প্রাচীন ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্ম

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রাচীন ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্ম” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

প্রাচীন ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্ম

ভাগবত-বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিম ভারতে। এই ধর্মের আদি প্রবক্তারা ছিলেন সম্ভবত যাদব উপজাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। যাদব ট্রাইবের অন্যতম বীরপুরুষ বাসুদেব কৃষ্ণ দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হলে এই নতুন একেশ্বরবাদী ধর্মের যাত্রা শুরু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে মথুরাতে বাসুদেব কৃষ্ণের নেতৃত্বে এই নবধর্ম আন্দোলনের সূচনা হয়। ব্যক্তি বাসুদেব কৃষ্ণের রাষ্ট্রনীতিক ক্রিয়াকলাপ ও ধর্মীয় বা ঐশ্বরিক শক্তির বিবরণ মহাভারতে ও তাঁর জীবনী ‘হরিবংশ’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। কালক্রমে বিষু ও নারায়ণের সাথে বাসুদেব কৃষ্ণ’র অভিন্নতার তত্ত্ব প্রচার লাভ করে।

প্রবল ব্যক্তিত্ব ও আদর্শবাদী যাদব ট্রাইবভুক্ত বাসুদেব কৃষ্ণ সমকালীন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মহাভারত থেকে প্রতীয়মান হয়। ঐতিহাসিক আর. জি. ভাণ্ডারকর, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখ বাসুদেব কৃষ্ণকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই মনে করেন। এঁদের মতে, যাদব ট্রাইবের সাত্বত শাখার অন্তর্গত বৃষ্টি বংশের দেবকীর পুত্র ছিলেন এই বাসুদেব। কালক্রমে তাঁকে ঘিরে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচারিত হলে, মানুষ কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা হারিয়ে যায় এবং তিনি দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হন। ছান্দোগ্য উপনিষদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে জনৈক ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য কৃষ্ণ ছিলেন দেবকীর পুত্র। মাতৃ পরিচয়ের নিরিখে কৃষ্ণ ও বাসুদেব কৃষ্ণকে অভিন্ন মনে করা হয়। আরো একটি চরিত্র বাসুদেব কৃষ্ণের উপর আরোপিত হয়েছে। তিনি পশ্চিম ভারতের গো-পালক আভীর উপজাতিভুক্ত জনৈক গোপাল-কৃষ্ণ। গোচারণের পাশাপাশি গোপিনীদের সাথে রঙ্গরস সহ উচ্ছল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। অবশ্য মহাভারতের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাজনীতিক কৃষ্ণের জীবনচর্চার সাথে গোপাল-কৃষ্ণের চরিত্রের মিল পাওয়া কষ্টকর। যাই হোক্, বাসুদেব-কৃষ ছিলেন একটি মিশ্র চরিত্র এবং তাঁর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে এ. বি. কীথ (A. B. Keith), হপকীনস্ (Hopkins) প্রমুখ সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ মহাভারত যদি একটি বীরগাথা হয় এবং দীর্ঘসময় ধরে লোকমুখে প্রচারিত বীরদের গল্প-কথার সংকলন হয়, তাহলে তার চরিত্রগুলির ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এঁদের মতে, বাসুদেব সূর্য দেবতার প্রতীক বা পাণ্ডবদের গোষ্ঠী দেবতা।

প্রাচীন সাহিত্যসূত্রগুলি বাসুদেব কৃষ্ণের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব বিষয়ক বিতর্কটিকে জটিলতর করেছে। জৈন গ্রন্থ ‘উত্তরাধ্যায়ন সূত্র’ অনুসারে সৌর্যপুরের রাজা বসুদেব ও দেবকীর পুত্র বাসুদেব (অন্যনাম কেশব) দ্বাবিংশতম জৈন তীর্থঙ্কর অরিষ্টনেমির সমসাময়িক ছিলেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে বাসুদেবকে বলা হয়েছে বলরামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তাঁরা ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। মহাভাষ্যের কয়েকটি পুঁথিতে বাসুদেবের নামের সাথে ‘তত্রভগবৎ’ অভিধাটি যুক্ত করা হয়েছে। আর. জি. ভাণ্ডারকর মনে করেন খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যে ক্ষত্রিয় রাজপুত্র বাসুদেব কৃষ্ণের উপর দেবত্ব আরোপ করা হলে ‘তত্র ভাগবত’ বিশেষণটি প্রয়োগ শুরু হয়।

মহাভারতের উদ্যোগপর্বে বাসুদেব ও অর্জুন নামক দু’জন বীরের কথা স্মরণ করা হয়েছে। এ থেকে অনুমিত হয় যে গ্রীকবীর আলেকজাণ্ডারের ভারত অভিযানের আগেই বাসুদেবকে কেন্দ্র করে বীর পূজা চালু হয়েছিল। সমকালীন অন্যান্য ধর্মসূত্রে বাসুদেব ও অর্জুনকে যথাক্রমে নারায়ণ ও নর নামক দুই প্রাচীন ঋষির অবতার রূপে কল্পনা করা হয়েছে। স্বাত্বত সংহিতা বা পাণিনির অষ্টাধ্যয়ী’র বিবরণের সাথে পাঞ্চরাত্র সংহিতা’র কিছু অমিল লক্ষণীয়। শেষোক্ত গ্রন্থে যে পাঁচজন বৃথ্বি বীর পূজার উল্লেখ আছে তাঁরা হলেন বলদেব (সংকর্ষণ), বাসুদেব-কৃষ্ণ, প্রদ্যুন্ন, শাশ্বত ও অনিরুদ্ধ। এঁরা রক্তসূত্রে সম্পর্কিত। বলদেব ও বাসুদেব দুই ভ্রাতা। প্রদ্যুম্ন ও শাম্ব বাসুদেবের পুত্র। তাদের মাতা যথাক্রমে রুক্মিনী ও জাম্ববতী। অনিরুদ্ধ ছিলেন প্রদ্যুম্নের পুত্র। এঁরা পরবর্তীকালে দেবতার আসনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে খোদিত ‘মোরা কুপ লেখ’ থেকে জানা যায় যে, তোষা নামক জনৈকা বিদেশিনী পাথরের মন্দির নির্মাণ করে সেখানে এই পাঁচজন বৃঘ্নি বীরের পবিত্র মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এত প্রাচীন ভারতে মন্দির নির্মাণ করে দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার রীতি প্রচলিত ছিল কিনা, তা তর্কাতীত নয়।

বৈষ্ণব ধর্মের বিবর্তনের প্রথম পর্যায়ে বাসুদেব কৃষ্ণের সাথে বৈদিক দেবতা বিষ্ণুর অভিন্নতা ঘোষণা করা হয়। বৈদিক দেবতা বিষ্ণু খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের আগে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সূর্যের সাথে সম্পর্কিত এবং অসুরনিধন কর্মে ইন্দ্র ও বরুণের সহকারী। পরবর্তীকালে যজ্ঞের চরম ফল অর্জনের জন্য আন্তঃদেবতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে বিষু সর্বপ্রধান দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হন (সৎপথ ব্রাহ্মণ)। বাসুদেব ও বিষ্ণুর মধ্যে এই অভিন্নতা প্রতিষ্ঠার পিছনে ভাগবত ধর্মকে বৈদিক ধর্মবিশ্বাসের ধারার সাথে যুক্ত করে দেবার প্রয়াস দেখা যায়।

বৈষ্ণবধর্ম বিবর্তনের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো এক দেবতা নারায়ণকে প্রথমে বিষুর সাথে একাত্ম করা হয় এবং কালক্রমে বাসুদেব-কৃষ্ণের সাথে অভিন্ন বলে গণ্য করা হয়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, আদিতে নারায়ণ কোন উপজাতীয় মানুষ ছিলেন যাঁর গোত্র ছিল ‘নর’। শতপথ ব্রাহ্মণের সূত্রানুযায়ী ব্যক্তি নারায়ণ প্রজাপতির আদর্শে তিনবার যজ্ঞ করেছিলেন এবং ‘পাঞ্চরাত্র মন্ত্রের’ অনুষ্ঠান করে সকলের উপর প্রভুত্ব অর্জন করেছিলেন। কালক্রমে পাঞ্চরাত্র উপাসক নারায়ণ-অনুগামীরা বৃষ্ণি বংশীয় পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যান। এইভাবে ‘বাসুদেব-কৃষ্ণ বিষ্ণু-নারায়ণ’ এই ত্রি-দেব সমন্বয় ঘটে। (নারায়ণায় বিঘ্নহে বাসুদেবায় ধীমহি তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াত্’)

নারায়ণের ঐতিহাসিকতাও বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন ভারতের জনৈক প্রাচীন চিন্তানায়ক ছিলেন নর। সেই নরের পুত্র নারায়ণ প্রাচীন ঋষি রূপে খ্যাতি পান। ক্রমে তাঁর শিষ্যরা নারায়ণকে দেবতার আসনে বসিয়ে দেন। দেবত্বে উন্নীত নারায়ণের অনুগামীরা ‘পাঞ্চ রাত্রিক’ নামে অভিহিত হতেন। সম্ভবত হিমালয় পর্বতের সমভূমি অঞ্চলে নারায়ণ উপাসনার সূচনা হয়েছিল। নর ও নারায়ণ উভয়েই সূর্যের উপাসক ছিলেন। পরবর্তীকালে বিষ্ণুর সাথে নারায়ণ এবং বিষ্ণু-নারায়ণের সাথে বাসুদেব-কৃষ্ণের অভিন্নতার তত্ত্ব প্রচারিত হয়। অন্যদিকে আর. জি. ভাণ্ডারকর মনে করেন যে, নারায়ণ কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন। এমনকি পৌরাণিক ঋষি হিসেবে এই নামের কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব সাহিত্যসূত্র বা ধর্মশাস্ত্র রচনাকার হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। তিনি মনে করেন ‘নারায়ণ’ শব্দের অর্থ হল নরের বা মানুষের বিশ্রামস্থল। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্ৰ রায় চৌধুরী মহাভারতের শান্তি পর্বের বিবরণের ভিত্তিতে মনে করেন নারায়ণ ছিলেন ধর্মের পুত্র এবং নর, নারায়ণ, হরি ও কৃয়—এই চার অংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ক্ষীর সমুদ্রের উত্তর ভাগের শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা দেবতা রূপে নারায়ণের উপাসনা করতেন। নারায়ণ সূর্য দেবতা হিসেবে উপাস্য ছিলেন। তাই পরবর্তীকালে নারায়ণের সাথে বৈদিক সূর্য দেবতা বিষ্ণুর একাত্মতা প্রতিষ্ঠা করতে অসুবিধা হয়নি।

প্রাপ্ত উপাদান থেকে ঐতিহাসিকদের অনুমান খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে মানুষ বীর বাসুদেবের উপর দেবত্ব আরোপের সূচনা হয়েছে। ঐ সময়ে রচিত পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী তে এর প্রথম আভাস পাওয়া যায়। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, মথুরা অঞ্চলের অধিবাসীরা ‘হেরাক্লেসের’ প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। গ্রীকবীর হেরাক্লেস-এর জীবন ও কাজের সাথে মহাভরতের কৃষ্ণের জীবন ও জীবিকার অনেক মিল আছে। যেমন, উভয়ে ছিলেন কৃষ্ণবর্ণ, উভয়েই সর্প নিধন করেছিলেন। উভয়ের মৃত্যু ঘটেছিল গোড়ালিতে বিষক্রিয়ার ফলে ইত্যাদি।

বৈদিক দেবতা ইন্দ্র, বরুণ প্রমুখের স্থানচ্যুতি এবং সেই স্থানে কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠার পশ্চাৎপটে বস্তুগত পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। বৈদিক ধর্মে যজ্ঞ ও পশুবলির মাধ্যমে ইন্দ্র, বরুণ প্রমুখ দেবতার আরাধনা করা হত। পরবর্তীকালে কৃষিভিত্তিক জীবনধারার সূচনা ঘটলে গো-হত্যা অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে গো-সম্পদের রক্ষক ও পালক হিসেবে কৃষ্ণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাসের সাথে বৈদিক দেবতা বিষ্ণুর একীকরণ প্রক্রিয়াও বৈষ্ণববাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়-এর মত, ব্যুহবাদ ও অবতারবাদের মাধ্যমে এই সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নারায়ণ-বিষ্ণু চারটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে (ব্যুহে) নিজেকে প্রকাশ করেন। এর ফলে বিভিন্ন আঞ্চলিক দেবতা বিষ্ণু-ধারণার অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন। এই আঞ্চলিক দেবতাদের অন্যতম ছিলেন বাসুদেব। বাসুদেবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষ্ণ সম্প্রদায়ের উপাস্য সঙ্কর্ষণও (বলদেব) এইভাবে বৈষ্ণবধর্মের অঙ্গীভূত হয়েছিলেন। কৃষ্ণ সম্পর্কেও একই প্রক্রিয়া কাজ করেছিল।

ভাগবত ধর্মের প্রধানতম তাত্ত্বিক ভিত্তি হল ভগবদ্গীতা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের দ্বিধাগ্রস্ততা ও তাঁর নানা প্রশ্নের উত্তর শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়ে জীব ও জগতের সম্পর্ক ও মুক্তির পথ নির্দেশ এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। সেই সময় বৈদিক কর্মবাদ, সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ, উপনিষদের প্রকৃতিবাদ, যোগানুশাসন, প্রতীক- উপাসনা, অবতারবাদ ইত্যাদি ধর্মের নানা ধারা প্রচলিত ছিল। এই অনুশাসনগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য ও বিরূপতা ছিল স্পষ্ট। ফলে মানুষ ছিল বিভ্রান্ত। কর্ম বড় না জ্ঞান বড়—এই প্রশ্নে মানুষ ঘোর বিভ্রান্তের মুখে পড়েছিল। গীতা এই বিরোধের অবসান ঘটায়। নিষ্কাম কর্ম ও আত্মজ্ঞান যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে গীতা বিভ্রান্তির অবসান ঘটায়। কর্ম বন্ধন সৃষ্টি করে না, বন্ধনের উৎসস্থল কর্মফলের চেতনা। নিষ্কাম কর্মের প্রতি আসক্তি স্বাভাবিক। সমস্ত কর্মের একটাই প্রেরণা থাকবে এবং তা হল আত্মজ্ঞান বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। এই আত্মজ্ঞানের দ্বারাই ব্রহ্মত্বলাভ সম্ভব। গীতার বাণী খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। চর্চা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞান—এই চারটি মার্গ অনুশীলন বৈষ্ণবধর্মের প্রধান আচরণ হিসেবে গৃহীত হয়।

পাণিনির ‘অষ্টাধ্যয়ী’ (খ্রিঃপূঃ ৫ম শতক) বা মেগাস্থিনিসের রচনায় (খ্রিঃপূঃ ৪র্থ শতক) ভাগবত সম্প্রদায়ের উল্লেখ থাকলেও, সম্ভবত খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের আগে ভারতে ভাগবত বৈষ্ণবধর্ম দৃঢ় ভিত্তি পায়নি। প্রাথমিক পর্বে উত্তর-ভারতের মথুরা ও মধ্যভারতের বিদিশা অঞ্চলে ভাগবত ধর্ম সমাজবদ্ধ ছিল। যাদব সম্প্রদায়ের অভিপ্রয়াণের সূত্রে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ধীরে ধীরে ভাগবত ধর্মের সম্প্রসারণ ঘটে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতকের কয়েকটি লেখ থেকে বিদিশা অঞ্চলে ভাগবত ধর্মের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, মথুরা ও বিদিশা অঞ্চলে বহিরাগত ভারতীয় শাসকদের কেউ কেউ ভাগবত ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। শক্, সাতবাহন ও কুষাণ রাজাদের একাধিক লেখ ও মুদ্রা থেকে সমকালে ভাগবত বৈষ্ণবধর্মের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে নায়নিকার ‘নানঘাট লেখ’, খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণীর ‘চিন্ন লেখ’, কুষাণরাজ হুবিস্কের ‘মুদ্রা’ ইত্যাদির নাম উল্লেখ্য। এগুলিতে বাসুদেব-বিষুর চতুর্ভুজ মূর্তি বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মুদ্রার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের অনুমান, চতুর্থ শতকের পূর্ববর্তীকালে ভাগবত ধর্মের অস্তিত্ব থাকলেও তা পুরোপুরি স্বনির্ভর, স্বতন্ত্র একটি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এই পর্বে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের সাথে ভাগবতীয়দের সহাবস্থান ও পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান ছিল স্পষ্ট। যেমন, চব্বিশজন জৈন তীর্থঙ্করের ধারণার সাথে বিষুর চতুর্বিংশরূপের সাযুজ্য লক্ষণীয়। আবার মহাযান বৌদ্ধধর্মে অবতারবাদের সাথে বৈষ্ণবধর্মের ‘অবতারবাদের’ মিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়।

খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে ভারতে বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। গুপ্তরাজাদের এবং আঞ্চলিক রাজপরিবারগুলির পৃষ্ঠপোষকতার ফলে চতুর্থ শতকের পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মমতের দ্রুত প্রসার ঘটে। গুপ্তরাজবংশের প্রতীক ছিল বিষ্ণুর বাহন গরুড়। গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজেকে ‘পরম ভাগবত’ বলতেন। তাঁর কন্যা প্রভাবতী গুপ্ত (বকাটক মহিষী) দাশরথি রামের ভক্ত ছিলেন। প্রথম কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত প্রমুখের আমলে রচিত বিভিন্ন লেখতে ‘বিষু’ ও তাঁর নানা রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। আঞ্চলিক রাজবংশগুলির মধ্যে পল্লবরাজ বিষুগোপ, মৌখরীরাজ অনন্ত বর্মন, কেরলরাজ কুলশেখর প্রমুখের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। গুপ্তযুগের বিভিন্ন লেখ থেকে উত্তর-পূর্বে নেপাল, উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, পশ্চিমে কাথিয়াবাড় এবং দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণবধর্মের প্রসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। অধ্যাপক রমাকান্ত চক্রবর্তীর রচনা থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন বঙ্গদেশেও বৈষ্ণবধর্ম যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন। যে, ষষ্ঠ থেকে নবম শতকের মধ্যে আলবার সাধকগোষ্ঠী দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণবধর্মকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। অন্ধপ্রদেশে নিম্বার্কগোষ্ঠী বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করেছিলেন।

দক্ষিণ-ভারতে বৈষ্ণববাদ :

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকেই দক্ষিণ ভারতেও বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। প্রাপ্ত লেখ থেকে অনুমান করা হয় ঐ সময় কৃয়া জেলায় বাসুদেব উপাসনার প্রচলন ছিল। গুন্টুরে প্রাপ্ত অন্য একটি লেখ থেকে জানা যায় যে, চতুর্থ শতকে সেখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নারায়ণের উপাসনা করা হত। পণ্ডিতদের অনুমান পাণ্ড্য রাজ্যের রাজধানীর নাম মাদুরা আসলে বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রভূমি মথুরা নামেরই দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চারণ। প্রাচীন তামিল সঙ্গম সাহিত্যে কৃষ্ণ ও বলদেবকে কেন্দ্রীয় চরিত্র রেখে কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টির প্রবণতা দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলির অনেক শাসকই ভাগবত ধর্মের উপাসক ছিলেন। পল্লব, চালুক্য, কদম্ব, গঙ্গ রাজারা নিজেদের হরি, বিষু বা ভাগবতীয় ধর্মের পৃষ্ঠপোষক বলেই প্রচার করতেন।

দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ধর্ম-সম্প্রদায় আলবার (আরবার / আলোয়ার)দের উদ্যোগে সপ্তম-নবম শতকে এই ধর্মদর্শন বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুসারে তামিল অঞ্চলে বারোজন আলবার সাধক জন্মেছিলেন। এঁরা হলেন পোইগই বা সরযোগী, ভূতাত্তা বা ভূতযোগী, যোই বা মহদযোগী, তিরুমঢ়িশাই বা ভক্তিসার, নন্মাঢ় বা শকটকোপ, কুলশেখর, মধুর কবি, পেরিয়া বা বিষু চিত্ত, আণ্ডাল (মহিলা সাধিকা এবং বিষু চিত্তের কন্যা), তোল্ডর ডিপ্পোড়ি, তিরুপ্পান বা যোগীবাহন এবং তিরুমঙ্গই আলবার বা পরকাল। এঁদের মধ্যে প্রথম চারজন পল্লবরাজ্যে জন্মেছিলেন। শেষের তিনজন চোলরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। মধুরকবি ছিলেন কেরলের মানুষ। অবশিষ্ট সবাই পাণ্ড্যদেশে আবির্ভূত হন। আলবার সাধকগণ অধিকাংশই সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ ছিলেন।

আলবার সাধকগণ সংগীত রচনা ও পরিবেশনের মাধ্যমে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব প্রচার করতেন। ‘প্রবন্ধম্’ নামক প্রাচীন তামিল সাহিত্য সংকলন গ্রন্থ থেকে আলবার সাধকদের সংগীতচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সংকলনে আলবার সাধকদের রচিত চার হাজারের বেশি সংগীত স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ আলবার সাধক তিরুমঙ্গই একাই রচনা করেছিলেন ১৩৬১টি সংগীত। একাদশতম সাধক তিরুপণ লিখেছেন মাত্র দশটি সংগীত। পঞ্চম আলবার নম্মাঢ় (শকটকোপ) তেরশোর বেশি সংগীত রচনা করেছেন। এঁদের সংগীতে বাসুদেব কৃষ্ণর পাশাপাশি রাম, বলরাম, নারায়ণ প্রমুখের লীলাকীর্তন স্থান পেয়েছে।

পূর্ব ভারতে বৈষ্ণব আন্দোলন :

পূর্ব ভারতে দেবতা রূপে বিষ্ণুর আরাধনার দৃষ্টান্ত সুপ্রাচীন লিপিতে পাওয়া যায়। বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পর্বত গুহায় রাজা চন্দ্রবর্মার লিপিতে বাংলায় বিষ্ণুপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। চন্দ্রবর্মা সম্ভবত খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে বাংলার শাসক ছিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘বাংলায় ইতিহাস’ (১ম খন্ড) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সপ্তম শতকের উৎকীর্ণ লিপিতে দেখা যায় বাংলার পূর্ব প্রান্তে অরণ্য প্রদেশে অনন্তনারায়ণ মন্দিরে বিষ্ণুর উপাসনা হত। বাংলার সেনবংশীয় রাজারা ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। রাজা লক্ষ্মণ সেন ছিলেন পরম বৈষ্ণব। অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে পূর্ব ভারতে বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তার নিদর্শন হিসেবে সমকালে প্রাপ্ত অসংখ্য বিষ্ণুমূর্তির কথা উল্লেখ করা যায়। বিশিষ্ট কবি জয়দেব কৃষ্ণের মহিমা বর্ণনামূলক অমর ও জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘গীতগোবিন্দ’ এই সময়েই রচনা করেন।

ষোড়শ শতকে পূর্ব ভারতে বৈষ্ণবধর্ম আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিঃ)। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত। মাত্র ৪৭ বৎসর বয়সে তাঁর দেহাত্তর ঘটে। কিন্তু এই স্বল্প পরিসর জীবনে তিনি বাংলা তথা পূর্ব ভারতের ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে এক দীর্ঘস্থায়ী আলোড়ন সৃষ্টি করে যান। কৈশোরে অতি-দুরন্ত নিমাই যৌবনে কৃপ্রেমে আপ্লুত হয়ে বাংলা ও উড়িষ্যার সমাজ ও ধর্মজীবনে ভক্তিবাদের জোয়ার আনেন। বৃন্দাবন দাস বিরচিত চৈতন্য ভাগবত’ ও কৃষ্ণরাজ কবিরাজ-এর ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থ থেকে তাঁর জীবন ও কর্মের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। চৈতন্যদেব নিজে কোন তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেননি। তবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বিশ্বাস করেন যে, ‘দশমূল-শ্লোক’ শ্রীচৈতন্যের নিজস্ব রচনা। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি গয়াধামে গিয়ে ঈশ্বর পুরীর কাছে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন। কাটোয়ায় কেশব ভারতী তাঁকে সন্ন্যাস দেন। চৈতন্যের দীক্ষাগুরু ও সন্ন্যাসগুরু উভয়েই ছিলেন ‘মাধ্ব’ সম্প্রদায়ভুক্ত। চৈতন্য নিজেকেও এই সম্প্রদায়ের সদস্য বলে গণ্য করতেন।

জাতিধর্ম নির্বিশেষে চৈতন্যদের সকলকে কৃষ্ণপ্রেমে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি প্রচার করেন যে শুধু কৃষ্ণনাম নিয়ে জীব মুক্তি লাভ করতে সক্ষম। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, চৈতন্যদেব যে মত প্রচার করেন তা ‘অচিন্ত ভেদাভেদ’ নামে পরিচিত। চৈতন্য ও তাঁর অনুগামীরা শংকরাচার্য প্রচারিত ‘নির্গুণ ব্রহ্মের পরমতত্ত্ববাদ’কে অস্বীকার করেন। এঁদের মতে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন সেই ব্রহ্ম যিনি এই বিশ্বজগতের প্রভুস্বরূপ এবং একই সঙ্গে বিশ্বের জীবকুলের সাথে যাঁর প্রেম ও স্নেহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। চৈতন্যবাদে ঈশ্বর ও তাঁর শক্তি হলেন যথাক্রমে কৃষ্ণ ও রাধা। অচিন্ত্য ভেদাভেদ হলো ঈশ্বর, জীবসমূহ ও জড় জগতের মধ্যে সম্পর্কের ধারণা। জীবশক্তি ও মায়াশক্তি ঈশ্বরের স্বরূপ শক্তির ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তবে তাঁর আর একটি বিশ্বাতীত রূপ আছে। তিনি বিভিন্ন শক্তি ব্যবহার করলেও তা পূর্ণ ও অপরিবর্তিত থাকে। ঈশ্বর তাঁর বিভিন্ন শক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের অতিক্রম করে এই সকল শক্তির সাথে অচিন্ত্য ভেদাভেদ সম্বন্ধসহ নিজেকে প্রকাশিত করেন।

কৃষ্ণই পরম ব্রহ্ম। তিনি অসীম ও পূর্ণ চৈতন্য স্বরূপ। চিৎশক্তি যুক্ত জীবাত্মা তাঁর একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। তবে অংশী ও অংশ অভেদ হলেও জীবাত্মার পৃথকসত্তা হেতু পরম ব্রষ্ম ও জীবাত্মার মধ্যে সূক্ষ্ম প্রভেদ বর্তমান। কৃয় মায়াশক্তি রূপে গোটা বিশ্বজগৎ আচ্ছাদিত করে আছেন। প্রভাব বিলাস ও বৈষ্ণব বিলাস এই দুই শক্তির মাধ্যমে তিনি বহুরূপে নিজের প্রকাশ ঘটান। প্রভাব বিলাস দ্বারা তিনি গোপীদের সাথে রাসলীলা কালে বহু কৃষ্ণে পরিরত হন। আবার বৈষ্ণব বিলাস শক্তির বশে তিনি বাসুদেব (বুদ্ধি), সংকর্ষণ (চেতনা), প্রদুম্ন (প্রেম) ও অনিরুদ্ধ (লীলা) এই চতুর্ব্যহ রূপ পরিগ্রহ করেন। কেবল নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে পরমব্রহ্মা কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করা যায়।

বাংলা ও উড়িষ্যায় চৈতন্যবাদের সর্বাধিক জনপ্রিয়তা দেখা যায়। পাপী-তাপী, দীন-হীন সকল মানুষকে তিনি হতাশার অন্ধকার ও বৈষ্যমের গ্লানি থেকে মুক্ত করে নবজীবনের আশ্বাস দেন। স্যার যদুনাথ সরকারের মতে, এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে চৈতন্যদেব পূর্ব-ভারতে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করে অধঃপতিত হিন্দু সমাজকে রক্ষা করেন। অধ্যাপক সুকুমার সেন চৈতন্যদেবের মতাদর্শকে কোন বিশেষ ধর্মীয় দিক থেকে বিচার না করে সামাজিক উপযোগিতার (Social utility) দিক থেকে দেখা উচিত বলে মনে করেন। চৈতন্যদেবের আন্দোলন ছিল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা প্রসারের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের এক বলিষ্ঠ অথচ নম্র পদক্ষেপ। ড. সেনের মতে, এটিই ছিল বাঙালীর প্রথম জাগরণ। চৈতন্যদেবের জীবন ও দর্শনতত্ত্বকে ভিত্তি করে পূর্ব-ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

আসামে বৈষ্ণবধর্ম ও ভক্তিবাদ প্রচার করেন শংকরদেব (১৪৮৬-১৫৬৮ খ্রিঃ)। তাঁর পিতা ও মাতা ছিলেন যথাক্রমে কুসুমবর ও সত্যসন্ধা। অল্প বয়সে তিনি পিতৃমাতৃহীন হন। বাল্যকাল থেকেই সাহিত্যচর্চায় তাঁর ঝোঁক দেখা যায়। চিত্রাঙ্কনেও তাঁর সহজাত দক্ষতা ছিল। শংকরদেবকে অসমীয়া সাহিত্যের জনক বলা যায়। যৌবনে তিনি নওগাঁ জেলায় এসে বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি বিবাহ করে সংসার ধর্মে ব্রতী হন। কিন্তু অল্পবয়সে পত্নী-বিয়োগের ফলে তাঁর মন ঈশ্বরমুখী হয়। তীর্থদর্শনে বেরিয়ে তিনি বৃন্দাবন, মথুরা, বদরিকাশ্রম, গয়া, কাশী, পুরীধাম, দ্বারকা, রামেশ্বরম্ প্রভৃতি পুণ্যস্থান পরিভ্রমণ করেন। ভারতের নানাপ্রান্তে ভক্তিবাদী বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তা তাঁকে আপ্লুত করে। নামসংকীর্তনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের দর্শনতত্ত্ব শংকরদেবকে গভীরভাবে আকর্ষিত করে। পুরীধামে এসে তিনি স্বয়ং চৈতন্যদেবের সাক্ষাৎ পান। এই সময় তাঁকে পুনরায় সংসারমুখী করার জন্য তাঁর আত্মীয়রা শংকরের দ্বিতীয় বিবাহের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বিবাহ করতে বাধ্য হলেও, শংকর আধ্যাত্ম চিন্তায় বিভোর থাকেন। ভগবত পুরাণের বক্তব্য তাঁর মনকে উতলা করে তোলে।

এই সময় বাংলা, উড়িষ্যা ও আসাম শাক্তধর্ম ও তন্ত্রাচারের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। পুরীর জগন্নাথদেব উপজাত দেবতা ছিলেন বলে মনে করা হয়। কালক্রমে তাঁর উপর বৈষ্ণববাদের আবরণ দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর পূজার্চ্চনার ক্ষেত্রে শাক্ততান্ত্রিক রীতির প্রভাব ও প্রকাশ স্পষ্ট। অনুরূপভাবে গৌহাটির কামাখ্যাদেবী আসলে খাসি উপজাতির মাতৃদেবী, যিনি পরে শাক্ততান্ত্রিক দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। শংকরের উদার ভাষ্য দ্রুত আসামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি ও সাহিত্য রচনায় তাঁর দক্ষতা সহজেই শংকরের দর্শনতত্ত্ব মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। তিনি প্রথমে সহজ-সরল ভাষায় ভাগবতের অনুবাদ করেন। কামরূপী ভাষায় ভাগবত ব্যাখ্যা করেন। গান, নাটক ও ছোটছোট কাব্যগাথা রচনা করে তিনি মানুষের মন জয় করে নেন। কামরূপী ভাষায় মার্কণ্ডেয় পুরাণের রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী এবং ভাগবত পুরাণের কয়েকটি অধ্যায় অনুবাদ করেন। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে ভক্তিধর্মের সারাৎসার সংগ্রহ করে তিনি ‘ভক্তি রত্নাকর’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ‘ভক্তি প্রদীপ’ শীর্ষক গ্রন্থে তিনি ভক্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তাঁর গ্রন্থ এবং কীর্তনের ভাব ও ভাষা আসামের জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তিনি ছ’টি একাংক নাটক (অনকিয়া নাট্য) রচনা করেন। এর মধ্যে পাঁচটিরই বিষয়বস্তু ছিল পরমব্রত্ন কৃষ্ণের জীবন ও দর্শনভিত্তিক। কামরূপী ভাষায় কৃষ্ণ ও রামকে ব্রহ্মরূপে কল্পনা করে শংকরদের অনেকগুলি গীতও (বরগীত) রচনা করেন। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে কুচবিহারের কোচরাজা তাঁকে সেই রাজ্যে আশ্রম স্থাপনের অনুরোধ জানান। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজ শংকরদেবের বিরুদ্ধে বহু প্রচার চালান। কিন্তু শংকরের উদার দর্শনতত্ত্ব ও ভক্তিবাদ আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসার লাভ করে।

শংকরদেবের ভক্তিবাদের মূল কথা হলো ভক্ত ও ভগবানের মিলন। জ্ঞান বা কর্মযোগের পরিবর্তে তিনি ভক্তিযোগের উপর বেশি গুরুত্ব দেন। ‘ভক্তি রত্নাকর’ গ্রন্থে তিনি ঘোষণা করেন যে ‘জীব ও ‘জগৎ’ ব্রষ্ম থেকে স্বতন্ত্র নয়। জীবজগৎ ও ব্রষ্মের স্বাতন্ত্র্যের ধারণার ভিত্তি হল অজ্ঞানতা। তিনি বলেন ব্রষ্ম সম্পর্কে অভেদ-এর ধারণাই হলো ‘জ্ঞান’। তিনি লিখেছেন ‘ক্ষর’ ও ‘অক্ষর’-এর সমন্বয়েই এই বিশ্বজগৎ। ক্ষর হলো ‘জীবাত্মা’ এবং ‘অক্ষর’ হলো পরমাত্মা। পরমাত্মা সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের নির্দেশক। পরমাত্মা হলেন পুরুষোত্তম। পুরুষোত্তম কৃষ্ণই পরমাত্মার প্রতিভূ। নামসংকীর্তনের মধ্য দিয়েই পুরুষোত্তম কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘কেবল আমাকে স্মরণ কর। শংকরদেব তাই এক স্মরণের কথা বলেছেন। এজন্য তাঁর ধর্মমত ‘এক শরনিয়া ধর্ম’ নামে পরিচিত। ‘নাম ঘর’-এর মধ্যে কীর্তন ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করার কথা বলেন।

শংকরদেবের প্রধান শিষ্য ছিলেন মাধবদের। মাধবদেবের মৃত্যুর (১৫৯৬ খ্রিঃ) পর তাঁদের প্রবর্তিত ‘মহাপুরুষিয়া সম্প্রদায়’ একাধিক উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। দামোদরদেব ‘ব্রত্নসংহতি’ বা বামুনিয়া সম্প্রদায় গঠন করেন। অন্য একটি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন অনিরাজদের। এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্য ছিলেন মৎস্যজীবী। এঁরা তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করতেন। এই সম্প্রদায় ‘মোয়া-মারিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। শংকরদেবের পৌত্র পুরষোত্তম ঠাকুর ‘ঠাকুরিয়া’ সম্প্রদায় গঠন করেন। তাঁরই জনৈক অনুচর গোপালদেব ‘কালসংহতি’ নামে অপর একটি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। পূর্ববঙ্গে চৈতন্যবাদের প্রসার ঘটান নরোত্তম ঠাকুর। চৈতন্যদেব জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করার কারণে নিম্নবর্ণের বহু মানুষ চৈতন্যবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ধনী বণিকদের অনেকেই বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment