আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে গুজরাট” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি আমলে গুজরাট
অর্থনৈতিক কারণে গুজরাট রাজ্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল বেশি। কাম্বে, সুরাট, ব্রোচ ইত্যাদি সমুদ্রবন্দরের সমাহারে গুজরাট ভারতের বাণিজ্যিক মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল কেন্দ্র হিসেবে স্থান পেয়েছিল। এই বাণিজ্যিক গুরুত্বের জন্যই গুজরাটের প্রতি দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক শক্তিগুলির লোলুপ দৃষ্টি ছিল। আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট রাজ্য দখল করে দিল্লি-সুলতানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। একজন প্রাদেশিক গভর্নরের নেতৃত্বে গুজরাটে সুলতানি শাসন কায়েম করা হয়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে দিল্লি-সুলতানির অবক্ষয়ের যুগে গুজরাটও দিল্লির অধীনতা মুক্ত হবার প্রক্রিয়া শুরু করে। জনৈক ধর্মান্তরিত রাজপুত্রের সন্তান জাফর খাঁ ১৩৯১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের গভর্নর নিযুক্ত হলে সেই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে জাফর খাঁ’র পুত্র তাতার খাঁ কিছু বিদ্রোহী অভিজাতদের সাথে ষড়যন্ত্র করে জাফর খাঁকে অসওয়াল দুর্গে বন্দি করে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন। তিনি নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহ নামে পরিচিত হন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী তাতার খাঁ দিল্লি অভিযান করে সুলতানি সাম্রাজ্য দখলের কর্মসূচি নেন। কিন্তু এই অভিযানে তিনি নিহত হন। এই সুযোগে জাফর খাঁ বন্দিমুক্ত হয়ে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন এবং ‘সুলতান মুজফ্ফর শাহ’ উপাধি নিয়ে শাসন শুরু করেন।
মুজফ্ফর শাহ মালবের শাসক হুসাং শাহকে পরাজিত করে ধর দখল করতে সক্ষম হন। ১৪১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র আহমদ্ শাহ গুজরাটের শাসক হন। আহমদ্ শাহকে স্বাধীন গুজরাট রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। পূর্ববর্তী দুজন শাসকের আমলে গুজরাটের রাজ্যসীমা অসওয়ালের সন্নিহিত এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। আহমদ শাহ তাঁর সাহসিকতা ও উদ্যম দ্বারা রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন এবং দীর্ঘ ত্রিশ বছর দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন। মালব, অসিরগড়, রাজপুতানা ও সন্নিহিত অন্যান্য অঞ্চলের বিরুদ্ধে তিনি সফল সামরিক অভিযান চালান। সাধারণ প্রশাসনকে সুসংগঠিত করা এবং নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রণয়নের কাজে তিনি বিশেষ দক্ষতা দেখান। রাজত্বের প্রথম বছরেই (১৪১১ খ্রিঃ) তিনি সুদৃশ্য আহ্মেদাবাদ শহরের পরিকল্পনা করেন এবং এখানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এই শহরের বিন্যাস ও বিভিন্ন সৌধের স্থাপত্যশৈলী তাঁর গভীর সংস্কৃতি মনস্কতার সাক্ষ্য বহন করে। অবশ্য বহুগুণের অধিকারী হলেও, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তাঁর চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্যকে খানিকটা ম্লান করে দিয়েছে।
সুলতান আহমদ শাহ’র মৃত্যুর (১৪৪২ খ্রিঃ) পর গুজরাটের শাসক হন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদ শাহ (১৪২২-‘৫১ খ্রিঃ)। তাঁর পরে সিংহাসনে বসেন যথাক্রমে তাঁর পুত্র কুতুবউদ্দিন আহমদ্ এবং ভ্রাতা দাউদ খাঁ। দাউদ খাঁ’র অযোগ্যতা ও দমনমূলক শাসনরীতি অভিজাতদের ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে। বিদ্রোহী অভিজাতদের সমর্থনে আহমদ্ শাহের পৌত্র ফ খাঁ সিংহাসনে বসেন। তিনি মামুদ বেগর্হা’র নামে অধিক জনপ্রিয় ছিলেন।
ড. কালীকিঙ্কর দত্ত ‘ডিস্ইন্ট্রিগ্রেশন অফ দি দিল্লি সুলতানেট’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, মামুদ বেগর্হা ছিলেন তাঁর বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক (‘Mahmud Begarha was by far the most eminent sultan of his dynasty.’)। সমকালের অগ্রণী ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, তিনি গুজরাট রাজ্যকে গৌরব ও দীপ্তি দ্বারা মহিমামণ্ডিত করেছেন। তাঁর আগে বা পরে গুজরাটের এমন দক্ষ প্রতিভাবান কোনো শাসক আসেননি। উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাহস, শক্তি ইত্যাদি বহু গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে। শাসনক্ষমতা দখল করেই তিনি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সংহতি বিধানের উদ্যোগ নেন। প্রথমেই তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বিরোধী আত্মীয় বা অভিজাতদের ক্ষমতাহীন করেন। কোনো মন্ত্রী বা আত্মীয়ের পরামর্শ ছাড়াই তিনি প্রায় তিপান্ন বছর দক্ষতার সাথে শাসন পরিচালনা করেন।
প্রতিটি সামরিক অভিযানেই মামুদ সফল হন। তিনি মালবের সুলতান মামুদ খলজির আক্রমণ থেকে বাহমনী নিজাম শাহি বংশকে রক্ষা করেন। কুচের দুর্ধর্ষ সুমরা ও বোধা উপজাতি সর্দারদের তিনি দমন করেন এবং জগৎ (দ্বারকা)-এর জলদস্যুদের বিতাড়িত করেন। মামুদ বেগস্হা’র সামরিক সাফল্যের ফলে গুজরাট রাজ্যের চূড়ান্ত বিস্তৃতি সম্ভব হয়। দুটি রাজপুত দুর্গ গিরনার ও চম্পানের দখল নিয়ে তিনি নিজ শক্তি বৃদ্ধি করেন। তার আমলে গুজরাটের রাজ্যসীমা পশ্চিমে আরব সাগর, পূর্বে মালবদেশ; উত্তরে রাজস্থানের জালোর ও নাগৌর এবং দক্ষিণে খান্দেশ-এর সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত হয়। রাজত্বের শেষদিকে মামুদ মিশরের সুলতান আল ঘউর-এর সাথে যুক্তভাবে ভারত সাগরে পোর্তুগীজদের ক্ষমতার প্রসার রোধ করার প্রয়াস চালান। ভাস্কো-ডা-গামা কর্তৃক উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে আসার পথ আবিষ্কারের কয়েক দশকের মধ্যেই পোর্তুগীজদের লোহিত সাগর ও মিশরের মধ্যে চলাচলকারী লাভজনক মশলা বাণিজ্য নিজের কুক্ষীগত করে নেয়। এর ফলে ক্যাম্বে, চাউল প্রভৃতি পশ্চিম ভারতীয় বন্দরগুলি এবং এখানে বাণিজ্যরত মুসলমান বণিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেড্ডার গভর্নর আমির হুসেন-এর নেতৃত্বে মিশরীয় নৌবহর এবং মালিক আয়াজ-এর নেতৃত্বে গুজরাটের বাহিনীর যৌথ আক্রমণে ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে চাউল বন্দরে পোর্তুগীজরা পরাজিত হয়। কিন্তু পরের বছরেই পোর্তুগীজদের পাল্টা আক্রমণে মুসলমান বাহিনী প্রচণ্ডভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। সুলতান মামুদ পোর্তুগীজদের সাথে এক সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন। দিউ’তে পোর্তুগীজদের কারখানা স্থাপনের জন্য একটি জমি বরাদ্দ করা হয়। শিল্পস্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। বারথেমা ও বারবোসার বিবরণে তাঁর জনপ্রিয় গুণাবলীর বহু উল্লেখ পাওয়া যায়।
মামুদ বেগর্হা’র মৃত্যুর (১৫১১ খ্রিঃ) পর গুজরাটের সুলতান হন তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুজফ্ফর শাহ। মালবের সুলতানের মিত্ররূপে তিনি মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সাফল্যের সাথে সুলতান মামুদ খলজিকে মালবের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। মুজফ্ফর-এর মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র সিকন্দর ও দ্বিতীয় মামুদ স্বল্পকালের জন্য সিংহাসনে বসেন। অতঃপর সিংহাসনে বসেন গুজরাটের আর এক সফল শাসক বাহাদুর শাহ (১৫২৬-৩৭ খ্রিঃ)। পিতামহ মামুদ বেগস্হার মতোই সাহসী ও সুযোদ্ধা বাহাদুর শাহ মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হন। একের পর এক রাজ্যকে পরাজিত করে তিনি গুজরাটের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে মালবের শাসক দ্বিতীয় মামুদকে তিনি পরাজিত করেন ও তাঁর রাজ্য দখল করে নেন। ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ মেবার রাজ্য আক্রমণ ও ধ্বংসকার্য চালান। গুজরাটের সেনাবাহিনী মেবারের রাজধানী চিতোরের ওপর ব্যাপক লুঠতরাজ চালায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি মুঘল শাসক হুমায়ুনের কাছে পরাজিত হন। এই ব্যর্থতার ফলে গুজরাট রাজ্যের কিছু অংশ মুঘলের অধিকারভুক্ত হয়। এদিকে পূর্ব ভারতে শেরখানের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হুমায়ুন গুজরাট ছেড়ে চলে এলে বাহাদুর শাহ তাঁর হারানো অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। অতঃপর তিনি পোর্তুগীজদের বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করেন। ইতিপূর্বে মুঘলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পোর্তুগীজদের সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে বাহাদুর শাহ দিউ’তে পোর্তুগীজদের একটি দুর্গনির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন (১৫৩৫ খ্রিঃ)। কিন্তু মুঘলের সাথে যুদ্ধকালে তিনি পোর্তুগীজদের কোনো সাহায্য পাননি। তখন হুমায়ুন শেরখানের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লে বাহাদুর শাহ পোর্তুগীজদের দমন করার কর্মসূচি নেন। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পোর্তুগীজ গভর্নর দ্য কুন্হো’র সাথে বোঝাপড়ার জন্য অগ্রসর হন। বাহাদুর শাহের মনোভাব পোর্তুগীজরা আগেভাগেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল। তাই এক ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা পোর্তুগীজরা বাহাদুর শাহর নৌ-যানগুলি সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়। বাহাদুর শাহের উত্তরাধিকারীরা সবাই ছিলেন অদূরদর্শী ও অদক্ষ। এই সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতরা ধীরে ধীরে সমস্ত ক্ষমতা দখল করে নেন। অভিজাতদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্রতর রূপ নেয়। গুজরাট তার অতীত গৌরব হারিয়ে একটি অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ রাজ্যে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত সম্রাট আকবর ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।