সুলতানি আমলে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

সুলতানি আমলে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়

সাধারণভাবে বলা হয় যে, অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত উপাদানের ফলে উদ্ভূত নব-সংস্কৃতির সাথে গঠনমূলক সমঝোতার (Adjustment) ধারাবাহিক প্রক্রিয়া থেকে সমাজব্যবস্থার রূপান্তর ঘটে। সুলতানি আমলে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার রূপ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এই মন্তব্য যথার্থ। এই পর্বে তিনটি পর্যায়ে গতিশীল শক্তির অভিঘাতে ভারতীয় সমাজের রূপান্তর লক্ষ্য করা যায়। যথা—(১) হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রয়াস, (২) নবাগত মুসলিম-সমাজ ও সংস্কৃতির ধারা এবং (৩) হিন্দু ও মুসলিম-সমাজের মিলিত ধারা। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি কীভাবে হিন্দুসমাজ মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরও বেশি করে নিয়মরীতির কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে কিছুটা আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হয়েছিল। আবার মুসলমানরাও সামাজিকভাবে অস্তিত্ব রক্ষা ও কর্তৃত্ব করার আশায় প্রাথমিকভাবে গোঁড়াপন্থী নেতৃত্ব দ্বারা চালিত হয়ে শাসকশ্রেণির অহংসর্বস্বতা জাহির করতে ব্যগ্র ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দুটি চরমপন্থী ধারাই অসার প্রতিপন্ন হয়। উত্থান ঘটে তৃতীয় ধারাটির। নীরবে এবং অতি ধীর গতিতে সমন্বয়ের উপাদানগুলি সামাজিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত করতে থাকে।

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারায় সমন্বয়বাদী চরিত্র প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা যায়। মুসলমানদের অনুপ্রবেশের আগে বহু জাতি ভারতে প্রবেশ করেছে এবং তাদের বাহিত সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে নতুনতর ও উন্নততর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। অতি প্রাচীনকালে আর্য-সংস্কৃতির সাথে দ্রাবিড়-সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে। তার পরে এসেছে গ্রিক, শক্, হূন প্রভৃতি জাতি। এরাও কালক্রমে ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে মিলিত হয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য্য ভুলে গিয়ে পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে গিয়েছে। অনুরূপভাবে, মধ্যযুগে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ও স্থায়ীভাবে বসবাসের সুত্রে ভারতীয় তথ্য হিন্দু-সংস্কৃতির সাথে ইসলামীয়-সংস্কৃতির মিলন-সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে। তবে এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ধারা কিছুটা ব্যতিক্রমী চরিত্রের। মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির আত্তীকরণ প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এবং অত্যন্ত ধীর গতিতে।

মুসলমানরা ভারতে আসার আগেই তাদের ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রদর্শন একটা পূর্ণ রূপ ধারণ করেছিল। সংগঠনগতভাবে ধর্মের সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শনকে যুক্ত করার ফলে ইসলাম-সংস্কৃতি অতি দ্রুত দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছিল। ইসলামের এই স্বকীয়তা ও স্বয়ম্ভরতার দরুন প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে তার মিলন সহজ ছিল না। ইসলাম ধর্ম একেশ্বরবাদী এবং প্রচণ্ডভাবে পৌত্তলিকতাবিরোধী। কিন্তু হিন্দু ধর্ম বহিরঙ্গে বহু ঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিক। আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও উভয় ধর্মের মধ্যে নানা বিষয়ে প্রত্যক্ষ বৈপরীত্য ও বিরোধ স্পষ্ট। স্বভাবতই এহেন দুটি ধর্মদর্শন ও জীবনধারার সমন্বয় বা সহাবস্থান নয়; প্রথম পর্বে তীব্র বিদ্বেষভাব দেখা দিয়েছিল স্পষ্টরূপে। ইসলাম রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুসারে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলমান এবং ‘অহল-ই-কিতাব’—যেমন ইহুদি, খ্রিস্টান প্রমুখ ছাড়া অন্য কারও অবস্থান বা অস্তিত্ব আইনগ্রাহ্য নয়। বিশেষ করে পৌত্তলিকদের সেখানে কোনো স্থানই নেই। অহল ই-কিতাব’রা ‘জিম্মি’ হিসেবে জিজিয়া কর প্রদানের শর্তে বসবাসের অধিকারী হলেও, পৌত্তলিকদের জন্য প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো স্থান স্বীকৃত ছিল না। তাই তাত্ত্বিক দিক থেকে ভারতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দুরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন এবং মুসলমানরা বিজয়ী পক্ষ হিসেবে ইসলামীয় রাষ্ট্রতত্ত্বকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে আগ্রহী থাকেন। ফলে অনিবার্যভাবে দেখা দেয় সংঘাত। সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে এই সংঘাত তীব্রভাবে প্রকাশ পায়। গোঁড়া মুসলমানদের চোখে ‘কাফের’ হিন্দুদের এবং গোঁড়া হিন্দুদের চোখে ‘ম্লেচ্ছ’ মুসলমানদের সহাবস্থান বা উভয় সম্প্রদায়ের সৌভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তা ছাড়া, উভয় ধর্মের শাস্ত্রবিদ্রা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রাখতে আগ্রহী ছিলেন, কারণ ধর্মের দোহাই দিয়ে গোষ্ঠীভুক্ত মানুষকে একত্রিত করে স্ব স্ব স্বার্থ পুরণ করা সম্ভব হত। হিন্দু তাত্ত্বিকরাও সামাজিক স্তরে একীকরণের দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদাবৃদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন।

প্রাথমিক সংঘাত সত্ত্বেও, ভারতে মুসলমান শক্তির ক্রমপ্রসারের গোড়া থেকেই এমন একটা সংস্কারবাদী ধারা প্রবাহিত ছিল, যা কালক্রমে এই দুই সংস্কৃতির মধ্যস্থিত পাঁচিলটিকে একটু একটু করে ভেঙে ফেলতে সাহায্য করেছিল। আরব সেনাপতি মহম্মদ-বিন্-কাশিম সিন্ধু ও মুলতান দখল করার পর (৭১১-৭১২ খ্রিঃ) খলিফার কাছ থেকে এখানকার হিন্দুদের জন্য ‘জিম্মি’র মর্যাদা আদায় করে আনেন। একান্ত রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে খলিফা পৌত্তলিকদের জন্য এই মর্যাদা সম্প্রসারিত করে রাষ্ট্রপ্রজ্ঞার পরিচয় দেন এবং ভবিষ্যতে এই দুটি মহান ও সবল সংস্কৃতির মিলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেন। ঐতিহাসিক এ. এল. শ্রীবাস্তব এটিকে খলিফার ‘তাৎক্ষণিক’ এবং ‘প্রয়োজনভিত্তিক’ সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন। ইতিমধ্যে ইসলামীয় আইন বা ‘শরা’ ব্যাখ্যাকারী হিসেবে চারটি গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল। এগুলি হল – হানাফি, মালাফি, শাফি এবং হানাবলী। হানাফি মতবাদের প্রবক্তা আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৬ খ্রিঃ) কেবলমাত্র ইসলামীয় রাষ্ট্রে পৌত্তিলিকদের “জিজিয়া’ প্রদানের বিনিময়ে বসবাস ও নিরাপত্তার তত্ত্ব প্রচার করেন। ভারতের তুর্কি-সুলতানগণ প্রয়োজনগত ভাবেই হোক, কিংবা আদর্শগত ভাবেই হোক ‘হানাফি’ মতটিকেই অধিক গুরুত্ব দেন। এইভাবে একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রে পৌত্তলিক হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রাথমিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তুর্কি-আফগান সুলতানেরা ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের (Theocratic state) তত্ত্বকে আক্ষরিক অর্থে অস্বীকার করে সংস্কৃতি-সমন্বয়ের কাজকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে দেন।

সংস্কৃতি-সমন্বয়ের কাজে মোঙ্গলদের পরোক্ষ অবদান উল্লেখ্য। মোঙ্গলদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ফলে পশ্চিম এশিয়া ও আফগানিস্তান থেকে ভারতবর্ষে মুসলমানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভারতে ধর্মান্তরিত মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং এরাই এদেশে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির রক্ষকে পরিণত হয়। মুসলমানদের প্রধান অংশ প্রাক্তন হিন্দু হওয়ার ফলে দেশের মূল জনসমাজের জীবনধারণ-পদ্ধতির সঙ্গে মুসলমানদের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। স্বভাবতই দুই ধর্মের মধ্যে প্রভেদ থাকলেও হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক সমঝোতা ও আদানপ্রদানের মনোভাব গড়ে ওঠে। একই সাথে দীর্ঘকাল বসবাস করার সূত্রে উভয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন সম্ভব হয়। ধর্ম, শিল্পকলা, সাহিত্য ও সামাজিক জীবনে সংস্কৃতি-সমন্বয়ের প্রভাব বেশি করে অনুভূত হয়।

আলোচ্য পর্বে ধর্মের ক্ষেত্রে এক উদার ও পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ জন্ম নেয় এবং জনমনে গভীর প্রভাব ফেলে। বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুযোগীদের প্রভাব ইসলামের মধ্যে অতীন্দ্রিয়বাদের উদ্ভবে কোনো না-কোনো ভাবে সাহায্য করে বলে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন। আবার ইসলামের একেশ্বরবাদ এদেশে ভক্তিবাদী আন্দোলনের উৎস হিসেবে কাজ করে বলে মনে করা হয়। সুফিবাদ ও ভক্তিবাদ উভয় মতবাদেই ‘এক ঈশ্বর’ এবং প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের তত্ত্ব প্রচার করা হয়। মুসলিম সুফি-সন্তগণ ধর্মসহিষ্ণুতার নীতি প্রচার করেন। সুফি-সন্তদের ‘দরগা’ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মপ্রাণ মানুষের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই ধর্মসহিষ্ণুতার পরিণতি স্বরূপ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্যপিরের আরাধনা জনপ্রিয়তা পায়। একথা অনস্বীকার্য যে, মধ্যযুগে ভারতে সংস্কৃতি-সমন্বয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে এই দুই মতবাদ নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। নিম্নবর্ণের বহু মানুষ সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সুফিবাদের প্রভাবে হিন্দু-সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথার ব্যাপকতা কিছুটা হ্রাস পায়। অবশ্য সামাজিক সমন্বয়ের ধারা সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তবে এই পর্বে সমন্বয়ের যে ধারা জন্ম নিয়েছিল, বর্তমান কালের সামাজিক মেলবন্ধন তারই ফলশ্রুতি।

শিল্পস্থাপত্যে সমন্বয়ের প্রক্রিয়া ছিল তুলনামূলকভাবে সরল এবং এর প্রভাব ছিল গভীর। তুর্কিদের সাথে ভারতে এসেছিল আরবি ও পারসিক শিল্পরীতি। ক্রমে বৌদ্ধ ও হিন্দু স্থাপত্যরীতির সাথে পারসিক শিল্পরীতির সম্মেলনে জন্ম নিল এক নতুন ধারা। মন্দির ভেঙে মসজিদ করতে গিয়ে প্রচলিত ‘চৌকাট’ সম্পন্ন খিলানের পাশাপাশি তির্যক খিলান ও গম্বুজের সহাবস্থান ইন্দো-পারসিক শিল্পরীতির জন্ম দেয়। ভারতীয় কারিগর বা শিল্পী মসজিদ নির্মাণ করতে গিয়ে কখন নিজের অজান্তে পারসিক রীতির সাথে শিল্পীমনের গভীরে লালিত ভারতীয়-রীতির মিলন ঘটিয়ে ফেলে। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন : “মুসলমান ও ভারতীয় স্থাপত্য-রীতির মিলনে যে নতুন রীতির জন্ম হয়, তার সঙ্গে উভয় প্রথাগত স্থাপত্যের পার্থক্য ছিল। হিন্দু প্রতীক, যেমন পদ্মফুল নতুন রীতির অঙ্গীভূত হয়ে যায়। এই সমন্বয় নানাভাবে হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মিলনের চরিত্র নির্দেশ করে। ব্রাহ্মণ বা উলেমা প্রমুখ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হলেও মিলনের স্রোত ধীরে ধীরে গতিশীল হয়ে উঠে।”

ক্রমে ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই দুই সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান গড়ে ওঠে। সাহিত্যে সমন্বয়ী ধারার পথপ্রদর্শক ছিলেন কবি আমির খসরু। তখন সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। আমির খসরুর প্রখ্যাত গ্রন্থগুলি ফারসিতে রচিত হয়েচিল। তবে তিনি হিন্দিতেও বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। খসরু ফারসি ভাষার ভারতীয়করণ করেন। সুফি-সন্ত এবং খসরুর মতো ভারতপ্রেমী সাহিত্যসেবীদের নেতৃত্বে ফারসি ও হিন্দি ভাষার সমন্বয়ে উর্দু ভাষার জন্ম হয়। ফলে ফারসিভাষী তুর্কিগণ কিংবা হিন্দিভাষী ভারতীয়দের মধ্যে ভাবের সেতুবন্ধন সহজতর হয়। এই পর্বে বহু মুসলমান লেখক হিন্দিতে এবং হিন্দু লেখক উর্দুতে কাব্য সৃষ্টি করে ভাবজগতের মেলবন্ধন ঘটান। ভাষা-সাহিত্যের মেলবন্ধনের পরিণতিস্বরূপ বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনূদিত হয় এবং ফারসি গ্রন্থ অনূদিত হয় হিন্দিতে।

সংস্কৃতি-সমন্বয়ের ঢেউ সামান্যভাবে হলেও, উভয় সম্প্রদায়ের বিজ্ঞানমনস্কতাকেও স্পর্শ করে। হিন্দু ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মুসলমানদের আকৃষ্ট করে। ভারতীয় বেদান্ত-দর্শন, যোগ-দর্শন তাঁরা আগ্রহের সাথে অধ্যয়ন করেন। সুফিবাদের প্রসারে ভারতীয় যোগ-দর্শনের প্রভাব আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আবার মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে হিন্দুরা জ্যোতির্বিদ্যায় নানা দিক, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হয়। বর্ষপঞ্জি, কোষ্ঠীবিচার প্রভৃতির ব্যাপারেও হিন্দুরা ইসলামীয় সংস্কৃতির কাছে কম ঋণী নয়।

সুলতানি যুগে হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতি সমন্বয় ব্যাখ্যা প্রসঙ্গ আবেগাপ্লুত হওয়া ইতিহাসসম্মত নয়। সমকালীন বৈষ্ণব সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে প্রসঙ্গটির সাদা কালো দুটি ছবিই দেখা যাবে। দীর্ঘদিনে একত্রে বসবাসের অনিবার্য ফলস্বরূপ এই দুটি সংস্কৃতি পরস্পরের কাছাকাছি এসেছে। তবে এই মিলন অনেকটাই বাহ্যিক। একে অপরের জীবনধারা, বিশ্বাস, সংস্কার ইত্যাদির ওপর হয়তো প্রভাব ফেলেছিল, কিন্তু মানুষ বা সমাজের বাহ্যিক আচরণের মধ্যেই এই প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো সংস্কৃতিই অপর সংস্কৃতির মর্মকে স্পর্শ করতে বা মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ড. মজুমদার ( R. C. Majumdar): “Each was influenced by other, in varying degrees, not only in different spheres of life, but also in ideas, beliefs and even superstitions. But all these merely affected, the external and superficial in man and society, and left untouched the core of the heart and the mind.” এটিও লক্ষণীয় যে, হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতা যেমন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলামের সাম্যবোধের প্রতি আকৃষ্ট করেছে, তেমনি ইসলামের গ্রাস থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্য এই ধর্মের মধ্যে রক্ষণশীলতা নতুন করে জেঁকে বসেছে। এই নেতিবাচক প্রাতরোধ হয়তো সঠিক নয়; কিন্তু ইতিহাসের ধারা এভাবেই অগ্রসর হয়েছে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment