আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে অভিজাত (শাসক) শ্রেণির গঠন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি আমলে অভিজাত (শাসক) শ্রেণির গঠন
দিল্লি-সুলতানির গঠন-বৈশিষ্ট্য আক্ষরিক অর্থে সামন্ততান্ত্রিক ছিল না। এই স্বতন্ত্রতার দুটি প্রধান কারণ ছিল ‘ইতা’-কেন্দ্রিক প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা এবং শাসকশ্রেণির চরিত্র। ইকতা’ ব্যবস্থায় শক্তিশালী সুলতানদের আমলে সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতার ভিত্তি সুদৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কম। এ বিষয়ে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে সুলতানি আমলে শাসকশ্রেণির গোষ্ঠী ও জাতিভিত্তিক ধারাবাহিক পরিবর্তনশীলতা সাধারণভাবে সুলতানির প্রবণতাকে পুষ্ট করেছিল।
ভারতে সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠায় প্রথমদিকে অবদান ছিল আফগানিস্তানের ‘ঘুর’ রাজ্যের। মহম্মদ ঘুরির উদ্যোগেই মুলত সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। এই কারণে ভারতে সুলতানি আমলের শাসকশ্রেণির চরিত্র অনুধাবনের ক্ষেত্রে ‘ঘুর’ রাজ্যের শাসকশ্রেণির বিন্যাস প্রাসঙ্গিক। দশম শতকে ইরানীয় তাজিক (শাসাবনী) বংশের শাসনকালে ‘শিসানী’ (Shishani) এবং ‘খারমিল’ (Kharmil) জাতিগোষ্ঠীর লোকেরাই সামরিক ও বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল এবং কালক্রমে এরাই ‘অভিজাত’-র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। কালক্রমে আলাউদ্দিন জাহানসোজ-এর আমলে (১১৪৯ ৬১ খ্রিঃ) ঘুর রাজ্যের প্রতিপত্তি ও সীমানা প্রসারিত হলে শাসকশ্রেণির বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে। এই সময় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ‘ঘুর’ শাসকশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়। এদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘খলজ’ জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। খলজ প্রদেশ নামানুসারে এরা ‘খলজি’ নামে পরিচিত হয়। কেউ কেউ এদের তুর্কিজাতির মতো অবয়ব, পোশাক ও ভাষাযুক্ত ‘গো-পালক শ্রেণি’ বলে মনে করেন। বারাণীর মতে, খলজিরা অ-তুর্কি এবং চেঙ্গিস খাঁ’র জামাতা কুলিজ খাঁ’র বংশধর। কিন্তু বসওয়ার্থ এদের তুর্কি যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ বলে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা অধিকাংশই খলজিদের তুর্কি গোষ্ঠীভুক্ত বলে মনে করেন। কিন্তু ভারতে তুর্কি শাসনের প্রাথমিক পর্বে শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে খলজিরা তুর্কিজাতির সাথে অভিন্ন বলে স্বীকৃতি পায়নি। তবে গজনিতে ‘ঘুরি’ বংশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এবং মহম্মদ ঘুরির প্রাথমিক সাফল্যগুলির পেছনে ‘খলজি’ অনুচরদের বিশিষ্ট অবদান ছিল। এমনকি তরাইনের প্রথম যুদ্ধে (১১৯১ খ্রিঃ) মহম্মদ ঘুরির প্রাণরক্ষার কাজে প্রধান ভূমিকা ছিল জনৈক খলজি অনুচরের। কিন্তু মহম্মদ তাঁর নব-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে উচ্চ রাজপদে শুধুমাত্র ‘ঘুরি’ বংশীয় অভিজাতদের নিয়োগ করেন।
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের (১১৯২ খ্রিঃ) পর ‘ঘুর’ রাজ্যের শাসকশ্রেণির চরিত্র দ্রুত পালটে যায়। পরবর্তী অভিযানগুলিতে এবং প্রশাসনিক পথে ঘুরিদের পরিবর্তে ধর্মান্তরিত তুর্কি-ক্রীতদাসদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। মহম্মদ ঘুরি কর্তৃক শাসকশ্রেণির চরিত্র পরিবর্তনের ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক ইরফান হাবিব। মহম্মদ ঘুরির শাসনকালের শেষ পনেরো বছরে এই রূপান্তর ঘটেছিল। এই রূপান্তরের মূল কারণ হল বৃহত্তর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করার কাজে ‘ঘুর’ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা। ধ্রুপদী ‘ঘুর’ রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী রাজনীতিতে গোষ্ঠী (clan) বা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম ছিল। সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার বিলি-বণ্টন দ্বারা শাসন পরিচালনার রীতি ছিল। এই রীতি অনুযায়ী ‘সুলতান’ না হয়েও মহম্মদ ‘ঘুরি’ গজনি’র স্বাধীন কর্তৃত্ব পেয়েছিলেন (১১৭৩)। মহম্মদ ঘুরি অসংখ্য তুর্কি ক্রীতদাস সংগ্রহ করে (বন্দেগান-ই-তুর্ক) সন্তান স্নেহে গড়ে তোলেন এবং এদের সমন্বয়ে নিজস্ব একটি নির্ভরযোগ্য শক্তিসংঘ গড়ে তোলেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গজনি রাজ্য এবং অভিযান দ্বারা দখলিকৃত ভারতীয় ভূখণ্ডে দুটি স্বতন্ত্র শাসকগোষ্ঠীর সেবালাভের ব্যবস্থা করেন। গজনিতে প্রধানত ‘ঘুরি’ অভিজাতদের নিয়োজিত রাখেন, কিন্তু অধিকৃত ভূখণ্ডের দায়িত্ব দেন তুর্কি-ক্রীতদাসদের ওপর। এই ব্যবস্থার সুফল ও কুফল দুইই ছিল। এর দ্বারা উপজাতিভিত্তিক কেন্দ্রবিমুখী উপাদান থেকে তাঁর নবার্জিত রাজ্য মুক্ত হয়েছিল, কিন্তু বিরূপ প্রভাবও কম ছিল না।
প্রথমত, নবগঠিত বাহিনীর উঁচু পদগুলিতেই তুর্কিদের প্রাধান্য ছিল। সাধারণ যোদ্ধাদের মধ্যে ঘুরি বা খলজিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে অ-তুর্কিদের হাতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা, বিহার দখল এবং স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠাকে সেই সম্ভাবনার প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তুর্কি ক্রীতদাসদের এই আকস্মিক ক্ষমতার উত্তরণ পুরাতন ঘুরি ও খলজি অভিজাত বা সেনাপতিদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কারণ তারা মনে করত যে, ভারতীয় রাজ্যের ওপর তাদের অবদান ও অধিকার তুর্কিদের থেকে কম নয়। স্বভাবতই অভিজাতগোষ্ঠীর মধ্যে এবং ‘অভিজাত’ পদ দখলের প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে।
মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লি-সুলতানির সর্বময় কর্তৃত্ব হস্তগত করে তুর্কি আমিরদের সাফল্য ঘোষণা করেন। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়া অথবা উপগোষ্ঠীর নেতাকে সুলতানিয়াত দেওয়ার লক্ষ্যে তুর্কি-আমিরদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব পরবর্তী সুলতানির ইতিহাসে প্রকট হয়ে ওঠে। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর ইলতুৎমিসের সিংহাসন আরোহণকে কেন্দ্র করে এই অন্তর্দ্বন্দু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘কুতবি-তুর্কি” দাস ও আমিররা ইলতুৎমিসের সমর্থনে দিল্লিতে সমবেত হলে, ‘মুইজি’ দাস ও আমিররা তাদের বিরুদ্ধাচরণে ঐক্যবদ্ধ হয়। মহম্মদ ঘুরি যেমন ‘ঘুরি’ অভিজাতদের হটিয়ে তুর্কি দাসদের ক্ষমতার চূড়ায় তুলেছিলেন; ঠিক তেমনি কুতুবউদ্দিনের অনুগত দাসরা মহম্মদ ঘুরির তুর্কি দাসদের ক্ষমতাচ্যুত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন। তুর্কি-দাসদের এহেন অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিণামে দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে তথাকথিত অ-তুর্কিদের উত্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল।
ইলতুৎমিস তাঁর অধীনস্থ শাসকশ্রেণির বিন্যাসে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তিনি ‘ঘুর’ অভিজাতদের সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যের ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই শাসকগোষ্ঠীকে ‘বিচ্ছিন্ন করে শাসন’ (Divide and Rule) চালানোর নীতি নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি তুর্কি-ক্রীতদাসদের সংখ্যাবৃদ্ধি করে নিজ শক্তি সুদৃঢ় করেন। মিনহাজউদ্দিন ও বারাণীর বিবরণ থেকে ইলতুৎমিসের আমলের যে পঁচিশ জন ক্ষমতাবান ‘সামসি’ দাসের কথা জানা যায়, তাদের কুড়ি জন বিভিন্ন তুর্কি উপজাতিভুক্ত ছিলেন (৬ জন কুইপেক, ৫ জন কারা খিটা, ৩ জন রুমি বা সেলজুক, ৩ জন ইলবেরি, ১ জন গর্জি এবং ১ জন খারিজম গোষ্ঠিভুক্ত)। মাত্র একজন ‘সামসি’ অভিজাত ছিলেন অ-তুর্কি বা হিন্দু, সম্ভবত মথুরা অঞ্চলের মানুষ। এদের মধ্যে তিন বা চার জনকে ইলতুৎমিস মোঙ্গলরাজ ঐতিহ্যের অনুসরণে সর্বোচ্চ ‘খান’ পদমর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। এদের সম্পদ ও ক্ষমতার ভিত্তি ছিল অধিকৃত ‘ইতা’ ও সামরিক দায়িত্ব। ইলতুৎমিসের আমলে সুলতানির শাসকশ্রেণিতে তাঁর তুর্কি ক্রীতদাসদের যেমন প্রাধান্য ছিল, তেমনি অ-তুর্কি দাস এবং স্বাধীন তুর্কি ও অ-তুর্কি অভিজাতর অবস্থানও ছিল।
অধ্যাপক ইরফান হাবিব লিখেছেন : “Iltumish accordingly presided over a nobility in which his own corps of Trkish slaves, who held a large number of ‘iqtas’, and free-born immigrants, who occupied high offices at the court-were almost evenly matched.” ১২২২ ও ১২২৩ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলগণ কর্তৃক ঘুর রাজ্য অধিকৃত হলে বহু ঘুরি অভিজাত ভাগ্যান্বেষণে ভারতে চলে আসেন এবং ইলতুৎমিসের সহানুভূতি অর্জন করেন। খারিজম ও তুর্কিস্তান এর রাজপুরুষদ্বয় ফিরোজ শাহ এবং মালিকজানি ইলতুৎমিসের অধীনে সরকারি উচ্চপদে যোগ দেন। এঁরা ছিলেন, তুর্কি, কিন্তু স্বাধীন। মিনহাজউদ্দিন ইলতুৎমিসের আমলের অভিজাতদের ‘তুর্কি’, ‘তাজিক এই দুটি জাতিগত উপাদানে গঠিত বলে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক হাবিবের মতে, ‘মিনহাজ তুর্কি’ বলতে তুর্কি ক্রীতদাস এবং ‘তাজিক’ বলতে অ-ক্রীতদাস বা স্বাধীন ব্যক্তিদের বুঝিয়েছেন।
ইলতুৎমিসের মৃত্যু এবং গিয়াসউদ্দিন বলবনের সিংহাসনে আরোহণের (১২৩৬-১২৬৬ খ্রিঃ) মধ্যবর্তী দশকগুলিতে সুলতানি শাসকশ্রেণির জাতিগত এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শঙ্কাজনক রূপে প্রতিভাত হয়। বারাণী লিখেছেন, এই পর্বে ‘চল্লিশ তুর্কি অভিজাত’ (বন্দেগান-ই-তুর্ক-ই-চাহেলগানী) অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং পুরাতন ঘুর ও খলজি অভিজাতদের দ্রুত ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। তাঁর মতে, ‘সামসি’ দাসদের সবাই ‘খান’ উপাধি দ্বারা সম্মানিত হয়েছিল। ইরফান হাবিবের মতে, এই মন্তব্য সঠিক নয়, কারণ তখন চল্লিশ জন তুর্কি দাস ক্ষমতার চূড়ায় ছিলেন কিনা—তা সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়। তবে এই পর্বে তাজিক ও অন্যান্য স্বাধীন অভিজাতদের ক্ষমতার যে অবনমন ঘটেছিল,— এ কথা মিনহাজউদ্দিন স্বীকার করেছেন। সুলতান রুকনউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল চারজন অভিজাতর মধ্যে একমাত্র কবীর খাঁ ছিলেন সামসি দাস। বাকি তিনজনই ছিলেন ‘তাজিক’। এদের নেতা ‘উজির’ নিজাম-উল্-মুল্ক জুনাইদি’ও ছিলেন একজন ‘তাজিক’। কিন্তু শীঘ্রই এই সংঘাত ‘জাতিগত’ চরিত্র নেয়। তুর্কি-আমিররা সংঘবদ্ধ হয়ে বহু ‘তাজিক’ অভিজাতকে হত্যা করে এবং রাজিয়াকে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়। রাজিয়ার উত্তরাধিকারী মুইজউদ্দিন বাহরাম শাহর অপসারণে ষড়যন্ত্রকারী অভিজাতদের নেতা ছিলেন তাজিকগোষ্ঠীর উজির মুহজাবউদ্দিন। এক বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতিতে মুহজাব তুর্কি-অভিজাতদের হাত থেকে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলি নিজ গোষ্ঠীর অভিজাতদের হাতে সরিয়ে আনতে থাকেন। এমতাবস্থায় ‘তুর্কান-ই-সুলতানি’ সদস্যদের হাতে তিনিও নিহত হন। এই সময় তুর্কি ক্রীতদাস বলবন (উলুঘ খাঁ) দ্রুত চল্লিশচক্রের ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসেন। ঘুরিবংশীয় অভিজাত, সুপণ্ডিত ও সুদক্ষ প্রশাসক কুতুবউদ্দিন হাসানকে অপসারিত করে ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দে বলবন নায়েব ই-মামলিকৎ’ পদে অধিষ্ঠিত হন। বলবনের ক্ষমতাবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করেও অভিজাতদের অন্তর্বিরোধ প্রকটিত হয়েছিল। হিন্দুস্তানি মুসলিম আমির ইমাদউদ্দিন রাইহানের নেতৃত্বে যে বিরোধীগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠে, তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা যেমন কিশলু খাঁ, কুতলঘ খাঁ প্রমুখ ছিলেন তুর্কি। এই বিরূপতার কারণে বলবন ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি পুনরায় কর্তৃত্বে ফিরে আসেন। ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে ঘুরি অভিজাত কুতুবউদ্দিন মারা যান। অতঃপর তুর্কি আমিরদের আধিপত্য প্রশ্নহীন হয়ে ওঠে। ইরফান হাবিব মনে করেন, এই পর্বে (১২৩৬-৬৬ খ্রিঃ) তুর্কি বনাম তাজিক কিংবা দাস বনাম স্বাধীন অভিজাতদের গোষ্ঠীসংঘাত সত্ত্বেও শাসকশ্রেণির মধ্যে এক ধরনের ‘মিশ্র’ চরিত্র বজায় ছিল (inspite of the great clevage between the Turks and Taziks, and the slave and the freeborn, the concept of a composite ruling class still existed)।। এবং এই সহাবস্থানের মূল কারণ ছিল বহিরাগত তৃতীয় শক্তি, যেমন রাজিয়ার আমলে হাবসি জামালউদ্দিন ইয়াকুৎ-এর উত্থান প্রতিরোধ করা। ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দে আমির বলবনের বিরুদ্ধে তুর্কি, তাজিক, ঘুরি ও হিন্দুস্তানি আমিরদের হাতে হাত রেখে রুখে দাঁড়ানোর পেছনেও ব্যক্তিগত অস্তিত্ব রক্ষার মানসিকতা সক্রিয় ছিল।
‘চল্লিশচক্রের’ (চাহেলগান) অন্যতম নেতা ছিলেন বলবন। স্বভাবতই তুর্কি-অভিজাতদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার লোভ সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন। তুর্কি ক্রীতদাস থেকে সুলতান পদে উন্নীত হলেও, বলবনের সামাজিক মর্যাদা যে অন্যান্য অভিজাতদের তুলনায় উন্নত নয়, এ বিষয়ে তাঁদের একটি ধারণা দৃঢ়মুল ছিল। তাই বলবন সুলতান ও রাজপদকে মর্যাদা ও কর্তৃত্বের এমন একটা স্তরে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন, যাকে স্পর্শ করা চাহেলগানীর সদস্যদের পক্ষে কেবল অসম্ভব নয়, অবাস্তবও মনে হয়। রাজপদকে তিনি ঈশ্বরের স্বীকৃতি বলে ঘোষণা করেন এবং মানসিক গুণাবলিসম্পন্ন অভিজাতদের সাথে সুলতানের দুরতিক্রম্য ব্যবধানের কথা ঘোষণা করেন। সুকৌশলে চাহেলগানীর ক্ষমতাবান সদস্যদের হত্যা কিংবা অপসারিত করেন এবং ক্রমে এই সংস্থাকে ভেঙে দেন। বংশকৌলীন্য এবং নীলরক্তের অধিকারীদের শুধুমাত্র উচ্চরাজপদের উপযুক্ত বলে জানিয়ে দেন। তবে জন্মগত কৌলীন্যের বেড়াজাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বলবনের পৌত্র ও উত্তরাধিকারী কাইকোবাদ বংশকৌলীন্যের পরিবর্তে যোগ্যতাকে উচ্চপদে নিয়োগের প্রধান শর্ত হিসেবে গ্রহণ করেন। অধ্যাপক ইকতিদার হুসেন সিদ্দিকী ‘Social mobility in the Delhi Sultanate’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, শিক্ষার প্রসার, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা, সুফিবাদের প্রচার, শিল্পকারখানার প্রসার ইত্যাদি কারণে বহিরাগত মুসলমানদের প্রশাসনিক একাধিপত্য ভেঙে যায় এবং সমাজের অধিকারহীন শ্রেণির উচ্চক্রমে উত্থান সম্ভব হয়। কাইকোবাদের আমলে উচ্চ অভিজাত রূপে ধর্মান্তরিত মুসলমান কমল মাহিয়া’র নিযুক্তি (এঁকে বলবন উচ্চপদ দিতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন) এই বক্তব্যকে সমর্থন করে।
‘খলজি’দের শাসন শুরু হলে সুলতানির উচ্চপদে নিয়োগনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। ড. কে. এস. লাল ‘খলজি’ শাসনের সূচনাকে ‘তুর্কি একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের জেহাদ ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, তুর্কি দাস ও তুর্কি অভিজাতগণ কর্তৃক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে আফগানি বা ভারতীয় মুসলমানদের সাথে খলজিদের একটা নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল। ঐতিহাসিক কারণে খলজিরা শাসকপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্ম, জাতি বা বংশগৌরব ইত্যাদিকে প্রথম থেকেই অগ্রাহ্য করেন। সুলতান জালালউদ্দিন খলজি ‘ভকিল-ই-দার’ পদে মন্দাহার জাতিভুক্ত জনৈক হিন্দুকে নিয়োগ করে এই পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। আলাউদ্দিন খলজি এই পরিবর্তন সম্পর্কে প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু বাস্তববাদী রাজনীতিক আলাউদ্দিন বুঝেছিলেন যে, বহিরাগত অভিজাতশ্রেণির একচেটিয়া আধিপত্য তাঁর কর্তৃত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই তিনি অ-তুর্কি এবং ভারতীয় অভিজাতদের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা দিয়ে দরবারে নিয়ে আসেন। বারাণী লিখেছেন যে, তাঁর রাজত্বের তৃতীয় তথা শেষ পর্বে দরবারে নিম্নবংশীয় ব্যক্তিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর বিবরণ থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় ও আধা-ধর্মীয় পদ, যেমন— প্রধান কাজি (কাজাৎ-ই-মামালিক), প্রধান সদর (Sadar-us-sudar) ইত্যাদিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন প্রথমদিকে কেবল শেখ, সৈয়দ প্রভৃতি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু ক্রমে তিনি বংশকৌলীন্যহীন, জালালউদ্দিন লিভালজী, মৌলানা জিয়াউদ্দিন, হামিদউদ্দিন সুলতানি প্রমুখকে নিয়োগ করে এই সকল পদের গুরুত্ব ও মর্যাদা হ্রাস করেন। সমসাময়িক কালের চিক্তি সাধক শেখ নাসিরউদ্দিন চিরাগ হামিদউদ্দিন-এর দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করলেও, বারাণী নীচবংশীয়দের উচ্চপদ লাভে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। যাই হোক্, এই পরিবর্তনের পথ বেয়েই মুবারক শাহ খলজির আমলে হিন্দু পারোয়ারী জাতিভুক্ত খসরু খান পারোয়ারী ‘নায়েব-ই-সুলতানৎ’পদে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক খসরু খাঁ’র শাস্তির দাবি তুলে অভিজাতদের সন্তুষ্ট করেন এবং খসরু খাঁ’কে সরিয়ে নিজের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন। অবশ্য তিনিও হিন্দু খোক্কর উপজাতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগ করে এবং ‘ইতা’ প্রদান করে নিম্নবংশীয়দের উচ্চক্রমে গতিশীলতাকে অব্যাহত রেখেছিলেন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের আমলে সূক্ষ্ম কিছু কূটনৈতিক পরীক্ষানিরীক্ষাসহ এই গতিশীলতা সক্রিয় ছিল। বলবন মূলত তুর্কি অভিজাতদের এবং আলাউদ্দিন হিন্দুস্তানি অভিজাতদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোপক্ষই এককভাবে সুলতানি প্রশাসনকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এই কারণে তিনি রাজত্বের প্রথম পর্বে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী তুর্কি অভিজাত এবং হিন্দুস্তানি অভিজাতদের পরিবর্তে বিদেশি মুসলমানদের উচ্চপদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। বিদেশিদের আকর্ষণ করার জন্য উচ্চপদ, দরবারি মর্যাদা, রাজকীয় খেতাব, মহার্ঘ উপহার ও পারিতোষিক প্রদানের অঙ্গীকার করেন। স্বভাবতই বহু বিদেশি মুসলমান সরকারি পদের লোভে ভারতে প্রবেশ করেন। বহিরাগত ‘অইজ্জা’(মাননীয় বন্ধু)-দের অভিজাতর মর্যাদা দিয়ে মহম্মদ তুঘলক তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। কিন্তু এই সকল ভাগ্যান্বেষী বিদেশি মুসলমান ছিলেন একান্তই পেশাদার। রাষ্ট্রের শুভাশুভ বিষয়ে তাঁদের সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। দ্রুত ভারতীয় সম্পদের অধিকারী হয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়াই ছিল এঁদের লক্ষ্য। এমতাবস্থায় সুলতান আবার একটা দুঃসাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এবারে তিনি জাতিধর্মনির্বিশেষে হিন্দুস্তানের সাধারণ মানুষকে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে উচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।
অধ্যাপক আশরাফ লিখেছেন, “রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পদগুলিতে সর্বশ্রেণির ভারতীয়দের অধিকার স্বীকৃত হয় এবং এইসব পদে নিযুক্তির আবশ্যিক যোগ্যতা হয় প্রার্থীর সহজাত দক্ষতা ও কর্মদক্ষতা।” বারাণী এবং ইবন বতুতা উভয়েই মহম্মদ তুঘলকের আমলে উচ্চপদে অতি নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষের নিযুক্তির কথা বলেছেন। এদের মধ্যে সাম্রাজ্যে ‘আবর্জনার মতো পরিত্যক্ত’ নাপিত, পাচক, মালি, ছোটো দোকানদার, নর্তক- নর্তকী, ক্রীতদাস ইত্যাদি সবাই ছিল। যেমন, হিন্দু নাপিত রতন সিন্ধুপ্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। অঙ্কশাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তির কারণে তিনি সুলতানের দাক্ষিণ্য পান। গায়ক নাজির পেয়েছিলেন গুজরাট, মালব ও বদাউনির শাসনভার। অনুরূপভাবে আজিজ খুমার, নাজিব, মাসুদ (মদ প্রস্তুতকারী), শেখবাবু (মালি), মকবুল (দাস) প্রমুখ অসংখ্য নিম্নবর্ণজাত মানুষ উচ্চপদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। বারাণী ও ইবন বতুতার বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে, নিম্নবর্ণীয়দের অভিজাতর মর্যাদা প্রদানে মহম্মদ তুঘলক কেবল রাজনৈতিক ভাবনা দ্বারা চালিত হননি। এঁদের শিক্ষাদীক্ষা, সহজাত দক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলিও সুলতানের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে নিম্ন প্রশাসনিক পদে আফগানদের নিয়োগ শুরু হয়েছিল। নতুন স্থাপিত পুলিশ চৌকি এবং আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে আফগানদের নিয়োগ করা হত। আমির খসরুর দৃষ্টিতে এই সকল বহিরাগত মুসলমান, যারা ধর্মান্তরিত মুসলমানের সাথে তুল্য, এরা ছিল অসংস্কৃত, অশিক্ষিত এবং সুসংস্কৃত তুর্কি সমাজে বসবাসের অযোগ্য। কিন্তু ক্রমে এদের মধ্যে শিক্ষালাভের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং আলাউদ্দিন খলজির আমলে একটি শিক্ষিত ও দক্ষ গোষ্ঠী হিসেবে আফগানরা রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদার অংশীদার হয়। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে আফগান অভিজাতদের প্রতিপত্তি প্রবল হয়ে ওঠে। সুলতানের গণতান্ত্রিক নিয়োগনীতি আফগানদের প্রবল ক্ষমতাশালী করে তোলে। তৈমুরের আক্রমণের পরেও এরা ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবং শেষ পর্যন্ত দিল্লির ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করে। এই পর্বে সরকারি উচ্চপদে অ-তুর্কি মুসলমান ও ভারতীয় (হিন্দু)-দের কর্তৃত্ব প্রশ্নহীন হয়ে উঠেছিল।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।