আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি যুগে মুদ্রাব্যবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি যুগে মুদ্রাব্যবস্থা
সুলতানি যুগে মুদ্রাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। তুর্কি শাসনের আগে ভারতীয় মুদ্রার একপাশে রাজা বা রাজার মস্তিষ্কের ছবি এবং অন্যপাশে দেবদেবী, পশুপাখি ইত্যাদির খোদিত অলংকরণ করা থাকত। প্রাচীন ভারতে রোমান মুদ্রার সাথে তাল রেখে ভারতীয় মুদ্রার ওজন নির্ধারিত হত। সাধারণভাবে ১২৪ গ্রেন, ১৪৫.১ গ্রেন, ১৪৬.৪ গ্রেন ইত্যাদি ওজনের মুদ্রা চালু ছিল। কোনো কোনো মুদ্রায় প্রবর্তকের নাম, উপাধি ও তারিখ খোদাই করা হত। দিল্লিতে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয় মুদ্রার ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ইসলাম ধর্মের রীতি মান্য করে মুদ্রায় দেবদেবী বা মানুষের মূর্তি বা পশুপাখির ছবি খোদাই করা নিষিদ্ধ হয়। পরিবর্তে লোককথা বা নীতিবাক্য খোদাই করার রীতি চালু হয়। সাধারণত ইসলামের ধর্মীয় বাণী ‘কলিমা’ ও ‘খলিফা’র নামে একপাশে উৎকীর্ণ করা হত এবং অপর পার্শ্বে সুলতানের নাম, উপাধি ও খোদাই করার তারিখ উৎকীর্ণ থাকত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মুসলিম শাসন শুরুর পূর্বে ভারতে মুদ্রার ওপর তার টাঁকশালের স্থান খোদাই করার রীতি ছিল না। মুদ্রার ওজন ও মানের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। মুদ্রামান হিসেবে ‘তোলা’র প্রচলন হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা উভয়ক্ষেত্রে নানা ‘একক’-এর প্রচলন করা হয়। অর্থাৎ তুর্কি-আফগান শাসনকালে ভারতীয় মুদ্রাব্যবস্থার প্রকৃতি গঠনে মধ্য-এশিয়ার মুদ্রাব্যবস্থার বিশেষ প্রভাব ছিল। অবশ্য সামান্য আকারে হলেও প্রাচীন ভারতে প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থার কাছে সুলতানি ও মুঘলযুগের মুদ্রাব্যবস্থা ঋণী ছিল। আদি-মধ্যযুগের মুসলমান শাসকদের মুদ্রার প্রাচীন ভারতীয় রীতির কিছু প্রভাব দেখা যায়। যেমন, গজনির সুলতান মামুদ ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি সন ৪১৮-১৯) যে মুদ্রা চালু করেন, তাতে হিন্দু প্রভাব স্পষ্ট। এই মুদ্রায় প্রথম পিঠে আরবি শব্দে ‘কলিমা’ খোদাই করা ছিল। এবং অন্য পিঠে কলিমার সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদসহ রাজার নাম (মামুদ), খোদাই স্থান (মামুদপুর অর্থাৎ লাহোর) এবং খোদাই করার সন (হিজরি ৪১৮-‘১৯) ইত্যাদি উৎকীর্ণ করা ছিল। সম্ভবত, এটিই একমাত্র মুদ্রা যেখানে ‘কলিমা’র সংস্কৃত অনুবাদ পাওয়া যায়। মহম্মদ ঘুরির কিছু মুদ্রায় রাজপুত রীতি অনুসারে দেবী লক্ষ্মীর খোদিত মূর্তি লক্ষ্য করা যায়। আদি-মধ্যযুগে প্রধানত তামা ও ব্রোঞ্জের মুদ্রা চালু ছিল। রৌপ্যমুদ্রা ছিল নগণ্য এবং স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিলই না।
সুলতানি আমলে মধ্য-এশিয়ার সাথে ভারতের বাণিজ্য-সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলে এদেশে আবার রোপ্যমুদ্রার প্রচলন ঘটে। এই সময় রৌপ্যটংকার প্রবর্তন করেন সুলতান ইলতুৎমিস। তিনি নানা ধরনের রৌপ্যটংকা চালু করেন। একটি টংকার আকার ছিল গোল এবং সম্মুখভাগে ছিল অশ্বরূঢ় রাজা’র, যা হিন্দুযুগের মুদ্রা থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিপরীত দিকের কাজটি ছিল স্বতন্ত্র। এখানে একটি চতুষ্কোণের মধ্যে আরবি শব্দে খোদিত ছিল ‘সর্বশক্তিমান সুলতান, বিশ্বের আলোক ও বিশ্বাসের উৎস, বিজয়ীদের নেতৃত্বস্বরূপ, সুলতান ইলতুৎমিস’। এই মুদ্রার ওজন ছিল ১৬৫ গ্রেন। ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতিলাভের পর তিনি আর এক ধরনের মুদ্রা চালু করেন, যা ইসলামিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই মুদ্রা সম্পূর্ণরূপে হিন্দু-প্রভাব রহিত। এর একদিকে মহান খলিফা ও অন্যদিকে সুলতান ইলতুৎমিসের গুণকীর্তন করা হয়েছে। আলাউদ্দিন খলজির আমলে রৌপ্যমুদ্রার খলিফার নাম খোদাই বন্ধ হয়ে যায়। তবে দক্ষিণ ভারত জয়ের সূত্রে তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তাই তিনি স্বর্ণমুদ্রারও প্রচলন করেন। অবশ্য তিনি পরোক্ষভাবে খলিফাকে সম্মান জানান। তাঁর মুদ্রায় উৎকীর্ণ একটি বাণী ছিল এরূপ—“দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, খলিফার দক্ষিণ হস্ত এবং বিশ্বাসীদের প্রধান সেনাপতি”। আলাউদ্দিনের উত্তরাধিকারী কুতুবউদ্দিন মুবারক আরও একধাপ এগিয়ে নিজ মুদ্রায় সুলতানকে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা’, ‘স্বর্গ ও মর্ত্যের খলিফা’, ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি (খালিফা)’ এবং ‘প্রধান ইমাম’ ইত্যাদি উপাধিতে বর্ণনা করেন।
সুলতানি আমলে রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রার পাশাপাশি রূপা ও তামার সংমিশ্রণে নতুন মুদ্রার (Billion) প্রচলন হয়। সাধারণভাবে এই মুদ্রার ওজন ছিল ৫৬ গেইন। তবে মুদ্রায় রূপা ও তামার অনুপাত অনুসারে মূল্যের তারতম্য ঘটত। এই মুদ্রার আকৃতি ও ওজন ছিল প্রায় একইরকম। ‘দেহলিওয়ালা’ নামক মুদ্রার একদিকে চৌহানবংশীয় মুদ্রার অনুকরণে ‘অশ্বারূঢ় ব্যক্তি’ এবং অন্যদিকে কুঁজবিশিষ্ট বৃক্ষের প্রতিকৃতি এবং নাগরী’ অক্ষরে সুলতানের নাম খোদাই করা থাকত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবি হরফ ব্যবহৃত হত। সুলতান রাজিয়ার একটি স্বর্ণমুদ্রার একপৃষ্ঠে এক অশ্বারূঢ় ব্যক্তিকে ঘিরে নাগরী রীতিতে লেখা ছিল ‘শ্রী হামির’ (আমির) এবং অন্যপৃষ্ঠে আরবিতে রাজিয়ার নাম খোদিত ছিল। এর ওজন ছিল ৫৪ গ্রেইন। বলবন ৫৫ গ্রেইন যুক্ত মুদ্রা চালু করেন। এর একদিকে মাঝখানে গোলাকারে সুলতানের নাম খোদিত ছিল। অন্যদিকে সুলতানের নাম ও উপাধি খোদিত থাকে। কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ চতুষ্কোণবিশিষ্ট মুদ্রা প্রচলন করেন। এর একদিকে ‘ঘটশ্বরের খলিফা, মুবারক শাহ’ এবং অন্যদিকে ‘আল্লাহর অনুগত সুলতান, বিশ্বাসীদের নেতা’ খোদিত ছিল। এই মুদ্রার ওজন ৮০ গ্রেইন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, আলাউদ্দিন খলজিই সর্বপ্রথম প্রকাশের তারিখসহ বিলিয়ন মুদ্রা চালু করেন। ইলবেরি তুর্কিদের তাম্রমুদ্রায় সুলতানের নাম থাকলেও তারিখ দেওয়া হত না। কিছু মুদ্রায় কেবল ‘আদিল’ কথাটি থাকত।
মুদ্রা-বৈচিত্র্যের দিক থেকে সর্বাধিক আকর্ষণীয় ছিল মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমল। তাঁর মুদ্রার আকৃতি ও খোদাইকর্ম ছিল খুবই উন্নতমানের। বিভিন্ন মানের বহু স্বর্ণমুদ্রা তিনি চালু করেন। মুদ্রাক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাঁর নাম ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। শাসনকালের সূচনায় তিনি প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ১৭২.৮ গ্রেইন-এর স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা চালু রাখেন। দক্ষিণ ভারত অভিযানের সূত্রে উত্তর ভারতে সোনা-রূপার অন্তঃপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় মুদ্রার মূল্যমান হ্রাস হলে তিনি রাজাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সোনা ও রূপার মুদ্রার ওজন কমিয়ে ২০১.৬ ও ১৪৪ গ্রেইন করে দেন। স্বর্ণমুদ্রা ‘দিনার’ ও রৌপ্যমুদ্রা ‘আদলি’ নামে পরিচিত হয়। অবশ্য নির্ধারিত ওজনের কমেও কিছু কিছু মুদ্রা পাওয়া যায়। ৭২৬ হিজরি সনের একটি স্বর্ণমুদ্রার ওজন ছিল ১৯৯ গ্রেইন। মহম্মদ তুঘলকের আমলে প্রায় ছয় ধরনের স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা চালু ছিল। রৌপ্য ও তামা মিশ্রিত (Billion) মুদ্রার পরিবর্তে তামা ও পেতলের (Copper and Bronze) মুদ্রা প্রচলনের প্রয়াস। আনুমানিক ১৩২৯ থেকে ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দের (হিজরি সন ৭০০-৭৩২) অন্তর্বর্তীকালে তাঁর প্রতীকী মুদ্রা চালু ছিল। কিন্তু এমন স্বল্পমূল্যের ধাতুনির্মিত প্রতীক মুদ্রাব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত নানা কারণে ব্যর্থ হয়ে যায় (বিস্তারিত আলোচনা ‘মহম্মদ তুঘলকের পরিকল্পনা শীর্ষক অংশে আছে)।
ফিরোজ তুঘলকের মুদ্রায় বিশেষ নতুনত্ব ছিল না। তবে খলিফার প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যহেতু তাঁর আমলের মুদ্রার একপিঠে খলিফাদের নামোল্লেখ থাকত এবং অন্যপিঠে খলিফার সেবক হিসেবে সুলতানের নাম খোদাই করা থাকত। তাঁর (Billion) মুদ্রার ওজন ছিল ১৪৪ গ্রেইন। ফিরোজের পরবর্তীকালে ভারতে সোনা-রূপার আমদানি হ্রাস পেলে শুধুমাত্র তামা ও রূপার Billion কিংবা তামার মুদ্রা চালু থাকে। লোদী সুলতানদের মুদ্রায় জৌনপুরের শার্কীশাসকদের মুদ্রাব্যবস্থার বিশেষ প্রভাব ছিল। ‘বহুমুখী’ মুদ্রার ওজন ছিল ১৪৫ গ্রেইন। দিল্লি ও জৌনপুর থেকে তাঁদের মুদ্রা প্রচলিত হত।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।