সুলতানি আমলে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের শাসন

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের শাসন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

সুলতানি আমলে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের শাসন

রাজা গণেশ বাংলাদেশের সিংহাসন দখল করলে বাংলায় ইলিয়াস শাহি শাসনের সাময়িক ছেদ ঘটেছিল। গণেশের রাজত্বকাল বিশেষ স্মরণীয় এই কারণে যে, বাংলায় পাঁচ শতাধিক বছরেরও বেশি মুসলমান শাসনের মাঝে তিনি একমাত্র হিন্দু যিনি অন্তত কিছুদিন এখানে হিন্দু রাজার শাসন প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘তবকৎ-ই আকবরী, ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’, ‘মাসির-ই-রহিমী’ প্রভৃতি গ্রন্থে গণেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া বুকাননের ‘ডায়েরি, দরবেশেদের জীবনীগ্রন্থ ‘মিরাৎ-উল আসবার, নূর কুতব আলমের ‘পত্রাবলী’ এবং জনৈক চৈনিক দূতের ‘বিবরণী’ থেকে রাজা গণেশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। রাজা গণেশের কোনো মুদ্রা বা লিপি আবিষ্কৃত না-হওয়ার ফলে ইতিহাস রচনার কাজ কিছুটা কষ্টকর হয়েছে। অবশ্য তাঁর ইতিহাসগত অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

উত্তরবঙ্গের ভাতুরিয়ার এক জমিদারবংশে গণেশের জন্ম। বিচক্ষণ ও সাহসী গণেশ ইলিয়াস শাহিবংশীয় সুলতানের অন্যতম আমির হিসেবে সম্মানিত হন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, হাজমা শাহ ও বায়াজিদ শাহের আমলে গণেশ বাংলার রাজনীতিতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। বায়াজিদ শাহের আমলে বাংলার সুলতানি প্রশাসনে রাজা গণেশই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি। বায়াজিদ শাহ ছিলেন গণেশের হাতের পুতুলমাত্র। সম্ভবত গণেশের চক্রান্তে বায়াজিদ শাহ নিহত হন। অতঃপর কিছু মুদ্রায় আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ নামক জনৈক সুলতানের উল্লেখ পাওয়া যায় (১৪১৪-‘১৫ খ্রিঃ)। যাই হোক্‌, গণেশ শেষ পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থান দ্বারা বাংলায় ইলিয়াস শাহিবংশের উচ্ছেদ করে স্বয়ং বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রাজা গণেশের শাসনকাল ছিল স্বল্পস্থায়ী। তবে স্বল্পকালের জন্য হলেও বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের প্রায় সমস্ত অংশ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গের একাংশ গণেশের শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলমানদের সার্বিক আধিপত্যের যুগে গণেশের পক্ষে হিন্দুশাসন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বাংলার দরবেশদের নেতৃত্বে মুসলমানদের একাংশ গণেশের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। রাজা গণেশ প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের কঠোর হাতে দমন করেন। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় দরবেশকে তিনি হত্যাও করেন। এমতাবস্থায় দরবেশের অন্যতম নেতা নূর কুতব আলম জৌনপুরের শাসক ইব্রাহিম শার্কির সাহায্যপ্রার্থী হন। তৎকালীন উত্তর ও পূর্ব ভারতের পরাক্রান্ত সুলতান ইব্রাহিমের কাছে তাঁর রাজা গণেশের অত্যাচারে বাংলাদেশে ইসলাম-বিপন্ন জাতীয় চিত্র তুলে ধরেন। ইব্রাহিম শার্কি বাংলাদেশ আক্রমণ করেন। গণেশ তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করেন। কিন্তু নিজপুত্র যদু বা জিল-এর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শেষ পর্যন্ত গণেশ পিছু হটতে বাধ্য হন। সিংহাসনের লোভে যদু শত্রুশিবিরে যোগ দেন এবং ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। পরে জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহ নাম নিয়ে যদু বাংলার সিংহাসনে বসেন। ১৪১৫-‘১৬ খ্রিস্টাব্দে এই পরিবর্তন ঘটেছিল।

জৌনপুরের সুলতান স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনের কিছুদিনের মধ্যেই রাজা গণেশ পুনরায় বাংলার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিজ হস্তগত করেন। সুলতান-পদে অবশ্য জালালউদ্দিনই বহাল ছিলেন। তবে রাজা গণেশের ইচ্ছানুসারেই তিনি রাজ্য চালাতে বাধ্য হন। এইভাবে কিছুদিন চলার পর গণেশ পুত্র জালালউদ্দিনকে অপসারিত করে নিজে দনুজমর্দনদের নাম নিয়ে পুনরায় সিংহাসনে বসেন। জালালউদ্দিনকে হিন্দুধর্মে পুনদীক্ষিত করে গণেশ তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখেন। ‘দনুজমর্দনদেব’ নামে গণেশ সমগ্র ১৩৩৯ শকাব্দ (১৪১৭-১৮ খ্রিঃ) এবং ১৩৪০ শকাব্দের (১৪১৮-১৯ খ্রিঃ) কিছুকাল রাজত্ব করে পরলোক গমন করেন।

ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার রাজা গণেশকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, কুশাগ্রবুদ্ধি ও কূটনৈতিক বলে অভিহিত করেছেন। ফেরিস্তার মতে, গণেশ ছিলেন দক্ষ শাসক। নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। চণ্ডীদেবীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তিনি নিজ মুদ্রায় চিণ্ডীচরণপরায়ণস্য’ শব্দটি খোদিত করেন। কিছু মসজিদ ও ইসলামিক প্রতিষ্ঠান গণেশ ধ্বংস করেছিলেন। তবে তাঁর এই কাজের মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল রাজনৈতিক দিক থেকে, ধর্মীয় দিক থেকে নয়। দরবেশরা গণেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তার রোষের শিকার হয়েছিলেন। অনথ্যায় সাধারণভাবে তিনি মুসলমানবিদ্বেষী ছিলেন না। ফেরিস্তা ও স্বীকার করেছেন যে, রাজা গণেশ অনেক মুসলমানের আন্তরিক ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। স্থাপত্যকর্মেও গণেশের আন্তরিক আগ্রহ ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন। এঁদের মতে, গৌড় ও পাণ্ডুয়ার কয়েকটি বিখ্যাত স্থাপত্যসৃষ্টি গণেশের আমলে সম্পন্ন হয়েছিল। এ ধরনের দুটি দৃষ্টান্ত হল—গৌড়ে ‘ফতে খাঁর সমাধিভবন’এবং পাণ্ডুয়ার ‘একলাখী প্রাসাদ’। গণেশ বিখ্যাত আদিনা মসজিদেরও সংস্কার করেছিলেন।

গণেশের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে হিন্দুশাসন পুনরুত্থানের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। অতঃপর তাঁর বংশধররা কিছুকাল রাজত্ব করেন। তবে তাঁরা ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান।

রাজা গণেশের মৃত্যুর পর জালালউদ্দিন (যদু) স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। তিনি সুশাসক ও ন্যায়বিচারক ছিলেন। হিন্দুদের প্রতি তিনি কিছুটা কঠোর আচরণ করেন। বুকাননের বিবরণী মতে, জালালউদ্দিন বহু হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন। তাঁর তীব্র হিন্দুবিদ্বেষের অন্যতম কারণ হল—তাঁর পিতা রাজা গণেশ ধর্মান্তরিত যদুকে হিন্দুধর্মে পুনদীক্ষিত করেছিলেন। কিন্তু সনাতনপন্থী হিন্দুরা তাঁকে সমাজে প্রত্যাবর্তনের অধিকার দেননি। তাই ক্ষমতালাভের পর জালালউদ্দিন হিন্দুদের ওপর প্রধানত ব্রাহ্মণদের ওপর নির্যাতন চালান। তবে এই বিদ্বেষ যে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাকে আচ্ছন্ন করেনি তার প্রমাণ হল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের নিয়োগ। তাঁর সেনাপতি ছিলেন রাজ্যধর নামক জনৈক হিন্দু। বস্তুত যোগ্য হিন্দুকে মর্যাদা দিতে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। জালালউদ্দিন পাণ্ডুয়া থেকে গৌড় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। জালালউদ্দিনের মৃত্যুর (১৪৩২-৩৩ খ্রিঃ) পর তাঁর পুত্র সামউদ্দিন আহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন। তাঁর কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার আমিরবর্গ সুলতানের দুজন ক্রীতদাসের সাহায্যে তাঁকে হত্যা করেন। সামউদ্দিনের মৃত্যুর (১৪৪২ খ্রিঃ) সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় গণেশীবংশের শাসনের অবসান ঘটে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment