আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে প্রাদেশিক শাসনকাঠামো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি আমলে প্রাদেশিক শাসনকাঠামো
সুলতানি আমলে রাজধানীর নিকটবর্তী অঞ্চল সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে থাকত। দূরবর্তী অঞ্চলে কেন্দ্রের অনুরূপ প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল। প্রদেশের সংখ্যা প্রথমে ছিল কম। পরে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ফলে প্রদেশের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। প্রদেশগুলির আয়তন এক ছিল না বা প্রাদেশিক শাসকদের (গভর্নর) ক্ষমতার পরিধিও নির্দিষ্ট ছিল না। প্রাদেশিক শাসকদের পদের স্থায়িত্ব এবং কর্তৃত্বের চরিত্র নির্ভর করত সুলতানের সাথে তাঁর সম্পর্কের ওপর। ছাড়া দুর্বল সুলতানদের আমলে প্রাদেশিক শাসকদের যতটা স্বাধীনতা বা কর্তৃত্ব থাকত, ক্ষমতাবান সুলতানদের আমলে স্বভাবতই তা কিছুটা কমে যেত। তবে করদ রাজ্যগুলি অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করত। সাধারণভাবে সুলতানি সাম্রাজ্যের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত না হলে, মুসলমান অধিবাসীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সমর্থ হলে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের কাজে বাধা সৃষ্টি না করলে রাজ্যের প্রশাসনিক স্বাধীনতায় সুলতান হস্তক্ষেপ করতেন না। কিন্তু অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের তীক্ষ্ণ নজরদারি সর্বদা বলবৎ থাকত।
প্রদেশগুলিকে ‘ইকতা’ নামক সামরিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করে একজন করে সামরিক শাসকের অধীনে রাখা হত। ইতা’র শাসকেরা ‘মুকৃতি’, ‘ওয়ালি’, ‘নায়েব সুলতান’ বা ‘ইকৃতাদার’ নামে অভিহিত হতেন। আলাউদ্দিন খলজির আমলে দু-ধরনের ইতা ছিল—–(১) যেগুলি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন এবং (২) যেসব নতুন স্থান তিনি দখল করেছিলেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সুলতান প্রাদেশিক শাসকদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন। বস্তুত, সুলতানি যুগে প্রাদেশিক শাসকরা নিজ নিজ রাজ্যে সুলতানের মতোই কর্তৃত্ব ও মর্যাদা ভোগ করতেন। এটা নির্ভর করত তাদের আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, কর্মদক্ষতা ইত্যাদির ওপর। এঁরা সেনাবাহিনী পোষণ করতেন এবং সুলতানের প্রয়োজনে তাঁকে বাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেন। এই বাহিনীর ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য আঞ্চলিক ‘আরিজ’কে কেন্দ্রের ‘আরিজ-ই-মমালিক’-এর অধীনে কাজ করতে হত। প্রাদেশিক শাসকগণ রাজস্ব আদায় করতেন কিন্তু স্থানীয় ব্যয়সংকুলানের পর উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রে পাঠাতে দায়বদ্ধ ছিলেন। প্রাদেশিক শাসকগণ নিয়মিত আয়ব্যয়ের হিসেব কেন্দ্রে পাঠাতে বাধ্য ছিলেন। সুলতান তাঁর দক্ষ গুপ্তচরবাহিনীর সাহায্যে প্রদেশগুলির ওপর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতেন। সুলতানি শাসনের গৌরবময় যুগের তেইশটি প্রদেশের নাম হল দিল্লি, দেবগিরি, বদাউন, মুলতান, মাবার, শিরসুত, তেলেঙ্গা, উচ, দ্বারসমুদ্র, হান্সী, সামানা, কারা, লাহোর, কনৌজ, খুরম, জাজনগর, বিহার, কালানুর, অযোধ্যা, লখনৌতি, গুজরাট, শেওয়ান এবং মালব। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ (লখনৌতি-এর অন্তর্ভুক্ত) স্বাধীন রাজ্য হিসেবেই প্রায় সারা সুলতানি আমলে নিজের অবস্থান রক্ষা করেছিল। সুলতান মৌখিক আনুগত্যের বিনিময়ে এবং নামমাত্র উপঢৌকনে সন্তুষ্ট থেকে বাংলার স্বাধীনতা মেনে নিয়েছিলেন।
সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং আঞ্চলিক প্রশাসনে উন্নতির ফলে পরবর্তীকালে প্রদেশগুলিকে আরও ছোটো এককে ভাগ করা হয়। এগুলিকে বলা হত ‘শিক’। শিকের শাসনকর্তা ছিলেন ‘শিকদার’। মহম্মদ-বিন্-তুঘলক দাক্ষিণাত্যকে চারটি ‘শিক’-এ বিভক্ত করেছিলেন। দোয়াবকে ভেঙে দুটি ‘শিক’ গঠন করা হয়েছিল। সম্ভবত, ‘শিকদার ও একজন সামরিক ব্যক্তি ছিলেন এবং নিজ নিজ অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন। শিকগুলির মধ্যে আরও ছোটো শাসনতান্ত্রিক বিভাগ ছিল ‘পরগনা’। প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে ‘পরগনা’র বিশেষ গুরুত্ব এই যে, এখানেই সরকারি কর্মচারীরা কৃষকদের সাথে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসত। পরগনার কর্মচারীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ‘আমিল’। আমিল “এর নেতৃত্বে একটি কর্মগোষ্ঠী কাজ করত। পরগনার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীর মধ্যে ছিলেন মুশারিফ, হিসাবরক্ষক, দুজন কারকুন, কানুনগো প্রমুখ। মুশারিফ ‘আমিন’ বা ‘মুনসেফ’ নামেও অভিহিত হতেন। মুশারিফ-এর প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব নির্ধারণ। মুশারিফকে সৎ বিশ্বস্ত (আমিন) বা ন্যায়পরায়ণ (মুনসেফ) নামে অভিহিত করার দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে, সুলতানি আমলে উৎপাদকদের প্রতি সরকারে আচরণ ছিল মোটামুটি সহনশীল ও যুক্তিপূর্ণ। দুজন কারকুন বা নথিলেখক ফারসি ও হিন্দিতে পরগনার নথিপত্র লিপিবদ্ধ করতেন, এইজন্য তাঁরা যথাক্রমে ‘ফারসিনবিস’ ও ‘হিন্দিনবিস’ নামে পরিচিত হতেন। কানুনগো পূর্ববর্তী বছরগুলির উৎপাদন ও নির্ধারিত করের হিসেব রক্ষা করতেন। ইবন বতুতা পরগনার সমতুল শাসনবিভাগ হিসেবে ‘সাদি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অবশ্য সমকালীন অন্য কোনো নথিতে এই নাম ব্যবহৃত হয়নি। যাই হোক, পরগনায় ‘চৌধুরী’ নামে একটি পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি সম্ভবত উৎপাদক ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থ হিসেবে কাজ করতেন।
শাসনব্যবস্থার ক্ষুদ্রতম একক ছিল ‘গ্রাম’। গ্রামের মুখ্য আধিকারিক ছিলেন ‘গ্রাম-প্রধান’। তাঁকে সাহায্য করতেন ‘পাটোয়ারী’ বা ‘হিসাবরক্ষক’। পাটোয়ারী চাষযোগ্য এলাকা ও মোট উৎপাদনের হিসেব রক্ষা এবং রাজস্ব নির্ধারণ এবং সরকারের প্রাপ্যপ্রদানের কাজ তত্ত্বাবধান করতেন। গ্রামীণ প্রজারা যাতে শাসকশ্রেণি বা শক্তিশালীশ্রেণির অত্যাচারের শিকার না হয় সেদিকে সুলতানেরা বিশেষ দৃষ্টি দিতেন। তবে সাধারণভাবে সুলতানেরা গ্রামের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতেন না।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, সুলতানি আমলের অসামরিক শাসনব্যবস্থা সুলতানি পূর্ব-আমলের অনুসৃতি মাত্র। শাসনকাঠামোর কোনো মৌলিক পরিবর্তন সুলতানি যুগে করা হয়নি। কেবল কর্মচারীদের নামগুলি পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। গ্রাম ও পরগনার শাসকশ্রেণি একই ছিল। অর্থাৎ আগের মতোই হিন্দুরা বংশানুক্রমিকভাবে এখানে শাসনদায়িত্ব প্রতিপালন করতেন। সতীশচন্দ্রের মতে, “তুর্কিরা যে গ্রামাঞ্চলে দ্রুত প্রভুত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ হল গ্রামের শাসনব্যবস্থায় পূর্বের কর্মচারীদের বহাল রাখা।”
সুলতানি প্রশাসনে অভিজাতদের, বিশেষত মুসলমান অভিজাতদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাস্তব প্রয়োজন থেকেই সুলতানরা উপলব্ধি করেন যে, একটি ‘যুদ্ধ-রাষ্ট্র’ (War-state)-কে টিকিয়ে রাখার জন্য অতি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য একদল প্রশাসকের প্রয়োজন। এদের মাধ্যমে সুলতান সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে তাঁর কর্তৃত্ব রাখতে প্রয়াসী ছিলেন। তবে সেকালে যেহেতু যুদ্ধের মধ্যেই একটি দেশের ওপর শাসকশ্রেণির কর্তৃত্ব বা স্থায়িত্ব নির্ভর করত, সেহেতু অভিজাতদের অধিকাংশই ছিলেন যুদ্ধবিশারদ। সুলতানি শাসনের প্রথমদিকে কেবলমাত্র বহিরাগত মুসলমানরাই অভিজাত হিসেবে মর্যাদা ও কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। এঁদের মধ্যেও গোষ্ঠীভেদ ছিল, যেমন—তুর্কি, আফগান, পারসি ও আরবি। তবে মর্যাদা ও প্রতিপত্তিতে সর্বাগ্রে ছিল তুর্কিদের স্থান। তার পরে আফগানদের এবং অন্যান্যদের। রাজনৈতিক উচ্চপদগুলি তুর্কি ও আফগান অভিজাতদের কুক্ষিগত ছিল। প্রথমদিকে বহিরাগত অভিজাতরাও গোষ্ঠীভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতেন। কিন্তু দীর্ঘকাল ভারতবর্ষে বসবাস করার ফলে এবং একই সুলতানের অধীনে কর্মরত অবস্থায় একই সমাজে অবস্থানের ফলে তাদের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধ ক্ষীণ হয়ে আসে। পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত এদেশীয় মুসলমানরাও বহিরাগত অভিজাতদের কাছাকাছি চলে আসেন। সুলতান জাতি বা বংশনির্বিশেষে যে-কোনো ব্যক্তিকে অভিজাতের মর্যাদা দিতে পারতেন। এই পদ বংশানুক্রমিকও ছিল না। পরে বংশানুক্রমিক হলে পদমর্যাদার ভিত্তিতে অভিজাতশ্রেণি গড়ে ওঠে। এই সময় এদেশীয় মুসলমানরা নিজেদের বিদেশি বংশজাত দাবি করে জাতে ওঠার চেষ্টা করেন। আরও পরে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সাথে তুর্কি-আফগানদের বিবাহ সম্পর্ক চালু হলে জাতে ওঠার প্রবণতা কমে যায়।
কাজের ভিত্তিতে অভিজাতদের দুভাগে ভাগ করা হয়, যথা—’অহল-ই-সৈফ’ এবং ‘অহল-ই-কলম’। প্রথম দলে ছিলেন মূলত সামরিক কাজের সাথে যুক্ত অভিজাতরা। দ্বিতীয় দলে ছিলেন ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ প্রশাসকগণ। ‘যুদ্ধ-রাষ্ট্র’ হবার ফলে সুলতানি আমলে প্রথম শ্রেণির অভিজাত সংখ্যায় এবং প্রতিপত্তিতে অগ্রণী ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণির অভিজাতদের অধিকাংশই ছিলেন ‘ধর্মতত্ত্ববিদ’ বা ‘উলেমা’। এঁরা ছিলেন গোঁড়া ‘সুন্নি’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। উলেমারা শরিয়ত সম্পর্কে সুলতানকে পরামর্শ দান করতেন। বিচারবিভাগে এঁদের একাধিপত্য ছিল।
অভিজাতদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ইকতার রাজস্ব কিংবা নগদ বেতন। অভিজাতরা প্রচণ্ড বিলাসব্যসনের মধ্যে জীবনযাপন করতেন। সুলতানের অনুকরণে তাঁরা প্রসাদ নির্মাণ করতেন, হারেম পরিচালনা করতেন, বহুসংখ্যক দাস-দাসী ও পারিষদ পোষণ করতেন। নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অভিজাতদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত এবং সেক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হত। সাধারণ অভিজাতদের বিষয়সম্পত্তি অক্ষত থাকত এবং বংশানুক্রমিকভাবে তা ভোগদখল করা যেত। জমি ক্রয় করে চাষ-আবাদের সূত্রেও অভিজাতদের প্রচুর আয় হত। অভিজাতদের অস্বাভাবিক অর্থবল মাঝে মাঝে সুলতানদের শঙ্কার কারণ সৃষ্টি করতে। সুলতান আলাউদ্দিন অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কয়েকটি কঠোর ব্যবস্থাও নেন। তবে সামগ্রিকভাবে অধিকাংশ সুলতানই অভিজাতদের তোষণ করে চলতেন। গ্রামীণ হিন্দু-অভিজাতদের প্রতিপত্তি ও অর্থবল ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।