আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য
নগর কাঠামো : হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্গত প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলি গঠন কাঠামো থেকে স্পষ্ট হয় যে, খ্রিস্ট পূর্বকালেই ভারত উপমহাদেশে এক উন্নত নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। নগরগুলির বিন্যাসে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য কমবেশী প্রায় সবগুলি নগরকেন্দ্রে উপস্থিত ছিল। নগরকাঠামোর বৈচিত্র বা পার্থক্যগুলি এসেছিল তাদের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান বা জীবনধারণের জন্য আবশ্যক বস্তুগত চাহিদার তারতম্যের কারণে। উন্নত নগর পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে হরপ্পীয় সংস্কৃতির অসামান্য অবদান। প্রধান দুটি নগরী মহেঞ্জোদড়ো এবং হরপ্পায় উন্নত নগর পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। মার্টিনার হুইলার মনে করেন যে, মহেঞ্জোদড়ো যখন পরিকল্পিত হয়েছিল, তখন নগর-পরিকল্পনা কেবল পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে ছিল না। হরপ্পা নগরীর উন্নত পরিকাঠামো এই মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে। হরপ্পীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনায় নিয়মমাফিক ছক লক্ষণীয়, তবে ক্ষেত্র বিশেষে নগর পরিকল্পনায় বৈচিত্র্যও দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি নগর উঁচু ও নিচু দুটি এলাকায় বিভক্ত। উঁচু এলাকাকে প্রায় সবাই জন মার্শালের অনুকরণে ‘সিটাডেল’ বা দূর্গ এলাকা বলে চিহ্নিত করেছেন। উঁচু এলাকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নগরের পশ্চিম বা উত্তর-পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত এবং আয়তক্ষেত্রাকার। প্রাকারবেষ্টিত এই এলাকা অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য কখনো বা গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কালিবনগানের উঁচু এলাকা দু’টি ভাগে বিভক্ত, যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। আবার অধুনা আবিষ্কৃত ধোলাবিরাতে গোটা নগরটি তিনভাগে বিভক্ত-উঁচু শহর, মাঝের শহর ও নীচের শহর। এই ধরনের মাঝের শহরের বিভাজন অন্যত্র নেই। অন্যদিকে গুজরাটের উপকূলে অবস্থিত লোথাল ছিল মূলত একটি বন্দর নগর। স্বভাবতই তার গঠনশৈলী কিছুটা স্বতন্ত্র। এই কারণে মনে করা হয় যে, কেবল ব্যবহারিক প্রয়োজন বা স্থায়িত্ব নয়, এই পরিকল্পনার পশ্চাদপটে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান (Cosmological principles) সম্পর্কিত ধারণাও সক্রিয় ছিল। সিটাডেল এলাকাতে প্রধান প্রশাসনিকভবন এবং শাসকদের আবাসগুলি অবস্থিত ছিল। এছাড়া প্রধান স্থাপত্যকর্মগুলি যেমন, ‘বিরাট স্নানাগার’, ‘বিরাট শস্যাগার’ ইত্যাদি এখানে গড়ে উঠেছিল। নিচু এলাকা বা প্রধান বসতি এলাকা থাকত পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। এই অংশ ছিল ঘন বসতিপূর্ণ।
লক্ষণীয় যে, হরপ্রীয় নগরগুলিতে পাথরের তৈরী কোন অট্টালিকা দেখা যায় না। কাঁচা কিংবা পোড়া ইট নির্মিত ছিল বাসস্থান ও প্রাকারগুলি। তবে কালিবনগানে কাদামাটির ইট দেখা যায়। বাড়িগুলি দ্বিতল বা আরো উঁচু হত, বাড়ির পরিকল্পনা ছিল একইরকম— আয়তাকার উঠোন ঘিরে ঘর। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োতে এখনকার কুলি-লাইনের মত সারিবদ্ধ ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরের সারি পাওয়া গেছে। সম্ভবত সমাজের দরিদ্রশ্রেণীর বাসস্থান ছিল এগুলি। এই বাসস্থানের বৈপরীত্য হরপ্পীয় সমাজে শ্রেণী বৈষম্যের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। আন্না সারকিনা মহেঞ্জোদড়ের উঠোনগুলির বিবিধ ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন। যেমন কোথাও বাস্তুবাড়ির প্রয়োজনে, কোথাও হাতের কাজ করার জন্য, কোথাও বা উভয়প্রকার কাজের জন্য ব্যবহৃত হত।
হরপ্পীয় সভ্যতার আমলে বৃহদাকার স্থাপত্য কর্মের অন্যতম হল মহেঞ্জোদড়োর বিশাল স্নানাগার বা জলাধারটি। কৃত্রিম এই জলাধার শহরের উঁচু এলাকায় প্রশস্ত আঙ্গিনার মাঝে অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তে ইট-নির্মিত সিঁড়ি বা ধাপ জলাধারের তলদেশ পর্যন্ত নেমে গেছে। ওঠা-নামার জন্য এগুলি ব্যবহৃত হত। জলাধারের চারপাশে ছোট ছোট ঘর, কৃত্রিম উপায়ে জল ভরা ও বের করানোর পদ্ধতি, মেঝেতে পাকা (পোড়ানো) ইঁটের ব্যবহার এই স্থাপত্যকর্মকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এই বৃহৎ জলাধারের ব্যবহার কিভাবে হত, সে প্রসঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ভিন্ন ভিন্ন অনুমান ব্যক্ত করেছেন। মার্শাল মনে করেন ‘জল চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হত; কৌশাম্বী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা ভেবেছেন; আবার হুইলার একে পুরোহিততন্ত্রের অঙ্গ বলে মনে করেন। ধোলাবিরার উঁচু এলাকায় অনুরূপ একটি জলাধারের অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পীয় নগর পরিকল্পনার আর একটি বৈশিষ্ট্য হল শস্যাগার। মহেঞ্ঝোদড়ো এবং হরপ্পাতে বৃহৎ শস্যাগারের অস্তিত্ব দেখা যায়। অন্যান্য নগরগুলিতেও শস্যাগার নির্মাণের রেওয়াজ ছিল। ইটের তৈরী শক্ত ভিতের ওপর সারিবদ্ধভাবে শস্য রাখার কক্ষগুলি দেখা গেছে। হরপ্পার সুপরিচিত ‘বৃহৎ শস্যাগারের’ পাশে ফসল ঝাড়াই-বাছাই করার জন্য গোল মঞ্চ নির্মিত ছিল। পাশ্ববর্তী গৃহগুলি শ্রমিকদের বাসস্থান ছিল বলে অনুমিত হয়। এ. এল. ব্যাসাম মনে করেন যে, শহরের জনগণকে খাদ্য সরবরাহ ছাড়াও মুদ্রা অর্থনীতির অনুপস্থিতির যুগে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের কাজও করত। হুইলার বলেছেন, কী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য, কী বিস্ময়কর উৎকর্ষ, সিন্ধু উপত্যকার শস্যাগারগুলির সাথে তুলনীয় কোন শস্যাগার খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগে বিশ্বের কোথাও দেখা যায়নি।
মহেঞ্জোদড়ো শহরের পশ্চিম অংশে আবিষ্কৃত একটি স্থাপত্যের অবশেষকে ম্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। নির্মাণশৈলীর প্রেক্ষিতে তিনি এটিকে ‘কলেজ-গৃহ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। মার্শালকে অনুসরণ করে এখানের আর একটি বৃহদাকার নির্মাণকে ‘সভাকক্ষ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ফেয়ারসার্ভিস এই বাড়িটিকে মহেঞ্জোদড়োর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন বলে মনে করেন। বিশালাকার এই হলঘরের ছাদটি কুড়িটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছিল। ম্যাকের অনুমান মহেঞ্জোদড়োর সাধারণ বাসগৃহগুলির মাঝে ২৫০ ফুট দীর্ঘ একটি প্রাসাদোপম বাড়ির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুটি প্রশস্ত আঙ্গিনা এবং চারপাশে ছোট ছোট কক্ষবিশিষ্ট এই নির্মাণকে তিনি সাধারণের বসতবাড়ি বলে মনে করেন না। তাঁর ধারণা এটি সম্ভবত প্রধান শাসক বা পুরোহিত-রাজা (Priest King) এর প্রধান দপ্তর ছিল। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
আগেই বলা হয়েছে যে, শহরের নিচু অংশে বসতবাড়িগুলি নির্মিত হয়েছিল। বসতবাড়ির আকার ও আয়তনের বৈচিত্র্য ও প্রভেদ সামাজিক তারতম্যের ইঙ্গিত দেয়। হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলিতে যেমন বিশাল অট্টালিকা, দ্বিতল বা বহুতল বাড়ি ছিল, তেমনি ছিল সাধারণ একতলবিশিষ্ট বাড়ি। তবে বাড়িগুলির গঠন-পরিকল্পনার মধ্যে মিল দেখা যায়।
বাড়িগুলিতে থাকত একটি করে চতুষ্কোণ উঠোন, কয়েকটি ঘর, রান্নাঘর ও স্নানঘর। বাড়িতে প্রবেশ করতে হত পাশের সরু গলি দিয়ে। রাস্তার দিকে কোন জানালা থাকত না। তবে পাথরের জাফরির মধ্যে দিয়ে হাওয়া চলাচল করত। দরজাগুলি চওড়া হত তিন থেকে চার ফুট। দরজা, জানালা বা চৌকাঠ তৈরি হত কাঠ দিয়ে। পাথর বা ইট গর্ত করে দরজার নিচের পাশের দিকের কোণ লাগানো হত। প্রকৃতপক্ষে তখনো খিলান নির্মাণ পদ্ধতি অজানা ছিল। প্রতি বাড়িতে একটি করে কুয়ো থাকত। তাছাড়া বাইরে, সাধারণের ব্যবহারের জন্যও শহরের নানা স্থানে কুয়ো ছিল। কুয়োগুলির উপর জলটানা দড়ির চিহ্ন ও কলসী রাখার ফলে সৃষ্ট গর্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
হরপ্পা-সভ্যতার নাগরিকরা যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন ছিল। কেননা প্রতি বাড়িতেই স্নানাগার থাকত, যার গঠনপ্রণালী ছিল যথেষ্ট আধুনিক। পোড়া ইট খাড়াভাবে বিছিয়ে স্নানাগারের মেঝে প্রস্তুত হত। ঐ ইট করাত দিয়ে কেটে ও মসৃণ করে ব্যবহার করা হত। তাই মেঝে খুবই সুন্দর দেখতে হত। অনেক বাড়ির ভিতরের দিকের দেয়ালে কুলুঙ্গী থাকত। শহরগুলিতে যথেষ্ট সংখ্যক দ্বিতল বাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ফলে উপরে যাবার জন্য সিঁড়ি ছিল। অবশ্য সিঁড়িগুলি সাধারণত সরু ও খাঁড়া ধরনের হত। বাড়িগুলিতে অবশ্য অলংকরণের ছাপ খুব একটা দেখা যায় না।
শহরের রাস্তাগুলি ছিল যথেষ্ট চওড়া (৯-৩৪ ফুট)। এগুলি সোজাভাবে শহরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যেত। ফলে শহরটি রাস্তার দ্বারা কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত হত। বড় রাস্তা থেকে বেরোনো বিভিন্ন গলির মাধ্যমে বাড়িতে প্রবেশ করতে হত। এক গলিপথ থেকে অন্য গলিপথ যাবার ব্যবস্থা ছিল। প্রধান রাস্তার ধারের বাড়িগুলির নিচেরতলার কিছু ঘর সম্ভবত দোকানঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলির পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। কোশাম্বীর মতে, এই উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাই সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতা থেকে হরপ্পা সভ্যতাকে পৃথক করেছে। প্রতিটি বাড়ির জল নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা থাকত। এমনকি দ্বিতল বা বহুতল বাড়িগুলির উপরিতল থেকে পোড়ামাটির নলের নর্দমা নীচে নেমে আসত। তারপর বাড়িগুলি থেকে পোড়ামাটির নলের মধ্যে দিয়ে জলসমূহ রাস্তার ধারের বড় নর্দমায় এসে পড়ত। রাজপথের পাশ দিয়ে থাকত টানা আচ্ছাদিত নর্দমা। এই নর্দমার স্থানে স্থানে গোল বা চতুষ্কোণ কুণ্ড থাকত, যাতে আবর্জনা জমা হত। এত প্রাচীনকালে মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পার নাগরিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সচেতনতা দেখে পণ্ডিতদের অনুমান ঐ সময় পৌর শাসনব্যবস্থা বর্তমান ছিল। সুচিন্তিত নগর পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত জল সরবরাহ, জলনিকাশী ব্যবস্থার উন্নত রূপ, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনা ইত্যাদি হরপ্পীয় সভ্যতায় একটি প্রগতিশীল পৌরজীবনের ইঙ্গিত দেয়। নাগরিকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধির জন্য প্রশস্ত রাজপথ, বহিরাগত বণিকদের রাত্রিবাসের বিশ্রামাগার, জলপথে আলোর ব্যবস্থা, সামাজিক বর্জ্য মাটিতে গর্ত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিঃসন্দেহে হরপ্পা সভ্যতায় এক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচায়ক। পরবর্তীকালে পৌর শাসনের কঠোরতা শিথিল হলে অপরিকল্পিতভাবে গৃহ নির্মাণ, পথঘাটের সংকোচন ইত্যাদি ঘটতে থাকে। হুইলার-এর মতে, এই পরিস্থিতিতে শহরগুলি তাদের সৌন্দর্য, সুষমা ও ব্যবহারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ হারিয়ে ফেলে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।