আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বঙ্কিম সাহিত্যে স্বদেশচেতনার প্রভাব ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ প্রকাশিত মনোভাব অবলম্বনে আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বঙ্কিম সাহিত্যে স্বদেশচেতনার প্রভাব ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ প্রকাশিত মনোভাব অবলম্বনে আলোচনা করো
বঙ্কিম সাহিত্যের স্বদেশ চেতনার উৎসভূমি তাঁর ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস এবং তার সার্থক প্রকাশ দেখি ‘কমলাকান্তের—যার পরিণতিতে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস। এর মাঝে রয়েছে প্রচ্ছন্ন স্বদেশ প্রেমের উপন্যাস ‘সীতারাম’, ‘দেবী চৌধুরানী’ এবং ‘রাজসিংহ’। বঙ্কিমচন্দ্রের মানবপ্রীতি এবং স্বদেশপ্রীতি পরস্পরের পরিপূরক।
ইতিপূর্বে বিবিধ প্রবন্ধ এবং ‘লোকরহস্যের’ প্রবন্ধগুলিতে দেশপ্রেমের তীব্রতা যথেষ্ট গভীর ছিল। ‘ভারতকলঙ্ক’, ‘বঙ্গদেশে কৃষক’, ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা’, ‘হনুমদ্বাবু সংবাদ’ ইত্যাদি রচনায় কখনও ব্যঙ্গের ছলে কখনও তীব্র ও বেদনা মিশ্রিত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশ ভাষা পেয়েছে: কমলাকান্তের ‘একটি গীত’ ও ‘আমার দুর্গোৎসবে’ সেই আবেগ-আকুল দেশপ্রেম উন্মত্ত উদাত্ততায় গীতিময় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ‘একটি গীত’ রচনায় আবেগ যেন পরিণত হয়েছে এক দিগন্তব্যাপী হাহাকার চাহিদার এক শ্মশানভূমি আছে—নবদ্বীপ। ….বঙ্গমাতাকে মনে পড়িলে, আমি সেই শ্মশান-ভূমির প্রীতি চাই…কলাধৌতবাহিনী গঙ্গা ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করি— তুমি আছ, সে রাজলক্ষ্মী কোথায় ? তুমি যাহার পা ধুয়াইতে ; সেই মাতা কোথায়…”.
বাঙালি গৌরবের ইতিহাস রচনার প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের অভিনিবেশ তার নানা রচনায় প্রকাশিত। মাত্র সপ্তদশ অশ্বরোহী সমগ্র বাংলা অধিকার করেছিল এই অলীক কল্পনায় বিশ্বাস ছিল না তাঁর। “আমার দুর্গোৎসবে” যে মাতৃমন্ত্র ধ্বনিত তা পূর্ণতা লাভ করেছে “আনন্দমঠের” মাতৃকল্পনার মধ্য দিয়ে। আনন্দমঠের সন্তানদের পূজা দেশ জননী পরিকল্পিত হয়েছেন দশভূজা মূর্তিতেই। কমলাকান্ত লিখেছেন—“চিনিলাম, এই আমার জন্মভূমি………রত্ন মন্ডিত দশ ভুজ—দশ দিক্-দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমৰ্দ্দিত…. বীরজন কেশরী শত্রু নিষ্পীড়নে নিযুক্ত।
‘একটা গীত’-এ যেমন বৈষ্ণব কবিতার সীমাবদ্ধ জগৎ অতিক্রম করে কমলাকান্তের দেশপ্রেম দূর প্রসারিত, তেমনি ‘আমার দুর্গোৎসবেই” হিন্দু-দেবী নির্ভর স্বদেশ ভাবনা সামগ্রিক দেশপ্রেমে পরিণত হয়েছে। “মনুষ্য ফল”, “বাঙালির মনুষ্যত্ব”, “পলিটিক্স” ইত্যাদি রচনায় বীর্যহীন আবেদন—নিবেদন—কেন্দ্রিয় ছদ্ম দেশপ্রেমের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন তিনি। কুক্কুর জাতীয় পলিটিকস্-এর প্রতি ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছে। “পলিটিকস” রচনায়। “মনুষ্য ফল”-এ লিখেছেন। “এ দেশে একজাতীয় লোক সম্প্রতি দেখা দিয়েছেন, তাঁহারা দেশহিতৈষী বলিয়া খ্যাত। তাঁহাদের শিমূল ফুল ভাবি।” এই ব্যঙ্গের পাশাপাশি ‘মনুষ্যফলে’ স্পৰ্ষতঃই ঘৃণার প্রকাশ—“বাঙালি হইয়া কে ঘ্যান ঘ্যানানি ছাড়া? কোন্ বাঙালির ঘ্যান ঘ্যানানি ছাড়া অন্য ব্যাবসা আছে?”
বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশ কোনো বিমূর্ত কবি-কল্পনা নয়। তা পূর্ণতা পেয়েছে দেশের মানুষ, ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। “ঢেঁকি” রচনাতে দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন কমলাকান্ত লিখেছেন—“সর্বাপেক্ষা ভয়ানক দেখিলাম লেখক ঢেঁকি–সাক্ষাৎ মা সরস্বতীর মুন্ড ছাপার গড়ে পিষিয়া বাহির করিতেছেন স্কুলবুক।” সাহিত্যের বড়োবাজারে বাংলা সাহিত্যিক খবরের কাগজে জড়ান কতগুলি অপক্ব কদলী রূপে’ দেখেও কমলাকান্ত একই রকম প্রচ্ছন্ন কৌতুকের আড়ালে বেদনা বিদ্ধ হয়েছিলেন। স্বদেশি শিক্ষা, স্বদেশি সাহিত্যের এই অসারতা উপলব্ধি কমলাকান্তরূপী বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রীতিরই নিদর্শন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।