আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি যুগে স্থাপত্যশিল্প” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি যুগে স্থাপত্যশিল্প
তুর্কি-আফগান শাসকদের সংস্কৃতি-চেতনা সম্পর্কে প্রাথমিক পর্বের ভারতীয় লেখকদের সাথে আধুনিক গবেষকদের কিছুটা মতভেদ আছে। প্রথম তুর্কি অভিযানকারীদের ‘অসভ্য বর্বর’ বলে আখ্যায়িত করার প্রবণতা ছিল। এটা তেমন অস্বাভাবিকও ছিল না। কারণ যে নৃশংসতা, হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও অত্যাচার দ্বারা তুর্কি-যোদ্ধারা ভারতভূমিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাতে তাদের মধ্যে শিল্পীর উদারতা, সুক্ষ্মতা বা কোমলতার অস্তিত্ব কল্পনা করাও কষ্টকর ছিল। আধুনিক গবেষকরা এই মুল্যায়নকে যথার্থ বলে মনে করেন না। স্যার জন মার্শাল মনে করেন, মধ্যযুগে এশিয়ার অধিকাংশ যোদ্ধাজাতির মধ্যেই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে তুর্কি-আফগান জাতি ইসলামীয় শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল—একথা কেবল অসত্য নয়, অযৌক্তিকও। তবে ড. কুরেশী দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘Cultural state’ বলে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাও অতিরঞ্জনদোষে দুষ্ট। ড. এ. এল. শ্রীবাস্তব মনে করেন যে, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ‘ধর্মাশ্রয়ী’ ; নৃত্যগীত, ভাস্কর্য বা জীবিত প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ইসলামীয় তত্ত্বে অস্বীকৃত ছিল। স্বভাবতই এই রাষ্ট্রকে এককথায় Cultural State বলা যায় না। তবে তিনিও স্বীকার করেছেন যে, ইলামীয় শিক্ষা ও শিল্পের প্রতি তুর্কি আফগান শাসকদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি লিখেছেন: “Though primarily a military people our Turkey-Afgan rulers patronized Islamic learning and arts.”
তুর্কিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ভারতের শিল্পভাবনার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। তুর্কিজাতি মধ্য-এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ায় এসে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে এবং সেখানকার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়। নবম-দশক শতকে আরবীয় ও পারসিক সভ্যতা চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করেছিল। এই সকল অঞ্চলে ইসলামের সম্প্রসারণের ফলে স্থানীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে ইসলামের পরিচয় ও আত্তীকরণ ঘটে। তাই তুর্কিরা যখন ভারতে আসে, তখন শিল্পস্থাপত্য সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল। তবে তুর্কি-আফগান যুগে ভারতে যে স্থাপত্যকলার চর্চা শুরু হয়, তা সম্পূর্ণ বহিরাগত বা ইসলামীয় ছিল না। ভারতে বসবাস শুরু করার পর তুর্কিরা ভারতীয়দের সুপ্রাচীন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত শিল্পস্থাপত্যের সাথে পরিচিত হয়। তুর্কিদের ওপর পারসিক শিল্পের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। আবার সুপ্রাচীন কাল থেকেই পারসিক ও ভারতীয় শিল্পসংস্কৃতির মধ্যে মিল ছিল। কারণ উভয় অঞ্চলেই ছিল আর্যসংস্কৃতির উপস্থিতি। তাই তুর্কি শাসনকালে ভারতীয় শিল্পস্থাপত্যে হিন্দু বা ভারতীয় ধারার সাথে ইসলামীয় ধারার সংমিশ্রণ ঘটে। উভয় ধারার সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত এদেশে এক সমৃদ্ধ শিল্পরীতির বিকাশ হয়। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্রের মতে, “এই সংমিশ্রণের কাজ চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে, বহু উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে। আত্তীকরণ ও সংঘাত দুটোই পাশাপাশি চলেছিল, তবে স্থান ও কাল বিশেষে কোনোটা বেশি বা কোনোটা কম।”
শেয়ানী (H. K. Sherwani) লিখেছেন : “They (Hindu and the Perso Turks) could not but be impregnated by each other in their culture and their ideas which are so visibly enshrined in Medieval architecture, art and literature.” যাই হোক, তুর্কি যোদ্ধারা ‘পৌত্তলিক’ ভারতবর্ষের সংস্কৃতির প্রতি হীনমন্যতার ভাব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং ঐতিহ্যশালী হিন্দুশিল্পে অপার্থিব সৌন্দর্য-সুষমা, কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিমা ও উদারতার সাথে ইসলামীয় স্থাপত্যের মানসিকতা, ধর্ম ও ভৌগোলিক প্রয়োজনবোধ ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক নবতম শিল্পধারার জন্ম দেন। সুলতানি আমলের এই শিল্পধারা ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্য, ইন্দো সারাসেনীয় স্থাপত্য’বা ‘পাঠান-স্থাপত্য ‘নামে আখ্যায়িত হয়। তবে ফার্গুসন (Fergusson) এর দেওয়া ‘পাঠান’ শিল্পধারা নামটিতে অধ্যাপক সরস্বতী (S. K. Saraswati) আপত্তি করেছেন। কারণ সুলতানি শাসনের সাথে যুক্ত রাজবংশগুলির মধ্যে শুধুমাত্র শেষ বংশটি ছিল পাঠানজাতির প্রতিনিধি।
সুলতানি আমলের শিল্পধারার সমন্বয়ে বা সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে প্রচলিত হিন্দুরীতি এবং নবাগত ইসলামীয় রীতির মধ্যে কোনটির প্রভাব বেশি ছিল, সে বিষয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। হ্যাভেল-এর মতে, এই শিল্পরীতির শরীর ও মন দুই-ই ছিল—ভারতীয়। শিল্প-নিদর্শনে হিন্দু-স্থাপত্যের প্রাধান্যই বেশি। অন্যদিকে ফার্গুসন, ভি. স্মিথ প্রমুখ মনে করেন, সুলতানি আমলের শিল্পস্থাপত্যে হিন্দুরীতির প্রভাব ছিল নেতিবাচক। কিন্তু স্যার জন মার্শাল, ড. মজুমদার প্রমুখ মনে করেন, ইন্দো ইসলামীয় শিল্পরীতি কেবল ইসলামীয় রীতির স্থানীয় (ভারতীয়) রূপ কিংবা হিন্দু স্থাপত্যের রূপান্তরিত প্রকাশ ছিল না; এর মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন শিল্পরীতির সাথে মুসলমান অভিযানকারীগণ কর্তৃক বাহিত পশ্চিম ও মধ্য-এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকান শিল্পরীতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। এই মত সমর্থন করে মার্শাল লিখেছেন: “Indo- Islamic architecture derives its character from both sources though not always in equal degrees.” অধ্যাপক মার্শাল মনে করেন, হিন্দু স্থাপত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল শক্তি-সৌন্দর্যের সমান্তরাল প্রকাশ। ইন্দো-ইসলামীয় শিল্পধারায় হিন্দু স্থাপত্যের এই বিশিষ্টতার উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়।
হিন্দু ও বৌদ্ধ শিল্পরীতির সাথে ইসলামি শিল্পরীতির মিলনের কয়েকটি বিশেষ কারণ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, তুর্কিরা ভারতে প্রথমে এসেছিল সামরিক ভাগ্যান্বেষী রূপে। তাদের সাথে দক্ষ কারিগর বা স্থপতি ছিল না। এদেশে কর্তৃত্ব-স্থাপনের পর তারা যখন বাসগৃহ ও উপাসনালয় নির্মাণে উদ্যোগী হয়, তখন তাদের নির্ভর করতে হয় ভারতীয় শিল্পী-কারিগরদের ওপর। এই কারিগররা নিজেদের অজান্তে এবং খুব স্বাভাবিক কারণে, পারসিক শিল্পরীতির মাঝে ভারতীয় রীতি ঢুকিয়ে দেয়। যেমন— ভারতীয় প্রতীক পদ্মফুলের সাথে পারসিক নকশা লতাপাতার সর্পিল অলংকরণ একাকার হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, মুসলিম শাসকরা প্রথমদিকে অল্প খরচে এবং অল্প সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় বাসগৃহ ও উপাসনালয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এজন্য তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন হিন্দু বা জৈন মন্দির বা অট্টালিকা। এই সকল নির্মাণের সামান্য পরিবর্তন, যেমন— দেওয়াল ভেঙে কয়েকটি খিলান এবং মাথার ওপরে গম্বুজ নির্মাণ করে এগুলিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। ফলে সম্পূর্ণ স্থাপত্য-কর্মটির মধ্যে ভারতীয় শিল্পধারা নানাভাবে বর্তমান থেকে যায়। তৃতীয়ত, বিশ্বের কোনো দেশের স্থাপত্যে শক্তি ও সৌন্দর্যের এমন সুষম বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, যা ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতে লক্ষ্য করা যায়। মুসলমান স্থপতি ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকগণ ভারতীয়-স্থাপত্যের এই অনন্যতাকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। তাই ইসলামি শিল্পরীতির মধ্যে বিশেষত স্থাপত্যে ভারতীয় ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী মনে করেন, ভারতে সমন্বয়ী আদর্শের জন্যই মুসলমান-শাসিত ভারত অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের তুলনায় উন্নততর স্থাপত্যের সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
তুর্কি-আফগান শাসকদের আমলে ভারতীয়-স্থাপত্যের রূপ বা অবয়ব এবং অলংকরণের ক্ষেত্রে অভিনবত্ব আসে। ভারতীয় শিল্পী-কারিগররা কংক্রিটের ব্যবহার জানতেন না। ভারতীয়দের স্থাপত্য কৌশল ছিল একের পর এক পাথর বসিয়ে দেওয়াল তৈরি করা এবং শীর্ষদেশে বিঘ্ন স্থাপন করে আচ্ছাদিত করা। কংক্রিট বা চুন, বালি ও জলের মিশ্রণে আস্তর (Mortor) তৈরির কৌশল ভারতীয়দের অজানা ছিল। ফলে প্রশস্ত স্থানের ওপর আচ্ছাদন-সমন্বিত মন্দির বা প্রাসাদ তৈরি করার কাজে উৎসাহ দেখানো হত না। তুর্কিদের সাথে সাথে ভারতীয় স্থাপত্যে খিলান ও গম্বুজ-এর ব্যবহার শুরু হয়। হিন্দু বা বৌদ্ধ স্থাপত্যে খিলান বা গম্বুজের অস্তিত্ব ছিল না। সতীশ চন্দ্রের মতে, খিলান বা গম্বুজের ব্যবহার ভারতীয়দের অজানা ছিল না। কিন্তু খিলান তৈরির বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং মর্টার সম্পর্কে ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল বলে হিন্দু বা বৌদ্ধ স্থাপত্যে খিলান বা গম্বুজ ব্যবহার হত না। মুসলমানরা পারস্যে এসে এই বিশিষ্ট স্থাপত্যধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। পারসিক স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল খিলান, তির্যক খিলান, গম্বুজ এবং গম্বুজের নিচে আটকোণবিশিষ্ট গৃহ। গম্বুজগুলি ছিল স্থপতিদের আত্মবিশ্বাস আর মুসলমান শাসকদের দত্তের প্রতীক। চারকোণবিশিষ্ট অট্টালিকার ওপর নির্মিত গম্বুজগুলির উচ্চতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। খিলান আর গম্বুজ ব্যবহারের ফলে বড়ো বড়ো উন্মুক্ত হলঘর নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। সমবেত প্রার্থনা কিংবা আলোচনাসভার পক্ষে এই ধরনের কক্ষ খুবই উপযোগী ছিল। কংক্রিটের অধিকতর ব্যবহারের ফলে পারসিক স্থাপত্যে বেশি জায়গা আচ্ছাদিত করাও সম্ভব হয়েছিল। সুলতানি আমলের স্থাপত্যে খিলান ও গম্বুজের পাশাপাশি প্রস্তরফলক ও বিম পদ্ধতিও ব্যবহার করা হত।
ভারতীয়দের মতো তুর্কিরাও অলংকরণপ্রিয় ছিল। ইসলামধর্মে জীবিত প্রাণীর প্রতিকৃতি অঙ্কন নিষিদ্ধ ছিল। তাই তুর্কিরা গৃহের শোভাবৃদ্ধির জন্য জ্যামিতিক আকৃতি, লতাপাতায় জড়ানো নকশা এবং কোরানের বাণী-সম্বলিত লিপি ব্যবহার করত। এর সাথে তুর্কিরা কিছু সংশোধন-সহ ভারতীয় অলংকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করে, যেমন—স্বস্তিকা, পদ্মফুল, ঘণ্টাকৃতি ইত্যাদি। এইভাবে সুলতানি আমলের স্থাপত্যকর্মের নির্মাণ-পদ্ধতি ও অলংকরণের ক্ষেত্রে এদেশে প্রচলিত হিন্দু ও বৌদ্ধ শিল্পরীতি এবং মুসলমানগণ বাহিত পারসিক শিল্পরীতির অপূর্ব সম্মেলন দেখা যায়। তাই ঐতিহাসিক দেশাই (Z. A. Desai) যথার্থই লিখেছেন: “The Islamic architecture of India is an interesting story of these two seemingly opposite styles mingling with each other with varying degrees in different parts of the country at different periods of time.”
সুলতানি আমলে ‘ইন্দো-ইসলামীয়’ স্থাপত্যের উদ্ভব ও বিকাশে তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল ‘দাস’ ও ‘খলজি’ বংশীয় সুলতানদের আমলে সৃষ্ট লাহোর, দিল্লির ও আজমিরের স্থাপত্যকর্মগুলি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল তুঘলকদের আমলের কাজগুলি, যেগুলি পূর্বেকার কাজের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র এবং উন্নত ছিল। তুঘলকদের পতনের পর দিল্লি-সুলতানি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যের সংহতি বিপন্ন হয়। এই সময়ে শুরু হয় তৃতীয় পর্যায়ের, যখন প্রাদেশিক স্তরে এবং নবনব গঠিত স্বাধীন রাজ্যগুলিতে নতুনভাবে স্থাপত্যকর্ম বিকাশলাভ করে।
পার্সি ব্রাউন (Percy Brown)-এর মতে, হিন্দু-স্থাপত্য ছিল স্তম্ভ-সদল (Trabeate system) রীতির ওপর প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে মুসলিম স্থাপত্য ছিল খিলান-নির্ভর (Arcute system) রীতিতে নির্মিত। মন্দিরের শিখরগুলি কোণাকৃতি দীর্ঘবিশিষ্ট কিংবা পিরামিড আকৃতির উচ্চস্তম্ভ (Tower) দ্বারা সুশোভিত। অন্যদিকে মসজিদের ছাদের ওপর একটি বা একাধিক গম্বুজ ও মিনার নির্মিত হত। মুসলমান যুগে এই দুটি স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে একটি নবতম ধারার উদ্ভব ঘটে। তাই ভারতে এই ধারা ইন্দো ইসলামিক বা ভারতীয় মুসলিম স্থাপত্য নামে আখ্যায়িত হয়। ভারতে এরূপ প্রাণবন্ত স্থাপত্যসৃষ্টির পেছনে পার্সি ব্রাউন দুটি কারণের উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যধারা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য স্থাপত্যধারার চেয়ে পরে বিকশিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় স্থপতি ও কারিগরদের মধ্যে নতুন প্রযুক্তিকে বুঝে নেওয়ার বিশেষ প্রতিভা ও দক্ষতা ছিল। প্রথম কারণ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, কায়রো, বাগদাদ, দামাস্কাস, জেরুজালেম প্রভৃতি নগরে সুদৃশ্য মসজিদ, মাকবারা ইত্যাদি নির্মিত হবার পর ভারতে মুসলিম-স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছিল। ফলে পূর্ব অভিজ্ঞতা এদেশে স্থাপত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। দ্বিতীয় কারণটি সম্ভবত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পার্সি ব্রাউন, সুলতান আহমেদ প্রমুখের মতে, সুলতানি আমলে অনন্য সাধারণ স্থাপত্যসৃষ্টির মুখ্য কারিগর ছিলেন ভারতীয় স্থপতিদের মনীষা, প্রজ্ঞা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।
দিল্লির সুলতানি আমলে স্থাপত্যের ক্রমবিকাশের ধারাকে পার্সি ব্রাউন তিনটি ধাপে বিভক্ত করেছেন। প্রথম ধাপে সীমা ছিল খুব কম। এই সময় আরব ও তুর্কি যোদ্ধারা হিন্দু-স্থাপত্য (মন্দির) অপবিত্রকরণ ও ধ্বংস করার নীতি নেন। ধর্মীয় আবেগ এবং আক্রমণকারীর দত্ত জাহির করার জন্যই এ কাজ করা হত। দ্বিতীয় ধাপে মন্দির বা হিন্দু ইমারতগুলি নির্মমভাবে ভাঙা হত না। ইমারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে মসজিদ বা মাকবারার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হত। বড়ো বড়ো থাম, কড়ি বা বর্গা হাতির সাহায্যে নতুন নির্মাণস্থলে সরিয়ে নেওয়া হত। তৃতীয় ধাপের সূচনা হয় এদেশে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। এই ধাপে পরিকল্পিত নকশা ধরে নতুন নতুন ইমারত, মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণ শুরু হয়।
দিল্লিভিত্তিক স্থাপত্যচর্চা শুরু হয়েছিল দ্বাদশ শতকের শেষদিকে মামেলুক তুর্কি সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের আমলে। লোদীবংশের শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীর শাসনের শেষ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। দিল্লির স্থাপত্য-পদ্ধতি, অলংকরণ বিশেষ আভিজাত্যমণ্ডিত ছিল। সুলতান আহমেদ একে ‘সনাতনী আদর্শ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ধারা প্রাদেশিক ধারা থেকে রূপে-গুণে-অলংকরণে আভিজাত্যে উন্নত ছিল। দিল্লির এই রাজকীয় পদ্ধতি ত্রয়োদশ শতক থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত ছিল। দিল্লির সুলতানি শাসনের ভাঙনের যুগে প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক স্থাপত্যচর্চার পর্ব শুরু হয়। দিল্লির অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রাদেশিক স্বাধীন মুসলিম ও হিন্দু রাজ্যগুলির উদ্যোগে নতুন শিল্পচর্চার সূচনা ঘটে। এইসব স্থাপত্যধারায় শাসকের নিজস্ব অভিরুচি ও আঞ্চলিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। শেষ পর্যায়ে মুঘল শাসকদের নেতৃত্বে এই ইন্দো ইসলামীয় স্থাপত্যশৈলী কাঠামো ও জাঁকজমকের দিক থেকে উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়।
কুতুবউদ্দিন আইবকের উদ্যোগে ভারতে ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্যের সূচনা হয়। প্রথমে তিনি অনুচরদের জন্য উপাসনাগৃহ নির্মাণে হাত দেন এবং সম্পূর্ণ নতুন গৃহনির্মাণের পরিবর্তে পুরোনো মন্দির বা অট্টালিকাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। তাঁর আমলে নির্মিত এরূপ দুটি প্রাচীনতম নিদর্শন হল দিল্লির ‘কুয়াত-উল-ইসলাম’ মসজিদ ও আজমিরের ‘আড়াই-দিনকা-ঝোঁপড়া’ প্রাসাদ। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের অব্যবহিত পরে একটি জৈন মন্দির ভেঙে ‘কুয়াত-উল্ ইসলাম’ মসজিদটি নির্মিত হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহটি ভেঙে তার সম্মুখভাগে তিনটি সুদৃশ্য খিলান তৈরি করা হয়। মন্দিরের পশ্চিমদিকে তৈরি করা হয় উপাসনার স্থানটি। খিলানের সামনে লতা-পাতা-ফুলের সর্পিল অলংকরণ এবং কোরানের বাণী খোদাই করে আকর্ষণ বৃদ্ধি করা হয়। এইভাবে সামান্য পরিবর্তনের ছোঁয়া দিয়ে মন্দিরকে পরিণত করা হয় মসজিদে। পরবর্তী সুলতানদের আমলে একটু একটু করে এই মসজিদের পরিধি বিস্তৃত করা হয়। আজমিরে একটি বৌদ্ধমঠ ও সংস্কৃত পাঠকেন্দ্রকে পরিবর্তিত করে ‘আড়াই-দিনকা-ঝোপড়া’ অট্টালিকা নির্মিত হয়েছিল। মুঘলদের পরাজিত করে মারাঠারা এই অট্টালিকা দখল করে আড়াই দিন বিজয় উৎসব পালন করেছিল। তারপর থেকে এটি ‘আড়াই-দিন-কা ঝোপড়া’ নামে পরিচিত হয়। তবে এই অট্টলিকার নির্মাণে শিল্পীর কল্পনার দৈন্য স্পষ্ট। তাই প্রখ্যাত শিল্প- সমালোচক ড. সরস্বতী লিখেছেন : “It was a perfect example to mathematical precision and technical skill; but in no account it can be regarded an artistic triumph.” কিলা-ই-রায়-পিথুরা বা পৃথ্বীরাজ চৌহানের দুর্গকে কেন্দ্র করে কুতুবউদ্দিন যে প্রাসাদরাজি নির্মাণ করেন, তাকে Gordon Hearson ‘মুসলিম শাসকগণ নির্মিত সাতটি নগরের প্রথম সৃষ্টি’ বলে বর্ণনা করেছেন।
কুতুবউদ্দিন ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে কুতুবমিনার নামক সুউচ্চ ও সুদৃষ্ট স্থাপত্য কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেন। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতগুলি মিনার নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে ‘কুতুবমিনার’ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। ফারগুসনের (Fergussion) মতে, সৌন্দর্যের প্রতীক রূপে এটি মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ববন্দিত হয়ে আছে। একমাত্র কায়রোর হাসান মসজিদের মিনারই কুতুবমিনার থেকে বেশি উঁচু।’ এই মিনারের আদি উচ্চতা ২২৮ ফুট এবং শীর্ষে অবস্থিত চন্দ্রাতপ বা ছত্রীর উচ্চতা কমপক্ষে ১০ ফুট। অর্থাৎ মোট উচ্চতা ২৩৮ ফুট। এটি প্রথমে চারতলায় সমাপ্ত হয়েছিল। প্রতিটি স্তরে বা তলায় ঝুলন্ত বারান্দা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। নীচের দিকে তিনতলা কক্ষও আছে। কিন্তু চতুর্থ তলা পরবর্তীকালে সংস্কার করা হয়। এই সময় একটি নতুন তল এর সাথে যুক্ত করা হয়। প্রথম তলার অধিকাংশ কাজ সুলতান কুতুবউদ্দিনের সময় করা হয়। মিনারের অবশিষ্ট কাজ সম্পূর্ণ করেন সুলতান ইলতুৎমিস। পরে বজ্রপাতে এর ক্ষতি হলে ফিরোজ শাহ তুঘলক এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পুনর্নির্মাণ কাজে যে মালমশলা ও বহিসজ্জায়ন ব্যবহার করা হয়, তা ছিল স্বতন্ত্র। তুঘলক বংশের শাসনকালে এর আবার সংস্কার করা হয়। সময়ের ব্যবধানের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটেছিল। তাই এর নির্মাণে বৈচিত্র্য আছে। তাই দেখা যায়, ফিরোজ তুঘলক যখন ওপর তলার সংস্কার করেন, তখন ওই অংশটুকু সম্পূর্ণ নতুন আকৃতিতে নির্মিত হয়। এতে একটি নতুন তলার সংযোজন ঘটে। চতুর্থ ও পঞ্চম তলা লাল বেলেপাথরে নির্মিত এবং এর পৃষ্ঠদেশ শ্বেতপাথরে ঢেকে দেওয়া। সতীশ চন্দ্র লিখেছেন, “কুতুবমিনার নানা কারণে অদম্য। এমন সুকৌশলে সৌধের অলিন্দগুলি নির্মিত হয়েছে যে, অলিন্দগুলি সৌধ থেকে অভিক্ষিপ্ত হয়েও ছিল সৌধের সাথে যুক্ত। প্যানেলসমূহে ও মিনারের ঊর্ধ্বে লাল ও বেলেপাথর ও মার্বেলের ব্যবহার আর পাঁজরের মতো বক্রাকার আকৃতি কুতুবমিনারকে শিল্প-সার্থকতা দান করেছে।”
কুতুবমিনার নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত আছে। যেমন—(১) মিনারের অভ্যন্তরে অবস্থিত নাগরী লিপিতে উৎকীর্ণ একটি পাথরের অবস্থান থেকে মনে করা হয় যে, এটি একটি হিন্দু স্থাপত্যকর্ম এবং পরে মুসলমানেরা এর বাইরের দেওয়াল নতুনভাবে খোদাই করেছে। অনুমান যে, চৌহান পৃথ্বীরাজ তাঁর কন্যার যমুনা দর্শনের ইচ্ছাপুরণের জন্য একটি মিনার নির্মাণ করেছিলেন। কুতুবমিনারে কিছু কিছু অলংকরণে ও সজ্জায়নে হিন্দু-স্থাপত্যের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন দড়ি ঝুলানো নকশা, প্রস্ফুটিত পদ্মফুল ইত্যাদি। কিন্তু এই কারণে এটিকে হিন্দু প্রতীক ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আছে।
(২) অন্য একটি মতে, বিশিষ্ট সুফিসাধক খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাজি (উচ্-কা-পির) এর স্মৃতিরক্ষার্থে এই মিনারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
(৩) তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কুতুবমিনার আসলে একটি বিজয় তোরণ। ফারগুসনের মতে, এটি গোলাকার দীর্ঘদণ্ড, অক্ষরেখা বা মেরুদণ্ড, ন্যায়বিচার ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কুতুবমিনারের গায়ে তোঘরা ঢঙের উৎকীর্ণ আরবি লিপিমালায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহর ছায়া পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তে প্রসারিত। পশ্চিম প্রান্তে আর এক মুসলিম শাসক প্রথম ইউসুফ স্পেনের সেভিলে অনুরূপ একটি উচ্চাকার স্তম্ভ নির্মাণ করেছেন। কুতুবমিনার সেভিল মিনারকে পরোক্ষে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে মুসলিম রাজ্যবিস্তারের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্বের দরবারে ইসলামের প্রতিপত্তি, গর্ব ও মর্যাদা ঘোষণা করার জন্য এরূপ সুউচ্চ মিনার নির্মাণের আরও দৃষ্টান্ত আছে, যা এই মতকে সমর্থন করে।
(৪) পার্সি ব্রাউন-এর মতে, এই বিজয়স্তম্ভটি মসজিদের মিনার হিসেবে সম্পূরক দায়িত্ব পালন করত। মসজিদের সন্নিকটে উচ্চ মিনার থেকে মুসল্লিদের নামাজে শরিক হওয়ার জন্য আহ্বান জানানোর রেওয়াজ ইসলামের বিকাশের গোড়া থেকেই দেখা যায়। সামার (ইরাক), ইব্নেতুলুন (কায়রো) রাক্কা (সিরিয়া) প্রভৃতি মসজিদের পাশে এমন মিনার দৃষ্ট হয়। তাই ‘কুয়াত-উল্-ইসলাম’ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নির্মিত কুতুবমিনারও এই উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। শেষ দুটি অভিমতই অধিক গ্রহণযোগ্য। যাইহোক, কুতুবমিনারের পরিকল্পনা কুতুবউদ্দিন আইবকের সৃজনশীল প্রতিভার অনবদ্য দৃষ্টান্ত, যা ভারতীয় স্থপতিদের মেধা ও মননশীলতার গুণে আজও বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে স্বীকৃত হয়।
পারসিক শিল্পধারার এক অসামান্য নিদর্শন হল ‘কুয়াতুল’ মসজিদের পাশে ইলতুৎমিসের নির্মিত ‘সমাধিসৌধ”। এতে তীর্যক খিলানের সার্থক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ধূসরবর্ণের গ্রানাইটের বহিরঙ্গের ওপর লাল বেলেপাথর ব্যবহার করে এই এককক্ষযুক্ত সৌধটিকে রঙিন ও প্রাণবন্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সমাধির ছোটো ছোটো দেওয়ালগুলিতে এত সূক্ষ্ম কারুকার্য করা হয়েছিল যে, এক বর্গ ইঞ্চি জায়গাও খালি ছিল না। ইলতুৎমিসের আমলে নির্মিত অন্য কয়েকটি স্থাপত্যকর্ম হল ‘হাউজ-ই-সামসী; ‘সামসী-ইদ্গাহ’, ‘জান-ই-মসজিদ’ ইত্যাদি। রায় পিথুরার দক্ষিণ-পূর্বে নির্মিত সমকোণী ও গম্বুজবিশিষ্ট বলবনের সমাধি-সৌধটি ইন্দো-ইসলামীয় শিল্পধারার আর একটি ক্ষয়িষ্ণু নিদর্শন।
আলাউদ্দিন খলজি রাজ্যবিজয়ের পাশাপাশি স্থাপত্যসৃষ্টির কাজেও যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। কুতুবমিনারকে সম্প্রসারণ করার এক বৃহৎ পরিকল্পনা তাঁর ছিল। অবশ্য সে কাজ তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তবে তিনি রাজকীয় চৌহদ্দির প্রবেশদ্বার স্বরূপ সুউচ্চ তোরণ ‘আলাইদরওয়াজা নির্মাণ করেন, যা ‘Treasure Gem of Islamic architecture’ হিসেবে শিল্পরসিকগণ কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। এই প্রবেশদ্বারের মাথায় একটি সুন্দর গম্বুজ আছে। এর খিলানগুলিও খুব সুন্দর। এই স্থাপত্য কাজটিতে কারিগরদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ‘আলাইদরওয়াজা’ নির্মাণে কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। দেশীয় ও বহিরাগত উভয় উপাদানের সমন্বয়ে এটি নির্মিত হয়। ইমারতের মূল কাঠামো ভারতীয় আঙ্গিকে নির্মিত। তবে কোনো কোনো কিনারার আকার এবং নকশায় বহির্ভারতীয় প্রভাব বর্তমান। বস্তুত ‘আলাইদরওয়াজা’আলাউদ্দিন পরিকল্পিত ‘জামি’ মসজিদের চারটি দরজার অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণে অন্য প্রবেশদ্বার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কেবল দক্ষিণেরটি সমাপ্ত হয়েছিল। তাই ‘আলাইদরওয়াজা’কে একটি নিঃসঙ্গ স্থাপত্য-কাঠামো বলা যায়। পার্সি ব্রাউনের মতে, সুলতান মসজিদের দক্ষিণের প্রাসাদে অবস্থান করতেন। এই পথ ধরে মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য অতি দ্রুততার সাথে এই দরওয়াজা নির্মাণ করেন। এই ইমারত একটি বর্গাকৃতি স্থাপত্য-কাঠামো, যার প্রতি পার্শ্ব ৫৫ ফুট এবং গম্বুজসহ উচ্চতা ৬০ ফুট। প্রত্যেক পার্শ্বের মাঝে দরজা এবং পার্শ্বদেশে পাথরের জালিকাট জানালা বর্তমান। এখানে ব্যবহৃত খিলান ‘সূক্ষ্মাগ্র অশ্বক্ষুরাকৃতি খিলান’ (pointed horseshoe arch) নামে পরিচিত। এই শৈলীর ব্যবহার খলজি পরবর্তী স্থাপত্যে দেখা যায় না। এই খিলানে মসৃণ সমতল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। ড. সুলতান আহমেদ লিখেছেন, “আলাইদরওয়াজায় ব্যবহৃত খিলানের আকারত্ব, এর সজ্জায়ন, অলংকরণ ও চিত্রাঙ্কন প্রণালী জোরালোভাবে এর সৌন্দর্যের প্রতিরূপকে আকারত্বে ও বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হতে সাহায্য করেছে।” আলাউদ্দিন কুতুবমিনারের কয়েক কিলোমিটার দূরে ‘সিরি’তে নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। এখানে তিনি হাজার স্তম্ভবিশিষ্ট (Mahal Hazar Satun) একটি মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করেন। পাশে ৭০ একর জায়গা জুড়ে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী খনন করে সুদৃশ্য প্রাচীর দ্বারা তাকে বেষ্টিত করেন। এটি ‘হাউজ-ই-খাস’ বা ‘হাউজ-ই-ইলাহি’ নামে খ্যাত। এইসব স্থাপত্যকর্মের সামান্য ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে মাত্র। সন্ত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগার কাছে ‘জামাতখানা’ মসজিদটিও আলাউদ্দিনের আমলে নির্মিত হয়। মার্শালের মতে, এটিই ছিল সম্পূর্ণভাবে ইসলামীয় আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারতে নির্মিত প্রথম মসজিদ। এই মসজিদের নির্মাণ কাজ আলাউদ্দিনের পুত্র খিজির খাঁ’র সময়ে সম্পূর্ণ হয়। প্রথমে এটিকে শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার রূপে নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন এর কেন্দ্রীয় কক্ষটিই শুধু ছিল। তুঘলকদের সময় একে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয় এবং পার্শ্ববর্তী কক্ষদুটি যুক্ত করা হয়। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে এর আরও পরিবর্তন ঘটানো হয়।
তুঘলকবংশের শাসনকালে দিল্লি-সুলতানি যেমন উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে, তেমনি এই সময়েই সুলতানির পতন সূচিত হয়। তুঘলকদের আমলে সুলতানি-স্থাপত্য লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। রেখার বাহুল্য বর্জিত হয়। অলংকরণ কমিয়ে দেওয়া হয়। বহিরঙ্গের সৌন্দর্য-সুষমার পরিবর্তে প্রাসাদ বা মসজিদগুলিকে অধিকতর ব্যবহারযোগ্য করার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়। অধ্যাপক শ্রীবাস্তবের মতে, এই পরিবর্তন দুটি কারণে ঘটেছিল। যথা—–(১) তুঘলক শাসকরা ছিলেন গোঁড়া সুন্নি মুসলিম। তাই ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী স্থাপত্যসৃষ্টিতে আগ্রহী ছিলেন এবং (২) তুঘলকদের রাজকোষ পূর্বের মতো সচ্ছল ছিল না, যাতে স্থাপত্যে বেশি অর্থব্যয় করা সম্ভব। স্যার জন মার্শাল আর একটি নতুন কারণ যোগ করেছেন। তাঁর মতে, তুঘলকদের আমলে উন্নত দক্ষ কারিগর ও শিল্পীর অভাব ছিল। ড. সরস্বতী খলজি আমলের সুদৃশ্য স্থাপত্যকর্মের সাথে তুঘলক-আমলের সুদৃঢ় ও বস্তুমুখী স্থাপত্যের তুলনা করে লিখেছেন, “In marked contrast to the rich and elaborate ornamental style of the Khalji buildings, those of the Tughluqs are characterized by a stark simplicity of design bordering almost on puritanical severity.” ড. সরস্বতী মনে করেন, তুঘলক যুগের স্থাপত্যে শক্তি ও কাঠিন্যের প্রকাশ ছিল, কল্পনার বিলাস সেখানে ছিল না।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ছিলেন মূলত একজন সমর নেতা। তাঁর স্থাপত্যকর্মের মধ্যেও এই মানসিকতার প্রকাশ দেখা যায়। তিনি দিল্লিতে তৃতীয় নগরী ‘তুঘলকাবাদ’ নির্মাণ করেন। আজ তার জীর্ণ ধ্বংসাবশেষটুকু বর্তমান। ইবন বতুতা এর সৌন্দর্য প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, এখানে রাজ্যের অগণিত সম্পদ সঞ্চিত হত। বিরাট স্বর্ণপ্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। যখন সূর্যের আলোক পড়ত, তখন প্রাসাদটি ঝলমল করে উঠত। তুঘলকাবাদ নগর একাধিক অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এটি ছিল নগর, দুর্গ ও রাজপ্রসাদের এক যৌগিক নির্মাণ। মোঙ্গল আক্রমণের কারণে আবাসিক এলাকার পাশেই সামরিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। পার্সি ব্রাউনের মতে, তুঘলকাবাদ নগরটি রোমান ঢং-এ নির্মিত ছিল। অবশ্য এর সাথে আরবদের ‘শিবির-নগর’ (camp-city)-এর একটা সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। এর চতুর্দিকের পরিসীমা ছিল ৬.৪৪ কিলোমিটার। দুর্গের প্রবেশদ্বারে উপদুর্গের মতো বহির্দেওয়াল সংলগ্ন প্রহরীদের চৌকি এবং প্রতি কোণে স্থূলাকার বুরুজ ছিল। বুরুজগুলি বৃত্তাকার এবং প্রায় দু-তলার সমান উঁচু করে নির্মিত। দুর্গ ও রাজপ্রাসাদ অংশ বেড়া দিয়ে আলাদা করা ছিল। রাজপ্রাসাদের জানালা মহলের নীচে দীর্ঘ করিডোর ও ঘর ছিল, যার দরজা বহির্মুখী। যমুনানদীর তীরে এক উপত্যকার শীর্ষে নির্মিত এই নগরীর সুবৃহৎ প্রাসাদ ও একাধিক অট্টালিকার ধ্বংসস্তূপ আজ কেবল অতীত সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে। ইবন বতুতা লিখেছেনঃ “হয়তো একান্ত মনে খুঁজলে আজও সেদিনের সুপ্রশস্ত রাজপথ নজরে পড়বে ; নজরে পড়বে সেই রাজকীয় প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ, যার শরীরজুড়ে ছিল সোনালী গিলটি করা টালি ও ইট, যার ওপর সূর্যালোক পতিত হলে বিচ্ছুরিত আভার দিকে তাকিয়ে থাকা একদা অসম্ভব হত।” গিয়াসউদ্দিনের স্বনির্মিত সমাধি-সৌধটিও অনবদ্য স্থাপত্যের নিদর্শন। সুউচ্চ বেদীর ওপর পঞ্চভুজ এই সৌধের গম্বুজটি মার্বেল পাথরের নির্মিত হওয়ার পর সৌন্দর্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে এটি অবস্থিত। ২৫০ গজ দীর্ঘ সরু বাঁধানো রাস্তা দ্বারা এটিকে মূল দুর্গ শহর তুঘলকাবাদের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে এটিও স্বতন্ত্র দুর্গের আকার নিয়েছে। তবে এর প্রবশেদ্বার স্বাভাবিক সৌষ্ঠবময় হলেও, এটি এমন কৌশলে নির্মিত যে, কেউ জোরপূর্বক প্রবেশ করতে চাইলে এটি তার মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারত। সমাধি সৌধের অধিকাংশ স্থান লাল বেলে পাথরে নির্মিত। গম্বুজ অংশ এবং নক্শা দ্বারা অলংকৃত করার স্থানগুলি শ্বেতমর্মর দ্বারা নির্মিত। এই নির্মাণের বিশেষত্ব হল বহির্দেওয়ালের ঢালুতা। এটি ৭৫ ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করে পিরামিড অনুরূপ ঢালু হয়েছে। এর মূল ভিত্তিটি প্রতি পার্শ্বে ৬১ ফুট এবং গম্বুজ চূড়াসমতে এর উচ্চতা ৮০ ফুট। এই সমাধি-সৌধ দুটি পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটেছে—বর্গা (lintel) বা চৌকাঠ হিন্দু রীতি এবং খিলান (arch)-নির্ভর মুসলিম রীতি। সম্ভবত খিলান পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে হিন্দু কারিগরদের সংশয় এবং ঐতিহ্যের গভীর আস্থা তাদের খিলানের সাথেই বর্গাব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটাতে প্ররোচিত করেছিল। পার্সি ব্রাউন এটিকে নিয়মবিরুদ্ধ স্থাপত্যকর্ম বলে উল্লেখ করেছেন।
মুলতানের প্রাদেশিক শাসনকর্তা থাকাকালে গিয়াসউদ্দিন সেখানে একটি আগাম সমাধি-সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি দিল্লির সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হলে এটির প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পির শাহ রুকন-ই-আলমের স্মৃতি সৌধ হিসেবে এটি ব্যবহার করেন। পিরের প্রতি এমন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত মধ্যযুগের ইতিহাসে বিরল। ভারতীয় উপমহাদেশে নির্মিত অষ্টভুজ সমাধি-সৌধগুলির মধ্যে এটি সুন্দরতম। ইট ও কাঠে নির্মিত এই সৌধের উচ্চতা ৫০ ফুট। প্রতি কোণে ছোটো ছোটো মিনার ও দেওয়ালে পাঞ্জাবে তৈরি উজ্জ্বল টালি ব্যবহৃত হয়েছে। শাহরুকন-ই-আলম মাকবারার প্রশংসা করে জন মার্শাল লিখেছেন, “The tomb of Rukan-i-Alam is one of the splendid memorials even erected in honour of the dead.”1 মহম্মদ-বিন-তুঘলক ‘আড়াই-দিন-কা ঝোঁপড়া’এবং ‘সিরি’নগরের মাঝে দিল্লির চতুর্থ নগরী ‘জাহানপনাহ’ নির্মাণ করেন এবং সুদৃঢ় দেওয়াল দ্বারা প্রথম ও দ্বিতীয় নগরীকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। দৌলতবাদে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠার সূত্রে মহম্মদ তুঘলক নিশ্চয়ই সেখানে বহু প্রাসাদ ও উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন। তবে দ্রুত নির্মাণের জন্য এবং উপযুক্ত মালমশলা ব্যবহার না করার ফলে সেগুলির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। মহম্মদ তুঘলক নির্মিত নগর প্রাসাদের কিছু দূরে আর একটি স্থাপত্যকর্মের সন্ধান পাওয়া যায়, যা ‘বিজয়মণ্ডল’ নামে পরিচিত। এর ছাদ সমতল টাওয়ার-সদৃশ। পি. ব্রাউন এটিকে ‘হাজার স্তম্ভ’ প্রাসাদ বলেছেন। জন মার্শালের মতে, মহম্মদ তুঘলকাবাদ নগরের সম্প্রসারণ করে ‘আদিলাবাদ’ দুর্গটি নির্মাণ করেন (Adilabad which was merely and outwork of the large city of Tughluqabad and almost identical with it in style.) I
ফিরোজ তুঘলক ছিলেন সু-নির্মাতা। তাঁর উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য নগর প্রাসাদ, মসজিদ, সরাইখানা, জলাশয়, পুল, ক্যানেল ইত্যাদি। তিনি দিল্লির ‘পঞ্চম নগরী’ ফিরোজাবাদ নির্মাণ করেন সিরি’র উত্তরদিকে। এ ছাড়া ফতেহাবাদ, হিসার-ফিরোজ এবং জৌনপুর শহরও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রখ্যাত প্রাসাদ-দুর্গ ও কোটাল-ফিরোজ শাহ তাঁর আর একগুচ্ছ স্থাপত্যকর্মের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
তুঘলক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হল ঢালু দেওয়াল। এর ফলে তৎকালীন অট্টালিকাগুলি প্রায় দুর্গের মতো শক্ত ও মজবুত হয়েছিল। অলংকরণের ক্ষেত্রে তুঘলকদের নতুনত্ব হল খিলানের সাথে চৌকাঠের সমন্বয়। অর্থাৎ এই সময়ের খিলানগুলি ছিল তীক্ষ্ণ এবং খিলানগুলির তলায় আড়াআড়ি ছিল একটি করে চৌকাঠ, যদিও সেগুলির ব্যবহারিক উপযোগিতা ছিল না।
ফিরোজ তুঘলকের আমলেই সুলতানি স্থাপত্যের অবক্ষয়ী রূপ প্রকাশ পাচ্ছিল। এই স্থাপত্যের অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে অনেকগুলি বিষয় নির্দিষ্ট করা যায়। যেমন—(১) দক্ষ প্রস্তর কারিগরের অভাব, (২) অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলী জনশক্তির অভাব, (৩) মহম্মদ-বিন-তুঘলকের অস্থির নীতির ফলে সৃষ্টির কাজে নিরুৎসাহ ইত্যাদি।
১৩৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে আমির তৈমুর লঙ-এর আক্রমণ সাধারণভাবে উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং নির্দিষ্টভাবে দিল্লি-সুলতানির স্থাপত্যকর্মের ওপর বিরাট আঘাত হিসেবে উপস্থিত হয়। মূর্তিমান অভিশাপ তৈমুর ও তাঁর বাহিনীর দাপটে দিল্লির অধিকাংশ শহর শ্মশানে পরিণত হয়। মানুষের তৈরি স্বর্গীয় শোভাযুক্ত অসংখ্য অট্টালিকা মাটির সাথে মিশে যায়। সৈয়দ বা লোদীবংশীয় সুলতানরা ইচ্ছা থাকলেও সময় ও শক্তির অভাবহেতু স্থাপত্যশিল্পের সেই গৌরবময় অধ্যায়ের পুনঃস্থাপন করতে ব্যর্থ হন। অবশ্য সীমিত রাজনৈতিক ও আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যেও তাঁরা স্থাপত্যের স্বর্ণযুগকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিলেন।
অধ্যাপক সুলতান আহমেদ-এর মতে, এ সময়ে যে সামান্যতম স্থাপত্যকর্ম গড়ে উঠেছিল, তা প্রশমিত মননের প্রাণচাঞ্চল্যহীন অবদানরূপে প্রতিভাসিত হয়েছে। তেমনি কোনো বৃহদাকার বা দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য সৃষ্টি করা হয়নি। সৈয়দ ও লোদীদের স্থাপত্যচেতনায় যুগসন্ধিক্ষণের আভাস স্পষ্ট। ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে শাসক ও প্রজাদের মানসিক প্রবণতা ছিল মৃতের কবরের ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতি অধিক প্রবণতা। সৈয়দ বংশ (১৪১৪-‘৫১ খ্রিঃ) ও লোদী বংশের (১৪৫১-১৫২৬ খ্রিঃ) আমলে কবরের ওপর সৌধ নির্মাণের আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এই সমাধি সৌধগুলির অবয়ব ও স্থাপত্যশৈলী একরকম ছিল না। কোনোটি সাধারণ উন্মুক্ত স্তম্ভায়িত সুদৃশ্য চন্দ্রাতপ আচ্ছাদিত, আবার কোনোটি সু-অলংকৃত আবেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা আবৃত এবং সুউচ্চ তোরণ দ্বারা সংযুক্ত। অষ্টভুজবিশিষ্ট এবং বর্গাকৃতি উভয় প্রকার সৌধ এই পর্বে নির্মিত হয়। তিনটি রাজকীয় অষ্টভুজ সমাধি সৌধের মধ্যে দুটি সৈয়দবংশ এবং একটি লোদীবংশের কীর্তি। মোবারক সৈয়দ-এর সমাধি একটি বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ স্থাপত্য কাঠামো। মহম্মদ সৈয়দ-এর সমাধির ক্ষেত্রেও অনুরূপ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। কিন্তু সিকন্দার লোদীর ‘মাকবারা’ একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম। প্রতিষ্ঠিত অষ্টভুজ বাহুর মুখে তিনটি খিলানবিশিষ্ট দরজা আছে। এর মধ্যে মাঝের দরজাটি অপেক্ষাকৃত বড়ো।
সৈয়দ ও লোদী আমলে নির্মিত অন্যান্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধি-সৌধ হল—(১) বড়ো খান কা-গম্বুজ, (২) ছোটো খান-কা-গম্বুজ, (৩) বড়ো গম্বুজ (১৪৯৮ খ্রিঃ), (৪) শীষ গম্বুজ, (৫) দাদী কা-গম্বুজ, (৬) শিহাবউদ্দিন তাজ খান-কা-গম্বুজ ইত্যাদি। এই পর্বে সরকারিভাবে শাসকদের উদ্যোগ ও অর্থসাহায্যে কোনো জামি মসজিদ নির্মিত হয়নি। অবশ্য বেসরকারি উদ্যোগে সমাধি সৌধের পাশে পাশে কয়েকটি জামি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এ ধরনের একটি নির্মাণ হল ‘মট-কা-মসজিদ’। সিকন্দার লোদীর প্রধানমন্ত্রী ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। এর কয়ক বছর আগে নির্মিত হয় বড়ো গম্বুজ মসজিদ’ (১৪৯৪ খ্রিঃ)। সম্ভবত মাখদুমা -ই-জাহান নামক জনৈক মহিলা এটি নির্মাণ করেছিলেন। পূর্বযুগে ব্যবহৃত স্থাপত্যশৈলীর কিছু বৈশিষ্ট্য এর নির্মাণে প্রকাশ পেয়েছে। এখানে বিকাশমান পর্যায়কে পার্সি ব্রাউন ‘যুক্তিসম্মত শিল্পসত্তার বিকাশ’ (logical development) বলেছেন। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে সিকন্দার লোদীর প্রধানমন্ত্রী ‘মট-কা-মসজিদ’ নির্মাণ করেন। তবে মি. স্টিফেন ও ব্রাউনের মতে, এর নির্মাণকাল যথাক্রমে ১৪৮৮ ও ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে। স্যার জন মার্শালের মতে, “মট-কা মসজিদটি ছিল শেষ পর্বের সর্বোৎকৃষ্ট স্থাপত্যসৃষ্টি।” লোদীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই স্থাপত্যে শিল্পীদের কল্পনার স্বাধীনতা, নকশার বৈচিত্র্য, আলোছায়ার অপূর্ব সমন্বয় এবং রেখা ও রং-এর অপূর্ব সাযুজ্য লক্ষণীয়। এই মসজিদের সৌন্দর্য ও অভিব্যক্তির প্রশংসা করে তিনি লিখেছেন : “The mosque epitomises in itselft all that is best in the architecture of the Lodies; and displays a freedom of imagination, a bold diversity of design, on appreciation of constracting light and a sense of harmony in line and colour which combine to make it one of the most spirited and picturresque buildings of its kind in the whole range of Islamic art. “
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।