আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে ““অশ্বমেধের ঘোড়া নামক গল্পে সমাজের যে অবক্ষয়ী মনোভাব স্পষ্ট হয়ে বিশেষ হয়ে উঠেছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
“অশ্বমেধের ঘোড়া নামক গল্পে সমাজের যে অবক্ষয়ী মনোভাব স্পষ্ট হয়ে বিশেষ হয়ে উঠেছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করো
একালের এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রেম সম্পর্কিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন—‘প্রেম বলতে যা বুঝি এখন তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত। উদ্ভিটির মধ্যে কতখানি যৌক্তিকতা আছে তা তর্কাতীত, তবে একটা কথাই বলা যেতে পারে, মানুষের মধ্যেকার শাশ্বত চিরন্তন ধর্ম প্রেম নামক বিষয়ের যদি অবলুপ্তি ঘটে তাহলে মানুষ আর মনুষ্য পদবাচ্য নন। প্রেম অবশ্যই আছে তবে তার সংজ্ঞা ও স্বরূপ পালটেছে। আগ্রাসী আধুনিকত্বের ছোঁয়ার পাশ্চাত্যের সহজতায় গা ভাসিয়ে বোধ করি এই চিরন্তন শুদ্ধ বিষয়ের উপর কালিমা লিপ্ত হয়েছে। কাজেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মধ্যে সূচিত হয়েছে বিস্তর ব্যবধান।
এ গল্পের নায়ক কাঞ্চন কলেজ শিক্ষক, ভালোবাসে রেখাকে। তবে রেখা কী করে গল্পে তা স্পষ্ট না হলেও সে যে কাঞ্চনের ছাত্রীতুল্য এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসে, কাছে পেতে চায়, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে উদগ্রীব হয়ে আছে। তবে তাদের সম্মুখে একটাই বাধা সমাজ-সংসার, গুরুজন। তবে কেন এই বাধা তাও অস্পষ্ট। যে কারণেই হোক তারা এক সাথে সবার অগোচরে, কোলাহল মুখর রাজপথে, পার্কে গঙ্গার তীর প্রভৃতি স্থানে বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া অন্য কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হতে এখনো পারেনি। শুধু বিনিময় হয়েছে নীরব সম্মতি, আর অগুচ্ছ মনের কথা।
কাঞ্চন সর্বদা ব্যাকুল হয়ে পড়ে কবে রেখাকে সে বিয়ে করবে, কবে তাকে বউ বলে ডাকবে, আর একান্ত অনুগতের ন্যায় তার দুবাহুর বন্ধনে এসে ধরা দেবে। কিন্তু শত আগ্রহ সত্ত্বেও তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই তো ঘুরে বেড়ানোর সময় যদি কোথাও লাউড স্পিকারে সানাইয়ের শুর শুনতে পায়, তারা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ওই বুঝি তাদের বিবাহের সানাই বেজে উঠছে। এমনিভাবে একদা ঘুরে বেড়ানোর সময় সানাই-এর সুরে কাঞ্চন বড় ব্যাকুল হয়ে পড়ে রেখাকে নিজের করে পেতে। ইচ্ছা হল ফুলওয়ালীর কাছ থেকে এক ছড়া ফুলের মালা কিনে নিয়ে রেখার খোঁপাতে পরিয়ে দেয় কিন্তু বিশেষ সংকোচবশত তা বাস্তবে সম্ভব হয় না। তবে কাঞ্চনের মনের কথা রেখার কাছে অজানা রইল না, রেখা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ফুলের মালা কিনে কাঞ্চনকে দেয় তার খোঁপাতে পরিয়ে দিতে, কাঞ্চন অপেক্ষায় থাকে কখন নির্জন স্থান আসবে সেইখানেই সে মালা পরাবে।
নির্জন স্থান হিসাবে গঙ্গার ধারকে তারা বেছে নেয়। যানবাহান হিসাবে ২ টাকা ৫০ পয়সা ভাড়া একটা ঘোড়া গাড়িতে তারা বসে পড়ে। বড়ো কাছাকাছি তারা, ঘোড়ার পায়ের শব্দে তাদের কথাবার্তা মিশে এক অপূর্ব প্রেমময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারপর নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গাড়ির পর্দা ফেলতেই একেবারেই নির্জন ঘরের রূপ নিল। ধীরে ধীরে তারা আরও কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু নীরবতার হাত থেকে তাদের মুক্তি নেই। যে সময়টার জন্যে এযাবৎ তারা অপেক্ষা করছিল, আকাশের বৃষ্টিধারা সেই সুযোগ করে দিলেও মনের দুর্বলতা আর কাটতেই চায় না। প্রাকৃতিক নিয়মে অবশেষে বড়ো কাছাকাছি চলে আসা সম্ভব হয়। কাঞ্চন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বউ বলে সম্বোধন করে রেখাকে, রেখাও তাকে ‘স্বামীন’ বলে ডাকে অনুচ্চস্বরে।
কখন তারা গাড়িতে গঙ্গার তীরের কাছে চলে এসেছে খেয়াল নেই। গাড়োয়ানের কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট হয়ে যায়। মালা পরানোর বিশেষ মুহূর্তটি আর শেষ হয়না। গাড়ি থেকে নেমে এসে ২ টাকা ৫০ পয়সা ভাড়া হিসাবে দিতে গেলে গাড়োয়ান তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে “পাঁচ টাকার কম হবে না।…ফূর্তি করবেন, হোটেল ভাড়া কী দেবেন না ?” গাড়োয়ানের একথা শুনতেই “রেখা চমকে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরতে যাওয়ায় মালাটা হাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেল।” তারপর সমস্ত ক্রোধ সম্বরণ করে পায়ে পায়ে দুজনে এগিয়ে গিয়েছিল। “কারণ একান্তে কাঁদবার মতো কোনও আশ্রয় তাদের জানা ছিল না।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ ইচ্ছার প্রতিকূলতার গমন করে তাদের মনের মধ্যেকার সুখ পাখিটাকে কীভাবে কঠোর যন্ত্রণার দ্বারা নিঃশ্বেষ করতে বসেছে দিনের পর দিন তার স্বরূপ ব্যাখ্যা প্রদানে এ গল্প বিশেষ সার্থকতা অর্জন করেছে। লেখকের দৃষ্টিতে প্রেম নামক অনুভূতিটা আজ হয়ে উঠেছে পুরাণের অশ্বমেধের ঘোড়া। লেখক জানিয়েছেন—“স্বর্গের উচ্চৈঃশ্রবা এখন ধর্মনিরপেক্ষ কলকাতার মাঠে পাটোয়ারি বুদ্ধিতে বাজি দৌড়ায়। আর যে যজ্ঞের অশ্বকে ফিরিয়ে আনতে ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গা এনেছিল, মাত্র আড়াই টাকার বিনিময়ে সে আমাদের খিদিরপুর পৌঁছে দেবে।” অর্থাৎ দিনে দিনে যে প্রেমের সংজ্ঞা পালটেছে, পালটাচ্ছে সে বিষয়ে নিশ্চিত।
আজ একবিংশ শতকের পাদলগ্নে এসে লেখকের বিশেষ অনুভূতি—“প্রেম আমাদের লজ্জা, আমাদের যন্ত্রণা। আরও জানিয়েছেন—“পৃথিবী বদলায়, জীবন বদলায়, আমাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, মনে মনে আমরা আরও দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছি, অথচ সেই মৌলিক ছকের ওপর খুঁটির মতো এগোচ্ছি, পেছোচ্ছি।” অর্থাৎ সমাজের সর্বত্র জুড়ে চলেছে অবক্ষয় আর অবক্ষয়, নেই কোথাও আশার প্রতিচ্ছবি, প্রেমও ক্রমেই হয়ে পড়েছে বিবর্ণ, পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরেছে অসংখ্য বাধার শৃঙ্খল। চাইলেও প্রত্যাশা পূরণ অসম্ভব, কোথাও নেই এতটুকু মুক্তি। তাই অশ্বমেধের গর্বিত দুরন্ত ঘোড়াকেও সময়ের নিষ্ঠুর শাসনে একদা বাঁধা পড়তে হয়। জানা নেই এর শেষ কোথায়
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।