আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি যুগের সমাজ : সামাজিক অবস্থা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সামাজিক অবস্থা
ত্রয়োদশ শতকে ভারতীয় সমাজের মূল জনগোষ্ঠীতে প্রাথমিকভাবে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল—হিন্দু এবং মুসলমান। হিন্দুসমাজ ও জনগোষ্ঠীর একক ও প্রবল অস্তিত্বের মাঝে মুসলমানদের আগমন ও প্রতিষ্ঠা ভারতের সমাজ-জীবনে একটা উত্তেজনাকর অধ্যায়ের সূচনা করে। ত্রয়োদশ শতক থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি ভাগ পর্যন্ত সময়ে ভারতীয় জীবনে এই দুটি স্বতন্ত্র এবং বহুলাংশে পরস্পরবিরোধী জীবনধারা ও সামাজিক ব্যবস্থার সংঘাত অব্যাহত থাকে। একদিকে পুরাতন হিন্দু সমাজব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষার রূঢ় ও দৃঢ় প্রয়াস এবং অন্যদিকে নবাগত ইসলাম সংস্কৃতির সামাজিক ভিত্তি পাওয়ার ঐকান্তিক প্রয়াস ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রে এক দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় অস্থিরতার সূচনা করে। হিন্দুদের প্রধান শক্তি ছিল তার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও কঠোর সামাজিক শৃঙ্খলা। অন্যদিকে নবাগত ইসলামের প্রধান শক্তি ছিল তার ধর্মভিত্তিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন দর্শন এবং সাম্য ভাবনা। ইতিপূর্বে শক্, কুষাণ প্রভৃতি বহু বিদেশি শক্তি ভারতে প্রবেশ করলেও সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো অস্থিরতা ছিল না। কারণ ওই সকল শক্তি বা জাতি কোনোরূপ সংগঠিত জীবনধারা বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এদেশে আসেনি। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ভারতীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির সাথে একীভূত হতে পেরেছিল। কিন্তু ইসলাম এসেছিল একটি সুসংবদ্ধ ও পরীক্ষিত জীবনধারার উত্তরাধিকার হিসেবে। স্বভাবতই সামাজিক ক্ষেত্রে সাঙ্গীকরণের সম্ভাবনা ছিল কম এবং সংঘাত ছিল অনিবার্য। অবশ্য ঈশ্বরের (বা প্রকৃতির) শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবকুল শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির অনিবার্যতাকে মেনে নিতে ভুল করেনি। তাই চতুর্দশ শতকে সামাজিক উত্তেজনা ও অস্থিরতার দাপট অনেকটাই শিথিল হয়ে গিয়েছিল।
হিন্দু সমাজের ভিত্তি ছিল তাঁর ঐতিহ্যের গৌরব ও কঠোর সামাজিক বিন্যাস। কিন্তু অসার, অবাস্তব ও জীবনবিমুখ হিন্দু সমাজব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অবক্ষয়ী প্রক্রিয়া পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্রুত ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল। জাতিভেদ, বর্ণভেদের কাঁটায় ক্ষত সমাজ-জীবনের রক্তপাত ও তার যন্ত্রণা তথাকথিত ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি। সেই মুক সমাজ যন্ত্রণা ইসলামের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার ফলে সৃষ্ট পরিবর্তিত স্থিতিতে মুক্তির পথ খুঁজে নিতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে। শাসকশ্রেণি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে এসে নিশ্চিত নিরাপত্তার আশায় কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়। আবার অনেকে আকৃষ্ট হয় ইসলামের সামাজিক সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শে। হিন্দু-সমাজের ওপর এই দুটি ধারারই পরিণাম এক হলেও, এই দুটি ধারণার সামাজিক তাৎপর্য ছিল স্বতন্ত্র। প্রথমটিতে অসহায় স্বার্থচিন্তা সক্রিয় ছিল, কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে একটি সমন্বয়ী ধারার সক্রিয়তা প্রকাশ পেয়েছিল। এই তৃতীয় ধারাটির বিকাশে হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষের ইতিবাচক ও বাস্তবমুখী চিন্তাভাবনা সক্রিয় ছিল।
অন্যদিকে মুসলমান সমাজের সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ধারণাও আক্ষরিক অর্থে কার্যকরী ছিল না। রোমিলা থাপার এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, অ-মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুলতানি শাসনের একেবারে প্রাথমিক পর্বে আন্তঃসম্প্রদায় সংঘাত শুরু হয়েছিল এবং এই ধরনের একটি সংঘাত থেকে সুলতান রাজিয়ার আমলে সুলতানির সংকট তীব্রতর হয়েছিল। তাঁর মতে, আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সময় ভারতে “শিয়া’ মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল। সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে ‘শিয়াদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। কিন্তু গোঁড়াপন্থী ‘সুন্নি’ মুসলমানরা শিয়াদের পছন্দ করত না। ভারতে তুর্কি আক্রমণের ফলে এদেশে সুন্নিদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তির সূচনা ঘটে। ইতিপূর্বে গজনির সুলতান মামুদ ভারতে (মুলতান ও সিন্ধু) শিয়াদের ধংস করার চেষ্টা করেও সফল হননি। কিন্তু এখন তুর্কিদের প্রবল দাপটের মুখে শিয়াদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। তাই তারা অন্যান্যদের সহায়তায় সুলতান রাজিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার একটা প্রয়াস নেয়। যদিও শিয়াদের এই প্রয়াস সফল হয়নি। এর পরে ‘সুফিদের সাথেও সুন্নিদের একটা দীর্ঘ সংঘাত শুরু হয়। শিয়াদের মধ্য থেকেই ‘সুফি’দের উদ্ভব ঘটেছিল। তুর্কি শাসনের মাঝপথে এরা ভারতে প্রবেশ করেছিল। সুন্নি মতবাদ ও বিশেষ করে উলেমাশ্রেণির বিরুদ্ধে এদের জেহাদ ঘোষিত হয়েছিল। এরা মনে করত যে, রাজক্ষমতার সাথে ধর্মের যোগসাধন করে উলেমারা কোরানের আদি গণতান্ত্রিক নীতিকে বিকৃত করেছে। ফলে উলেমারাও সুফিদের ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে। এ ছাড়া মুসলিম সমাজে জাতি বা গোষ্ঠীভিত্তিক ভেদাভেদ ও রেষারেষী তো ছিলই।
সুলতান : সামাজিক অবস্থা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব
রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বোচ্চে ছিল সুলতানের স্থান। সাধারণ মানুষের কাছে সুলতান ছিলেন অতি সামাজিক একজন পুরুষ। আসলে যে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা, ব্যস্ততা ও আড়ম্বরের মধ্যে সুলতান বাস করতেন, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে সুলতান কল্পরাজ্যের একজন বাসিন্দা রূপেই প্রতিভাত হতেন। পারস্যের রাজকীয় ঐতিহ্যের আকাশস্পর্শী মহিমা, দত্ত ও কর্তৃত্বের অতলস্পর্শী অবস্থান গজনির মাটি ছুঁয়ে ভারতের মাটিতে পৌঁছেছিল। সুলতানের সেই অদৃষ্টপূর্ব কর্তৃত্বের সাথে চোখ-ঝল্ল্সানো ঐশ্বর্য সম্পদ, সুবিশাল রাজপ্রাসাদ, অসংখ্য দাসী-বাঁদি, সশস্ত্র অনুচরবর্গ, সদা সন্ত্রস্ত লোক-লস্কর, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদির মেলবন্ধন সুলতানকে সামাজিকভাবেও এক স্বতন্ত্র জগতের বাসিন্দা রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সুলতানের কর্তৃত্বের সাথে ‘ঐশী’ শক্তির সম্পর্ক এবং ‘ঈশ্বরের ছায়া’ (জিল-উল্-আহ) রূপে সুলতানের প্রতিষ্ঠা তাঁর গৌরব মুকুটে ঔজ্জ্বল্য দিয়েছিল, তা মুক্ত চোখে অবলোকন করা সত্যিই ছিল কষ্টকর। তবুও মধ্যযুগে সুলতান (বা বাদশা)-ই ছিলেন সমাজের প্রতিবিম্ব। কারণ প্রশাসনের সাথে যুক্ত মানুষেরা তাঁদের অর্থ ও সামর্থ্য অনুযায়ী সুলতানকেই অনুসরণ করতেন। বারাণীর ভাষায়: “সুলতানের ব্যক্তিগত প্রভাব অনুযায়ী সাধারণভাবে গোটা সমাজের সুর বাঁধা হত। আর নিম্নবর্গীয়দের অবস্থান, কী মুসলিম, কী হিন্দু, তৎকালীন চালচিত্রে ছিল ঝাপসা।”
সুলতানের মহিমা ও মর্যাদার অন্যতম প্রতীক ছিল তাঁর দরবার ও হারেম। অপ্রতিহত ও ঐশী ক্ষমতার তত্ত্বে গড়ে ওঠা সুলতানি রাষ্ট্রে দরবারের কার্যকরী উপযোগিতা ছিল শূন্য। বর্তমানকালের সংসদীয় ব্যবস্থায় ছায়ামাত্রও ছিল না। আসলে পারসিক রীতি অনুযায়ী রাজকীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই সুলতানি আমলে দরবার অনুষ্ঠানের প্রচলন হয়েছিল। দরবারে উপস্থিত ব্যক্তিদের পোশাক পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা, শিষ্টাচার সবই ছিল কঠোরভাবে নির্দিষ্ট। রীতি-পদ্ধতির সামান্যতম বিচ্যুতি বা শিথিলতা সহ্য করা হত না। সাধারণত অভিজাতবর্গ ও উচ্চ অমাত্যবর্গ স্বয়ং দরবারে উপস্থিত থাকতেন। প্রয়োজনে তাঁদের প্রতিনিধি (ভকিল) উপস্থিত থাকতে পারতেন। পদমর্যাদা অনুসারে প্রত্যেকে সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করতেন। ‘বারবক’, ‘হাজিব’ ও ‘ভকিল’ ছিলেন দরবারের প্রথম তিনজন কর্মী। এরাও অভিজাত ছিলেন। সুলতান উপস্থিত হলে উপস্থিত সবাই উঠে দাঁড়াতেন। তারপর বারবক-এর আহ্বান অনুযায়ী একে একে সুলতানকে ‘কুর্নিশ’ ও ‘তসলিম’ দ্বারা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন এবং ‘নজর’ নিবেদন করতেন। বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিদের সুলতান স্পর্শ বা আলিঙ্গনও করতেন। তবে এরূপ দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যায়। মেজর রাভার্টি অনূদিত ‘তবকাত-ই নাসিরী’র ভাষ্য অনুযায়ী সুলতানকে ‘স্বর্গচ্যুত সূর্য’, অভিজাতদের ‘গ্রহরাজি’ এবং দরবারকে ‘উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কপুঞ্জের সভা’ রূপে বর্ণনা করা যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।