জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটি আসলে একটি প্রেমবঞ্চিতা নারীর করুণ কথার কাব্যরূপ। অনিঃশেষ প্রেমের আর্তি কবিতাটিতে কীভাবে অবয়বিত হয়েছে তার পরিচয় দাও

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “nn” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

২০০৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা একটি নিবন্ধে জয় গোস্বামী প্রেম সম্পর্কে তাঁর একটি নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, “প্রেমেই তো মনে হয় আবার নতুন করে জন্মালাম। মানুষ তখন তার পার্থিব অসংগতি, তার সাংসারিক তুচ্ছতা, তার অর্থাভাব,—সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যায়। অহংকার আলো করে রেখে দেয় তাকে, যতই তার জামা মলিন হোক না কেন। সন্ধ্যা হতে দেয় না সেখানে।” প্রেমের এই চিরায়ত হার্দিক অনুভূতিটিই বাংলা কবিতার সাম্প্রতিকতম কবিগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও গতিময় করে রেখেছে জয় গোস্বামীকে। দুই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আধুনিক নৈরাশ্যবাদীতার ধারা এবং তৎপরবর্তী ক্রমক্ষয়িষ্ণু, পরাজিত, নৈরাজ্যময়তায় পূর্ণ এ পৃথিবীর পঙ্কিলতায় তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রেমের সঞ্জীবনী সুধা।

‘আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো’ কাব্যগ্রন্থের ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটিও একটি প্রেম কবিতাই। মানব-মানবীর চিরন্তন অথচ অনিবার্য এই বোধ অজস্র প্রতিকূলতার মাঝখানেও এক ধরনের জৈবিক স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রাখে। তবে জয় গোস্বামী দেখিয়েছেন, আধুনিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রেমের এই বিকাশ ও অনেকখানি ব্যহত। তাই অনায়াসে এই কবিতাটিকে নিহত প্রেম কবিতা আখ্যা দেওয়া যায়। আশ্চর্য একটি ভঙ্গিমায় কবিতাটির শুরু। সূচনালগ্নেই পাঠক পেয়ে যান একটি সার্থক ছোটোগল্পের আভাস। কবিতায় গল্পধর্মীতার রীতি বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম নয়, বহু আগে, রবীন্দ্রনাথ থেকেই এজাতীয় উচ্চারণ প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে। কবিতার গল্পটি অত্যন্ত সাধারণ একটি মেয়ের গল্প। এ কবিতায় তার কোনো নাম নেই। বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক লগ্নে মেয়েটির মন ছুঁয়েছিল ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবির রং। বেণী মাধব তমালমূলে মোহন বাঁশি বাজায় আর সেই বাঁশির সুরে মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী অখ্যাত কালো মেয়েটির মনে পূর্বরাগের অরুণ রং লাগে। দৈনন্দিনতার অজস্র কাজ এরপর থেকেই বারবার ভুল হয়ে যায় মেয়েটির। এরপর একদিন বান্ধবী সুলেখাদের বাড়িতে বেণীমাধবের সঙ্গে তার প্রথম দেখা। শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে আসা বেনীমাধবকে ঘিরে এরপর থেকেই মেয়েটির মনে অজস্র স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা মূর্তিরূপ পেতে থাকে। কিন্তু এইসব কিছুর মাঝখানেও এক ধরনের মানসিক বাধা আচ্ছন্ন করে রাখে মেয়েটির চিন্তা-চেতনাকে। কবিতার অবয়বে বেণীমাধবের সামাজিক ও মানগত অবস্থানটিকে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন কবি। অবস্থানগত এই বৈষম্যকে ফুটিয়ে তোলবার জন্যই কবি মেয়েটির মুখে ‘বেণীমাধব বেণীমাধব লেখাপড়ায় ভালো’ কিংবা ‘আমার বাবা দোকানে কাজ করে’র মতো বাক্যবন্ধ বসিয়েছেন।

কিন্তু যৌবনের স্বপ্ন কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই স্বীকার করে না। যৌবনের তমাল তরুমূল থেকে যে অনবরত বাঁশির ডাক আসে তাতেই মেয়েটির মনকুঞ্জে অলিদের গুঞ্জরণ শুরু হয়ে গেছে। যে সুরের আবহে পড়াশোনায় মন বসে না তার। অঙ্ক কষতেও বারবার ভুল হয়ে যায়। এরপর একদিন সেই মধুর লগ্নটি আসে মেয়েটির জীবনে। ব্রীজের ধারে লুকিয়ে দুজনার দেখা হয়। মন দেয়া নেয়ার এই খেলার সাক্ষী যিনি সেই বিধাতা কিন্তু এই দৃশ্যে পরিহাসের হাসিই হেসেছিলেন। কারণ বাস্তব মেয়েটির জীবনে চূড়ান্ত বিরুদ্ধ পরিবেশের জন্মই দিয়ে গেছে। চিরকিশোরের বৃন্দাবনের অপ্রাকৃত বৈষ্ণবীয় অনুরণন মেয়েটির জীবনে সত্য হয়নি। জীবনের মধুলগ্নটি মেয়েটির জীবনে শুধু স্মৃতি হয়ে ভাসে। কারণ বেণীমাধব আজ রূপে-গুণে অনন্যা একটি মেয়েকে তার জীবন সঙ্গিনী হিসাবে পেয়ে গেছে। মেয়েটির জীবনের বাস্তব যতই বিরুদ্ধতার জন্ম দিক মনের সহজ প্রকাশকে সে উন্মোচিত করেছে স্বাভাবিক পথেই,

আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে 

দেখেছিলাম আলোর নিচে ; অপূর্ব সে আলো!

স্বীকার করি দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো।

কিন্তু আপাত কল্যাণ কামনার অন্তরালে বেদনার অগ্নিবাণ প্রেমবঞ্চিতা মেয়েটিকে সারাটি জীবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। তার রক্তাক্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা ও কূলপ্লাবী অশ্রুর বন্ধন হারা উচ্ছ্বাস গোপন থাকে না।

অসহনীয় দারিদ্র্য ও প্রতিনিয়ত সংগ্রামী পথচলায় ক্লান্ত হতে হতে মেয়েটি কবে যেন পাড়ার সেলাই দিদিমনি হয়ে যায়। গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থানের পাশে তার ভবিষ্যৎটি কি হবে সেটি কিন্তু জানা নেই মেয়েটির। সেই অজানা ভবিষ্যৎ প্রতিনিয়ত নিজের ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করে চলেছে যখন তখন মেয়েটিকে বলতে শুনি,

“আজ জুটেছে, কাল কী হবে? কালের ঘরে শনি,

আমি এখন এই পাড়ার সেলাই দিদিমনি।”

আসলে জীবনের এই বঞ্চনা, লাঞ্ছনা এবং অপমানের অসহায়-জ্বালাটিই বয়ে গেছে সত্য হয়ে তা আগুন হয়ে জ্বলে উঠতে পারেনি মেয়েটির জীবনে। বরং তার পরিবর্তে এক ধরনের ক্ষয়, নষ্ট হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে তার উক্তিতে।

“তবু আগুন, বেণীমাধব আগুন জ্বলে কই ? 

কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই”

অন্তহীন প্রতীক্ষার উপকূলে নিঃসঙ্গ জীবনের দীপশিখাটি জ্বালিয়ে মেয়েটি আজও বেণীমাধবের কথা ভাবে। অভাবের সংসার জীবনের ‘চোরা পথের বাঁকে টেনে নিয়ে গেছে তার ছোটো বোনকে। সেই চোরাপথ তাকেও টেনে নিতে পারত, কিন্তু তার স্মৃতিতে এখনও আলোকোজ্জ্বল বারান্দার মতো স্বপ্নময় হয়ে আছে মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়, তমাল তরুমূলে শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে আসা বেণীমাধব, তার হাতের মোহন বাঁশি, ব্রীজের ধার, সদ্য শাড়ি পরতে শেখা কিশোরীর প্রথম আত্মনিবেদনের ছবি। প্রকৃতপক্ষে প্রেম বোধ হয় এভাবেই চোখের জলে বিদ্বেষের আগুনটিকে নিভিয়ে দেয়। তবু এক ধরনের বঞ্চনা ও হতাশার অগ্নিবাষ্পে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে মেয়েটির বেঁচে থাকবার ইচ্ছা। স্মৃতির সমাধিতে ফুল ছড়ানোর মধ্যে দিয়েই আজ সে সুখ । আসলে চোরাপথে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকলেও প্রেমের অবিনশ্বরতাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে সে শুধু দেখে নিয়েছে তার অতীত থেকে বর্তমান ছুয়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকেও। মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় তাই একটি অনামী, অখ্যাত মেয়ের প্রেম বঞ্চিত জীবনের করুণ কথার কাব্যরূপ। মেয়েটি ও কবি এ কবিতায় সমার্থক হয়ে গেছে—একথা বলা যায়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment