে লিখলেন ‘সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে। এই স্বপ্ন প্রশস্তি কবি চেতনায় সময়ের অনুষঙ্গই এনে দেয়। বাংলাদেশের উজ্জ্বল নিসর্গচেতনা অতীতের প্রেক্ষাপটে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডল গড়ে তুললেও চিরন্তনের এই উপলব্ধি সময় চেতনার সঙ্গেই গভীর সম্পর্কযুক্ত।

‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে এরপর জীবনানন্দের সময়চেতনা অনেক বেশি গাঢ় হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির আঙ্গিক ‘হাজার বছরের’ চিত্রকল্পটিই নয়, ‘পথ হাঁটা’ কবিতার ‘বেবিলনে একা-একা এমনই হেঁটেছি’র মতো বহু রূপকথাগুলি অখণ্ড সময় চেতনার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কিছু কিছু কবিতায় বিষণ্ণতার আবিলতায় মোড়া একটি সময়কে কবি নদীর জল, দুপুরের পরিপূর্ণ জীবনের প্রতীকে মুড়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মনে আসে ‘আমাকে তুমি’ কবিতাটির কথা। আম, নিম, হিজল বাংলার অতিপরিচিত ফুল গাছ পাখিদেরকেও কবি কতখানি অনায়াস দক্ষতায় সময়ের ব্যাপ্তি দিয়েছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের একাধিক নারী নামাঙ্কিত কবিতাগুলিতেও কবির অখণ্ড সময়চেতনার সাক্ষ্য রয়েছে। ‘সুচেতনা’ কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। কবিতাটির শুরুতেই রয়েছে বিকেলের নক্ষত্রের কাছাকাছি দূরত্বের মতো সুচেতনার দূরতর ব্যাপ্তি। চল্লিশের দশকের উত্তাল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে মানবতার কাছে সহজলভ্য নয়। সে যেন মানবের অন্তর্লীন সত্তায় দূরতম দ্বীপের দারুচিনি বনানীর নির্জনতা। এই পৃথিবীর অজস্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, অত্যাচার-অবিচার, শোষণের প্রেক্ষিতে সুচেতনার গভীর আশ্বাস মানবের কাছে হয়তো দূরতর কিন্তু তার অস্তিত্বে কবির গভীর আশ্বাস। মানবের অক্লান্ত পরিশ্রম—কবির ভাবনায় যা রণ-রক্ত-সফলতার নামান্তর, সেইসব কিছুর পরেও এমন একটা কিছু রয়ে গেছে যা শেষ এবং একমাত্র সত্য নয়। সুচেতনার গভীরতর আশ্বাস এই রণ রক্ত কোলাহলের মাঝখানে মানুষকে জীবনের নতুন পটভূমি রচনায় উদ্‌বোধিত করে। প্রসঙ্গত মনে আসে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের আর একটি নারী নামাঙ্কিত কবিতা ‘সুরঞ্জনা’র কথা। এখানেও কবি বলেছেন, মানবের গভীর বিপর্যয়ের দিনেও তার সংযোগ সম্বন্ধ বিনষ্ট হয়ে যায় না। এই সংযোগ সম্বন্ধ দেশ-কাল, প্রতিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে অন্বিত যা সুচেতনার অনুভবী সহজ প্রকাশ ছাড়া কখনও সম্ভব নয়। একই সঙ্গে সময়চেতনার অনুষঙ্গটিও এখানে সহজেই এসে পড়ে যখন কবি সু-চৈতন্য বিষয়টিকে আবহমানকালের সমাজ ও সত্যে উজ্জ্বল করে তোলেন। কবি জানেন, মানবের মৌল অনুভবগুলির বিনষ্টি ঘটে না কখনও। হয়তো রূপান্তর হয়। দৈনন্দিনতার অজস্র বাস্তব পরিস্থিতি, সময় পরিবর্তনের রূঢ়তা, ভাঙন মানুষের মূল্যবোধগুলিকে সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে, হয়তো অপ্রকাশিতই থেকে যায় তার ধরন। সাম্প্রদায়িক শোষণ, ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে এক গভীরতর অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে চলেছে। সেই অসুখের বিমিশ্র প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর সামগ্রিক মানব জাতিই হারিয়ে ফেলেছে সমস্ত স্বাভাবিকতা। সমাজের সর্বস্তরে অসুখরূপী এই সার্বিক অবক্ষয় মানব হত্যালীলায় নিরন্তর মাতিয়ে রেখেছে। আর সেই হত্যার লীলায় সামিল হয়ে মানুষ নিজেরই আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনকে হত্যা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। অগণিত মানুষের মৃতদেহ পার হয়ে সময়ের শস্য নিয়ে মানুষ পার হয়ে চলেছে এই পৃথিবীর পথ। তবে সময়ের শস্য নিয়ে যে বাণিজ্য তরী মানবের সামনে এসেছিল অগণন প্রিয় মানুষের মৃতদেহকেই তা পণ্য করে এনেছিল।

তবে পৃথিবীময় এই দুঃসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েও কবি বিশ্বাস করেন, ‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে। আসলে মৃত্যুবর্ষী এক সভ্যতায় দাঁড়িয়েও কবি বুঝেছেন এই পৃথিবীর রণ-রক্ত-অস্থিরতাই একমাত্র সত্য নয়। এর মাঝখানেও মানুষ জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই বাঁচবে। আরও অনেক দেওয়ার ও নেওয়ার আছে মানুষের। মৃত্যুময় এই সময়ে দাঁড়িয়েও মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য এ পৃথিবীর কাছে ঋণী হয়ে থাকতে হবে। কবি তাই মানুষের থেকে মানবের অস্তিত্বে বিশ্বাসী এই মানবই এক জীবন থেকে আর এক জীবনের দিকে এক সভ্যতা থেকে আর এক সভ্যতার দিকে চিরন্তন এক আশ্রয়ের নীড় খুঁজে পাবে। খুঁজে পাবে মানবতার শুভ চৈতন্যের আশ্রয়, যার অপর নাম সুচেতনা।

কবির ভাবনায় চিরন্তনের অর্থবাহী দ্যোতনায় স্থান পেয়েছে গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াসের মতো দার্শনিকদের গভীর প্রত্যয়। কারণ তারাই মানবকে শোনাবেন মুক্তির কথা। চারপাশের অজস্র সঙ্কীর্ণতার মাঝখানে এইসব মনীষীরা এখনো মানুষের মনে আলো জ্বালিয়ে রাখেন, বাঁচার মন্ত্র শুনিয়ে যান তারা। সময়চেতনার ব্যাপারটি এই অংশে স্পষ্ট হয়েছে যে বাক্যবন্ধের মাধ্যমে সেটি হল, ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’। নিবিড় অমারাত্রির অবসানে সূর্যের আলোকোজ্জ্বল স্পর্শ যেমন অবক্ষয়ের গ্লানি মুছিয়ে দিনটিকে করে তোলে মহিমময়—তেমনি ধ্বংস ও মৃত্যুর কালো দিনগুলি পেরিয়ে পৃথিবীর মানবের জীবনও আবার নতুন উত্তাপ উষ্মতায় ভরে উঠেছে। এত হানাহানি ও মারণযজ্ঞের লীলা পেরিয়েও, মানুষ মৃত্যুর পরে ‘মানব’ থেকেই যায়। তারা জীবনকে ভাঙে না কখনও, গড়েই তোলে। সেই আপাত ক্লান্ত অথচ ক্লান্তিহীন জীবনের নাবিকদের পথ কাটার লড়াই থামে না কখনও। যদিও সেকাজ অদূর ভবিষ্যতের নয়—আরও দীর্ঘ অন্ধকার দিনের অবসানের পরই সম্ভব হবে।

আধুনিক কবিতার সপ্রাণতার প্রসঙ্গে জীবনানন্দ নিজেই বলেছেন “আধুনিক কাল ও সমাজ সম্পর্কে জাগ্রত চেতনা বজায় রেখে আরও দীর্ঘতর সময়ানুভূতির ভিতরে সে কবিতাকে সার্থক হয়ে উঠতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন, সমসাময়িককালকে অতীত ও অন্তরের সঙ্গে অন্বিত করে ঈষৎ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার ক্ষমতা।” (কবিতার কথা পৃ-৩১) ‘মহাপৃথিবী’র কবিতায় ব্যক্তি-চৈতন্য এক বিপন্ন বিস্ময়ের দ্বারা অধিকৃত। যেন ‘পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নষ্ট হয়ে খসে যায় চারদিকে আমিষ তিমিরে’। এ পর্যায়ে কবির সময় ভাবনা খণ্ডকালের বিনাশী স্বরূপটিকেই তুলে ধরেছে। ‘মহাপৃথিবী’র এই ভাবসম্পদের পাশে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের নবসংস্করণের বেশ কিছু সংযোজিত কবিতার কথা মনে আসে। এক নতুন সময়চেতনার মূল্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি কবিতাগুলিতে। কালের চক্রানুবৃত্তির ধারণাটি এখানে স্পষ্টভাবে কাব্যরূপায়িত হল। জীবনানন্দ একেই বলেছেন, ইতিহাসের ধারা-ধারণা। সেই ইতিহাসচেতনা থেকেই উদবর্তিত হয়েছে কালচক্র বা গতিশীল সময়ের ক্রমিক প্রস্মৃতি ও আবর্ত-অনুবৃত্তির ভাবনা। একজন দীক্ষিত প্রজ্ঞাশীল কবি জীবনানন্দ এখানে বলেছেন, “সুচেতনা এইপথে আলো জ্বেলে—এপথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে। সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।” অতীত ও ভবিষ্যৎকে একটি বিন্দু বা যুগপ্রতিবেশবদ্ধ সময়চিহ্নে যেন মিলিত হতে দেখেছেন কবি। তিনি জানতেন, মানুষ বর্তমানে পা রেখেও একই সঙ্গে অতীতচারী ও ভবিষ্যস্বাপ্নিক। চেতনার কালগত বিচারেও সে ত্রিভুবনচারী। নিসর্গের নিরবচ্ছিন্ন প্রাণ প্রবাহের মধ্যে নিমজ্জনের বার্তা তাই কবি শোনালেও তার থেকে আরও বড়ো চেতনালোকে উত্তর প্রবেশ তাঁর সম্ভব হয়েছে। সময়চেতনার প্রসার ও পরিণতির মধ্য দিয়েই। মানবজীবনচর্যা ও নিসর্গজীবন এই দুইয়ের মধ্যেকার ব্যবধানটিকেও কবি চিনতে কখনও ভুল করেননি। সেই চেতনার ওপর পড়েছিল তাঁর পারিশীলিত কালজ্ঞানের আলো। সময় সম্পর্কিত অনুভাবনায় ‘বনলতা সেনে’র নব সংস্করণের কবিতাগুলি একটা অন্যমাত্রা এনেছে একথা বলা যায়।

‘সুচেতনা’ কবিতাটির মধ্যে কালের নিত্য ধাবমানতার প্রাচীন ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে শাশ্বত মানব-অভীপ্সার শক্তি। ধাবমান এই বিশ্বসংসারের সঙ্গে, মহাকালের সঙ্গে মানবও চিরযাত্রী। কিন্তু এই যাত্রা কোনো সুদূর রহস্যের জন্য নয়। এক নবপৃথিবীর নব পরম্পরার জন্য শুভ প্রয়াণ যাত্রা। কবিতাটির অন্তিম চরণের চিররাত্রি ও চিরসূর্যোদয়ের চিত্রকল্প কিংবা ‘সুরঞ্জনা’, ‘সবিতা’ কবিতার অতীতের মৃত সভ্যতার পাশাপাশি নব সভ্যতার আবর্তনের চিত্র কালের চক্রানুবৃত্তির ধারণাটিকে জাগিয়ে তোলে। আর সেই অনুভববেদ্য পরিণতিকেই জীবনানন্দের ভাবনায় সময়গ্রন্থির নতুন রূপ বলা যায়। এক ব্যাপ্ত বৈনাশিকতার পটভূমিতে অগ্রসরমান নবীন প্রাণের চেতনার উন্মেষেই জীবনানন্দের সময় ভাবনা কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে। ‘সুচেতনা’ও তার ব্যতিক্রম নয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment