উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক ও গ্রীক আক্রমণ : পারসিক অভিযানের প্রভাব

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক ও গ্রীক আক্রমণ : পারসিক অভিযানের প্রভাব” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক ও গ্রীক আক্রমণ : পারসিক অভিযানের প্রভাব

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে উত্তর-পূর্ব ভারতে মগধের নেতৃত্বে যখন সাম্রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল, তখন উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বস্তুত এই সময় উত্তর-পশ্চিম ভারত এই উপমহাদেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কোন বৃহত্তর সাম্রাজ্য বা কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা উত্তর-পশ্চিমে ছিল না। কম্বোজ, গান্ধার, মদ্র ইত্যাদি একাধিক ছোট ছোট রাজ্যের অবস্থান এবং তাদের মধ্যে নিরন্তর যুদ্ধ-বিগ্রহ উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল। এই অনৈক্য ও অস্থিরতার সুযোগ নেয় পারস্যের আকামেনিড (Achaeminian) রাজবংশ। পারস্যের আকামেনিয় সম্রাট কুরু (কাইরাস) পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অভিযান চালান। তাঁর আমলে (খ্রিঃপূঃ ৫৫৮-৫৩০ অব্দ) হিন্দুকুশ ও গান্ধার অঞ্চল পারস্যের অধীনস্থ হয়েছিল।

মূলত গ্রীক ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে ভারতে পারসিক ও গ্রীক অভিযানের কাহিনী জানা যায়। রোমান লেখক প্লিনি’র রচনাও এক্ষেত্রে সাহায্য করে। এছাড়া পারস্য সম্রাট দারায়ুষ (ড্যারিয়াস)-এর কিছু লেখ যেমন— বেহিস্তান লেখ (আনুঃ খ্রিঃ পূঃ ৫২০-১৮ অব্দ), পার্সিপোলিস লেখ (খ্রিঃপূঃ ৫১৮-‘১৫ অব্দ), নকস্-ই রুস্তম লেখ (খ্রিঃ পূর্ব ৫১৫ অব্দ), সুসা প্রাসাদ লেখ ইত্যাদি থেকেও পারস্যের ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায়। তবে গ্রীক লেখকদের বক্তব্যের মধ্যে কিছু অস্পষ্টতা বা বিরোধ আছে।

বিশিষ্ট গ্রীক পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস এবং টিসিয়াস, জেনোকান প্রমুখের মতে, পারস্য সম্রাট কুরু তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল জয়ের মাধ্যমে পশ্চিম বৃহত্তর পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে ভারতের যোগ ঘটিয়েছিলেন। সম্রাট কুরু পূর্বমুখে ড্রাঙ্গিয়ানা (সিস্তান) এবং গান্ডারাইটিস অর্থাৎ গান্ধার অঞ্চল দখল করেছিলেন। হেরোডোটাস লিখেছেন গান্ধার ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের বিংশতিতম প্রদেশ। আকামেনিয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় গান্ধার ছিল বেশী জনাকীর্ণ এবং সমৃদ্ধ। সমকালীন গ্রীক লেখক জেনোফোন-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কুরু ব্যাকট্রিয় ও ভারতীয়দের তাঁর শাসনাধীনে এনেছিলেন এবং ভারত মহাসাগর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল। তিনি আরও লিখেছেন যে, জনৈক ভারতীয় রাজা কুরুর কাছে দূত প্রেরণ করে সম্ভবত কর বাবদ কিছু অর্থ দিয়ে পারস্য সম্রাটের অধীনতা মেনে নিয়েছিলেন। রোমান লেখক প্লিনি উল্লেখ করেছেন যে, কুরু ঘোরবন্দ উপত্যকার কপিশ (কাক্রিস্থান) নগরটি দখল করতে সক্ষম হন। টিসিয়াস-এর মতে, কুরু একটি উপজাতির সাথে যুদ্ধকালে মৃত্যু মুখে পতিত হন।

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ম্যাসিডোনীয় আক্রমণ সম্পর্কে লিখিত গ্রীক বিবরণীতে ভিন্নমত প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে নিয়ারকস ও মেগাস্থিনিসের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ারকসের মতে, সম্রাট কুরু বেলুচিস্তানের (গেড্রোসিয়া) মধ্য দিয়ে ভারত অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে উপজাতিদের আক্রমণ তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। অন্যদিকে গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস লিখেছেন যে, হেরাক্লেস, ডায়োনিসাস এবং পরবর্তীকালে ম্যাসিডোনীয়গণ ছাড়া কোনো বিদেশী দ্বারা ভারত আক্রান্ত হয়নি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পারসিকগণ ভারতের অধিবাসী ক্ষুদ্রকদের ভাড়াটে সেনা হিসেবে গ্রহণ করেছিল (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬/৮৫ অব্দ)। গ্রীক লেখক এ্যারিয়ানও মনে করেন যে, গ্রীকদের আগে কোনো বিদেশী শক্তি দ্বারা ভারত আক্রান্ত হয় নি।

এই বিতর্কের একটা যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান পাওয়া যায় ড. দীনেশচন্দ্র সরকারের বিশ্লেষণে। ড. সরকার মনে করেন যে, ভারতের পশ্চিম সীমান্ত সম্পর্কে ভ্রান্তি থেকেই এই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। নিয়ারকস এবং মেগাস্থিনিস সিন্ধুনদকে ভারতের পশ্চিমতম সীমান্ত মনে করেছিলেন। এটিও ঘটনা যে কুরু সিন্ধুনদের প্রান্ত পর্যন্ত ভুখণ্ড দখল করেছিলেন। লক্ষণীয় যে সিন্ধুনদ ও কাবুলনদের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের ওপর কুরুর আধিপত্য বিস্তারের কথা স্বয়ং এ্যারিয়ানও স্বীকার করেছেন। এমনকি এই বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীরা পারসিকদের নিয়মিত কর দিতে বাধ্য হয়েছিল। পণ্ডিত ই. মেয়ের (E. Meyer) যথার্থই লিখেছেন যে, সম্ভবত কুরু হিন্দুকুশ ও কাবুল উপত্যকার উপজাতিদের এবং নির্দিষ্ট ভাবে গান্ধারদের জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সাফল্যের সূত্র ধরে পরবর্তীকালে দারায়ুষ (ড্যারিয়াস) সিন্ধুনদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন।

কুরুর পরবর্তী পারস্য সম্রাট ক্যামবাইসিস বা কম্বুজ (খ্রিঃ পূঃ ৫৩০-৫২২ অব্দ) সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় এতটাই বিব্রত ছিলেন যে, সিন্ধুনদের দিকে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কর্মসূচী নিতে পারেন নি। তাঁর পরবর্তী শাসক দারায়ুষ বা ড্যারিয়াসের আমলে (খ্রিঃ পূঃ ৫২২-৪৮৬ অব্দ) ভারত অভিমুখে পারসিক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কাজে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়।

ড্যারিয়াসের বিভিন্ন লেখ এবং গ্রীক ইতিহাসকারদের রচনা থেকে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে পারসিক অভিযান ও সাফল্যের কাহিনী জানা যায়। তাঁর পার্সিপোলিস লেখ ও নক্‌ক্স-ই-রুস্তম লেখতে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলকে পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সিন্ধু ও গান্ধার অঞ্চল দুটির ওপর পারস্য সম্রাটের কর্তৃত্বের উল্লেখ আছে। হামাদান স্বর্ণ ও রৌপ্য ফলক লেখতেও সিন্ধুকে পারসিক সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস কর্তৃক ‘ইন্ডিয়া’ (সিন্ধু বা ইন্দুস) কে দারায়ুষের আধীন পারস্য সাম্রাজ্যের বিংশতিতম প্রদেশ বলে উল্লেখ ওপরের মতকেই সমর্থন করে। তিনি লিখেছেন যে, পারস্য সাম্রাজ্যের মোট রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ ‘ইন্দুশ’ থেকে আসত। এর ভিত্তিতে এ. এল. ব্যাসাম বলেছেন যে, সম্ভবত পাঞ্জাবের নদী বিধৌত উর্বর এলাকার অনেকটাই পারসিকদের অধিকারভুক্ত ছিল। হেরোডোটাসের রচনা থেকে আরও জানা যায় যে সিন্ধুর অববাহিকা অঞ্চলে অনুসন্ধানের জন্য দারায়ুষ স্কাইল্যাক্সের নেতৃত্বে একটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন (খ্রিঃপূঃ ৫১৭ অব্দ)। এর পরেই তিনি অভিযান চালিয়ে নিম্ন সিন্ধু ও পাঞ্জাবের কিছুটা অংশ দখল করে নেন। ড্যারিয়াসের আমলে ভারতে পারসিকদের অধিকৃত অঞ্চলগুলির নাম অ্যাকামেনিয় লেখাতে পাওয়া যায়। এগুলি হল—ব্যাকট্রিয়া (বল্‌ল্খ), এ্যারিয়া (হেরাত/হিরাট), ড্রাঙ্গিয়ানা (জারাঙ্কা), আরাকোসিয়া (কান্দাহার), গেড্রোসিয়া (মাকরান), সাট্টাগিডিয়া (সঠিক এলাকা নিশ্চিত নয়), সগড়িয়ানা (সুগুড) ইত্যাদি। অর্থাৎ ভারতীয় পারসিক সাম্রাজ্যের অধীন এলাকা ছিল সিন্ধু, ভারতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এবং সিন্ধুর পশ্চিম তীরবর্তী পাঞ্ঝাবের একাংশ।

পারসিক অভিযানের প্রভাব :

ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে প্রায় দুশো বছর পারসিক আধিপত্য স্থায়ী হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে বৃহত্তর ভারতের সমাজ বা রাজনীতির ওপর এই পারসিক শাসনের ব্যাপক বা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব না-থাকাই স্বাভাবিক। সিন্ধুনদ ও কাবুল নদের মধ্যবর্তী ছোট ভূখণ্ডের বাইরে পারসিকদের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল না। পারস্যের অধীনস্থ অঞ্চলের জনসমাজকে উত্তর ও পূর্ব ভারতের ব্রাক্ষ্মণ সমাজ অপবিত্র বলে মনে করতেন। স্বভাবতই ভারতের রাজনীতি বা সমাজ জীবনের ওপর পারসিক শাসনের দৃঢ় ও প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল ক্ষীণ, তবে শূন্য নয়। ডি. বি. স্পুনার, মার্টিমার হুইলার প্রমুখ ভারতীয় শাসন কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সাথে পারসিক শাসনের যোগ খুঁজে পেয়েছেন। বস্তুতই ভারতের শিল্পস্থাপত্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, এমনকি রাজনীতির ওপরেও পারসিক শাসনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

সিন্ধুপারের অঞ্চলকে ‘হিন্দু’ নামে পারসিকরাই প্রথম অভিহিত করে (ইন্দুস (Indus) > হিন্দুস > হিন্দু)। পারসিকরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে ‘ক্ষত্রপ’ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, পরবর্তীকালীন ভারতীয় শাসকেরা, বিশেষত শক্ ও কুষাণ আমলে, তার প্রয়োগ দেখা যায়। মৌর্য সাম্রাজ্য ও শাসন ব্যবস্থার ওপর পারস্যের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। পারস্যের সম্রাটরা সমুদ্র থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। পারস্যের এই বিশালাকার সাম্রাজ্যের দৃষ্টান্ত মৌর্য শাসকদের উৎসাহিত করেছিল। বিম্বিসার থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পর্যন্ত রাজন্যবর্গ পারস্যের দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়েই মগধ সাম্রাজ্যবাদের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। মৌর্য সম্রাটেরা, বিশেষত চন্দ্রগুপ্ত অবশ্যই পারসিকদের অতীত যোগ থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। ম্যাসিডোনিয়ার সাথে পারসিকদের সংঘাতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুফল মৌর্যদের স্বপক্ষে বর্ধিত হয়েছিল। গ্রীক আক্রমণের মুখে পারসিকরা ভারতকেই তাদের নিরাপদ আশ্রয় মনে করে এদেশে এসে ভারতীয় শিল্প-স্থাপত্যকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছিলেন। মৌর্য শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কেন্দ্রীকরণ প্রবণতা। পারস্যের আকামেনিয় সরকারের কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টান্ত মৌর্য শাসকদের প্রভাবিত করেছিল। বলে মন করা হয়। হুইলার মন্তব্য করেছেন যে, ভারতীয় অঞ্চল অধিকার করে পারস্য ভারতকে কেবল শাসক দেয়নি, নতুন ভাবধারাও দিয়েছে।

মৌর্যদের দরবারী আচার-অনুষ্ঠানের ওপর পারসিক রাজকীয় আদব-কায়দার প্রভাব স্পষ্ট। প্রাসাদে নারী-রক্ষী নিয়োগ, রাজার দেহরক্ষী পদে নারীদের অগ্রাধিকার, রাজার কেশচর্চা, প্রাসাদের অভ্যন্তরে পূতাগ্নি প্রজ্জ্বলিত রাখা ইত্যাদি পারসিক দরবারের অনুকরণেই নেওয়া হয়েছিল। নারীরক্ষী পদে পারসিক রমণীদের অগ্রাধিকার পারসিক প্রভাবের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

ভারতের সাথে পাশ্চাত্যের যোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবেও পারসিক ভারতীয় সাম্রাজ্যের ভূমিকা লক্ষণীয়। The Achaemenids and India শীর্ষক প্রবন্ধে সুধাকর চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে, গ্রীক, শক বা কুষাণদের তুলনায় আকামেনিড শাসকেরা ভারতের রাজনীতিতে কম সাফল্য পেয়েছিলেন। তবে ভারতের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ ঘটানোর কাজে তাদের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। পারসিকরা ভারতের সোনা-রূপা স্বদেশে রপ্তানি করে ভারতবর্ষ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। ভারতীয় উপজাতি গোষ্ঠীর শ্রমশক্তির ব্যবহারও পাশ্চাত্যের অন্যতম আকর্ষণের কারণ হয়েছিল। পারস্যের সেনা বাহিনীতে ভারতীয়দের সৈনিক হিসেবে নিয়োগ ভারত সম্পর্কে গ্রীকদের ঔৎসুক্য বৃদ্ধি করে। পারস্যের শাসক জারাক্লেস এবং তৃতীয় ড্যারিয়াস ভারতীয় সেনাদের সাহায্যে গ্রীকদের আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি আলোকজান্ডার কর্তৃক পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণের সময়েও ভারতীয় সেনাদের অংশগ্রহণ ঘটেছিল। এই ঘটনা ভারতবর্ষ সম্পর্কে গ্রীকদের এবং বিশেষ করে আলেকজান্ডারের আগ্রহ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল। এই বিচারে পারস্য ভারত ও গ্রীসের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছিল।

গ্রীকবীর আলেকজান্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে ইরানের সুখ্যাত পার্সিপোলিস নগরী বিধ্বস্ত করে দেন। এই ঘটনা পরোক্ষে ইন্দো-পারসিক সম্পর্ক এবং ভারতীয় শিল্পকলাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। গ্রীক আক্রমণের পরে বহু পারসিক শিল্পী আশ্রয়চ্যুত হয়ে ভারতে চলে আসেন এবং বসবাস শুরু করেন। পারসিক শিল্পধারার সংস্পর্শে এসে ভারতীয় শিল্পভাবনা সমৃদ্ধ হয়। রোমিলা থাপারের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালেখর প্রেরণা সম্ভবত পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুসের শিলালিপি থেকেই এসেছিল। হুইলারের মতে, সম্রাট অশোকের স্তম্ভগুলির মধ্যে পারসিকদের শিল্পকুশলতার প্রভাব দেখা যায়। অশোকের আমলে নির্মিত স্তম্ভগুলির অপূর্ব পালিস পারসিকদের অবদান। সারানাথের স্তম্ভে সিংহমূর্তির সংযোজন পারসিক শিল্পধারা থেকেই গৃহীত হয়েছিল। শিলাখণ্ডের ওপর বাণী খোদাই করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া পারসিক শাসকদের একটি প্রচলিত ও জনপ্রিয় রীতি। মৌর্য সম্রাট অশোক পারস্যের অনুকরণেই শিলাখণ্ডে তাঁর বাণী খোদাই করেছিলেন। অশোকের লেখমালার ভুমিকার সাথে পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুষের লেখনীর মিল দেখা যায়। অশোকের শিলালেখতে ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন ‘দিপি’ (অনুশাসন) ও ‘নিপিষ্ট’ (লিখিত) পারসিক শব্দ থেকেই গৃহীত। উত্তর-পশ্চিম ভারতে অশোকের শিলালেখগুলিতে মূলত ‘খরোষ্ঠী’ লিপি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘খরোষ্ঠী’ লিপি পারস্যের ‘অ্যারামাইক’ লিপি থেকে নেওয়া হয়েছে বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা। ধর্মভাবনার ক্ষেত্রেও পারসিক শাসনের প্রভাব দেখা যায়। রোমিলা থাপার লিখেছেন যে, ভারতের বৌদ্ধ ধর্মদর্শন এবং পারস্যের জরথুস্ট মতবাদ পরস্পরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথমে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব গিয়ে পড়ে পারসিক ধর্ম ও দর্শন তত্ত্বের ওপর। পরবর্তী পর্যায়ে পারসিক ধর্মতত্ত্বের দ্বারা মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত হয়েছিল।

ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রেও পারসিক শাসনের কিছু সুফল লক্ষ্য করা যায়। দারায়ুষের ‘সুসা’ প্রাসাদ লেখ থেকে জানা যায় যে, ভারতের সেগুনকাঠ ও হাতির দাঁতের তৈরী নানা সৌখিন পণ্য পারস্যে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। এই সকল পণ্য পারস্যে রপ্তানি করার ফলে ভারতের কারিগর ও বণিক শ্রেণী লাভবান হন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিপুল পরিমাণে পারসিক মুদ্রা পাওয়া গেছে। এ থেকে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের আভাস পাওয়া যায়। অনেকের অনুমান পারস্যের সাথে ভারতের সংযোগের সূত্রে এদেশে মুদ্রা সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট রূপ পেয়েছিল। পারস্য থেকে স্বর্ণমুদ্রা ‘দারিক’ এবং রৌপ্যমুদ্রা ‘সিগলোই’ ভারতে এলে এদেশে মুদ্রা ব্যবস্থা বিষয়ে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। পারস্যের অনুকরণে ভারতেও ‘সিগলোই’ ধরনের মুদ্রা তৈরী শুরু হয়। ভারতে পারসিক অভিযানের আগেই লোহার সাথে এই উপমহাদেশের পরিচয় ঘটেছিল। কিন্তু লৌহ-ধাতুর ব্যাপক ও কার্যকরী ব্যবহারের ক্ষেত্রে পারসিকদের বিশেষ অবদান আছে। মার্টিমার হুইলার মনে করেন, পারস্যের সাথে সংযোগের সূত্রে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালে ভারতে লোহার বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment