সুলতানি আমলে আঞ্চলিক স্থাপত্য | সুলতানি যুগে আঞ্চলিক স্থাপত্য

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে আঞ্চলিক স্থাপত্য,সুলতানি যুগে আঞ্চলিক স্থাপত্য” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়

সুলতানি যুগে আঞ্চলিক স্থাপত্য :

দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাঙনের সূত্রে যেমন একাধিক আঞ্চলিক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠে, তেমনি ওই সকল আঞ্চলিক রাজ্যের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠে। দিল্লির সুলতানদের স্থাপত্যকর্মের মতো এত বিশাল ও ব্যাপক না-হলেও, ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্যধারার নিদর্শন হিসাবে এদের গুরুত্ব কম নয়। এইসব আঞ্চলিক স্থাপত্যে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও স্থাপত্যরীতির প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। স্থানীয় উপকরণ এবং শিল্পী-কারিগরদের সহায়তায় গড়ে ওঠা এই সকল স্থাপত্যকর্মেও শিল্পীদের নিষ্ঠা ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ, জৌনপুর, গুজরাট, মালব ও দক্ষিণ ভারতের বাহমনী ও বিজয়নগর রাজ্যে স্থানীয় স্থাপত্যের বহু নিদর্শন আজও কালের সাক্ষী হয়ে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে।

পাঞ্জাব : ভারতে আঞ্চলিক স্তরে মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীনতম ক্ষেত্র হল পাঞ্জাব। পাঞ্জাবে মুলতান ও লাহোরকে কেন্দ্র করে ইসলামি সভ্যতা গড়ে ওঠে। অবশ্য এই দুটি নগরে স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য অনুরূপ ছিল না। মূলতানে যেসব স্থাপত্যশিল্প সৃষ্টি হয়েছিল, তা আরব ও পারস্য-সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত। অন্যদিকে লাহোরে গড়ে ওঠা স্থাপত্য ও সংস্কৃতি গজনি ও সেলজুক্‌ তুর্কি-বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত। মিচেল (G. Michell)-এর ভাষায়, “The architecture of Multan blossomed from a blending of indegenous Indian building tradition and culture likes with southern Iron…”। সামগ্রিকভাবে এই দুটি ধারাকেই একত্রে ‘পাঞ্জাব-স্থাপত্য’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইমারতগুলির নির্মাণ উপকরণ ছিল ইট। ইটের দেওয়াল অতিরিক্ত মজবুত করার জন্য কড়ি বা বর্গা দেওয়ালের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। বৃহৎ কাষ্ঠখণ্ড দ্বারা ঝুল বারান্দা (Balcony) নির্মিত হত। মুলতান ও লাহোরের সমাধি সৌধগুলির নির্মাণ-বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে পার্সি ব্রাউন লিখেছেন যে, এখানে আরবীয়, পারসিক ও ভারতীয় এই তিনটি সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে (“In the style the mausoleum represents three pattern of culture Arabian, persian and Indian.”

বাংলা : বাংলার স্বাধীন ও অর্ধস্বাধীন মুসলিম রাজবংশগুলি রাজ্যের নানাস্থানে প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। নদীমাতৃক বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের খুব কমই এখন টিকে আছে। যেগুলি আছে তাদের অবস্থাও জরাজীর্ণ। মূলত গৌড় ও পাণ্ডুয়াকে কেন্দ্র করেই বাংলার মুসলিম-স্থাপত্য বিকশিত হয়। বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনের ভিত্তিতে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়—(১) ১২০২ থেকে ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে নির্মিত স্থাপত্য যার অধিকাংশই গৌড় নগরীতে অবস্থিত, (২) ১৩৪০ থেকে ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল যখন স্থাপত্যকর্ম পাণ্ডুয়াতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। (৩) তৃতীয় তথা শেষ পর্বের সময়কাল ১৪৪২ থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসানকাল পর্যন্ত প্রসারিত। এই সময় স্থাপত্যকর্মের কেন্দ্র পুনরায় রাজধানী গৌড়ে সরে গিয়েছিল। প্রথম পর্বের ইমারতগুলি ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম ও হুগলির পাণ্ডুয়াতে নির্মিত হয়। এই সময় ইট ও পাথর দিয়ে গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ নির্মিত হয়। এগুলির কোনো বুরুজ বা কার্নিশ ছিল না। মসজিদের মিহরাবের মধ্যে টেরাকোটার অলংকরণ থাকত।

বাংলায় সুলতানি স্থাপত্যের দ্বিতীয় ধাপে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। এই স্থাপত্যকর্মে মুসলিম স্থপতিদের নিজস্ব আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন দেখা যায়। পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ এই পর্বের একটি অনবদ্য স্থাপত্য নিদর্শনরূপে অভিহিত হয়। সুলতান সিকদার শাহ ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নতুন রাজধানীর (পাণ্ডুয়া) কেন্দ্রস্থলে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। আদিনা মসজিদের প্রাঙ্গণটি সুবিস্তৃত আয়তাকার এবং অসংখ্য খিলানায়িত পথ দ্বারা পরিবেষ্টিত। এর অঙ্গনের পরিমিতি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে যথাক্রমে ৪০০ ফুট ও ১৩০ ফুট। মসজিদের ছাদের সমস্ত ভার ২৬০টি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। মসজিদের সামগ্রিক দৈর্ঘ্য ৫০৭.৫ ফুট ও প্রস্থ ২৮৫.৫ ফুট। দামাস্কাসে নির্মিত আদি মসজিদের সাথে আদিনা মসজিদের সীমানা প্রায় সমান। প্রাঙ্গণের অভ্যন্তর ভাগ ৮৮টি স্তম্ভনির্ভর একটানা খিলান পর্দা দ্বারা শোভিত। মসজিদের প্রবেশপথটি তুলনামূলকভাবে অপরিসর ও ভ্রান্তস্থানে পরিকল্পিত। বিশাল মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে তিনটি খিলানায়িত প্রবেশদ্বারটি বাইরের দিকে উন্মুক্ত। মসজিদের বিশাল জুল্লাহ বা মুসল্লাটি পশ্চিম অংশে স্থাপিত। এটি এখন ছাদবিহীন অবস্থায় আছে। আড়াআড়িভাবে পাঁচসারি খিলানপথের সাথে অবস্থিত। এটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে যথাক্রমে ৭০ ফুট ও ৩৪ ফুট। মসজিদের উপরাংশের খিলান ও গম্বুজ মুলত ইট দ্বারা নির্মিত। তবে সামনের দেওয়ালের উপকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে মসৃণ ঘোর কৃষ্ণবর্ণের পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এই প্রস্তরখণ্ডগুলি নতুন নয়। সম্ভবত লক্ষণাবতী বা নিকটবর্তী কোনো হিন্দু-স্থাপত্যের কাঠামো থেকেই এগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে। ড. সুলতান আহমদ-এর মতে, প্রথম পর্যায়ের মুসলিম স্থাপত্যের উপকরণগুলি অধিকাংশই হিন্দু-স্থাপত্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। আদিনা মসজিদের অভ্যন্তর দেওয়ালে খোদাই করা প্রস্তরখণ্ড মূর্তির ছাপযুক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা এই মত সমর্থন করে। মসজিদের দরজাগুলি সবই প্রয়োজন অনুসারে পুরোনো স্থাপত্য থেকে সংগ্রহ করে এনে বসানো হয়েছে। লক্ষণাবতীর সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা ধ্বংস করে সম্ভবত এগুলি সংগ্রহ করা হয়েছিল।

আদিনা মসজিদের চোরাকুঠরিটি খুবই সৌষ্ঠবময়। এর সৌন্দর্য ও অলংকরণ মানবমনের সৌন্দর্যানুভূতির অনবদ্য প্রকাশ রূপে বিবেচিত হবে। এর মিহরাবটি সম্ভবত বৌদ্ধ বা হিন্দু মন্দিরের পবিত্র বিগ্রহের অধিষ্ঠানের ক্ষেত্র ছিল। পার্সি ব্রাউন লিখেছেন যে, “সামান্য রদবদলের পর বৌদ্ধ স্তূপের ডিঙি নৌকার মতো কুলঙ্গি বা হিন্দু-মন্দিরের অলংকৃত ডিভাগোস্তাকে (Devagosta) মুসলিম মিহরাব হিসেবে আদিনা মসজিদে স্থাপন করা হয়েছে।” সামগ্রিকভাবে আদিনা মসজিদ রাজকীয় মর্যাদা, গাম্ভীর্য ও শিল্পচর্চার উৎকর্ষতা-সম্পন্ন একটি শিল্পসৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলার সুলতানি স্থাপত্যশিল্প বিকাশের তৃতীয় পর্যায়ে (১৪৪০-১৫২৬ খ্রিঃ) নতুন স্থাপত্যধারার সূচনা ঘটে। ইতিমধ্যে বাংলার স্থাপত্যশিল্পে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছিল। এখন বাংলার আর্দ্র জলবায়ুর উপযোগী স্থাপত্যসৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছাদের জল দ্রুত অপসারণের জন্য ঢালু ছাদ ও বক্র কার্নিশের সংযোজন ঘটে। তৃতীয় পর্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য সৃষ্টি হল একলাখি সমাধি (১৪২৫ খ্রিঃ), দাখিল দরওয়াজা (১৪৫৯-৭৪ খ্রিঃ), তাঁতিপাড়া মসজিদ (১৪৭৫ খ্রিঃ), ছোটো সোনা মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ), সুরা মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ), বড়ো সোনা মসজিদ (১৫২৬ খ্রিঃ), কদম রসুল মসজিদ (১৫৩০ খ্রিঃ) ইত্যাদি।

সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে (১৪১৪-৩১ খ্রিঃ) ‘একলাখি’ স্মৃতি সৌধটি নির্মিত হয় (১৪২৫ খ্রিঃ)। এখানে সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর তৃতীয় ধারার প্রথম প্রকাশ দেখা যায়। এর ভিত্তি বর্গাকার। প্রতি পার্শ্ব ৭৬ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা কার্নিশ পর্যন্ত ২৫ ফুট। এর ওপরে আছে ৪০ ফুট ব্যাসার্ধের গোলাকার গম্বুজ। চূড়া অষ্টভুজাকৃতি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় দ্বিতলবিশিষ্ট। প্রকোষ্ঠের উন্মুক্ত স্থানগুলি সুচারুরূপে অলংকৃত। তবে অলংকরণের জন্য কোনো লতাপাতার নকশা ব্যবহৃত হয়নি। প্রতি পার্শ্বের মাঝখানে প্রস্তর নির্মিত দরজা। মূল কবরের প্রকোষ্ঠের গড়ন অষ্টভুজাকৃতি এবং এখানে কোনো জানালা নেই। দরজার ওপর দিয়ে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা আছে। ‘দাখিল দরওয়াজা’ একটি বিজয় তোরণ হিসেবে গৌড় দুর্গের উত্তর প্রাকারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। সুলতান বারবক শাহ আনুমানিক ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা হল ১১৩ ফুট × ৭৩ ফুট ৪ ইঞ্চি x ৬০ ফুট। বিশালাকার এই নির্মাণ মুসলিম শাসকদের বিপুলাকার স্থাপত্য সৃষ্টি দ্বারা চমক জাগানো মানসিকতার পরিচয় দেয়। গৌড়ের তাঁতিপাড়া মসজিদ ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এর বহির্ভাগ দৈর্ঘ্যে ৯১ ফুট এবং প্রস্থে ৪৪ ফুট। আয়তাকার এই মসজিদের দেওয়াল গড়ে ৬ ফুট। নির্মাণশৈলী ও স্থায়িত্বের বিচারে এটি দাখিল দরওয়াজা থেকে অনেক উন্নত। সৌন্দর্যময়তার দিক থেকে ছোটো সোনা মসজিদ’ অনবদ্য। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল জুড়ে এর নির্মাণকাজ চলেছিল। পার্সি ব্রাউনের মতে, ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল। আয়তাকার এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের পরিধি ৮২ ফুট × ৫২ ফুট। মসজিদ-কাঠামোর চার কোণায় চারটি অষ্টভুজাকৃতি বুরুজ (Tower) শোভা আছে। শীর্ষে আছে ১২টি গম্বুজ। মাঝখানের ছাদ বাংলার আদি কুঁড়েঘরের চৌচালার আদলে নির্মিত। ‘ঘোড়াঘাটা’ দুর্গের (দিনাজপুর জেলা) ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে ‘সুরা মসজিদ’ নির্মিত হয়। বর্গাকার সুরা মসজিদের নামাজগৃহের প্রতি বাহুর অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ৪.৯০ মিটার। মোট আটটি প্রস্তর স্তম্ভের ওপর সুবিশাল একটি ইট দ্বারা নির্মিত গম্বুজ আছে। দেওয়ালে ফুল ও লতাপাতার অলংকরণ-এর শোভা বৃদ্ধি করেছে। অধ্যাপক দানি (A. H. Dani)-র মতে, এটি হুসেন শাহের আমলে নির্মিত হয়েছিল।

গৌড়ের মসজিদগুলির মধ্যে বৃহত্তম ছিল বড়ো সোনা মসজিদ। বর্গাকার এই নির্মাণের সম্মুখভাগের দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট। এর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকের মাঝবরাবর একটি করে খিলানবিশিষ্ট তোরণদ্বার আছে, নির্মাণ উপকরণ হিসেবে এখানে ইট ও পাথর উভয় উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। মূল মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ১৬৮ × ৭৬ ফুট। মসজিদের নামাজঘর তিনটি খিলানায়িত আইলে বিভক্ত। মূল মসজিদের অংশবিশেষ কারুকার্য শোভিত। অলংকরণের উপকরণ হিসেবে উজ্জ্বল মিনা করা বহু বর্ণের টালি ব্যবহৃত হয়েছে। বড়ো সোনা মসজিদের বহিরাঙ্গ দৃষ্টিনন্দন নয়, কিন্তু এর সারল্য মনোমুগ্ধকর। ফারগুসন (J. Ferguson)-এর মতে, “এখনো টিকে থাকা গৌড়ের স্থাপত্যকীর্তিগুলির মধ্যে বড়ো সোনা মসজিদ বাংলা স্থাপত্যের একটি সুন্দর ও অনবদ্য হর্ম্য।”। জন মার্শালের মতে, এই মসজিদের নকশা দ্রাবিড় স্থাপত্যের অনুরূপ। তাই অনেকে এটিকে দ্রাবিড় স্থাপত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত সৃষ্টি বলে মনে করেন। গৌড়ের ‘কদম রসুল’ মসজিদের নির্মাণ-উপকরণ স্থূল এবং সম্ভবত এগুলি হিন্দু ইমারত থেকে সংগৃহীত হয়েছে।

সুলতানি আমলে জৌনপুর স্থাপত্য :

জৌনপুর সুলতানি পাশ্চাত্যের অন্যতম অঙ্গরাজ্য ছিল। এই অঞ্চলের শাসক তুঘলক আমলে মালিক-আস-শার্ক বা প্রাচ্যের রাজা উপাধি পান। কালক্রমে শার্ক বংশীয় সুলতান দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে জৌনপুরে স্বাধীন শাকীবংশের শাসন শুরু করেন। শাকীবংশের আমলেই এখানে স্থাপত্যচর্চা হয়। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, “জৌনপুরের সুলতানরা শিক্ষা ও শিল্পের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। তাঁদের নির্মিত একাধিক অট্টালিকা ও মসজিদ তাঁদের সু উন্নত স্থাপত্যরুচির পরিচয় বহন করে।” তবে এখানেও দুর্গ ও কয়েকটি মসজিদ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো স্থাপত্যকর্ম দেখা যায় না। যাই হোক, জৌনপুরের শাসকরা প্রজাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে কার্পণ্য করতেন না। তাঁরা স্বল্পকালের মধ্যেই সুন্দর প্রাসাদ, মসজিদ, মাকবারা ইত্যাদি নির্মাণ করে রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। জৌনপুর-স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য কাঠামো হল অটলা মসজিদ। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একদা এর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৪০৮ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরের শার্কী শাসক শামসউদ্দিন ইব্রাহিম এটির নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন। ১৭৭ ফুট ব্যাসযুক্ত বর্গাকার অঙ্গন নিয়ে এটি গঠিত। ‘অটলা মসজিদ’ নামকরণ থেকে অনুমিত হয় যে, সম্ভবত অটলাদেবী নামক কোনো মন্দির থেকে এর উপকরণ সংগৃহীত হয়েছিল। এর নির্মাণশৈলী প্রচলিত মসজিদ স্থাপত্যের অনুরূপ। তিনদিকে ৪২ ফুট লম্বা ছাদযুক্ত বারান্দা এবং পশ্চিমদিকে মুল্লাহ অবস্থিত। অটলা মসজিদের জুল্লাহ বা নামাজঘরটি খুবই সুদৃশ্য। সামনের দেওয়াল জৌনপুরের শিল্পকর্ম দ্বারা শোভিত। মধ্যপ্রান্তে সুউচ্চ পিরামিডসদৃশ তোরণ, যার উচ্চতা প্রায় ৭৫ ফুট। এই মসজিদের গঠন-বৈশিষ্ট্য থেকে শিল্পসমালোচকরা মনে করেন যে, এখানে তুঘলক স্থাপত্যশৈলী অনুকরণের আন্তরিক চেষ্টা করা হয়েছে। জৌনপুরের অন্য দুটি স্থাপত্য সৃষ্টি হল ‘খালেছ মোঘলেছ মসজিদ’ এবং ‘জাহাঙ্গীরি মসজিদ’। অত্র অঞ্চলের দুজন শাসক মালিক খালেছ ও মোঘলেছ এর নির্দেশে প্রথমটি নির্মিত হয়েছিল। এর গঠনশৈলী ও অলংকরণ অতি সাধারণ। দ্বিতীয় মসজিদটির খিলান তোরণে মসৃণ পর্দাযুক্ত থাকার কারণে একে জাহাঙ্গীরি (পর্দা) মসজিদ বলা হয়। এর নির্মাতারা ইমারতের সমুদয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুষমতার প্রতি যত্নবান হননি। তাই এর সৌন্দর্যময়তার সাথে কাঠামোর অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ে। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে জনৈক কাময়ু নামক হিন্দু স্থপতি লাল দরওয়াজা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। শাকীবংশের সর্বশেষ শাসক হোসেন শাহ ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরে জামা মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। এই নির্মাণকে জৌনপুরের সর্বাধিক উচ্চাভিলাষী স্থাপত্য সৃষ্টি বলা হয়। সতীশ গ্রোভারের মতে, “এই মসজিদের গড়ন ও বিশালত্ব থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি সম্পূর্ণ হতে অন্তত এক যুগ সময় লেগেছিল” (“This is apparent from the form and shape of the great Jami Mosjid of Jaunpur that took over a generation to complete.”)। ২০ ফুট উঁচু বেদীর ওপর মসজিদটি স্থাপিত। বর্গাকার মসজিদ গৃহের প্রতি পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ২১ ফুট। ক্রমোন্নত সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হত। এই সোপানবিশিষ্ট নির্মাণ পদ্ধতি ফিরোজশাহ তুঘলকের আমলে প্রথম পরিলক্ষিত হয়। মসজিদের নামাজঘরের ঠিক সম্মুখভাগে প্রশস্ত প্রবেশপথটি অবস্থিত। বিশাল মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ স্তম্ভ বা অন্য কোনোরকম আলম্ব দ্বারা ভারাক্রান্ত নয়। এ ধরনের উন্মুক্ত স্থাপত্য কাঠামো অন্যত্র চোখে পড়ে না। আদিনা মসজিদের সাথে এর কিছুটা মিল দেখা যায়। তবে আদিনার ইট নির্মিত স্থাপত্য কাঠামো প্রায় মাটিতে মিশে গেছে। কিন্তু জৌনপুরের ধনুকাকৃতি ছাদ এখনো অক্ষত আছে।

সুলতানি আমলে গুজরাট স্থাপত্য :

গুজরাটে সুলতানি স্থাপত্যের সূচনা হয় চতুর্দশ শতকের গোড়ায়। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির প্রাদেশিক গভর্নর উলুঘ খাঁ তৎকালীন রাজধানী অনহিলওয়াড়া পাটনা শহরকে কেন্দ্র করে স্থাপত্য গড়তে শুরু করেন। এই স্থাপত্যধারা অব্যাহত ছিল ষোড়শ শতকের শেষ দিকে গুজরাটের স্বাধীন আহমদ শাহি বংশের অবসানকাল পর্যন্ত। এই বংশের স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন মুজফ্ফর শাহ (১৪০৭ খ্রিঃ)। এই বংশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বেশি। এঁরা স্থাপত্যসৃষ্টির কাজে ধারাবাহিকভাবে আগ্রহ দেখায়। অবশ্য শিল্পকলা বা সৌন্দর্যপ্রীতি থেকে তাঁরা এই কাজে ব্রতী হয়েছিলেন তা নয়। তাঁদের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে এগুলি নির্মিত হয়েছিল। তবে প্রাদেশিক মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসে গুজরাটের মুসলিম স্থাপত্য অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন। গুজরাটে ভারতের সবচেয়ে পারদর্শী কারিগর ও স্থপতিদের বসবাস ছিল। এই সকল দক্ষ স্থানীয় কারিগরদের জোগান গুজরাটে স্থাপত্যের বিকাশে সহায়ক ছিল। প্রাথমিক পর্বের স্থাপত্যকর্মগুলিতে প্রচলিত ‘শীলপাস’ (Silpas) রীতি অনুসৃত হত। পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমান স্থপতিদের সহযোগী হিসেবে হিন্দু স্থপতিরা শিল্পসৃষ্টিতে যুক্ত হতেন।

গুজরাটে সুলতানি-স্থাপত্যের প্রথম পর্বের পরিধি ১৩০০ থেকে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময় পাটনে শেখ ফরিদের সমাধিসৌধ ও একটি ‘আদিনা মসজিদ’ নির্মিত হয়। এই সকল নির্মাণের উপকরণ হিন্দুমন্দির থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। পুরোনো উপাদাননির্ভর এই দুটি স্থাপত্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। একই ধরনের আর একটি নির্মাণ হল ভারুচ (ব্রোচ)-এর ‘জামি মসজিদ’। অবশ্য হিন্দু বা জৈন মন্দির থেকে স্তম্ভগুলি সংগ্রহ করা হলেও মসজিদে সেগুলি হুবহু ব্যবহার করা হয়নি। নতুন কাঠামোর প্রয়োগ অনুসারে সেগুলিতে পরিবর্তন ঘটানো হয়। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ভারুচ থেকে ক্যাম্বে শহরে স্থানান্তরিত হলে এই বন্দর শহরে স্থাপত্য-নির্মাণ শুরু হয়। স্থানীয় গভর্নর মহম্মদ বুতমারি ক্যাম্বেতে ‘জামি মসজিদ’ নির্মাণ করেন। আয়তাকার ক্যাম্বে মসজিদের চৌহদ্দি উত্তর-দক্ষিণে ৭৬.৮০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৬৪.৬০ মিটার ছিল। মসজিদের মূল নামাজ গৃহ ৭ আইল ও ২৭টি ‘বে’ (Bay)-তে বিভক্ত ছিল। এর চূড়ায় ছিল ১৪টি গম্বুজ। এই মসজিদের নির্মাণশৈলী ও পদ্ধতির সাথে খলজি আমলের স্থাপত্যশৈলীর প্রচুর মিল দেখা যায়।

গুজরাট-স্থাপত্যের দ্বিতীয় পর্বের পরিধি ১৪১১-‘৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সুলতান প্রথম আহম্মদ শাহর (১৪১১-‘৪২ খ্রিঃ) ক্ষমতালাভের সঙ্গে সঙ্গে গুজরাটে স্থাপত্যচর্চার পরিবেশে ফিরে আসে। তিনি ১৪১১ খ্রিস্টাব্দে নিজ নামে আহমেদাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করে রাজধানী সরিয়ে আনেন। এই দুর্গনগরী আয়তাকার পরিবেষ্টনসহ নদীর তীর বরাবর প্রলম্বিত। দুর্গের প্রধান ফটকের অনতিদূরে রাজকীয় বিজয় তোরণটি স্থাপিত। আহমদ শাহের আমলে চারটি মসজিদ নির্মিত হয়—সৈয়দ আলম মসজিদ (১৪১২ খ্রিঃ), আহমদ শাহ মসজিদ (১৪১৪ খ্রিঃ), হায়রৎ খাঁ’র মসজিদ (১৪২৪ খ্রিঃ) এবং আহমেদাবাদ জামি মসজিদ (১৪২৪ খ্রিঃ)। আহমদ শাহ ‘তিন দরজা’ নামক একটি স্থাপত্য কাঠামো নির্মাণ করেন। এটি হল প্রাসাদের প্রবেশ মুখের সম্মুখস্থ সদর দরজা। মন্ত্রী, অমাত্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ রাজদরবারে প্রবেশের প্রাক্কালে এখানে সমবেত হতেন। সব আকারের তিনটি দরজা দ্বারা এটি সুসজ্জিত। মাঝের দরজাটি সুন্দর ও মজবুতভাবে ঢালাই করা মিনার দ্বারা সমর্থিত। এ ছাড়াও আহমদ শাহর সমাধি, রানি-কা-হুজরা, দরিয়া খানের সমাধিসহ অসংখ্য মসজিদ ও সমাধি সৌধ এই পর্বের স্থাপত্যধারাকে সমৃদ্ধ করেছিল।

গুজরাট-স্থাপত্যের তৃতীয় পর্বের সূচনা হয় সুলতান মাহমুদ বাগড়ার শাসনকালে (১৪৮৫-১৫১১ খ্রিঃ)। তিনি চম্পানীর, মাহমুদাবাদ ও জুনাগড় শহর প্রতিষ্ঠা করে বহু সুদৃশ্য ইমারত ও পথঘাট দ্বারা শোভিত করেন। এই পর্বে চম্পানীর জামি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ, শাহি মসজিদ, নওলাখি মসজিদ ইত্যাদি নয়ন মনোহর স্থাপত্যসৃষ্টি সম্পন্ন হয়। সোপানবিশিষ্ট কূপ নির্মাণের কাজেও এ যুগের কারিগররা বিশেষ দক্ষতা দেখান।

সুলতানি আমলে মালোয়া (মালব) স্থাপত্য :

মালোয়া চতুর্দশ শতকের শেষ পর্যন্ত দিল্লি-সুলতানির অধীনে ছিল। ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে মালোয়ার সুবাদার দিলওয়ার খাঁ ‘ঘোরি শাহ’ উপাধি নিয়ে স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। তাঁর পুত্র হুমাং শান্তর (আদি নাম আলবা খাঁ) -এর আমলে মালোয়াতে ইসলামিক-স্থাপত্যের নতুন যুগের সূচনা হয়। মালোয়াতে স্থাপত্যচর্চার দুটি প্রধান কেন্দ্র ছিল ধর ও মাণ্ডু। তবে এই দুটি শহরে কোনো শিল্প-ঐতিহ্য ছিল না। ফলে এখানে স্থাপত্যচর্চার জন্য বহিরাগত স্থপতি ও কারিগরদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ইতিমধ্যে তৈমুর লঙের আক্রমণের ফলে দিল্লির সুলতানদের রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রতিপত্তি এতটাই বিনষ্ট হয়েছিল যে, স্থাপত্যচর্চার মতো মানসিকতা ও আর্থিক সংগতি তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই অবস্থার সুযোগ পায় মালোয়া। রাজধানী দিল্লির এই সকল কর্মহীন কারিগর জীবিকার সন্ধানে মালোয়া, গুজরাট প্রভৃতি প্রাদেশিক রাজ্যগুলিতে পাড়ি দেয়। পার্সি ব্রাউন মনে করেন যে, মালোয়ার স্থাপত্যকর্মগুলির সাথে দিল্লির স্থাপত্যশৈলীর সাযুজ্যের ভিত্তিতে মালোয়ার স্থাপত্যে দিল্লির স্থপতিদের অবদানের ধারণা করা যায়।

মালোয়া-স্থাপত্যে ইমারতগুলি সুউচ্চ ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ক্রমোন্নত সোপান বেয়ে মূল মেঝেতে আসতে হত। এই সুউচ্চ চত্বর সমগ্র কাঠামোকে একটা বিশেষ মর্যাদা ও আভিজাত্যমণ্ডিত করেছে। সোজা ও ঊর্ধ্বমুখী এই কাঠামোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হল বিচিত্র রঙের কারুকার্য দ্বারা অলংকরণ। কালের নিয়মে এই সকল রঙ এখন অনেকটাই ম্লান। তথাপি অবশিষ্ট নিদর্শন সেকালের শিল্পীদের সৌন্দর্যরসিক মানসিকতার সাক্ষ্য দেয়। রঙ করার জন্য নানা রঙ-এর পাথর ও মার্বেল ব্যবহার করা হত। এ ছাড়া মাটির ঢালিকে আগুনে পুড়িয়ে রঙিন করে তোলা হল এবং পরে তার নানা খণ্ড ইমারতের দেওয়ালে লাগানো হত। ইমারতের মূল উপকরণ হিসেবে বেলে পাথর ও স্নিগ্ধ লাল আভাযুক্ত বেলে পাথর ব্যবহৃত হত। মালোয়ার প্রথম পর্বের স্থাপত্যসৃষ্টিগুলির অন্যতম চারটি মসজিদ। এগুলি হল ধরের (১) কামাল মওলা মসজিদ ও (২) লাট মসজিদ। দুটিই ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। অন্য দুটি মসজিদ (৩) দিলেয়ারা খাঁ’র মসজিদ (১৪০৫ খ্রিঃ) এবং (৪) মালিক মুগিম মসজিদ (১৪৫২ খ্রিঃ) নির্মিত হয় মাণ্ডুতে।

মাণ্ডুতে মালোয়ার রাজধানী স্থানান্তরিত হলে সেখানে ব্যাপক স্থাপত্যনির্মাণ ঘটে এবং মালোয়া স্থাপত্যের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। হুসাং শাহের আমলে এই কাজের সূচনা হয়। রাজধানী স্থানান্তরের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল সুপ্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা। তাই মাণ্ডু নগরদুর্গের চতুর্দিকে সুউচ্চ, মজবুত প্রাচীর এবং বহির্দিকে প্রসারিত তোরণের ওপর প্রহরা-চৌকির ব্যবস্থা দ্বারা এই নির্মাণকে স্মরণীয় করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত দুর্গনগরীর মাণ্ডুর পরিধি প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ ইমারতগুলির মধ্যে সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক স্থাপত্য কমিটি হল মাণ্ডু জামি মসজিদ। বর্গাকার এই মসজিদ সুলতান প্রথম মাহমুদ শাহ ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র তিনটি কাঠামোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যৌগিক স্থাপত্য আশরফি মহল ও মাণ্ডুর দৃষ্টি নন্দন একটি স্থাপত্যকর্ম। প্রথমে মহাবিদ্যালয় হিসেবে এটি পরিকল্পিত হয়। পরে প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহারের জন্য এর কিছু রদবদল ও সংযোজন করা হয়। অবশেষে এই যৌগিক ইমারতের এক অংশের ওপর রাজকীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। পার্সি ব্রাউনের মতে, এই ইমারতের গাঁথুনি বা নির্মাণ-প্রক্রিয়া অলংকরণ দ্বারা সমৃদ্ধিশালী করা হলে এই সমাধিসৌধ মুসলিম স্থাপত্যের এক অনিন্দ্যসুন্দর কীর্তি রূপে চিহ্নিত হয়ে থাকত। ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই স্থাপত্য কাঠামোর সাথে একটি বিজয়স্তম্ভ যোগ করা হয়। চিতোরের রানাকে পরাজিত করার গৌরবের সাক্ষ্য হিসেবে সুলতান মাহম্মদ উত্তর-পূর্ব কোনাকে ১৫০ ফুট উঁচু করে এই বিজয়স্তম্ভ রচনা করেন। তবে দ্রুততার সাথে এবং যথেষ্ট মজবুত রূপে নির্মাণ না করার কারণে বর্তমানে এর কেবল ভিত্তিটুকু অবশিষ্ট আছে। মাণ্ডুতে নির্মিত আর একটি স্মরণীয় স্থাপত্যকর্ম হল হুসাং শাহের সমাধি। তিনি স্বয়ং এটির সূচনা করেন এবং সমাপ্ত করেন তাঁর বংশধর মাহমুদ (১৪৪০ খ্রিঃ)।

মাণ্ডুতে আদি পর্বের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দুটি উল্লেখযোগ্য ইমারত হল হিন্দোলা মহল ও জাহাজ মহল। প্রাসাদজাতীয় এই দুটি ইমারতের নির্মাণবৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। ‘হিন্দোলা মহল’ মালোয়া স্থাপত্যের কাঠিন্য ও অদম্য রূপটি তুলে ধরে। অন্যদিকে ‘জাহাজ মহল’ প্রাণময়তা ও জীবনীশক্তির প্রকাশ। ‘হিন্দোলা মহল’ ছিল ‘দরবার কক্ষ’ বা ‘জামাতখানা’। এর গঠন অতি সুঠাম। এর পুরু ঢালু দেওয়াল এটিকে অনেকাংশে দুর্গের প্রতিরূপ দিয়েছে। এর ভূমি-নকশার আকার অনেকটা ইংরেজি “T” অক্ষরের মতো। নীচু থেকে ঊর্ধ্বমুখী লম্বমান অংশটিই প্রধান মিলনায়তন। মাথার ওপরের আড়াআড়িভাবে স্থাপিত T অংশটি মাথা হিসেবে পরে বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রধান মিলনায়তনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা হল ১১০ × ৬০ × ৩৫ ফুট। ‘জাহাজ মহল’কে মাণ্ডু-স্থাপত্যের ক্রান্তিলগ্নের সৃষ্টি বলা যায়। পার্সি ব্রাউন লিখেছেন, “The Jahaz Mahal, in the final building representing the classic phase of the building art at Mandu”। রাজকীয় প্রাসাদের প্রাণচাঞ্চল্য এই নির্মাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কারুকার্যমণ্ডিত এই নির্মাণটি বিলাস সম্ভারে পরিপূর্ণ এবং সম্ভবত রাজপরিবারের মহিলাদের চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হত। প্রয়োজনমতো দরবার কক্ষ হিসেবেও এর ব্যবহার ছিল। জন মার্শালের মতে, “Its (Jahaz Mahal) fine arched halls, its roof, pavilions and badly designed reservoirs still forms one of the most conspicuous landmarks in Mandu. “2 স্থানীয় ভিত্তিতে স্থাপত্যের কেন্দ্র হিসেবে চান্দেরী শহরের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ হল চান্দেরীর রাজপ্রসাদ। এটি ‘কুশাক মহল’ (Kushak Mahal) নামে পরিচিত। মালোয়ার শাসক প্রথম মাহমুদ ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে ফতেহাবাদের নিকট সাততলাবিশিষ্ট এই প্রসাদ নির্মাণ করেন। ফেরিস্তার বিবরণেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়া কিছু মাকবারা, মাদ্রাসা, মসজিদ এখনো নির্মিত হয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment