আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুকান্ত ভট্টাচার্যের বোধন কবিতায় মন্বন্তরের চিত্র এবং তার প্রতিরোধ সংকল্প কতখানি বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছে তার পরিচয় দাও” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের বোধন কবিতায় মন্বন্তরের চিত্র এবং তার প্রতিরোধ সংকল্প কতখানি বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছে তার পরিচয় দাও
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতার প্রেক্ষিতজুড়ে রয়েছে তেরোশো পঞ্চাশের মহামন্বন্তর। সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এই বিপর্যয় মৃত্যুময়তার চরম অভিঘাত হয়ে নেমে এসেছিল সেদিন। ঐতিহাসিক এই বিপর্যয়ের কারণ ও স্বরূপ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দুটি বিশেষ অবস্থা নজরে আসে। একটি হল প্রাকৃতিক কারণ অন্যটি মনুষ্য সৃষ্ট বা কৃত্রিম কারণ। ১৩৫০-এর অবিভক্ত বঙ্গদেশে যে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের দুর্যোগ নেমে এসেছিল, সেকালের পত্র-পত্রিকা, দলিল, দুর্ভিক্ষ কমিশনের রিপোর্ট থেকে এই দুর্ভিক্ষের তিনটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলি হল প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ। প্রাকৃতিক কারণ অনুযায়ী দেখা গেছে ১৯৪৩-এর ১৬ই অক্টোবর প্রবল বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ে চাল উৎপাদনে সমৃদ্ধ মেদিনীপুর জেলাটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এই জেলা থেকে প্রচুর ধান ও চাল রপ্তানি হত। শীতের ফসল থেকে ওঠার মুহূর্তে এই ঘূর্ণিঝড় মেদিনীপুর জেলাটিকেও ঘাটতিপূর্ণ একটি জেলায় পরিণত করে। ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পলগ্রীনো তাঁর ‘আধুনিক বাংলা, সমৃদ্ধি ও দারিদ্র্য’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, “১৬ই অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় উপকূলবর্তী অঞ্চলে দিনের বেলায় আছড়ে পড়ে এবং প্রায় সমস্ত কাঁচা ঘরবাড়িই ভেঙে পড়ে। কিন্তু বাঁধগুলি অক্ষত থাকে। বিকেল ও সন্ধ্যায় ঝড়ের গতি চরমে পৌঁছায় এবং সমুদ্রের ঢেউ সবচেয়ে উঁচু হয়ে যায়। প্রায় ১৬ ফুট উচ্চতার তিনটি প্রকাণ্ড ঢেউ এক অথবা দুই ঘণ্টার ব্যবধানে উপকূল থেকে সাত মাইল ভিতরে ঢুকে পড়ে। জলস্রোত রোধের জন্য তৈরি বাঁধ এবং নিয়ন্ত্রিত জল আসা যাওয়ার ব্যবস্থা ভেঙে যায়।…..গাছ ও শস্য ধ্বংস হয়, সমস্ত উর্বর জমি নোনাজল ও বালিতে ভরে যায়। সরকারি হিসেবে ঘূর্ণিঝড়ের সময় অথবা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ১৪,৪৪৩ জন মারা গিয়েছিল। এরমধ্যে প্রায় ১১,০০০ জনের মৃত্যু ঘটে শুধু কাঁথি মহকুমায় ।…..ঘূর্ণিঝড়ের ফলে মেদিনীপুর ও প্রতিবেশি ২৪ পরগনা জেলায় বিশাল ক্ষতি হয়। ৩৩০০ বর্গমাইল অঞ্চলের প্রায় ৭৪০০ গ্রাম আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছিল।”
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় ১১ কোটি টাকার শস্য নষ্ট হয়েছিল। প্রায় ৩৬ ঘণ্টার এই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ২৫ লক্ষ বাড়িঘর সম্পত্তি জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের এই প্রভাব ছিল বহু বছরের। প্রচুর গাছ ধ্বংস হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের উৎস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর দুগ্ধবতী গাভী মারা যাওয়ায় দুধের প্রচুর অভাব দেখা যায়। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে সমগ্র মেদিনীপুর জেলাকে রক্ষা করবার একটা উপায়ই খোলা ছিল তা হল বাইরে থেকে চাল আমদানি করা। কিন্তু বিদ্রোহী মেদিনীপুর জেলাকে শাস্তি দিতে প্রাদেশিক সরকার সাধারণ বাণিজ্যকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে চাল বর্জন নীতির ফলে এই জেলার চাষিদের কাছ থেকে বাইরের দালাল, মজুতদাররা সব চাল কিনে নিয়েছিল। ফলে দক্ষিণবঙ্গ ও মেদিনীপুরে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক কারণটিই যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল—এমনটা মনে হয় না। সমকালীন ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা একটি রিপোর্টও এই অঞ্চলিক কারণটিকে দুর্ভিক্ষের একমাত্র কারণ বলে নির্দেশ করে না। ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইহার নিমিত্ত দায়ী নহে। এই দুঃখ-দুর্দশার নিমিত্ত দায়ী বর্তমান বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ সম্ভৃত জটিল কুটিল পরিস্থিতি এবং তদনুষঙ্গে সরকারের দূরদৃষ্টির অভাব এবং অবিমৃষ্যকারিতা।”
এই দুর্ভিক্ষের পিছনে বিদেশি রাজশক্তি বা মহাযুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে ইংরেজরা কী ভূ মিকা নিয়েছিল তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ১৯৪২ সালের মে মাসে জাপানিদের আক্রমণের কথা ভেবে উপকূলবর্তী এলাকায় নৌকা কেড়ে নিল বা পুড়িয়ে দিল। এর ফলে জেলেদের জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ জনজীবন সংকটগ্রস্ত হল ভীষণভাবে। এর পাশাপাশি ছিল সরকারের ‘Rice Denial Policy। যুদ্ধের কারণে আক্রমণ স্থল থেকে এরা সমস্ত বাড়তি খাদ্য কিনে নিয়ে আরব, সিংহল প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করে দিতে থাকে। ফলে ব্যবসায়ী এবং বড়ো বড়ো আড়তদার পল্লি অঞ্চলে যত শস্য সঞ্চিত ছিল তার সবটুকুই কিনে নিয়েছিল। অত্যাধিক মূল্যে অবাধে চাল কেনাবেচার ফলেই এই বাংলাদেশের সর্বাধিক ক্ষতি করা হয়েছিল। যে অঞ্চলেই সরকার কর্তৃক চাল এভাবে কেনা হয়েছিল সেখানেই দুর্গতি ও মূল্যবৃদ্ধি চরম আকার ধারণ করে। সরকারের এই ‘Rice Denial Policy’র ফলে চোরাবাজারের সৃষ্টি হয়। চোরাবাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সেদিন যদি যথাযথ ভূমিকা পালন করত তবে হয়তো বাঙালির জীবনে এতবড়ো সর্বনাশ সংঘটিত হত না। সরকার যদি এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যের সুষম বণ্টন করতেন তাহলে মন্বন্তর বাংলাদেশকে জর্জরিত করতে পারত না। সরকারের মদতপুষ্ট চোরাবাজারই এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে অধিকাংশভাবে দায়ী ছিল একথা বলা যায়।
এমন একটি সময়েই দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের নিরন্ন মানুষগুলির মুখে অন্ন তুলে দিতে এগিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অনুগামী বিভিন্ন সংগঠন। এই কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসাবেই সুকান্ত ভট্টাচার্য একজন সেবাব্রতীর সংকল্প নিয়ে পথে নেমেছিলেন। শুধু সেবাব্রতের দ্বারা নয়, কর্মে ও কথায় সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার মাধ্যমেও এইসব দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষগুলির অন্তর্বেদনাকে তুলে এনেছিলেন সুকান্ত। দুর্ভিক্ষ বিষয়ক একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করতে গিয়ে সুকান্ত বলেছিলেন, “তেরোশো পঞ্চাশ সম্বন্ধে কোনো বাঙালিকে কিছু বলতে যাওয়া অপচেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে ? কেননা তেরোশো পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সাল নয়, নিজেই একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস, সেই ইতিহাস একটি দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, ঘর ভাঙা, গ্রাম ছাড়ার ইতিহাস। দোরে দোরে কান্না আর পথে পথে মৃত্যুর ইতিহাস।” ‘বোধন’ কবিতাটি এই মৃত্যুময় সময়ের প্রেক্ষিতকে নিজের রক্তমজ্জায় অনুভব করে লিখেছিলেন সুকান্ত। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ কবিতায় ছিন্নমূল ঘরভাঙা মানুষের অনন্ত হাহাকার, মারী মড়ক, বন্যার নির্মম আঘাতে জর্জরিত মৃত্যুর পদধ্বনি রয়ে গেছে।
কবিতাটির প্রথম স্তবকেই এই ইতিহাস সম্মত অনুপুঙ্খ দৃষ্টিটি রয়েছে। রয়েছে বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ এবং ঘরছাড়া মানুষের পোড়ো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার চিত্র। সুকান্ত লিখেছেন,
“মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো”
১৯৫০-এর এই দুর্ভিক্ষ তাই কোনো প্রাকৃতিক-বিপর্যয়জনিত কারণেই সৃষ্টি হয়নি, এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে মুনাফালোভী মানুষ ও বিদেশি রাজশক্তির বর্বর শোষণনীতি অনেকখানি দায়ী। ক্ষয়িষ্ণু এই মানুষগুলির নির্মম লোভ, ক্ষমাহীন মানসিকতার চরম প্রকাশ হয়ে দেখা দিয়েছিল মনুষ্যসৃষ্ট এই মহামন্বন্তর। কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে শোষণের চূড়ান্ত রূপটিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন কবি সুকান্ত। আর সাধারণ মানুষকে এই অন্যায় প্রতিহত করবার জন্য সোচ্চার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে বলেছেন। কবি এই সমস্ত মূঢ় মূক মানুষগুলির নিরুচ্চার সহনশীলতায় সমস্ত রকম অন্যায়কে মাথা পেতে নেবার মানসিকতাকেও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির অন্যতম কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। অবিরাম কান্নাকে বুকের ভিতরে যারা নিরন্তর বহন করে চলেছেন, সেইসব মানুষকে উদ্দেশ্য করে সুকান্ত লিখেছেন—
“ব্যহত জীবনযাত্রা চুপি চুপি কান্না কত বুকে
হে নীড় বিহারী সঙ্গী। আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছে সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে। তবু আজো বিস্ময় আবার
ধূর্ত প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ ক্ষমা, ডেছে নিজের সর্বনাশ।”
দিনরাত এক করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সমস্ত মানুষ ফসল ফলিয়ে তুলছে, তাদের সেই ফসল মাঠ থেকেই লুঠ হয়ে যায়। দিনের পর দিন কৃষকের ঘরে অন্ধকার জমে থাকে। আর বিদেশি শাসকদের নির্মমনীতি গোপনে হানা দিয়ে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করা শস্য লুঠ করে মাঠের রাজা কৃষককে সর্বশান্ত করে দিয়ে যায়। অথচ এইসব বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষগুলিই দুঃসহ ক্ষমায় সেইসব বর্বর শোষক শ্রেণির পায়ে প্রাণ ঢেলে দিয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সার সার। চরম ক্ষুধার মুখে তাদের নিষ্ফল ক্রন্দন অভিসম্পাত হয়ে নেমে আসতে চাইলেও যুগব্যাপী ব্যর্থতার সমুদ্রে হারিয়ে যায়। প্রশ্নহীন এই আত্মসমপর্ণই ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিদেশি শক্তি, জোতদার, মজুতদার, মুনাফালোভী এইসব কালো ব্যবসায়ীরা লোভ আর বর্বরতার ঘৃণ্য নেশায় যতবড়ো অন্যায় করে চলেছে, সাধারণ মানুষের নির্বিচার মেনে নেওয়ার মানসিকতা ঠিক ততবড়ো অন্যায়ই সংঘটিত করেছিল সেদিন। এইসব অসহায় নির্বিবাদী মানুষগুলির প্রতিনিধি হয়েই বিদেশি শাসক, চোরাবাজার আর অসাধু ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে প্রতিরোধে শানিত বাক্যবাণ নির্মাণ করেছিলেন সুকান্ত। কবিতাটির পরবর্তী স্তবকগুলিতে তাই সতর্ক ও সচেতনবার্তা জনমানসে ছড়িয়ে দেবার দৃঢ় অঙ্গীকার শোনা যায়।
“লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।”
বিদেশি শাসক এদেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে নিরন্তর শোষণ করেই শুধু চুপ করে থাকেনি, তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৈষম্যকে প্রতি প্রাণে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সেদিন, যা মানুষের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠবার চেষ্টাকে দুর্বল করে দিয়েছে প্রতিনিয়ত। কবি তাই মন্বন্তর, মারী-মড়কের নিদারুণ অভিঘাত বুকে নিয়েও সেইসব অসহায় মানুষগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য, তাদের চিন্তা চেতনায় জ্বেলে দিয়েছেন দীর্ঘদিনের শোষণ লাঞ্ছনার প্রতিবাদী ভাষার আগুন। স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে চুপ করে থাকা নয়, সুকান্ত চেয়েছিলেন সেই দীর্ঘনিশ্বাস শ্মশানের চিতার আগুনে পরিণত হয়ে উঠুক। শান্ত অসহায় মানুষের এমন বঞ্চনাময় আপ্লুত উচ্চারণ এর আগে কোনো কবি শিল্পীর লেখনী থেকে পাওয়া যায় না। সাধারণ নিরন্ন মানুষের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস ছিল বলেই, মানবিক চেতনাকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য সবরকম হিংস্রতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কবি। তার মনে হয়েছিল এইসব ভীরু, অন্যায়কারীর পৃষ্ঠপোষক প্রতিবাদহীন মানুষগুলিও এক অর্থে দেশদ্রোহী। গতানুগতিক জীবনে অভ্যস্ত হতে হতে এইসব মানুষেরা নিজের দেশকেই প্রতারিত করে চলেছে, এদের উদ্দেশ্যে তাই তার অগ্নিময় উচ্চারণ ভাষা পেয়েছে এইভাবে,
বিপদ নামুক ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝব তুমি তো মানুষ নও—
গোপন গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নি কো, দেয়নি জল
দেয়নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে তাই,
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই”
সমকালীন বিভিন্ন কথাসাহিত্যে ১৩৫০-এর ভয়ঙ্কর এই মন্বন্তর বহুধা বিভক্ত হয়েই উঠে এসেছে। কিন্তু কবিতায় মন্বন্তর এমন সার্থক উপস্থাপনা ‘বোধন’ কবিতাটিতেই দেখা গেল। অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য এ কবিতার পংক্তিগুলিকে কোনো মানবিক আচার সর্বস্ব ন্যায় নীতিদ্বারা অভিষিক্ত করেননি, বলেছেন এ কবিতা যেন ‘ক্রোধদীপ্ত দুর্বাসার অভিশাপ। আর ঠিক এই জায়গাটি থেকেই সর্বগ্রাসী সময়ের সংহতিহীন নিশ্চেষ্ট অসহায়তাকে আঘাতে আঘাতে প্রতিহত করে সুকান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ‘বোধন’ কবিতাটি তাই মন্বন্তরের ইতিহাস সম্মত বাস্তব চিত্রায়নের পাশাপাশি সংগ্রামী সংকল্প বুকে নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধের চির উদ্বোধন হয়ে উঠেছে একথা বলাই যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।