আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘সোহিনী মানুষটা কীরকম, তার মনের জোর, তার লয়ালটি, এই হল আসলে বড়ো কথা—তার দেহের কাহিনি তার কাছে তুচ্ছ। রবীন্দ্রনাথের এই উত্তর পরিপ্রেক্ষিতে সোহিনী চরিত্রটি বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
গল্পের নাম ল্যাবরেটরি হলেও গল্পের প্রেক্ষাপটে আমরা ল্যাবরেটরির কার্যকলাপ বা পরীক্ষা নিরীক্ষাকে তেমনভাবে পাইনা। বরং সমগ্র গল্পের আদ্য-পান্ত জুড়ে সোহিনী নাম্নী এক নারী চরিত্রে কার্যকলাপকেই ফুট উঠতে দেখি। সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে এই সোহিনীর মতো নারী চরিত্রের আর দেখা মেলে না। বলা যেতে পারে সোহিনী রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য নারী চরিত্র। প্রসঙ্গত শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তটি বলা যেতে পারে—‘আধুনিক কালে ব্যক্তিত্ব কত নতুন নতুন ধারালো হইয়া উঠিতেছে, ও পূর্বতন মৌলিক সংস্কার ও নীতিবোধকে হেলায় অতিক্রম করিতেছে, এই গল্পে তাহারই সন্ধান মেলে। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে আধুনিক ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতর রূপটি মূলত বিকশিত হয়েছে সোহিনীকে কেন্দ্র করে।
সোহিনীর মধ্যে নারী ব্যক্তিত্বের এক অভিনব ও আশ্চর্য রূপ প্রকাশিত হয়েছে সোহিনী চরিত্রের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ আজীবন নারীর দুইরূপের কথা উল্লেখ করেছেন—প্রেয়সী ও ও জননী। কিন্তু সোহিনী এই দুই রূপের কোনটাকেই প্রাধান্য দেয় নি। সে যে আদর্শ প্রেমিকা বা প্রেয়সী নয় সমগ্র গল্পে তার অজস্র প্রমাণ মেলে। নন্দকিশোরকে স্বামী হিসাবে জীবন সঙ্গী করেছে প্রেমের আবেগে নয়, এর আগেও সে অনেক পুরুষের সঙ্গিনী হিসেবে জীবন কাটিয়েছে। এমনকি নন্দকিশোর মারা যাবার পরেও পুরুষসঙ্গ বর্জিত জীবন কাটায় নি। আর এর জন্য তার কোথাও কোনও অনুশোচনা নেই, নেই সংকোচ। বরং সে উল্টে বলেছে—“মন যে লোভী, মাংস মজ্জায় নীচে লোভের চাপা আগুন লুকিয়ে রেখে দেয়ে, খোঁচা পেলে জ্বলে ওঠে। আমার সত্যি কথা বলতে বাধে না।”
প্রেয়সী তো নয়ই এমনকি মাতৃত্বের কোনও বোধও তার মধ্যে ফুটে উঠতে দেখিনা। তার একটা কন্যা সন্তান আছে, নাম নীলা। কিন্তু তার পিতা নন্দকিশোর নয়, যে সে কার সন্তান, পাঠক তার হদিস পায়না। শুধু তাই নয় সন্তানের জন্য কোন বাৎসল্য রসের প্রকাশ ঘটতেও দেখা যায় না। এমনকি সে প্রয়োজনে নিজের কন্যার প্রতি ছুরি উত্তোলন করতেও কোন দ্বিধা বোধ করেনা। জননী বা প্রেয়সী কোন ধর্মের আধারে প্রকাশিত না হয়েও সোহিনী আশ্চর্যভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে কেবল তার ব্যক্তিত্বের আলোকে। তবে এ ব্যক্তিত্বের মূলে রয়েছে নীরাত্ব। এ প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশীর উক্তিটি দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন—“রবীন্দ্রনাসাহিত্যে ব্যক্তিত্বশালিনী নারীর অভাব নেই। কিন্তু সর্বত্রই ব্যক্তিত্বের ওপর প্রেয়সী বা জননীর আরোপ হইয়াছে। কিন্তু সোহিনী অন্ধসংস্কারে মুক্ত—“ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ নারীত্ব যেমন সমুজ্জ্বল ভাবে প্রকাট এমন আর কোথাও হয় নাই।” সোহিনীর এই ব্যক্তিত্বের প্রকাশ দেখেও নন্দকিশোরের মনে হয়েছিল—’মেয়েটির ভিতর থেকে ঝকঝক করছে ক্যারেকটারের তেজ, বোঝা গেল ও নিজের দামও নিজে জানে।’
সোহিনী এই ব্যক্তিত্বের জোরেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং পাঠক তথা শ্রোতাদের চমকে দিয়েছে। সমস্ত রকম প্রতিকূলতায় সে ভেঙে না পড়ে লড়াই করার সাহস রাখে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘সব পেয়েছির দেশে’ বলেছেন সোহিনী—’যে একদিকে বাস্তবিক খারাপ মেয়ে, কিন্তু অন্যদিকে মহৎ জীবন ব্রতে সে উৎসর্গীত। সমালোচক কথিত এই ‘খারাপ মেয়ে’র ধারণা এসেছে সমাজের নৈতিক দৃষ্টি থেকে। কিন্তু সোহিনী সমাজের অনুগতা হন। সুতরাং সামাজিক দৃষ্টিতে তার মূল্যায়ন করা যায় না। আসলে সোহিনীর মতে সমাজের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য সমাজ। আর তাই সে মন্মথ রায়কে চুম্বন করতেও দ্বিধা বোধ করেনি তা সে একজন হিন্দু বিধবা রমণী হয়েও। আর মন্মথ রায় এঘটনার পর যখন বলে—ঐরে সর্বনাশ শুরু হল দেখছি। তখন সোহিনী নিরুত্তাপভাবে উত্তর দিয়েছে——সে ভয় যদি একটু থাকত তাহলে কাছে এণ্ডতাম না। এর মধ্যে দিয়ে যেমন প্রকাশ পায় তার সংস্কার মুক্ত মনের পরিচয় তেমনি ফুটে ওঠে সচেতন ব্যক্তিত্ব। আসলে সে পাঁক ঘাঁটিলেও পঙ্কিল নয়—পঙ্কজ।
ব্যক্তিত্বের এই দৃঢ়তার জন্যই সে একা একজন বিধবা রমণী হয়েও সকল লোভী পুরুষের হাত থেকে ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করার মতো দুঃসাহসিক কাজে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তবে একথা মনে করলে চলবে না যে সে পতি নিষ্ঠ বলে পতির আদর্শকে রক্ষা করার জন্য একাজে ব্রতী হয়েছে। বরং এই ল্যাবরেটরি রক্ষার মধ্য দিয়েই তার অভিনব নারী ধর্মকে পালন করতে দেখি আমরা। যা প্রচলিত সতীত্ব বোধের সঙ্গে কোনভাবে জড়িত নয়। এই ব্যক্তিত্ববোধের মূল কারণ যেমন পতি অনুগত পত্নীত্ব নয়, তেমনি সন্তান স্নেহগত মাতৃত্বও নয়। কেবল নারীত্বই এর মূলে রয়েছে।
তবে এই ল্যাবরেটরি রক্ষার জন্য যেমন কৌশলের পরিচয় সে দিয়েছে, তেমনি সাহস ও সংস্কারমুক্ত মনের দিকটিও অস্বীকার করা যায় না। সাহসের দিকটি লক্ষিত হয় যখন সোহিনী আইমাকে দেখার জন্য আম্বালায় যায়, তখন যাওয়ার আগে মেয়েকে উন্মুক্ত ছুরি দেখিয়ে বলে যায়—‘ফিরে এসে যদি হিসাব নেবার হয় তো হিসাব নেব। আম্বালা থেকে ফিরে এসে সে হিসাব নিয়েছে এবং তার হিসাবের খাতা থেকে সে তার একমাত্র সন্তান নীলাকে বাদ দিয়েছে। পিতার একমাত্র সন্তান হিসাবে সম্পত্তির অধিকার দাবী করলে সোহিনী তাকে এক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে—’কে তোর বাপ….একথা মুখে আনতে তোর লজ্জা হয়। আসলে লজ্জা সোহিনীরই হওয়ার কথা। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ববোধের কাছে লজ্জা, সংকোচ, ভয়-এ কোন অস্তিত্ব নেই।
এহেন সোহিনী চরিত্রকে নিয়ে এক সময় নানা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে লেখক এ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই শ্রী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে বলেছিলেন—‘সোহিনীর মতো একটা মেয়ের সম্বন্ধে এমন করে লিখেছে—এটা লেখা ওর উচিত হয়নি। আবার রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“আমি ইচ্ছা করেই তো করেছি। সোহিনী মানুষটা কিরকম, তার মনের জোর, তার লয়ালটি, এই হল আসলে বড়ো কথা। তার দেহের কাহিনি তার কাছে তুচ্ছ, নীলা সহজেই সমাজে চলে যাবে, কিন্তু সোহিনীকে বাধবে। অথচ মা আর মেয়ের মধ্যে কথা তফাৎ সেইটিই তো বেশি করে দেখিয়েছি।”
আসলে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রের আঁতের কথা বের করে উপস্থানের প্রয়াসী ছিলেন। সেই কারণে ‘চোখের বালি’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’ প্রভৃতি উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে এই অন্তর বাস্তবতাকে আমরা ক্রমশ ফুটে উঠতে দেখেছি। সোহিনী চরিত্র সেই রকমই একটি অন্তর বাস্তবতাময় চরিত্র—এখানে লেখকের জীবনের তত্ত্ব, দর্শন, আদর্শ সব কিছুকে উপেক্ষা করে চরিত্র স্রষ্টার গৌরবই ফুটে উঠেছে। সোহিনী ভালো মন্দ মেশান আধুনিক কালের নারী, যার কাছে সমাজ বড়ো কথা নয়, আপন ব্রতই বড়ো। তাই সোহিনীর সতীত্ব তার দেহের নয়, কথার এবং কাজে তথা মনুষ্যত্বে। আর এখানেই তার অসাধারণত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।