আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে সামাজিক সচলতা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি আমলে সামাজিক সচলতা
দিল্লির সুলতানি শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাক্-মুসলিম হিন্দু (রাজপুত) সামাজিক ধ্রুপদীয়ানার ভাঙন এবং সামাজিক বিভিন্ন স্তরের গতিশীলতা। ত্রয়োদশ শতকে দিল্লি-সুলতানির প্রতিষ্ঠা উত্তর ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনধারায় রূপান্তরের সূচনা করেছিল। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের রাজনীতিতে যে বহুরাষ্ট্রীয় চরিত্র সন্নিবিষ্ট হয়েছিল, তার পরিবর্তন ঘটে এবং কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিক মহম্মদ হাবিব, নিজামী, ইকতিদার হুসেন সিদ্দিকি প্রমুখ নানা প্রবন্ধে সুলতানি আমলে সামাজিক সচলতার প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।
সুলতানি আমলে সামাজিক গতিশীলতার দুটি প্রধান উপাদান ছিল ব্যাপক নগরায়ণ (urbaniza tion) এবং সমৃদ্ধ বাণিজ্য। মহম্মদ হাবিব দিল্লি-সুলতানির প্রতিষ্ঠাকে ‘উত্তর ভারতে নগর-বিপ্লবের পূর্ব’ (the urban revolution in North India) বলে উল্লেখ করেছেন। সুলতানি শাসনের দুটি সামাজিক প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয়। প্রথমত, সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠা শাসকশ্রেণির চরিত্র বদলে দিয়েছিল। রাজপুত ঠাকুরদের পরিবর্তে ভারতের প্রধান শাসকশ্রেণি হিসেবে বহিরাগত তুর্কিদের প্রতিষ্ঠা ঘটে। দ্বিতীয়ত, সমস্ত স্তরের নগর-কর্মীদের জাতিগত ভেদাভেদের অবসান ঘটেছিল। অধ্যাপক হাবিবের মতে, হিন্দু রাজপুত আমলে সমস্ত স্তরের হিন্দু নগর-শ্রমিক (Hindu city labour) অর্থাৎ কারিগর, শ্রমিকসহ সাধারণ হিন্দু জনতা বর্ণভেদ ও জাতিভেদের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে তাদের স্বাভাবিক অধিকার ও বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এই শ্রেণির সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লি-সুলতানির প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব বিধানে মুসলমানদের পাশাপাশি সামাজিকভাবে অবহেলিত হিন্দুদের অবদান অনস্বীকার্য। অধ্যাপক সিদ্দিকির মতে, সুলতানি আমলে নব প্রতিষ্ঠিত শহরগুলিতে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু কারিগর ও শিল্পীরা শাসকশ্রেণির পাশাপাশি থেকে তাদের প্রতিভার বিকাশ ও শ্রমশক্তির সদ্ববহার করার পূর্ণ সুযোগ পায়। এই নগরায়ণ ব্যবস্থা কারিগরশ্রেণির সামাজিক গতিশীলতা নিয়ে আসে। তিনি লিখেছেন : “This process of urbanization, started under the Sultans, soon led to social mobility among craftsmen in the urban centres.”। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে, মুসলিম শাসকগোষ্ঠী তাঁদের আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বৃহৎ সংখ্যক কারিগর, শিল্পী ও শ্রমিকদের নগরবিন্যাসের সাথে যুক্ত করতেন। এরা নগরবাসী হিসেবে সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করত। কিন্তু যারা ভূমিহীন বা কোনোরকম উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত নয়, তাদের পক্ষে কি সামাজিক সচলতার শরিক হওয়া সম্ভব হয়েছিল?
সামাজিক সচলতার আর একটি উপাদান ছিল বাণিজ্যিক প্রসার। সুলতানি আমলের নতুন আর্থ সামাজিক পরিবেশে কারিগরশ্রেণি আর্থিক প্রগতির নানা সুযোগ পেয়েছিল। সীমান্ত অঞ্চলের সাথে গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির মধ্যে উন্নত সড়ক যোগাযোগ এবং মাঝে মাঝে পুলিশ চৌকি দ্বারা সুনিশ্চিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা বিদেশি বণিকদের ভারতে বাণিজ্যে উৎসাহিত করে। স্থলপথ বাণিজ্যের এই ব্যাপকতা শহরবাসীর পছন্দের বৈচিত্র্য আনে এবং নতুন থেকে নতুনতর জিনিসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে কারিগর ও শ্রমিকশ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। একইভাবে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে ইসলাম ধর্মের পূর্বমুখী প্রচার ও প্রসার এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যে নতুন জোয়ার আনে। মুসলমান শাসনের সূচনা ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন ও বহির্বিশ্বের সাথে পুনরায় সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপনের পথ খুলে দেয়। এইভাবে বাণিজ্যের অগ্রগতি ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে নগরায়ণের অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিদেশি শাসককুল কর্তৃক নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে বসবাসের ইচ্ছাও নগরায়ণের পথ তৈরি করে দেয়; এবং ব্যাপক নগরায়ণ সামাজিক সচলতার সম্ভাবনা সবল করে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিদ্দিকি (I. H. Siddiqui) ক্যাম্বে ও দিল্লি শহরের বিশেষ অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি দিল্লি থেকে মহম্মদ-বিন্ তুঘলক কর্তৃক দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের একটি সামাজিক প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন। মহম্মদ তুঘলক কর্তৃক রাজধানী স্থানান্তরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দিল্লিবাসীকে কিছুটা জব্দ করা। কিন্তু এই ঘটনা সামাজিক সচলতার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, দিল্লির অধিবাসীরা দৌলতাবাদে গেলেও, দিল্লির জনসংখ্যা হ্রাস পায়নি। ওই শূন্যস্থান পুরণ করতে এগিয়ে এসেছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ। ইসামী এদের ‘অসংস্কৃত ও বর্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এরাই শহর দিল্লিতে এসে এমন সব বৃত্তি ও পদ গ্রহণ করেছিল, যা কিছুকাল আগেও তাদের চিন্তার অতীত ছিল। এইভাবে সাধারণ মানুষের সামাজিক উচ্চক্রমে উত্থান সম্ভব হয়েছিল।
ভারতে তুর্কি-শাসনের প্রতিষ্ঠাপর্বে প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হয়ে ভাগ্য গড়ে তোলার একটা সুযোগ এসেছিল। তুর্কিদের সাথে সাথে খলজি, আফগান ইত্যাদি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও ভারতে এসেছিল। মিনহাজউদ্দিনের মতে, স্বদেশে অবহেলিত এবং আর্থিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ এই সকল গোষ্ঠী ভাগ্যানুসন্ধানে তুর্কিদের সহযোগীরূপে জড়িত ছিল। অবশ্য খলজিরা তুর্কি-শাসনে দ্রুত উচ্চক্রমে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেলেও, আফগানদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। বরং ধর্মান্তরিত হিন্দুদের অবস্থান ছিল তুলনামূলকভাবে ভালো। যাইহোক্, খলজি ও তুঘলক বংশের শাসনকালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অ-তুর্কি মুসলমানদের ক্রমোচ্চস্তরে ওঠার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা পাই। সুলতানি আমলে শাসকশ্রেণির গঠন শীর্ষক আলোচনায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করছি।
বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী, যেমন—আফগান, কালাল, জৈন, ক্ষত্রি, কম্বো প্রভৃতির ক্রম-উত্থান দিল্লি সুলতানির আমলে সামাজিক সচলতার আভাস দেয়। ইসলাম ধর্মগ্রহণের আগে থেকেই পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিমের সীমান্ত অঞ্চলে আফগানদের বসবাস শুরু হয়েছিল। দশম শতকে আফগানরা ইসলাম ধর্মের সাথে যুক্ত হতে শুরু করে এবং দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগে প্রায় সমস্ত আফগান উপজাতিগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অধ্যাপক সিদ্দিকি লিখেছেন যে, “প্রাথমিক পর্বে উচ্চ-সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের অভাবহেতু আফগান উপজাতীয়রা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হলেও, সাধারণ সৈনিকের বৃত্তি ছাড়া কোনো উচ্চাসন পায়নি” (“Their lack of culture and sophistication apparently retarded their upward mobility.”)। শ্লথ গতিতে হলেও সুলতানি শাসনের পালাবদলের সাথে সাথে আফগান উপজাতিদেরও সামাজিক ক্রমোচ্চস্তরে উত্থান ঘটতে থাকে। সুলতান বলবনের আমলে আফগানদের সামাজিক উত্থান স্পষ্ট হয়। আঞ্চলিক বাহিনীর সৈনিক এবং দিল্লির চারদিকে স্থাপিত নিরাপত্তা চৌকিগুলির দায়িত্বে বহু আফগানকে তিনি নিয়োজিত করেন। দস্যু-কবলিত দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির কার্যকরী নিরাপত্তা বিধানের জন্য বলবন ‘অসভ্য, বর্বর’ আফগানদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। আফগান উপজাতি সম্পর্কে আমির খসরুর এই মূল্যায়ন তিনি নিজেই কিছুদিন পরে সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘তুহুকাৎ-ই-সিগর’ গ্রন্থের মন্তব্য সংশোধন করে তিনিই ‘আইন-ই সিকন্দরী তৈ আফগানদের কৃতিত্বসম্পন্ন ও দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষ বলে স্বীকার করে নেন। আফগান উপজাতির এই মানোন্নয়নের মূল কারণ ছিল দ্রুত শিক্ষা-সংস্কৃতির সাথে পরিচয়। সুলতানির অধীনে কর্মরত হওয়ায় তাদের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে শিক্ষাপ্রসারের তাগিদ অনুভূত হয়েছিল। এবং আলাউদ্দিন খলজির আমলে আফগানরা সামাজিক আভিজাত্যের অধিকারী হতে পারে। মহম্মদ বিন্-তুঘলকের আমলে আফগানদের সামাজিক সচলতা আরও স্পষ্ট হয়। মহম্মদের আমলে সুলতানি প্রশাসনে আফগানরা একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। মুলতান, গুজরাট, দাক্ষিণাত্য প্রভৃতি অঞ্চলে তাদের সামাজিক অবস্থান এতটাই সুদৃঢ় হয়েছিল যে, ক্রমে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের চূড়ায় আরোহণ করার লক্ষ্যে তারা এগোতে পারে। পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় আফগান মালিক খুররম নুহানি কর্তৃক রাজস্থানের জালোরে প্রথম স্বাধীন আফগান রাজ্য প্রতিষ্ঠা সামাজিক গতিশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মদ প্রস্তুতকারী ‘কালাল’ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্রম-উত্থানকে সামাজিক গতিশীলতার অপর দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। জিয়াউদ্দিন বারাণী এদের খুমার (মদ প্রস্তুতকারী) এবং আরকি (পতনকারী) নামে অভিহিত করেছেন। এই গোষ্ঠীর অনেকেই বংশগত বৃত্তি ত্যাগ করে প্রশাসনিক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আজিজ় খুমার মহম্মদ-বিন্ তুঘলকের আমলে রাজস্ববিভাগের প্রধান এবং পরে মালবের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। নিম্ন জাতিভুক্তদের ইসলাম গ্রহণের পরে সামাজিক উচ্চক্রমে উত্থানের অপর দৃষ্টান্ত হল পঞ্চদশ শতকে জাফর খাঁ ও সাম্স খাঁ কর্তৃক যথাক্রমে গুজরাট ও নাগাউর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। এই দুই ভাই ছিলেন কালাল গোষ্ঠীভুক্ত। ফিরোজ শাহ তুঘলকের বদান্যতায় এঁরা উচ্চমর্যাদার অধিকারী হন। ইসলামে ধর্মান্তরিত না-হয়েও কালাল গোষ্ঠীভুক্ত অনেকেই সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন। ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দের একটি লিপি থেকে জানা যায়, জনৈক ভোলা মহারাজ খুমার তাঁর বংশগত বৃত্তি দ্বারা এত বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন যে, জনসেবার কাজে বহু অর্থ ব্যয় করে তিনি সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হতে পেরেছিলেন। সুলতান নাসিরুদ্দিন খলজির সাথে জনৈকা ‘কালাল’ রমণীর বিবাহকেও সামাজিক সচলতার দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করা যায়।
পাঞ্জাব ও দিল্লির সন্নিহিত অঞ্চলের ‘ক্ষত্রি’ জাতিভুক্ত হিন্দুরাও সুলতানি আমলে কেন্দ্রে এবং প্রদেশিক রাজ্যগুলিতে বিশেষ সামাজিক শ্রেণি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সৈয়দ ও লোদী বংশের শাসনকালে কেন্দ্রীয় রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরে ‘ক্ষত্রি’দেরই প্রাধান্য ছিল। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে কেন্দ্রীয় অর্থদপ্তরে হিন্দু-ক্ষত্রিদের একাধিপত্য দেখে বিস্ময় প্রকাশও করেছেন। অঙ্ক ও হিসাবশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করে এই গোষ্ঠী তাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন। গুজরাট ও মালবের প্রশাসনে ‘ক্ষত্রি’দের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়। স্বাধীন গুজরাট রাজ্যের স্থপয়িতা সুলতান মুজফ্ফর শাহের অতি বিশ্বস্ত ও প্রভাবশালী আমলা হিসেবে জীবন ক্ষত্রি, রাইদাস ক্ষত্রি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাঞ্জাব ও মুলতান অঞ্চলের আর একটি হিন্দুগোষ্ঠী ‘কম্বো’রাও সুলতানি আমলে উচ্চক্রমে উত্থানের সুযোগ পেয়েছিল। প্রধানত কৃষিজীবী এই শ্রেণি সুফিসাধকদের সংস্পর্শে এসে ইসলামধর্মে আকৃষ্ট হয় এবং প্রশাসনিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পায়। শেখ সুরাবর্দী, শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া প্রমুখের সংস্পর্শে এসে এরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয় এবং শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ বোধ করে। বাহাউদ্দিনের বংশধর ইউসুফ কুরেশি পঞ্চদশ শতকে মুলতানে স্বাধীন শাসনের সূচনা করলে কম্বো সম্প্রদায় তাঁকে সমর্থন জানায় এবং একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এই সময় উলেমা ও সুফিসাধক (মুশাইক) হিসেবেও কম্বোদের অনেকে খ্যাতি পান। লোদীবংশের আমলে শেখ সামসুদ্দিন কম্বো, শেখ জামালি প্রমুখ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
কম্বো, ক্ষত্রি, কালালদের মতো ব্যবসাবৃত্তিধারী জৈনদেরও সামাজিক উচ্চক্রমে উত্তরণের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। অভিজ্ঞ রত্নবিশারদ ফেরু জৈন আলাউদ্দিন খলজির আমলে সরকারি টাকশালের সুপারিনটেন্ডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলেও তাঁর যথেষ্ট মর্যাদা ও প্রতিপত্তি ছিল। আগা মেহদী হুসেন-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, মুবারক শাহ খলজির আমলে জনৈক সমর সিং জৈন সরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গুজরাট, নাগাউরসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক রাষ্ট্রে জৈন সম্প্রদায়ভুক্তদের সামাজিক মর্যাদার ক্রমোন্নতি অব্যাহত ছিল। সুলতানি আমলের পতনের কালেও জৈনদের সামাজিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত ছিল।
সামাজিক সচলতার ক্ষেত্রে সুফি দর্শনের প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুফি মতাদর্শে সমস্ত সামাজিক স্তরের মানুষ সমমর্যাদা ও অধিকার ভোগের অধিকারী ছিল। উচ্চশ্রেণির তুলনায় তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মুসলমান, সামাজিক বা অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই, সুফিবাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সুফি-সন্তদের শিষ্য (মুরিদ) গ্রহণের ক্ষেত্রে এই উদারতা স্বাভবিকভাবেই সামাজিক সচলতার সহায়ক হয়েছিল। শেখ হুসেন নাগাউরি চিস্তির অন্যতম মুরিদ জনৈক ঝাড়ুদার পরবর্তীকালে সুফি-সন্ত হিসেবে প্রভূত খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। অধ্যাপক সিদ্দিকি উল্লেখ করেছেন যে, সুফিসাধক হিসেবে এই নিম্নবর্ণীয় ধর্মান্তরিত হিন্দু যে শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করেছিলেন, তা পঞ্চদশ শতকের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অভিন্ন ছিল। সামাজিক সচলতার উপাদানগুলিও একই বৈশিষ্ট্য ও শক্তিসহ অবস্থান করছিল। নগরায়ণের ধারা এবং উদারতান্ত্রিক ধর্ম ও সমাজ দর্শনের প্রসার নিঃসন্দেহে এই সচলতার প্রক্রিয়াকে মূল শক্তি জোগান দিয়েছিল। রাজকীয় দাসব্যবস্থাকে সামাজিক সচলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হয়। অর্থাৎ আলোচ্য পর্বে একাধিক উপাদান স্বতন্ত্রভাবে এবং মিলিতভাবে এই প্রক্রিয়াকে একটা লক্ষণীয় রূপ দিতে সাহায্য করেছিল। অধ্যাপক সিদ্দিকির ভাষ্য থেকে আমরা সেই উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করতে পারি। এদের মধ্যে প্রাথমিক উপাদানগুলি হল সুলতানি শাসনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, নগরায়ণ প্রক্রিয়া, কয়েকজন সুলতানের আলোকপ্রাপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি, সুফিসাধকদের কর্মধারা ও আদর্শ ইত্যাদি।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।