আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “হরপ্পা সভ্যতার কয়েকটি প্রধান কেন্দ্র” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
হরপ্পা সভ্যতার কয়েকটি প্রধান কেন্দ্র
হরপ্পা সভ্যতার অস্তিত্ব একাধিক কেন্দ্রে উৎখনন থেকে জানা সম্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে দু’টি মূল কেন্দ্র হল মহেঞ্জোদড়ো এবং হরপ্পা। দ্বিতীয় স্তরের কেন্দ্র হিসেবে কালিবনগান, লোথাল ও ধোলাবিরা’র নাম উল্লেখযোগ্য। এই প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রগুলির রূপ কেমন ছিল বা এখানকার বাড়ি-ঘর, পথঘাট, জীবনধারা সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ অসীম। কিন্তু এই সভ্যতার কোন লিখিত বিবরণ নেই। সামান্য কিছু লিপি পাওয়া গেছে যেগুলি তামার ফলক, ঝিনুকের বালা সীলমোহর ইত্যাদির ওপর খোদিত। কিন্তু এদের পাঠোদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া লিপির দৈর্ঘ্য এত কম যে, এখান থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের নির্ভর করতে হয় মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাক্ষ্যের ওপর। সমস্যা হল যে দীর্ঘকাল মাটি চাপা অবস্থায় থাকার ফলে এগুলির অধিকাংশই ভঙ্গুর বা বিকৃত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যাই হোক, প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা এবং রেডিও কার্বন (Carbon-14) জাতীয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রয়াস জারী হয়েছে।
মহেঞ্জোদড়োতে জলস্তর উপরের দিকে। তাই একেবারে নিচের স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। গভীর নলকূপ খননের সময় পাইপের মধ্যেকার কাদা-মাটিতে বসতির কিছু ভগ্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে নিচের স্তরে বসতির অস্তিত্ব ছিল নাকি ওপরের বসতির ব্যবহার্য বাতিল জিনিস নিচে জমা হয়েছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত বলা কঠিন। হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কৃত অঞ্চলগুলির মধ্যে মহেঞ্জোদড়ো সর্বাধিক সুবিস্তৃত এবং এখানে প্রায় তিনশো ভবনের অবশেষ এবং প্রায় সত্তরটি কূপের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মহেঞ্জোদড়ো শহরের দু’টি অংশ—দূর্গ (সিটাডেল) এর এলাকা প্রায় ৮ হেক্টর এবং বসতি এলাকা, যার বিস্তৃতি ১১৫ হেক্টর বা তার বেশি এলাকাজুড়ে। এই দুয়ের মাঝে আছে প্রায় ১৫০ হেক্টর জায়গা। এই এলাকাটি জলসম্পদ বা বনজ সম্পদে ভরা থাকত। লক্ষণীয় যে, মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা ‘যমজ শহর’ বলে বিবেচিত হলেও হরপ্পাতে দূর্গ ও বসতি এলাকার মধ্যে এতটা দূরত্ব ছিল না। দূর্গ এলাকাটি কৃত্রিমভাবে তৈরী উঁচু ভিতের ওপর গড়ে উঠেছে। নিচের জমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১২ মিটার। গোটা দূর্গ এলাকাটি বেষ্টন করে ছিল পোড়া ইটের তৈরী দেয়াল। পশ্চিমের দূর্গ এলাকার সাথে পূর্বের বসতি এলাকার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত প্রভেদ স্পষ্ট। পশ্চিমের দূর্গ এলাকা আয়তনে ছোট, কিছু সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। পুবের এলাকা অনেক বড়, কিন্তু তুলনামূলকভাবে পশ্চাদপদ, যাকে জনবসতি এলাকার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বলা যায়।
পশ্চিমের উঁচু অংশে ছিল বিরাট স্নানাগার, স্তম্ভবিশিষ্ট সভাকক্ষ, অভিজাত শ্রেণীর বাসস্থান এবং একটি শস্যাগার। দূর্গ এলাকার উত্তর-পূর্ব কোণে কুষাণ আমলে নির্মিত একটি বৌদ্ধস্তূপের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। এর নিচে খনন চালানো হয়নি। এটির উল্টোদিকে একটি বাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সম্ভবত এর দ্বিতলে পুরোহিতরা বাস করতেন এবং নিচের গবাক্ষ অঞ্চলে স্নানের জন্য নেমে আসতেন। এরই পাশে নির্মিত অন্য একটি বাড়িতে পুরোহিতদের সাথে যুক্ত মহাবিদ্যালয়টি ছিল বলে অনুমিত হয়। দূর্গ এলাকায় পাওয়া গেছে বিশাল স্নানাগারটিকে। নির্মাণশৈলীর উন্নত রূপ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, এটি হরপ্পা সভ্যতার পরিণত পর্যায়ে নির্মিত হয়েছিল। ইটের দেয়াল নির্মাণে উন্নত কারিগরি কৌশল স্পষ্ট। ওপর-নিচে বসানো দু’টো ইটের মাঝে সৌখিনভাবে পাতলা মিশেল ব্যবহার করা হয়েছে। গাঁথনির মশলা হিসেবে ‘জিপসাম ও ‘বিটুমেন’ (পিচ)-এর ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল। জলনিরোধক হিসেবে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্নানাগারের জল নির্গমনের জন্য নিখুঁত দক্ষতার সাথে একটি নির্দিষ্ট কোণায় মেঝের ঢালটি দেওয়া হয়েছে। পুকুরের তিনদিকে খোলা বারান্দা, তারপর সারিবদ্ধ ঘর। একটি ঘরে পাকা ইটের একটি কুয়ো আছে। সম্ভবত এখান থেকে জল নিয়ে পুকুরটি ভরানো হত। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ঢালু কোণ দিয়ে খিলানযুক্ত প্রণালী মাধ্যমে জল বের করে দেওয়া হত। শিরিন রত্নাগরের মতে, সমবেত স্নানাগারের জন্য এটি নির্মিত হয়নি। কারণ এর আয়তন খুবই ছোট ১২ × ৭ মিটার। গভীরতা ৭.৫ মিটার। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ ভারতের ধর্মীয় স্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে নির্মিত পুষ্করিণীগুলি অনেক বড় হত। সম্ভবত রাজকীয় পুণ্য অবগাহনের জন্য কেবল রাজা বা রাজপরিবারের কেউ এখানে অবতরন করতেন। উত্তর ও দক্ষিণদিকে নির্মিত সিঁড়ির একদিক দিয়ে অবতরন করে, পুণ্যস্নানের পর অন্যদিক দিয়ে উঠে যেতেন। সমকালীন বিশ্বের কোথাও এত সুন্দর স্নানাগার পাওয়া যায়নি।
পুষ্করিণীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি কাঠামোর ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, যাকে শস্যাগার বলে অনুমান করা হয়। ৪৫.৭২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২২.৮৬ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এলাকায় উঁচু ইটের তৈরী ভিতের ওপর এটি নির্মিত হয়েছিল। কাঠ দিয়ে তৈরী একাধিক চতুঃস্কোণবিশিষ্ট পেটিকাতে শস্য রাখার ব্যবস্থা ছিল। পেটিকাগুলির মাঝে হাঁটা-চলার মত ফাঁক রাখা ছিল। তবে এখানে কোনো শস্য দানা পাওয়া যায়নি, যা হরপ্পাতে পাওয়া গেছে। তাই নির্মাণকৌশলের প্রকৃতি দেখে এটিকেও শস্যাগার বলে প্রত্নবিদরা অনুমান করেন। এছাড়াও মহেঞ্জোদড়োতে সারি সারি মাচাবিশিষ্ট একটি প্রশস্ত বর্গাকার ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতি সারিতে পাঁচটি করে চার সারি মাচা ছিল বলে অনুমিত হয়। সম্ভবত আলোচনা সভা বা বাজার হিসেবে এটি ব্যবহৃত হত।
পূর্বদিকের বসতি অঞ্চলটি অপেক্ষাকৃত নিচু ক্ষেত্রের ওপর গড়ে উঠেছিল। অন্তত তিনটি রাজপথ উত্তর থেকে দক্ষিণমুখে সমান্তরালভাবে নির্মিত ছিল। এগুলি অন্তত ৯ মিটার বা কিছু বেশী চওড়া। অর্থাৎ পশুর টানা দ্বি-চক্র যান চলাচলের উপযোগী ছিল। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তাগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিম মুখে চালিত হয়ে বড় রাস্তাগুলিকে ছেদ করেছে। ফলে নগর পরিকল্পনা অনেকটা দাবার ছকের মত দেখতে। সাধারণভাবে বসতবাড়িগুলি এক বা একাধিক খোলা উঠোনকে ঘিরে নির্মিত হয়েছিল। কাঁচা ও পোড়ানো উভয়প্রকার ইটের ব্যবহার ছিল। গাঁথুনি হিসেবে কাদামাটির প্রয়োগ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কাদার সাথে জিপসামের সংমিশ্রণ দেখা যায়। ছাদ, মেঝে আর প্রবেশপথ নির্মাণে কাঠের ব্যবহার ছিল। প্রতিটি বাড়ি থেকে জল নিষ্কাশনের উপযোগী সরু নালা ছিল, যা প্রধান রাস্তার পাশে আচ্ছাদিত বড় নালার সাথে যুক্ত ছিল। সম্ভবত কেবল জল নিষ্কাশনের জন্য এটি ব্যবহৃত হত। কিছু দূর অন্তর গভীর গর্ত করা ছিল। সম্ভবত বর্জ্য ফেলার জন্য এগুলি করা হয়েছিল। ঘরের দেয়ালে জানালার অস্তিত্ব দেখা যায়নি। এমন হতে পারে ওপরের ভেঙ্গে পড়া দেয়ালের অংশে জানালার অস্তিত্ব ছিল। দেয়ালের ওপরের অংশে মাটির প্রলেপ দিয়ে তার ওপর চুনকাম করা ছিল বলে অনুমিত হয়। গৃহকাঠামোর মধ্যে রান্নার চুল্লি, শিল-নোড়া, জল সংরক্ষণের বয়াম ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
হরপ্পার ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে রাভি নদীর শুকিয়ে যাওয়া পুরানো খাতের পাশে। হরপ্পাতে সামান্য কয়েকটি কাঠামো এখনো টিকে আছে। সাম্প্রতিককালে ব্যাপক সংখ্যায় ইট সরিয়ে নেওয়ার জন্য এখানকার নির্মাণ কাজের নিদর্শন প্রায় হারিয়ে গেছে। পূর্বদিকের বৃহৎ বসতি অঞ্চলটির অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। পশ্চিমের দূর্গপ্রাকারটির অস্তিত্ব কিছুটা পাওয়া যায়, তবে দূর্গের ভেতরের ঘরবাড়ির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। এটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৯৩ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১২ মিটার। সম্পূর্ণ এলাকাটি উঁচু এবং ভিতে কাঁচা ইট এবং তার ওপরে পাকা ইটের দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। উত্তর ও পশ্চিমদিকে দু’টি প্রবেশ পথ। পশ্চিমের প্রবেশ পথের সামনে একটি আবদ্ধ স্থান দেখা যায়। হুইলারের মতে, কেল্লার মধ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সম্ভবত এখানে শোভাযাত্রা সহ সাধারণ মানুষ সমবেত হতেন। উত্তরের প্রবেশপথের পাশে রক্ষীদের কোনো ঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই গবেষক এ. কেশরওয়ানি মনে করেন যে, কেল্লার মধ্যে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল এবং শত্রু প্রতিরোধের জন্য এই কেল্লা নির্মিত হয়েছিল। এমন যুক্তি দেওয়া যায় না। শিরিন রত্নাগরের মতে, দুর্গের এই ঘেরাটোপের একটা সামাজিক ও প্রতীকী তাৎপর্য আছে। উচ্চশ্রেণীর শাসকদের থেকে সাধারণ প্রজাদের মধ্যে একটা দূরত্ব বোঝানোর জন্য কেল্লা অংশটি থাকারবেষ্টিত রাখা হয়েছিল, যদিও জনগণ অবাধে ঢুকতে পারতেন।
হরপ্পার পশ্চিমের বসতি অঞ্চলের সাথে মহেঞ্জোদড়োর পশ্চিম অঞ্চলের অনেক মিল থাকলেও, হরপ্পাতে বাড়িঘর বা স্নানাগার ইত্যাদির কিছু পাওয়া যায়নি। নদীর পাড়ের দিকে দুর্গপ্রাকারের নিচে এমন একটি নির্মাণের অবশেষ পাওয়া গেছে যাতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ‘শস্যাগার’ বলে চিহ্নিত করেছেন। রোমান যুগের ব্রিটেনের শস্যাগারের সাথে এটির মিল আছে। উত্তরদিকে ১.২২ মিটার উচ্চ ভিতের ওপর দু’টি সারিতে কাঠের পাটাতনের ওপর এগুলি নির্মিত। প্রতি সারিতে ছয়টি করে সংরক্ষণ কক্ষ। এদের মাঝে প্রায় ৭ মিটার চওড়া একটি বারান্দা আছে। ভিত থেকে ওপরের শস্যাগারে ওঠার জন্য পাদানি (সিঁড়ি) করা ছিল। এই নির্মাণের দক্ষিণদিকে ইটে বাঁধানো এবং মাঝে গর্তবিশিষ্ট গোলাকার একটি জায়গা দেখা গেছে। এই গর্ত-অংশে যবের ও গমের খড় এবং তুষ পাওয়া গেছে। ঢেঁকি জাতীয় বস্তু দিয়ে এখানে শস্য মাড়াই হত বলে অনুমিত হয়। আরও দক্ষিণে দু’সারি বিশিষ্ট সাতটি করে চোদ্দটি ছোট ছোট ঘরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। হুইলার এগুলিকে শ্রমিকদের বাসস্থান (ব্যারাক) বা ‘কুলি লাইন’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
হরপ্পার আর একটি নির্মাণ প্রত্নতাত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে কিছু চুল্লি দেখা যায় যাদের ভেতরের দিকের ইটগুলি আগুনে পুড়ে ঝামা হয়ে গেছে। তামা গলানোর উপযোগী মাটির পাত্রের অবশেষও পাওয়া গেছে। তাই হরপ্পাতে তামা গলানোর প্রযুক্তিজ্ঞান এবং তামার ব্যাপক ব্যবহার ছিল বলে অনুমান করা যায়।
পূর্বদিকের বসতি অঞ্চলে পরিণত পর্বের যে সমাধিস্থানটি খোঁড়া হয়েছে (R-37) এবং শেষ পর্যায়ের যে সমাধিস্থান খোঁড়া হয়েছে (cemetry-H) তাদের থেকে মৃতদেহ সৎকারের সাধারণ রীতির অস্তিত্ব মেলে। পরিণত পর্বের একটি সমাধি সাধারণভাবে ১০ ফুট লম্বা ৩ ফুট চওড়া এবং ২ ফুট গভীর হত। দেহটি পাশ ফিরিয়ে শায়িত রাখা হত। মাথা থাকত উত্তরমুখে। অবশ্য ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। মাথার পাশে মৃতের ব্যবহৃত বা প্রিয় তৈজসপত্র, ব্যক্তিগত অলংকার ইত্যাদি রাখা থাকত। অলংকারের মধ্যে তামার আংটি, দুল, পুঁতির মালা, কাজল পাতি, ঝিনুকের তৈরী হাতের বালা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। সাধারণভাবে মাটিতেই দেহ শোয়ানো হত। তবে একটি ক্ষেত্রে নারীদেহ শায়িত কাঠের কফিন পাওয়া গেছে।
কালিবনগানের শহর পরিকল্পনা কয়েকটি ক্ষেত্রে হরপ্পা কিংবা মহেঞ্জোদড়োর থেকে স্বতন্ত্র ছিল। এখানে বাড়িঘরগুলি মূলত কাঁচা ইটে নির্মিত হয়েছিল। রাস্তাতেও পাকা ড্রেন ছিল না। স্নানাগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি, কূপের সংখ্যাও সীমিত। তবে পরিকল্পিত নগরায়ণের বৈশিষ্ট্য মান্যতা পেত। এখানেও বসতি দু’ভাগে বিভক্ত। পশ্চিমের অংশটি দুর্গপ্রাকারে ঘেরা। ব্যবহার করা হয়েছে কাঁচা ইট। দু’টি পর্যায়ে প্রাকার গড়া হয়েছিল। প্রথমপর্বের ইটগুলি ছিল তুলনায় কিছু বড়। প্রাকারের উভয়দিক মাটির প্রলেপযুক্ত। পশ্চিমের এই দুর্গ এলাকা উত্তর ও দক্ষিণ, দুটি অংশে বিভক্ত। এই দুটি অংশ একটি প্রাকার দ্বারা বিভক্ত। উত্তর অংশে আছে উচ্চশ্রেণীর আবাসস্থল, যদিও বাসগৃহগুলি কাঁচা ভিতের ওপর নির্মিত। দক্ষিণের এলাকাটি সম্ভবত গণ-ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত। এখানে কাদামাটি নির্মিত কয়েকটি বর্গাকার পাটাতনমঞ্চ আছে। অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। টিকে থাকা অংশে পূজাবেদীর ছাই ভর্তি কুণ্ডু, জলের কূপ ইত্যাদির অস্তিত্ব দেখা যায়। পোড়া ইটে নির্মিত একটি গর্তে গবাদি পশুর কিছু হাড়গোড় পাওয়া যায়। সম্ভবত দেবদেবীর উদ্দেশে এদের উৎসর্গ করা হয়েছিল।
পূর্বের বসতি অঞ্চলটি বড় (উঃ-দক্ষিণে ৩৬০ মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে ২৪০ মিটার) এবং প্রাকারবেষ্টিত। রাস্তাগুলি সমান্তরালভাবে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত। তবে একটি বাঁকানো রাস্তা ভেতরের অংশকে চৌখুপি’র মত দেখতে করেছে। বাড়িগুলির আঙিনায় একটি করে চৌবাচ্চা আছে। পশুকে খাওয়ানো কিংবা জল সংরক্ষণের জন্য সম্ভবত এগুলি নির্মিত হয়েছিল। দ্রুতগামী যানের ধাক্কা থেকে দেয়াল রক্ষা করার জন্য রাস্তা ও ঘরের কোণে শক্ত খুঁটি পোতা থাকত। সাধারণভাবে ঘরের মেঝেগুলি পেটানো মাটির হত। একটি ক্ষেত্রে নকশাযুক্ত পোড়ামাটির টালি পাওয়া গেছে।
সরস্বতীর প্রাচীন প্রবাহের দক্ষিণ তীরে (ফতেহাবাদ তহশিল) অবস্থিত বানওয়ালি। ১৯৭৪-৭৭ খ্রিঃ এবং ১৯৮৩-৮৪ খ্রিঃ মোট পাঁচবছর জুড়ে এই প্রত্নক্ষেত্রটি খনন করা হয়েছে। এটিও প্রাকারবেষ্টিত নগর। তবে দক্ষিণের প্রাকার এখনো বের করা যায়নি। পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরের প্রাকার মোটামুটিভাবে যথাক্রমে ২৬০ মিটার, ৩০০ মিটার এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য। উত্তরদিকের নগরে ঢোকার একটি রাস্তা পাওয়া গেছে। তবে মূল তোরণটি পূর্বদিকের প্রাকারের উত্তরদিক ঘেঁষে নির্মিত হয়েছিল। নিরাপত্তার জন্য পরিখা খনন করা ছিল। ভেতরের অংশটি প্রাচীর দিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত করা আছে। দেয়ালের ভেতরের অংশটি সম্ভবত শাসক ও অভিজাতদের বাসস্থানরূপে ব্যবহৃত হত। বাইরের অংশটি ছিল সাধারণ মানুষের বসবাসের ‘নিচের শহর’। পথঘাট, জলনিকাশী ব্যবস্থা, আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা, আঙ্গিনাঘেরা বাড়ি সবই অন্য শহরের মতই ছিল। ঘরের মধ্যেই সম্ভবত পূজাবেদীর অস্তিত্ব ছিল।
গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে সবরমতী নদীর উপত্যকায় লোথাল কেন্দ্রটি অবস্থিত। এটিও একটি আয়তাকার শহর। মূল কেন্দ্রটি ৪০০ × ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে এবং ১৩ মিটার চওড়া কাঁচা ইটের দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। তবে প্রাচীরের গায়ে কোনো আরক্ষাকেন্দ্র বা আরক্ষা পাটাতন নেই। তাই এটি দুর্গ-প্রাকার ছিল নাকি বন্যার জল আটকানোর জন্য করা হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ হয়। তবে সমকালীন সভ্যতার ধারা অনুযায়ী এটিকে দূর্গপ্রাকার বলেই মনে হয়। দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কিছুটা উঁচু এলাকা আছে। সম্ভবত এটি ছিল ‘অ্যাক্রোপলিস’ বা কেল্লা অংশ। অবশিষ্ট এলাকাটি সাধারণের বসতি বা ‘নীচের শহর’। কেল্লার কয়েকটি রাস্তা ইটে বাঁধানো এবং ওপরে কাঁকর বিছানো ছিল। নীচের বসতি এলাকায় একটি রাস্তা প্রায় ১৩ মিটার চওড়া। অবশ্য ৩-৫ মিটার চওড়া রাস্তাও ছিল। অধিকাংশ রাস্তার নিচে জলনিকাশী নালা আছে। বাড়ির জল রাস্তার নালার সাথে যুক্ত করার সুব্যবস্থা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে নোংরা জল বা বৃষ্টির জল শুষে নেওয়ার জন্য রাস্তার ধারে বড় বড় বয়সে পোঁতা ছিল।
লোথালের পূর্ব-অংশে একটি নৌকো বা সেকালের জাহাজ নোঙর করা এবং মেরামতির উপযোগী একটি ডকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ডকটি উত্তর-দক্ষিণে ২১৯ মিটার লম্বা এবং পূর্ব পশ্চিমে ৩৮ মিটার চওড়া। ক্যাম্বে উপসাগরের একটি ফাঁড়ি থেকে লোথাল জলপথ দ্বারা যুক্ত ছিল বলে অনুমান করা হয়। এখানেও জল ঢোকা এবং বের করার উন্নত ব্যবস্থা ছিল। সমকালীন পৃথিবীতে এত উন্নত ‘ডক’ কোথাও দেখা যায়নি। ডকের পশ্চিম দিকে ইট দিয়ে বাঁধানো প্রশস্ত এলাকাটিকে নৌকো থেকে মাল নামানোর জায়গা বলে মনে করা হয়। লোথাল বন্দর থেকে মেসোপটেমিয়া, সুমের, মধ্য এশিয়া, ইজিপ্ট প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঘটত বলে মনে করা হয়।
প্রাকারের বাইরে উত্তর-পশ্চিম কোণে লোথালের সমাধি ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দু’টি সমাধিতে নারী-পুরুষ উত্তরদিকে মাথা রেখে শোয়ানো অবস্থায় দেখা গেছে। মৃতদেহের পাশে অলংকার, মৃৎপাত্র এবং পশুর হাড়ের অস্তিত্ব দেখা যায়। এখানে ৯/১০ বছরের একটি শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে, যার খুলিতে চৌকো করে একটি ফুটো করা আছে। সম্ভবত এটি অস্ত্রোপচার বা কোনো চিকিৎসার কারণে করা হয়েছিল।
কচ্ছের ‘রান’ অঞ্চলের ভেতর খাদির নামক একটি দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম কোণে ধোলাবিরা কেন্দ্রটির অবস্থান। সাধারণভাবে এখানে বৃষ্টিপাতের গড় হার খুবই কম। চাষাবাদের উপযোগী জমির পরিমাণও খুব সীমিত। তবে অতীতে ঘরে হাকরা (সরস্বতী) এবং সিন্ধুনদের মিলিত প্রবাহ রান অঞ্চলে মিলিত হত বলে শ্যামলিমা দেখা যেত। ধোলাবিরায় প্রাচীন শহরের আয়তন পূর্ব পশ্চিমে ৮০০ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৫০ মিটারের মত ছিল। সমস্ত এলাকাটি প্রাকার দিয়ে ঘেরা। ধোলাবিরার দূর্গ এলাকাটি উত্তরদিকে অবস্থিত। এর পশ্চিমদিকে অবস্থিত নীচের বসতি এলাকা। দু’টি অংশই স্বতন্ত্রভাবে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এর মাঝে রয়েছে কিছুটা ফাঁকা এলাকা, যা ‘মাঝের শহর’ নামে পরিচিত। ২৬০ × ২৫০ মিটার ব্যাসার্ধবিশিষ্ট এই অঞ্চলটিও প্রাকারবেষ্টিত। এর পূর্বে আছে সাধারণের বসতি ‘নীচের শহর’। লক্ষণীয় যে, উচ্চ, মধ্যম ও নীচের এলাকা—এমন শহর-বিন্যাস হরপ্পা সভ্যতার অন্য কোন কেন্দ্রে দেখা যায়নি। শহরের মধ্যে এত বড় উন্মুক্ত এলাকাও অন্যত্র বিরল। বৃষ্টির জল ধরে রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা ধোলাবিরায় দেখা যায়, তাও অন্যত্র নেই। কাঠের ফলকের ওপর স্থাপিত প্রস্তরের ওপর লিপিযুক্ত নির্দেশিকাটিও ধোলাবিরা কেন্দ্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
কচ্ছের ভূজ থেকে প্রায় ১৬০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে আদিসর নামক শহরের ১২ কি.মি. উত্তর-পূর্বে সুরকোটাডা কেন্দ্রটির অবস্থান। কৃষিকাজের উপযুক্ত ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে নেই। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনেকের বিশ্বাস এটি সাধারণ শস্য উৎপাদক বা পশুপালক মানুষের বসতি ছিল না। সম্ভবত একটি দূরবর্তী সামরিক ঘাঁটি হিসেবে এটি গড়ে উঠেছিল। এখানে বসতি অঞ্চল একটিই। প্রাকার দ্বারা সুরক্ষিত একটি আয়তাকার ক্ষেত্র। কোণে কোণে বেষ্টনী বা বুরুজ দিয়ে সুদৃঢ় করা। মাঝবরাবর আরো একটি বুরুজযুক্ত প্রাকার দিয়ে এলাকাটিকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। পশ্চিমের অংশটিকে বলা হয় দূর্গকেন্দ্র (Citadel) এবং পূর্বের অংশে বাসগৃহগুলি তৈরী হয়েছিল। তিনটি পর্যায়ে এখানে বসতি বিন্যাস ঘটেছিল। সকল পর্যায়েই কাঁচা ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে যত্ন করে কাটা পাথরের টুকরোর ব্যবহার দেখা যায়। দুর্গকেন্দ্রে ঢোকার রাস্তাটি দক্ষিণদিকে। প্রবেশপথটি প্রতিরক্ষা ধাঁচের। এখানে প্রবেশের জন্য কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোতে হবে, তারপর সমকোণে ঘুরে একটা ঢালু স্তর বেয়ে কিছুটা উঠে আবার ঘুরে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে দূর্গের মধ্যে পৌঁছানো যাবে। দূর্গের প্রাকার তিনটি পর্যায়ে নির্মিত হয়েছিল। প্রাকারের প্রস্থে কিছু পরিবর্তন এলেও নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে সকল পর্যায়েই কাঁচা ইটের ব্যবহার দেখা যায়। দুর্গ অঞ্চলের মধ্যে কিছুটা নিচু অংশে কয়েকটি বসতবাড়ির অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমিত হয়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।