আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি আমলে ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন
সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ইলিয়াস শাহি বংশ নামে খ্যাত। বস্তুত, ইলিয়াস শাহের সিংহাসনারোহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন পর্যায়ের সূচনা হয়েছিল। দিল্লির অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই স্বাধীন সুলতানির প্রতিষ্ঠার পটভূমি তৈরি করে দেয়। এই সময় উত্তর ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলককে বিব্রত ও ব্যস্ত করে রেখেছিল। এই সুযোগে হাজি ইলিয়াস লক্ষ্মণাবতীর শাসনক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। তবে ঠিক কোন সময়ে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তা বিতর্কিতই থেকে গেছে। ড. এন. বি. রায় মনে করেন, যেহেতু সোনারগাঁও ও লক্ষ্মণাবতীতে যথাক্রমে ফকরউদ্দিন ও আলি শাহ ১৩৪০-৪৫-এর মধ্যবর্তীকালে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেহেতু হাজি ইলিয়াস সম্ভবত সাতগাঁওকে কেন্দ্র করে নিজ দক্ষতা সংহত করেছিলেন। এবং ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে লক্ষ্মণাবতীর কর্তৃত্ব দখল করেন।
সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্ব-ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট। আরবি ঐতিহাসিক ইবন্ হজর ও আল সখাই-এর মতে, ইলিয়াসের আদি নিবাস ছিল পূর্ব-ইরানের সিজিস্তান। আবার কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁকে আলি শাহের বৈমাত্রেয় ভাই কিংবা ভৃত্য বলা হয়েছে। যাই হোক্, তিনি আলি শাহের অধীনে রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং ষড়যন্ত্র দ্বারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তারিখ-ই-ফিরোজশাহি, তরকৎ ই-আকবরী, তারিখ-ই-ফিরিস্তা, সিরাৎ-ই ফিরোজশাহি প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে তাঁর রাজত্বকালের বিবরণ জানা যায়। লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসন দখল করার পরেই ইলিয়াস শাহ রাজ্যবিস্তারে মন দেন। ত্রিহৃত অধিকার করে তিনি হাজিপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। চম্পারণ, গোরক্ষপুর, কাশী প্রভৃতি অঞ্চলও তিনি জয় করেন। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইলিয়াস শাহ ঐশ্বর্যশালী উড়িষ্যার পূর্ব গঙ্গারাজ্য আক্রমণ করেন। গঙ্গারাজ্যে প্রবল প্রতিরোধ ভেঙে ইলিয়াস শাহের বাহিনী চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। সুলতান উড়িষ্যা থেকে ৪৪টি হাতি ও প্রচুর ধনরত্নসহ প্রত্যাবর্তন করেন। নেপালের বিরুদ্ধেও তিনি সফল অভিযান প্রেরণ করেন। নেপালের বহু মন্দির ধ্বংস করেন। পশুপতিনাথের বিখ্যাত মূর্তিটিও তিনি তিন খণ্ডে পরিণত করেন (১৩৫০ খ্রিঃ)। নেপালে থেকে বহু অর্থ সংগ্রহ করে ইলিয়াস স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে গাজি শাহকে পরাজিত করে ইলিয়াস শাহ পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও অঞ্চল দখল করেন। ফলে বাংলায় রাষ্ট্রীয় ঐক্য স্থাপিত হয়। কামরূপ রাজ্যের কিয়দংশও তাঁর অধিকারভুক্ত হয়।
ইলিয়াস শাহের সামরিক সাফল্যে ও ক্ষমতার দ্রুত প্রসার দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলককে শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল। তাই ইলিয়াসকে দমন করার জন্য তিনি বিশাল বাহিনীসহ বাংলাদেশ আক্রমণ করেন (১৫৫৩ খ্রিঃ)। সুলতানি বাহিনী ত্রিহৃত পুনর্দখল করে বাংলায় উপস্থিত হয় এবং পাণ্ডুয়া দখল করে নেয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইলিয়াস শাহ সপরিবারে পাণ্ডুয়ার অনতিদুরে দুর্ভেদ্য ‘একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। দীর্ঘদিন একডালা দুর্গ অবরোধ করে রেখেও ফিরোজ তুঘলক ইলিয়াস শাহকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে বিফল হন। দিল্লির সুলতানি সৈন্যের এই অবরোধে ইলিয়াস শাহের সেনাদের মধ্যে সর্বাধিক বীরত্ব দেখায় বাঙালি পাইক বা পদাতিক বাহিনী। পাইকদের সর্দার সহদেব এই যুদ্ধে প্রাণ দেন। অবশেষে ৪৪টি হাতি ও কিছু অর্থসম্পদ দখল করে তিনি দিল্লিতে ফিরে যান। এই অভিযানের অগ্রগতি ও পরিণতি সম্পর্কে বিতর্ক আছে। বারাণী, ইসামী প্রমুখের লেখা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সুলতান ফিরোজ তুঘলক ইলিয়াস শাহকে বিধ্বস্ত করেছিলেন কিন্তু দুর্গের অভ্যন্তরে ক্রন্দনরত মহিলাদের প্রতি করুণাবশত দুর্গ দখল না করেই দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। স্বভাবতই তাঁদের বক্তব্যে ঐতিহাসিক সত্যতা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। ড. মজুমদার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ইতিহাসবিদ মনে করেন, এই যুদ্ধে কোনোপক্ষই চূড়ান্তভাবে জয়ী হতে পারেনি। যুদ্ধে উভয়পক্ষেরই প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সম্ভবত, বর্ষাকালের আগমন-সম্ভাবনা থেকেই ফিরোজ তুঘলক একডালার অবরোধ অসম্পূর্ণ রেখে রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অনেকের মতে, ইলিয়াস শাহ ফিরোজের অবরোধ ভাঙার জন্য উড়িষ্যার গঙ্গরাজের সাহায্য চেয়েছিলেন। এটিও ফিরোজের আশঙ্কার কারণ ছিল। যাই হোক্, ফিরোজ তুঘলক দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করে বিজয়-উৎসব পালন করে আত্মপ্রমাদ লাভ করেন। এদিকে দিল্লির বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে ইলিয়াস তাঁর হারানো রাজ্যাংশগুলিও পুনরুদ্ধার করে নেন। শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির দ্বারা ফিরোজ তুঘলক কার্যত, ইলিয়াস শাহের মর্যাদা স্বীকার করে নেন। পক্ষান্তরে, ইলিয়াস শাহ ফিরোজ তুঘলককে দু-বার প্রচুর মূল্যবান উপটৌকন প্রেরণ করে সন্তুষ্ট করেন।
দিল্লির অনুগ্রহপুষ্ট লেখকেরা ইলিয়াস শাহকে সিদ্ধি বা ভাঙ-জাতীয় নেশায় আসক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহি’র মতে, তিনি কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ছিলেন। ড. মজুমদার এই বক্তব্যকে ‘বিদ্বেষপ্রণোদিত মিথ্যা উক্তি’ বলে মনে করেন। আনুমানিক ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহের মৃত্যু হয়।
ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকন্দর শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর (১৩৫৮-‘৯১ খ্রিঃ) তিনি রাজত্ব করেছিলেন। পিতার মতো তিনিও যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শাসক ছিলেন। নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করার জন্য সিকন্দর দিল্লির সাথে সংঘাত এড়িয়ে চলার পক্ষপাতী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রচুর উপঢৌকনসহ দিল্লিতে দূত পাঠান। কিন্তু সুলতান ফিরোজ তুঘলক প্রথমবার বাংলা অভিযানের ব্যর্থতা ভুলতে পারেননি। তাই সিকন্দর শাহের আমলে তিনি বাংলাদেশ আক্রমণ করেন। সোনারপুরের জনৈক আমিরের প্রতি অমানবিক ব্যবহার করা হয়েছে, এই অজুহাতে ফিরোজ বাংলা আক্রমণ করেন। ‘আফিফ’ও ‘সিরাৎ’গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সিকন্দর শাহ সুলতানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে পিতার মতোই দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফিরোজ শাহ কয়েকমাস দুর্গ অবরোধ করে রাখেন, কিন্তু দুর্গ অধিকার করতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ ক্লান্ত হয়ে সন্ধি স্থাপন করেন। ফিরোজ শাহ ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে সসৈন্যে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। পরবর্তী ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, সুলতান বাংলাদেশের উপর সিকন্দর শাহের সার্বভৌম কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। সমমর্যাদাসম্পন্ন নৃপতির মতোই উভয়ের মধ্যে দূত ও উপঢৌকন বিনিময় তার অন্যতম প্রমাণ। পরবর্তী দীর্ঘ দুশো বছর আফগানের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে দিল্লির কোনো শাসক অভিযান করেননি।
সিকন্দর শাহ কেবল প্রতিভাসম্পন্ন যোদ্ধা ও শাসক ছিলেন না, শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক রূপেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তাঁর উদ্যোগে বহু সুদৃশ্য মসজিদ, মিনার ও প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। সিকন্দর শাহের বিশিষ্ট শিল্পকীর্তি হল পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ (১৩৬৯ খ্রিঃ)। ড. মজুমদারের মতে, “স্থাপত্য-কৌশলের বিচারে এই মসজিদটি অতুলনীয়। ভারতবর্ষে নির্মিত সমস্ত মসজিদের মধ্যে ‘আদিনা মসজিদ’ আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয়”। গৌড়ের কোতোয়ালী দরওয়াজা, মোল্লা সিমলাই (হুগলী)-এর মসজিদ তাঁর আমলেই নির্মিত হয়। মুসলিম সাধুসন্তদের প্রতিও তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ ছিল। পাণ্ডুয়ার প্রখ্যাত দরবেশ আলা-অল্-হকের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেবীকোটের জনপ্রিয় সন্ত মোল্লা আতার স্মৃতিরক্ষার্থে সিকন্দর পূর্বোক্ত মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
সিকন্দর শাহের শেষ জীবন খুব সুখের ছিল না। ‘রিয়াজ-উস্-সালাতিন’ গ্রন্থের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তাঁর পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিরোধ তাঁকে যথেষ্ট বিব্রত করেছিল। তাঁর প্রিয় পুত্র গিয়াসউদ্দিন অকারণ আশঙ্কাবশত সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। সোনারগাঁও থেকে তিনি সসৈন্যে লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করলে যে যুদ্ধ হয়, তাতে জনৈক সৈনিকের হাতে সিকন্দর শাহ নিহত হন। অবশ্য এই পরিণতি গিয়াসউদ্দিনের অনিচ্ছাকৃত ছিল এবং তাঁর মনে অনুতাপের সঞ্চার করেছিল।
পরবর্তী শাসক গিয়াসউদ্দিন আজম শাহপ্রায় কুড়ি বছর (১৩৯১-১৪১১ খ্রি) বাংলা শাসন করেন। পূর্বসুরিদের মতো তিনিও প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। তবে ইলিয়াস শাহ ও সিকন্দর শাহ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁর সামরিক দক্ষতা ও সাম্রাজ্যের সংগঠন-ক্রিয়ার জন্য। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ খ্যাত ছিলেন তাঁর লোকরঞ্জক ব্যক্তিত্বের জন্য। ড. মজুমদারের মতেঃ “তাঁর মতো বিদ্বান, রুচিবান, রসিক ও ন্যায়পরায়ণ নৃপতি এ পর্যন্ত খুব কমই আবির্ভূত হয়েছেন।” যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দেন। কামতা রাজ্য ও অহোম রাজ্যের মধ্যে বিরোধের সুযোগে তিনি কামতারাজ্যের একাংশ দখল করে নেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কামতা ও অহোম রাজ্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়াসউদ্দিনের বাহিনীকে আক্রমণ করে ও কামতা রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে। এই ব্যর্থতা বাংলা সুলতানের মর্যাদা হানি করেছিল। অবশ্য ন্যায়পরায়ণতা ও বিদ্যোৎসাহিতার জন্য তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘রিয়াজ এ বলা হয়েছে যে, একবার গিয়াসউদ্দিন অসাবধানতাবশত এক বিধবার পুত্রকে আহত করলে বিধবা কাজির কাছে বিচারপ্রার্থী হন। সুলতান সশরীরে কাজির দরবারে উপস্থিত হয়ে দোষ স্বীকার করে নেন। এমনকি কাজির সাহস ও নিরপেক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান কাজিকে পুরস্কৃতও করেন। বিহারের দরবেশ মুজফ্ফর বলখির পত্র থেকেও গিয়াসউদ্দিনের ন্যায়নিষ্ঠা ও ধর্মপরায়ণতার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। বলখি লিখেছেন যে, সুলতান নির্ভীকতা, উদারতা, মহত্ত্ব বিদ্যানুরাগ ইত্যাদি বহু গুণে ভূষিত ছিলেন। পিতা ও পিতামহের মতো সাধুসন্তদের সাথেও গিয়াসউদ্দিনের মধুর সম্পর্ক ছিল। বলখি ছাড়াও প্রখ্যাত সন্ত নূর কুতব আলমের সাথে সুলতানের ঘনিষ্ঠতা ছিল। বহু অর্থব্যয় করে তিনি মক্কা ও মদিনার দুটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। নিজে হানাফি হলেও ইসলামের অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। মক্কাতে তিনি একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন ও খাল খননের ব্যয়ভার বহন করেন। মক্কা ও মদিনার লোকেদের দান করার জন্যও তিনি বহু অর্থ প্রেরণ করেন।
কবি ও কাব্যমোদী হিসেবে গিয়াসউদ্দিন আজন্ম খ্যাতি পেয়েছিলেন। পারস্যের অমর কবি হাফিজের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল। কথিত আছে যে, সুলতান একটি অসমাপ্ত ফারসি গজল হাফিজের কাছে পাঠালে হাফিজ তা পূরণ করে ফেরত দিয়েছিলেন। অবশ্য ভারতীয় কবিদের সাথে তাঁর কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল, তা জানা যায়নি। বিদ্যাপতি কবির নামযুক্ত একটি পদে জনৈক ‘গ্যাসদীন সুরতান’-এর প্রশস্তি পাওয়া গেছে। অনেকের মতে, এই পদকর্তা মিথিলার প্রখ্যাত কবি বিদ্যাপতি এবং ‘গ্যাসদীন সুরতান’ বলতে গিয়াসউদ্দিন সুলতানকে বোঝানো হয়েছে। ড. মজুমদার এই মন্তব্যের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বিদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন গিয়াসউদ্দিনের একটি প্রশংসনীয় কাজ। জৌনপুরের সুলতান মালিক সরওয়ারের সাথে তাঁর দুতবিনিময় হয়েছিল। চিনদেশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, চিনসম্রাট ইয়ুং লোর কাছে গিয়াসউদ্দিন ১৪০৫, ১৪০৮, ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে দূত প্রেরণ করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে চিনের দূতও বাংলাদেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই দূতদের সাথে দোভাষী হিসেবে মা-হুয়ান এদেশে আসেন। তাঁর বিররণী থেকে তৎকালীন বাংলা ও বাঙালিদের সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। তিনি বাংলার উন্নত কৃষিব্যবস্থা ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যের উল্লেখ করেছেন। বাঙালিদের আতিথেয়তার তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
গিয়াসউদ্দিনের লোকরঞ্জক চরিত্র তাঁর প্রচ্ছন্ন ধর্মীয় অনুদারতার জন্য কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছে। দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলকের মতো গিয়াসউদ্দিনের ধর্মীয় দানের সুফল ভোগ করেছিল কেবল মুসলমানরা। এমনকি রাজনৈতিক কাজেও তিনি হিন্দুদের যুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। সমকালীন চৈনিক দূতরা উল্লেখ করেছেন যে, তখন বাংলার সুলতানের অমাত্য ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সকলেই ছিলেন মুসলমান। এমনকি চিনা দূতদের বিবরণীতে কেবলমাত্র মুসলমানদের বিবরণ স্থান পেয়েছে, হিন্দুদের সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। ড. মজুমদার মনে করেন, গিয়াসউদ্দিন শেষ জীবনে হিন্দুবিরোধী নীতির জন্যই হিন্দুরাজা গণেশ সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং তাঁকে হত্যার পটভূমি তৈরি করেছিলেন।
গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সৈফুদ্দিন হামজা শাহ সিংহাসনে বসেন। দুই বছর রাজত্ব করে সৈফুদ্দিন মারা যান। আরবদেশীয় ইবন্-ই-হজর-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, সৈফুদ্দিন হামজা তাঁর জনৈক ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিন কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন। অতঃপর ওই ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ শাহ নাম নিয়ে বাংলার সুলতান হন। অবশ্য তিনি ছিলেন নামেমাত্র সুলতান। প্রকৃত শাসনক্ষমতা ছিল সমকালীন রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হিন্দু-সামন্ত রাজা গণেশের হাতে। ক্ষমতালাভের পর শিহাবউদ্দিন কিছুটা আত্মসচেতন হয়ে উঠলে রাজা গণেশ তাঁকে হত্যা করেন। অতঃপর শিহাবউদ্দিনের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ’কে সিংহাসনে বসিয়ে রাজা গণেশই রাজত্ব চালাতে থাকেন। তবে কেবলমাত্র ১৪১৪-‘১৫ খ্রিস্টাব্দের কিছু মুদ্রা থেকে ফিরোজ শাহের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেছে। সমকালীন কোনো গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত, কয়েক মাসের মধ্যেই আলাউদ্দিন ফিরোজকে হত্যা করে রাজা গণেশ প্রকাশ্যে শাসনক্ষমতা দখল করেছিলেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।