আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রাচীন ভারতবর্ষে সংস্কৃতির সুবর্ণযুগ বিতর্ক” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
প্রাচীন ভারতবর্ষে সংস্কৃতির সুবর্ণযুগ বিতর্ক
প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা, ধর্মভাবনা ইত্যাদি পরবর্তী অধ্যায়ে ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য বিতর্ক অর্থাৎ গুপ্তযুগে সমাজ, সংস্কৃতি যথার্থই একটি মানবতাবাদী, সর্বজনীন ও প্রগতিশীল জীবনধারার ধারক ও বাহক ছিল কিনা, তা অনুধাবনের জন্য সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতির বিস্তারিত ধারণা আবশ্যক। তাই বর্তমান আলোচনার সংযোজন হিসেবে পরবর্তী অধ্যায়ের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমরা কেবল সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ দ্বারা আলোচ্য বিতর্কের মূল্যায়ন করতে প্রয়াসী হব।
গুপ্ত রাজবংশের শাসনকালের মূল পর্বে (৩০০-৬০০ খ্রিঃ) ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির নানাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা যায়। ধর্মীয় সহনশীলতা, কাব্যসাহিত্যের ব্যাপকচর্চা, বিজ্ঞান-অনুশীলন, জ্যোতির্বিজ্ঞানে কালজয়ী আবিষ্কার, ভেষজ বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, শিল্প স্থাপত্যের কাজে নতুনত্বের সৃষ্টি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে কেউ কেউ গুপ্তযুগকে ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে ‘সুবর্ণ যুগ’ (Golden Age) বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের নিরিখে ভারতের গুপ্তযুগকে গ্রীসে ‘পেরিক্লিসের যুগ’, রোমে ‘অগাস্টাসের যুগ’ এবং ইংল্যান্ডে ‘এলিজাবেথের যুগে’র সাথে তুলনা করেছেন। সাম্প্রতিক কালে একটি ভিন্নমত উপস্থাপিত হয়েছে। এই মতে, অর্থনৈতিক অধোগতি ও সামাজিক বৈষম্যের বিচারে গুপ্তযুগকে ‘সুবর্ণযুগ’ বলা সঠিক হবে না। বস্তুত ঐতিহাসিকের নৈর্ব্যক্তিক বিচারে উভয় মতই আংশিকভাবে সত্য।
শিল্প-সাহিত্যের বহুমুখী চর্চা ও বিকাশ ধ্রুপদী সভ্যতার (classical) মাপকাঠি হলে, গুপ্তযুগকে ধ্রুপদী যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা অতিরঞ্জন হবে না। এই যুগে শিল্প সাহিত্যের যে উন্নতি ঘটেছিল, তা ইতিপূর্বে সম্ভব হয়নি। গুপ্তযুগে ভারতের বৃহত্তর অংশের রাজনৈতিক ঐক্য এবং গুপ্ত সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব করেছিল। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে সমুদ্রগুপ্তকে ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে তাঁর কাব্যপ্রীতি ও কাব্যচর্চায় আগ্রহের আভাস দেয়। দুটি মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং আদি পুরাণ গ্রন্থগুলি গুপ্তযুগের পূর্বাঙ্গ রূপ পেয়েছিল। গুপ্তযুগে হিন্দুধর্মের মধ্যে নতুন কয়েকটি সম্প্রদায়ের (শৈব, সৌর, শাক্ত ইত্যাদি) উদ্ভব ঘটলে, তাদের মতবাদগুলিকে পুরাণের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। একই সাথে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক কিছু বিষয় পুরাণের অন্তর্ভুক্ত করে এগুলিকে ধর্মশাস্ত্রের মত গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধর্মশাস্ত্রও খ্রিষ্টীয় ৫০০ থেকে ৭০০ অব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। দেবল স্মৃতি, কাত্যায়ন স্মৃতি, পরাসর স্মৃতি, হারিত স্মৃতির পাশাপাশি নারদ, বৃহস্পতি প্রমুখের স্মৃতিশাস্ত্রের সংকলন গুপ্ত আমলের অনেকটা সময়কাল জুড়ে সম্পন্ন হয়েছিল। গুপ্তযুগে ধর্মীয় সাহিত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিসমূহের ওপর টীকা ভাষ্য রচনা। সাংখ্যদর্শনের ওপর টীকা রচনা করেন ঈশ্বর কৃয় (চতুর্থ / পঞ্চম শতক), ন্যায় সূত্রের প্রাচীনতর টীকাকার পঞ্চিলস্বামিন বাৎসায়ন সম্ভবত চতুর্থ শতকের মানুষ ছিলেন। সমকালের পণ্ডিত দিঙনাগ বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়সূত্র ব্যাখ্যা করেন। প্রশস্তপদ গুপ্ত আমলেই পরমার্থ সংগ্রহ গ্রন্থে কনাদের বৈশেষিক সূত্রের ভাষ্য রচনার পাশাপাশি কিছু নতুন অংশ এতে জুড়ে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ দাবি করেন, জৈমিনি মীমাংসা সূত্র গুপ্তযুগের শেষ দিকে রচিত হয়েছিল।
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশের সাক্ষী গুপ্তযুগ। এ যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন মহাকবি কালিদাস। তিনি কিংবদন্তীর নবরত্নসভার সদস্য ছিলেন বলে মনে করা হয়। কালিদাস গুপ্তরাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এবং প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালের কিছু সময় তাঁর সাহিত্যচর্চা করেছিলেন। কালিদাস রচিত চারটি কাব্যগ্রন্থ কুমারসম্ভব, রঘুবংশ, মেঘদূত ও ঋতুসংহার এবং তিনটি নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলা, মালবিকাগ্নিমিত্রম্ ও বিক্রমোর্বশী পাওয়া গেছে, যেগুলি কালজয়ী সাহিত্যকর্ম হিসেবে বন্দিত হয়। তাঁর রচনাবলীতে সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, প্রকৃতি বর্ণনা, মানবীয় প্রেম-প্রীতি ভালবাসা-ঈর্ষা ইত্যাদি সুলোলিত ছন্দে ও ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও মৃচ্ছকটিক প্রণেতা শূদ্রক, মুদ্রারাক্ষস ও দেবীচন্দ্রগুপ্ত রচয়িতা বিশাখদত্ত, বাসভদত্তা প্রণেতা সুবন্ধু, অমরকোষ প্রণেতা অমরসিংহ, কিরাতাজুনীয় প্রণেতা ভারবি প্রমুখ পণ্ডিত গুপ্তযুগের সাহিত্যাঙ্গনকে আলোকিত করেছিল।
ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের পাশাপাশি গুপ্তযুগে বহু পণ্ডিত বৌদ্ধ, জৈন ও ন্যায়দর্শনের ওপর ভাষ্য রচনা করেছিলেন। বৌদ্ধপণ্ডিত বুদ্ধঘোষ, মহানাম, আসঙ্গ, বসুবন্ধু যথাক্রমে বিশুদ্ধি মার্গ, মহাভাষ্য, যোগাচারভূমি শাস্ত্র, মহাযান সূত্রালঙ্কার টীকা প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। বিশিষ্ট দার্শনিক সিদ্ধসেন, ঈশ্বরকৃয়, বাৎসায়ন প্রমুখ গুপ্তযুগে আবির্ভূত হয়ে দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক বহু অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ছন্দবিজ্ঞান, অভিধান, ব্যাকরণ ইত্যাদি রচনার কাজেও গুপ্তযুগের পণ্ডিতরা প্রশংসার দাবী রাখেন। এই প্রসঙ্গে ভট্টি, দণ্ডিন, ভামহ, বরাহমিহির প্রমুখের নাম উল্লেখ্য। ভট্টির ‘ভট্টিকাব্য’, দণ্ডিনের ‘কাব্যাদর্শ’, ভামহের ‘কাব্যালংকার’, বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ প্রভৃতি গ্রন্থ ছন্দবিজ্ঞান, অলংকারের প্রয়োগ বৈচিত্র্য, শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে নতুন দিগ্দর্শন ঘটায়। ঐতিহ্য অনুসারে নবরত্নসভার সদস্য ছিলেন অমর। তাঁর বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থ অমরকোষ। তাঁর সমকালীন অপর বিখ্যাত অভিধানবিদ ছিলেন ‘অনেকার্থসমুদ্বয়’ গ্রন্থ প্রণেতা শাশ্বত। সংস্কৃত ব্যাকরণচর্চার ক্ষেত্রে দুটি বিখ্যাত রচনা ছিল চন্দ্রগোমিন রচিত ‘চান্দ্রব্যাকরণ’ এবং জনেন্দ্র রচিত ‘জৈনেন্দ্র ব্যাকরণ’। ব্যাকরণ রচনার পাশাপাশি গুপ্তযুগে ব্যাকরণের বিভিন্ন টীকা ভাষ্যও রচিত হয়েছিল। এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন জয়াদিত্য, বামন, জিনেন্দ্রবুদ্ধি প্রমুখ পণ্ডিত।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মহাকাশ সম্পর্কিত গ্রন্থাদি রচনার ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগ বিশেষ স্মরণীয়। এ. এল. ব্যাসাম-এর মতে, অঙ্কশাস্ত্র উদ্ভাবনের জন্য সমগ্র বিশ্ব ভারতের কাছে ঋণী। অঙ্কশাস্ত্র চর্চায় গুপ্তযুগের পণ্ডিতরা যে উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন, সমকালীন অন্য কোন জাতি তা পারেনি। গুপ্তযুগে গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক উদ্ভাবন প্রত্যক্ষ করলে, এই প্রশংসার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। গুপ্তযুগের বিশ্ববরেণ্য জ্যোতির্বিদ ছিলেন আর্যভট্ট। বিহারের পাটলিপুত্রে তিনি ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রহনক্ষত্র বিষয়ক তাঁর তিনটি গ্রন্থ পাওয়া গেছে—আর্যভট্টীয়, দশগীতিকাসূত্র এবং আর্যাষ্টিশত তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যভট্টীয়’ রচিত হয় ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে। এখানে তিনি অঙ্কশাস্ত্রের মাধ্যমে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি, অবস্থান, প্রাকৃতিক প্রভাব ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেন। পৃথিবী যে আপন কক্ষপথে আবর্তিত হয় এবং পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রের ওপর পড়লে চন্দ্রগ্রহণ হয়, এই মহাজাগতিক সত্য তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। আর্যভট্টই প্রথম দশমিক সংখ্যার মূল্য নিরূপণ করেন। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দের ‘বাঁকশালি পাণ্ডুলিপি’তে দশমিক পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে গণনার কাজে দশমিকের প্রয়োগ প্রথম করেন আর্যভট্ট। বীজগণিতের প্রয়োগ, বৃত্তের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য, ত্রিকোণমিতির প্রয়োগ আর্যভট্টের মাধ্যমেই প্রথম সম্পাদিত হয়। গুপ্তযুগের আর এক বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ছিলেন বরাহমিহির (৫০৫ খ্রিঃ)। তিনি গ্রহ-নক্ষত্র বিজ্ঞানকে সমগুরুত্বপূর্ণ তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন— জ্যোর্তিবিদ্যা ও অঙ্কশাস্ত্র, কোষ্ঠীচর্চা এবং জ্যোতিষশাস্ত্র। আর্যভট্টের সাথে তাঁর তফাৎ এখানেই যে, বরাহমিহির অঙ্কশাস্ত্রভিত্তিক মহাকাশচর্চার পরিবর্তে জ্যোতিষশাস্ত্রকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তন্ত্র বিষয়ক তাঁর গ্রন্থ ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’। এই সিদ্ধান্তগুলি হল—পৈতমহ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত, পৌলিস সিদ্ধান্ত, বাশিষ্ঠ সিদ্ধান্ত এবং সূর্য সিদ্ধান্ত। শেষোক্ত চারটি সিদ্ধান্তের ওপর গ্রীক মহাকাশচর্চার প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। জ্যোতিষ বিষয়ক তাঁর গ্রন্থের নাম ‘বৃহৎসংহিতা’। ১০৬টি অধ্যায় বিশিষ্ট এই গ্রন্থে তিনি একদিকে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ঘটনাবলী যেমন বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প ইত্যাদি এবং বিভিন্ন গাছপালা, শাক-সব্জি, গৃহনির্মাণ, উদ্যান নির্মাণ ইত্যাদি বিবিধ বিষয় আলোচনা করেছেন। জন্মকুণ্ডলী বিষয়ক তাঁর দুটি গ্রন্থ লঘুজাতক ও বৃহৎজাতক। গুপ্তযুগের অব্যবহিত পরে জ্যোতির্বিদ-গণিতজ্ঞ ব্রহ্মগুপ্ত আর্যভট্টকে অনুসরণ করে গাণিতিক নিয়মাবলী আলোচনা করে খ্যাতি পান। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলি হল ‘ব্র্যসিদ্ধান্ত’, ‘খণ্ডখাদ্য’ এবং ‘ধ্যানগ্রহ’। তিনিই সর্বপ্রথম মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রসঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
ভেষজ বিদ্যা বা চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগ পিছিয়ে ছিল না। এযুগের বিখ্যাত চিকিৎসাশাস্ত্রকার ছিলেন বাগভট। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর স্থান ছিল চরক ও শুশ্রুতের পরেই। বাগভট নামে দুজন চিকিৎসাশাস্ত্রকার ছিলেন। তাঁরা যথাক্রমে ‘অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ’ ও ‘অষ্টাঙ্গ -হৃদয়-সংহিতা’ নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রথম গ্রন্থটি আংশিক গদ্যে ও আংশিক পদ্যে রচিত। দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ পদ্য ছন্দে লেখা হয়েছে। প্রাক্-গুপ্তযুগে রচিত চিকিৎসাশাস্ত্রগুলির সারাংশ সংকলিত করে গুপ্তযুগে রচিত হয়েছিল ‘নবনীতক’ নামক গ্রন্থটি। পশু চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘হস্ত্যায়ুর্বেদ’ গুপ্তযুগে রচিত হয়। এছাড়া হাতি ও ঘোড়ার চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘অশ্বশাস্ত্র’ রচনা করেছিলেন শালিহোত্র।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা চর্চার দিক থেকেও গুপ্তযুগ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। গুপ্তযুগে ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পে দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একদিকে গুপ্তযুগে প্রাচীন গুহা স্থাপত্য পূর্ণ পরিণতি লাভের পর অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, অন্যদিকে এ-যুগেই নবরূপে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হয়েছিল। স্থাপত্য কর্ম হিসেবে স্তূপ ও চৈত্য নির্মাণ এযুগেও অব্যাহত ছিল। অজন্তা ও ইলোরার চৈত্যগুলি আগের মতই পর্বতগাত্র খোদিত করে নির্মাণ করা হয়েছিল। এ যুগের চৈত্যগুলিতে দণ্ডায়মান বা উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি দেখা যায়। সম্ভবত এই সময় পৌত্তলিকতার প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে নবনির্মিত চৈত্যগুলিকে পবিত্র স্থান হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রয়াস ছিল। শিল্প সমালোচকদের মতে, পরিবর্তিত অবস্থায় চৈত্যগুলি তার প্রাথমিক প্রয়োজন হারিয়ে ফেলে এবং চৈত্য-শিল্প ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক ও অ-জনপ্রিয় হতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে গুপ্তযুগে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা ব্যাখ্যা করা যায়। প্রাক-গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইট ও পাথরের মত স্থায়ী উপাদান দ্বারা ব্যবহারযোগ্য মন্দির নির্মাণ বিকাশ লাভ করে। সুউচ্চ শিখর, বর্গাকার গর্ভগৃহ, প্রদক্ষিণ পথ, ভাস্কর্য শোভিত গুপ্তযুগের মন্দিরগুলিকেই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের পরবর্তীকালের বৃহদাকার মন্দির স্থাপত্যের পথিকৃৎ বলা হয়। গুপ্তযুগের স্থাপত্যে দুটি নতুন স্থাপত্যশৈলীর সূচনা ঘটেছিল, যা, নাগর রীতি ও দ্রাবিড় রীতি নামে পরিচিত। নাগর রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য-এর মন্দিরের ভিত ক্রুশাকার এবং রেখ ধরনের শিখর। দেওগড় ও ভিটরগাঁও মন্দিরে এই রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। দ্রাবিড় রীতির মূল বৈশিষ্ট্য হল যে, মন্দিরের ছাদ ক্রমহ্রাসমান পিড়ি বা থাকের ওপর ক্রমান্বয়ে বিন্যস্ত। নাচনাকুঠারা ও আইহোলি মন্দিরে এর প্রয়োগ দেখা যায়।
ভাস্কর্য শিল্পে গুপ্তযুগে যথার্থই ধ্রুপদী ধারার প্রকাশ ঘটে। নন্দনতত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য একাধারে নমনীয়তা ও ঋজুতা, ইন্দ্রিয় পরায়ণতা ও আধ্যাত্মিকতা এযুগের ভাস্কর্য শিল্পে গুরুত্ব পেয়েছিল। ইতিপূর্বে মথুরা শৈলীর আদিমতা গুপ্ত-ভাষ্কর্যে ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়েছিল। অন্যদিকে গন্ধার শৈলীতে গ্রীক্-রোমান শৈলীর যে গভীর প্রভাব ছিল, এযুগে তা কাটিয়ে উঠে ভাস্কর্যের ভারতীয়করণের প্রয়াস বাস্তব রূপ পেয়েছিল। গুপ্তযুগে ভাস্কর্য শিল্পের মূল তিনটি ধারা মথুরা, সারনাথ ও পাটলিপুত্রে গড়ে উঠেছিল। গন্ধার শিল্পের চূড়ান্ত পরিপূর্ণতার যুগে মথুরা শিল্পের সূচনা হলেও, গন্ধার শিল্পের পরদেশ অনুকরণ প্রবণতা বর্জন করে গুপ্তযুগে মথুরা ভাস্কর্য স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে সক্ষম হয়েছিল। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, গুপ্তযুগের ভাষ্কর্যে আদি মথুরা শিল্পের পার্থিবতা এবং বেঙ্গির ইন্দ্রিয় পরায়ণতা বর্জন করা হয়েছে। গুপ্তযুগের ভাস্কররা মহৎ শিল্পাদর্শ থেকে তাঁদের সৃষ্টিকে পার্থিব সৌন্দর্যের পরিবর্তে আধ্যাত্মিক-ভাবনার আধার রূপে তুলে ধরতে আন্তরিক ছিলেন। সিকরি অঞ্চলে ছোপযুক্ত লাল বেলে পাথরের বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তি পাওয়া যায়। জামালপুরে প্রাপ্ত দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি, কলিকাতা যাদুঘরে রক্ষিত বুদ্ধমূর্তি কাটরায় প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি (লউ মিউজিয়াম), বোধগয়ার আসীন বুদ্ধমূর্তি মথুরা শিল্পের কয়েকটি নিদর্শন। কুষাণ যুগের স্থূলদেহ, এই শিল্পে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। গুপ্তযুগের মথুরা ভাস্কর্যের মুখমণ্ডলে বুদ্ধির দীপ্তি এবং অবয়বে সক্ষমতার ছাপ স্পষ্ট। সারনাথে গড়া বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলির অধিকাংশই সারনাথ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। এই সৃষ্টিতে বিদেশী প্রভাব প্রায় নেই। এখানে বুদ্ধের মূর্তির পাশাপাশি তাঁর জীবনের ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে যেমন ধর্মচক্র প্রবর্তন, মূর্তি নির্মাণের নতুন প্রয়াস দেখা যায়। পশিষ্যের সম্মুখে বুদ্ধের ধ্যাননেত্র, কল্যাণ বাণী প্রদানের ব্যাখ্যান মুদ্রাযুক্ত উপবিষ্ট মূর্তিগুলি অপূর্ব সৃষ্টি হিসেবে গণ্য হয়। বাম প্রান্তে শিশুসহ নারীমূর্তিটির কল্পনাও শিল্পীদের স্বকীয়তার পরিচায়ক। পাটলিপুত্রে নির্মিত বুদ্ধমূর্তিগুলিতে আধ্যাত্মিকতার সাথে আবেগের উয়তার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। ভাগলপুরের সন্নিকটে সুলতানগঞ্জে প্রাপ্ত তাম্র নির্মিত বুদ্ধমূর্তি এবং নালন্দায় প্রাপ্ত বিশাল ধাতুমূর্তিটির রূপসজ্জায় মথুরা ভাস্কর্যের অনুকরণ দেখা যায়। তবে অন্যান্য ভাস্কর্যে অপার্থিবতার সাথে মানবিকতার সামঞ্জস্য ঘটানোর অভূতপূর্ব প্রয়াস লক্ষণীয়। গুপ্তযুগে বুদ্ধমূর্তিকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্য সৃষ্টিতে প্রাধান্য দেওয়া হলেও, ভিলসা, উদয়গড়, দেওগড় প্রভৃতি স্থানে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে ভিত্তি করে ভাস্কর্য শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস দেখা যায়। দেওগড়ের হিন্দুদেবদেবীর মূর্তিগুলিকে মধ্যযুগের ভারতীয় ভাস্কর্যের পথপ্রদর্শক বলা যায়। গোয়ালিয়রের সূর্য মূর্তিটিও অনবদ্য। সাঁচিতে প্রাপ্ত হাত, পা ও মাথা বিযুক্ত বোধিসত্ত্ব মূর্তিটিকে গুপ্ত ভাষ্কর্যের একটি সূক্ষ্ম অথচ বলিষ্ঠ সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।
গুপ্তযুগে চিত্রকলাচর্চা উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল। কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকে চিত্রশালার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘রঘুবংশম্’ ও ‘মেঘদূতম্’ কাব্যেও ব্যক্তিগত চিত্রসংগ্রহশালার উল্লেখ আছে। সঙ্গীতের অনুসঙ্গ হিসেবে চিত্র-প্রদর্শনের সাহায্যে নৃত্য-গীত অনুশীলনের প্রথা গুপ্ত যুগে জনপ্রিয় ছিল। প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলা চর্চার গৌরবময় কেন্দ্র অজন্তার গুহাচিত্রগুলির একাংশ গুপ্তযুগে সম্পাদিত হয়েছিল। অজন্তার ছয়টি গুহায় (১০ নং, ১৬ নং, ১৭ নং, ১৯ নং ১ নং ও ২ নং) গুপ্তযুগের চিত্রচর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়। এর কয়েকটি চিত্রের দৃশ্যমানতা প্রায় শূন্য। তবে যেগুলি টিকে আছে সেগুলি অবশ্যই উন্নত চিত্রশৈলীর পরিচয় দেয়। অবশ্য টিকে থাকা দু’একটি চিত্র খুবই সাধারণ মানের। আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই চিত্রগুলি রূপায়িত সাধারণভাবে গৌতমবুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও জাতকের কাহিনী প্রাচীন চিত্রগুলির বিষয়বস্তু। ১ নং গুহায় বোধিসত্ত্ব পদ্মপানি অবলোকিতেশ্বরের মূর্তিটি সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর করুণাঘন দৃষ্টি অবনত, শান্ত দুটি চোখে বহুকালের বেদনাসঞ্জিত হয়ে আছে। জগত সংসারের দুঃখবেদনা তিনি উপলব্ধি করে কাতর। কিন্তু অসংখ্য অনুগামীর কাছে তাঁর ঠোঁট দুটি যেন সান্ত্বনার বাণী উচ্চারণ করে চলেছে। ২ নং গুহার চিত্রাবলী রং ও নির্মাণ শৈলীর বিচারে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুহাচিত্রগুলিতে রাজা, রাজপ্রসাদ, অন্তঃপুর, ভিক্ষুক, কৃষক, সন্ন্যাসী, কুলি থেকে নানা পশুপাখি, ফুলপাতা চিত্রায়িত হয়েছে। এই সকল গুহাচিত্র প্রকৃতিগতভাবে পার্থিব ও ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু এদের রূপায়ণের অন্তর্নিহিত নির্যাসে একটা ধর্মীয়ভাব লুক্কায়িত। জীবন সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং নিরাসক্তির সাথে আধ্যাত্মচেতনা যুক্ত করে এগুলিকে মহিমান্বিত করেছে। অজন্তার প্রায় একশো মাইল উত্তরে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের বাঘ-গুহা চিত্রগুলিতে অজন্তা চিত্রশৈলীর প্রবাহমানতা দেখা যায়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের বাঘ গুহা চিত্রগুলি তুলনামূলকভাবে বেশি জাগতিক ও মানবিক। কোন গভীর অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা চিত্রগুলির প্রকাশ জটিল করা হয় নি। একটি চিত্রে হাতির শোভাযাত্রার দৃশ্য অঙ্কিত আছে। কোনটিতে নৃত্য-গীতরতা নৃত্যশিল্পী ও গায়িকার চিত্র, ক্রন্দনরতা রমণী যুগল ইত্যাদি পার্থিব জীবনের চিরন্তন ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বেঞ্জামিন রোল্যান্ডের মতে, অজন্তা ও বাঘ-গুহার চিত্রাবলী অন্তর্নিহিত আবেগ ও অনুভূতির যথার্থ প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।
অগ্রণী সংস্কৃতির অন্যতম শর্ত হল উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা প্রসারের কাজে গুপ্ত রাজাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ সেই লক্ষ্য পুরণের কাজে অনেকটাই সফল হয়েছিল। সমুদ্রগুপ্ত স্বয়ং সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। একাধিক গুপ্তরাজা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনার কাজে আন্তরিক ছিলেন। শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য ছিল জ্ঞানার্জন, সামাজিক দায়বদ্ধতা বোধ এবং ধর্মমনস্কতা বৃদ্ধি প্রতিটি বিষয়েই গুপ্তযুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া হত। গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণরা বেদের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে শিক্ষা দানের কাজে রত থাকতেন। বিভিন্ন তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, রাজা ও ধনী ব্যক্তিরা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের নিষ্কর ভূমিদান (অগ্রহার) দ্বারা তাঁদের শিক্ষাদান কাজে, উৎসাহী ও সহায়তা করতেন। গ্রামাঞ্চলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের গৃহ, ঋষিদের আশ্রম ইত্যাদি শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে সক্রিয় ছিল। শহরাঞ্চলেও বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে নালন্দা ও বলভীকে কেন্দ্র করে দুটি বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার বিদ্যাচর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। পাঁচজন গুপ্তরাজা এবং জনৈক রাজা হর্ষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছয়টি বিহার গড়ে তুলেছিলেন। এগুলির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল বিশ্বখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদালয়। প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী বিনাব্যয়ে এখানে বৌদ্ধ সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয় যেমন তর্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, ষড়দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতেন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিদ্যাচর্চা করতে হত। বহু বিদেশী শিক্ষার্থীও নালন্দায় পাঠগ্রহণে আসতেন। নিঃসন্দেহে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্রের মর্যাদা অর্জন করেছিল।
গুপ্ত শাসনকালে ভারতে ধর্মীয় সহিষ্বতার বাতাবরণ জোরালো ছিল। এ. বি. কীথ-এর মতে, গুপ্ত রাজারা বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গুপ্তযুগের বিভিন্ন মুদ্রা, সীলমোহর এবং রাজাদের উপাধি গ্রহণ থেকে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, গুপ্ত রাজারা বৈষুবধর্মের অনুরাগী ছিলেন। বস্তুত গুপ্ত রাজাদের ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক না কেন, তাঁদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট উদার। গুপ্তযুগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পাশাপাশি শৈব, শাক্ত, কার্তিকেয়, গানপত্য ও সৌর (পঞ্চোপাসনা) ধর্মের অস্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা ছিল। ফা-হিয়েনের বিবরণ, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, প্রথম কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত প্রমুখের একাধিক লেখ, তাম্রশাসন ও মুদ্রা থেকে স্পষ্ট হয় যে, গুপ্ত আমলে প্রতিটি ধর্মমত স্বাধীনভাবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম ছিল। ধর্ম বিষয়ে গুপ্ত রাজাদের এই উদারতা ও সহনশীলতা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য সৃজনশীলতার প্রেক্ষিতে কোন কোন ঐতিহাসিক গুপ্ত শাসনাধীন ভারতের তিন শতককে (৩০০-৬০০ খ্রিঃ) সুবর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত এমন অভিধা প্রদানের ক্ষেত্রে আবেগের প্রাবল্য থাকলেও, গুপ্ত আমলে সাহিত্য-সংস্কৃতির যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। রাজনৈতিক সংহতি ও কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠার কাজেও গুপ্ত রাজারা সফল ছিলেন। মৌর্য্যোত্তর ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও বিদেশী শক্ শাসকদের ক্ষমতা নাশ করার কাজেও গুপ্তযুগের সাফল্য প্রশংসনীয়। বিদেশী শক্ শাসনের অবসানকে কেউ কেউ গুপ্তরাজাদের জাতীয়তাবাদী প্রেরণার পরিণতি বলেও প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা বা রাজনৈতিক সংহতি বিধানের প্রেক্ষিতে গুপ্ত আমলকে ভারত ‘সুবর্ণযুগ’ বলা সঠিক কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক আছে।
ডি. ডি. কোশাম্বী, ডি. এন. ঝা, রামশরণ শর্মা প্রমুখ ‘সুবর্ণযুগ’ সংক্রান্ত ধারণার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংশয় ব্যক্ত করেছেন। কোশাম্বীর মতে, গুপ্তদের শাসন জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা ঘটায়নি, বরং জাতীয়তাবাদী লেখকরাই বিংশ শতকের গোড়ায় গুপ্তযুগ সম্পর্কে একটা স্বর্ণময় স্বপ্নের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। ডি. এন. ঝা’র মতে, গুপ্ত রাজাদের সম্পর্কে প্রশংসা বর্ষিত হয়েছে শুধুমাত্র তাদের নিজ লেখগুলিতে। ব্রিটিশ লেখকরা ঔপনিবেশিক শাসনকে যুক্তিগ্রাহ্যতা দেওয়ার জন্য ভারতের ইতিহাসকে হানাদারের পর হানাদারের দখলদারির ইতিহাস বলে প্রচার চালাচ্ছিলেন। এর প্রত্যুত্তরে ভারতের জাতীয়তাবাদী লেখকরা গুপ্তশাসনকালকে ভারতের জাতীয়তাবাদী জাগরণ ও সংগ্রামের যুগ বলে প্রচার চালাতে থাকেন। এখান থেকে সুবর্ণযুগের ধারণাটি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে গুপ্তকালীন ভারতের সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে এমন কিছু সীমাবদ্ধতা বা সংকীর্ণতা বহমান ছিল, যেগুলি সুবর্ণযুগ তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত।
‘সুবর্ণযুগ’ অভিধা দ্বারা একটি সুখী, সমতাবাদী, শোষণমুক্ত প্রগতিশীল সমাজের অস্তিত্বকে নির্দেশ করা হয়। কিন্তু গুপ্তযুগে সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক জগতে বিকাশের ক্ষেত্রগুলি সর্বজনীন ছিল না। সমাজের উচ্চশ্রেণী সমকালের উন্নয়নের সুফল ভোগ করতেন। সাধারণ মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সাথে তাদের কোন যোগ ছিল না। গুপ্তযুগে সাহিত্যচর্চার সুফল ভোগের অধিকারী ছিলেন কেবল সমাজের উচ্চশ্রেণীর সংখ্যালঘিষ্ট মানুষ, ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা। কোশাম্বীর মতে ‘শ্রেণী বিশেষের দ্বারা (ব্রাহ্মণ) শ্রেণী বিশেষের জন্য (মূলত ব্রাহ্মণ) এই সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল’। সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাভোগী ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণী উচ্চবর্ণভুক্ত মানুষের বিলাসী জীবনের অনুসঙ্গ হিসেবে সাহিত্যসৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় (প্রাকৃত) সাহিত্য সৃষ্টি করে শ্রমজীবী মানুষকে আনন্দ দানের আদৌ প্রয়াস গুপ্তযুগের কবি-সাহিত্যিক নাট্যকারদের মধ্যে ছিল না। অবসর বিলাসী এই সকল মানুষ সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁদের সূক্ষ্ম চিন্তাকে যেভাবে প্রকাশ করতেন, তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে ছিল। সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল মূলত ধর্ম, দর্শন, মহাকাশতত্ত্ব ইত্যাদি। সমাজ জীবনের দৈনন্দিন চিত্র সাহিত্যে গুরুত্ব পায়নি। স্বভাবতই ভাষার বাধা কাটলেও গুপ্তযুগের সাহিত্যের বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অনুরণন তুলতে পারত না।
একটি আদর্শ সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক সাম্য, সহনশীলতা এবং ন্যায় বিচার। গুপ্তযুগের সমাজে এই সকল বৈশিষ্ট্যের অভাব ছিল স্পষ্ট। বর্ণভেদের কঠোরতা গুপ্তযুগে বৃদ্ধি পায়। বরাহমিহিরের রচনা, পুরাণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, চতুর্বর্ণের ব্যবধান স্পষ্টতর করার জন্য একাধিক সামাজিক নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। বাসগৃহের আকার, রঙ-এর ব্যবহার বর্ণভিত্তিক নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। যেমন শূদ্ররা দু’কক্ষের অধিক কক্ষবিশিষ্ট গৃহে বাস করতে পারত না। তাদের কালো রঙ-এর প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হত। শূদ্রের কাছ থেকে খাদ্যগ্রহণ ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের মধ্যেও পার্থক্যের কঠোরতা বেড়ে ছিল। কোন শূদ্র চণ্ডাল রমণীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকেও চণ্ডাল গণ্য করা হত। আগের তুলনায় গুপ্তযুগে অস্পৃশ্যতা প্রথা ব্যাপক ও কঠিনতর হয়েছিল। স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে চণ্ডালদের স্পর্শজনিত পাপের জন্য কঠোর প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেওয়া হয়েছে। সমকালীন সাহিত্যে চণ্ডালগণ অশুদ্ধ, লোভী, কলহপ্রিয়, কাম ক্রোধের অধীন, চোর ইত্যাদি দোষের আধার হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বৈশ্য, শূদ্র ও নারীদের হীনবংশজাত আখ্যা দিয়েছেন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে শূদ্রদের হিংস্র, মিথ্যুক, লোভী, অকৃতজ্ঞ, অশুদ্ধ, অলস এবং রাজার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন বলে চিত্রিত করা হয়েছে। মহাভারতের একত্র বলা হয়েছে যে, কেবল ব্রাহ্মণের সেবা আর ঈশ্বরে ভক্তির মাধ্যমে শূদ্রদের মোক্ষলাভ ঘটতে পারে। আইন ও বিচারের ক্ষেত্রেও শূদ্রদের বঞ্চিত করা হত। একটি স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে অপরাধ নির্ণয়ের জন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের পরীক্ষা হবে যথাক্রমে তুলাদণ্ড, অগ্নি ও জল দ্বারা, কিন্তু শূদ্রের ক্ষেত্রে বিষপান দ্বারা। উত্তরাধিকার আইনেও পক্ষপাতিত্ব ছিল। উচ্চবর্ণের কোন ব্যক্তির শুদ্র পুত্র সম্পত্তির সবচেয়ে কম অংশ পাওয়ার অধিকারী হতেন। কোন সামাজিক বিবাদ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে শূদ্রদের সাক্ষী দানের অধিকার ছিল না। কোন কোন স্মৃতিগ্রন্থে কেবল শূদ্রদের বিচারে শূদ্রদের সাক্ষ্যদান স্বীকৃত হয়েছে।
গুপ্তযুগে নারীদের সামাজিক মর্যাদা ছিল অধোগামী। নিয়মিত শিক্ষালাভের অধিকার নারীদের ছিল না। উচ্চবংশজাত সীমিত সংখ্যক নারী আচার্য বা শিক্ষাবিদের উল্লেখ সমকালীন সাহিত্যে পাওয়া গেলেও, অধিকাংশ নারী অনাদর, অবহেলা ও অপমানের মধ্যে জীবনযাপন করতে বাধ্য ছিলেন। বাল্যবিবাহ দানের প্রবণতা এযুগে বেড়েছিল। বিধবাদের কঠোর কৃচ্ছসাধনের মধ্যে বাঁচতে বাধ্য করা হত। সতীদাহ প্রথা আইনত স্বীকৃত ছিল। অবশ্য গুপ্তযুগে কেবল উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। মধ্যপ্রদেশের এরান থেকে সতীদাহ বিষয়ক প্রথম স্মারকটি (৫১০ খ্রিঃ) আবিষ্কৃত হয়েছে। পোষাক-পরিচ্ছদ, বিবাহকালে প্রাপ্ত অলংকার ও অন্যান্য উপহার (স্ত্রীধন) ছাড়া পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকৃত ছিল না। দেবদাসী নামক জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। এক কথায়, নারী স্বাধীনতা ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা গুপ্তযুগে ভীষণভাবে সংকুচিত হয়েছিল।
গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ ও ধর্মস্থানগুলিকে নিষ্কর ভূমিদান (অগ্রহার) প্রথার ক্রমবৃদ্ধি ভারতীয় সমাজে সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক আমদানি করে। ক্রমে ব্রাক্ষ্মণ বা ধর্মস্থানের পাশাপাশি রাজকর্মচারীদেরও অগ্রহার দান করা শুরু হয়। ক্রমে দান গ্রহিতা প্রাপ্ত জমির রাজস্বভোগের পাশাপাশি উক্ত জমিতে কৃষক (কর্ষক) নিয়োগ, রাজস্বের হার নির্ধারণ, রাজস্ব আদায় ইত্যাদি প্রশাসনিক ক্ষমতাও লাভ করে। এইভাবে বিচার ক্ষমতা, পুলিশি ক্ষমতা ও আর্থিক অধিকার দান গ্রহীতার হস্তগত হলে রাজশক্তিও যেমন দুর্বল হয়, তেমনি দান করা জমি ও গ্রামের বাসিন্দা ও কৃষকেরা অত্যাচারের শিকার হয়। নতুন ভূমিদান ব্যবস্থা মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর শোষণ-পীড়ন অনিবার্য করলে, কৃষকের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। কৃষকেরা প্রায়-ভূমিদাস শ্রেণীতে পরিণত হয়। মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিকতার আবির্ভাব গুপ্তযুগকে ‘সুবর্ণযুগ’ নামে আখ্যায়িত করার সাথে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। গুপ্তযুগের ভারত ‘সামন্ততান্ত্রিক’ ছিল কিনা, সে প্রশ্নে সংশয় হয়তো আছে, কিন্তু এই পর্বে সামন্ততান্ত্রিক উপাদানগুলি যেমন মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব, বাণিজ্যের অধোগতি, নগরের অবক্ষয়, মুদ্র অর্থনীতির ভাঙন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযোগী ছিল না।
গুপ্তযুগের রাষ্ট্র প্রান্তিক স্তরে শোষণ বন্ধের যথার্থ ব্যবস্থা নেয়নি, বরং তাকে সমর্থন করেছিল। তখন ‘বিষ্টি’ (বলপূর্বক খাটানো) নামক পীড়নমূলক প্রথা প্রচলিত ছিল। মৌর্য আমলে কেবল দাস ও ভাড়াটে মজুরদের জোর করে খাটানো হত। কিন্তু গুপ্তযুগে সব শ্রেণীর মানুষকে খাটানো শুরু হয়। বাৎসায়নের কামসূত্র থেকে জানা যায় কৃষক রমণীদের নানা কাজে বেগার খাটানো হত। রাজার সেনাবাহিনী যুদ্ধ যাত্রাকালে কেবল গ্রামে অবস্থান করলে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জোর করে তাদের জন্য অর্থ আদায় করা হত। এহেন পীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সুবর্ণযুগের মুকুট দেওয়া যায় না।
কেউ কেউ গুপ্ত শাসনকালকে ‘হিন্দু নবজাগরণের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। ড. এ. বি. কীথ গুপ্তযুগে ‘ব্রাষ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যুত্থান’ ঘটেছিল বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু কোন মতটিই যথার্থ নয়। অধ্যাপক ডি. এন. ঝা’র মতে, ‘হিন্দু’ কথাটির ব্যবহার ভ্রান্তিজনক। গুপ্ত পরবর্তী যুগে আরবগণ ‘সিন্ধু পারের বাসিন্দা’ বোঝাতে ‘হিন্দু’ (Indus) কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয়রা নিজেদের হিন্দু ভাবতেন না। গুপ্তযুগের ভাস্কর্য, চিত্রকলার মুখ্য বিষয়বস্তু ছিল বৌদ্ধমূর্তি এবং বুদ্ধের জীবন ও কর্ম সংক্রান্ত ঘটনা। জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে রোম ও গ্রীসের কার্যকরী প্রভাব ছিল। তথাকথিত হিন্দু নবজাগরণ তত্ত্বের ভিত্তি হল কালিদাসের রচনাবলী, পুরাণ, মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থের সংযোজন, স্মৃতিশাস্ত্রগুলির আবির্ভাব ইত্যাদি। কিন্তু এই ভিত্তি যুক্তিসিদ্ধ নয়। কালিদাস প্রাচীন সাহিত্য শৈলীকে নবরূপে, হয়তো বেশি আকর্ষণীয় রূপে, উপস্থাপিত করেছিলেন। অন্যদিকে গুপ্ত শাসনের বহু আগে থেকেই চারণ কবিদের গানে গানে পুরাণের কাহিনী লোকসমাজে পরিচিত ছিল। গুপ্তযুগে কয়েকটি পুরাণ সংকলনের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল মাত্র। একইভাবে শৈবধর্ম ও বৈঘ্নবধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিকেও গুপ্তযুগের কৃতিত্ব বা ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন বলা যায় না। শৈবধর্ম ও বৈষুববাদ বহুকাল আগে থেকেই ভারতে প্রচলিত ছিল। গুপ্তযুগে এদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র। ড. ঝা-এর মতে, ‘বহু প্রচারিত হিন্দু নবজাগরণ, আদৌ নবজাগরণ নয়, হিন্দু নবজাগরণ তো দূরের কথা।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুজ্জীবন বা পুনরুত্থান তত্ত্বটিও অতিরঞ্জিত এবং আবেগসর্বস্বতা দোষে দুষ্ট। বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কখনোই অস্তিত্ব শূন্য হয়নি। বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা ও প্রতিপত্তি কিছু সময়ের জন্য বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছিল মাত্র। অশোকের সময় থেকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তি বিস্তার এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে পশ্চাদপদ করেছিল। কিন্তু প্রাক্-গুপ্ত শুঙ্গদের আমলেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুনরায় শাসকশ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিল। ‘মহাভাষ্য’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, পুষ্যমিত্র দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন। কান্ব এবং সাতবাহন বংশীয় রাজারাও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী ছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের আগেই সাতবাহন রাজ সাতকর্ণী, বশিষ্টপুত্র; ইক্ষ্বাকু বংশীয় শ্রীচাতমূল; বাকাটকরাজ প্রথম প্রবর সেন; পল্লববংশীয় রাজা শিবষ্কন্দবর্মন প্রমুখ অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনার জোয়ারকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। প্রাক্-গুপ্তযুগেও সংস্কৃত ভাষার চর্চা চলত। তবে তার পূর্ব প্রতিপত্তি হয়ত ছিল না।
গুপ্তবংশের শাসনাধীন ভারতে খ্রিষ্টীয় ৩০০ থেকে ৬০০ অব্দকে ‘সুবর্ণযুগ’ অভিধা দানের ক্ষেত্রে সংশয় থাকলেও, আলোচ্য সময়কালের তাৎপর্য ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে রোমিলা থাপার এই তিন শতককে ‘পরিবর্তনের ভিত্তিভূমি’ (threshold time) বলে চিহ্নিত করেছেন। এশিয়া মহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচার করে দক্ষিণ-এশিয়ার পরিস্থিতিকে ‘অন্ধকারের মধ্যে আলোর ছটা’ হিসেবে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। পূর্ব এশিয়ায় চীনদেশের হান সাম্রাজ্য দীর্ঘকাল রাজত্ব করার পর ক্রমশ অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হয়েছিল। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার স্থানে চলে আসে তাং সাম্রাজ্য। কিন্তু আলোচ্য সময়ে তাং সাম্রাজ্যের ভিত্তি ততটা সুদৃঢ় হয়নি। অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ায় তখন ছিল সাসানীয় বংশের শাসন। কিন্তু সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে সাসানীয়দের সাফল্য তখনও অধরা। মধ্য এশিয়ায় হন উপজাতির উত্থান ও অগ্রগতি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বতন্ত্র্য্য। আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জগতে অগ্রগতি ছিল অব্যাহত। রাজনৈতিক স্থিতি সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার সহায়ক হয়েছিল। মননশীলতার চর্চা সর্বজনীন না হলেও, সমগ্র মহাদেশের প্রায় জড়বৎ অবস্থার মাঝে ভারত উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গতিশীলতা উপেক্ষণীয় ছিল না। জমিতে ব্যক্তি মালিকানার আবির্ভাব ও কৃষি সমাজের প্রসার, বৈষুব ভক্তিবাদ সহ পৌরাণিক ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মসম্প্রদায়ের পুনরুত্থান, ভারতে প্রাচীন যুগ থেকে আদি-মধ্যযুগে উত্তরণের সন্ধিক্ষণ ইত্যাদি উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে নতুন সম্ভাবনার বীজ রোপণ করেছিল, তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।