আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একজন নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলমানের মতোই আচরণ করতেন। তিনি নিজেকে ইসলামের অনুগত সেবক বলে ঘোষণা করেন এবং কোরান-নির্দেশিত পথে রাষ্ট্রশাসনের অঙ্গীকার করেন। সিন্ধু থেকে দিল্লি প্রত্যাবর্তনের সময়েই তিনি উলেমা ও ধর্মগুরুদের মূল্যবান ধাতু ও অর্থ প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। শরিয়তের বিধান অনুসারে প্রায় আঠাশ প্রকার বেআইনি শুল্ক রহিত করে দেন। অধ্যাপক মহম্মদ হাবিবের মতে, উলেমাদের চাপে পড়েই তিনি শরিয়তবিরোধী শুল্কগুলি নিষিদ্ধ করেন। হিন্দুদের ওপর তিনি ‘জিজিয়া কর আরোপ করেন। এমনকি ব্রাহ্মণদেরও ‘জিজিয়া কর’ দিতে বাধ্য করেন। সুলতানের যুক্তি ছিল এই যে, শরিয়তে এমন কথা বলা নেই যে, ব্রাহ্মণরা ‘জিজিয়া’ থেকে মুক্ত থাকবে। তাঁর মতে, অ-মুসলমানরা সপরিবারে নিরাপত্তাসহ বসবাস করার অধিকারের বিনিময়ে এই কর দিতে বাধ্য। শরিয়তের বিধান অনুসারে ‘খামস’-এর ভাগ পরিবর্তন করেন। ইতিপূর্বে খামসের তিন-চতুর্থাংশ ভাগ সুলতান নিজে নিতেন এবং এক-চতুর্থাংশ ভাগ সেনাদলকে দিতেন। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী ফিরোজ এক-চতুর্থাংশ ভাগ সেনাদের প্রদান করেন। একজন মুসলমান সুলতান হিসেবে সমধর্মী মুসলমানের রক্তপাতকে তিনি অনৈতিক ও ইসলামের আদর্শবিরোধী বলে ঘোষণা করেন। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও বিরোধী মুসলমানের হত্যাকাণ্ডকে যথাসম্ভব পরিহার করার চেষ্টা করেন। ইসলামীয় ধর্মরাষ্ট্রের আদর্শ অনুযায়ী তিনি খলিফার অনুমোদন প্রার্থনা করেন। সিংহাসনে বসার ছয় বছরের মধ্যে তিনি দুবার খলিফার স্বীকৃতি অর্জন করেন। খলিফার প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে মুদ্রায় নিজের নামের সাথে তিনি খলিফার নামও খোদাই করেন। মুসলমান শাসকদের মধ্যে ফিরোজই প্রথম নিজেকে ‘খলিফার প্রতিনিধি’ বা ‘খলিফার নায়েব’ বলে ঘোষণা করেন। ড. আর. পি. ত্রিপাঠীর মতে, খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ফিরোজ দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছিলেন। এর ফলে মুসলমান প্রজাদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল এবং ধর্মের আবরণে তিনি নিজের দুর্বলতা ঢেকে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফিরোজ সিংহাসনে বসেই উলেমা ও মৌলবিদের প্রতি প্রশ্নহীন আস্থা জ্ঞাপন করেন। উলেমাদের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন। গোঁড়া উলেমারা যে সকল রীতি বা কাজকে ইসলাম-বিরোধী মনে করতেন, ফিরোজ শাহ সেগুলি নিষিদ্ধ করেন। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মনে করেন, ফিরোজ শাহ উলেমাদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে মৌলবাদীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, ফিরোজ শাহ ছিলেন গোঁড়া ও ধর্মান্ধ। এই ধর্মীয় সংকীর্ণতা তাঁর চরিত্রকে কলঙ্কিত করেছে। ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ. এল. শ্রীবাস্তব, আগা মেহদী হোসেন প্রমুখ ইতিহাসবিদও ফিরোজের ভ্রান্ত ধর্মনীতির বিরূপ সমালোচনা করেছেন। ড. মজুমদার লিখেছেন যে, ‘ফুতুহ-ই-ফিরোজশাহি’ গ্রন্থ পাঠ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাঁর চরিত্রে একজন গোঁড়া মুসলমানের দোষ-গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। এই দোষগুলির মধ্যে প্রধান ছিল সুন্নি-ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মমতের প্রতি অনুদারতা। তিনি মুসলমান সমাজকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন—সুন্নি মুসলমান এবং অ-মুসলমান। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমানরাও অ-মুসলমানের পর্যায়ে বিবেচিত হত। প্রথম শ্রেণিভুক্তরাই তাঁর সহানুভূতি লাভের অধিকারী ছিল। পরন্তু, সুলতান মনে করতেন অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের বিনাশ এবং সুন্নি মতবাদের প্রসার ঘটানোও তাঁর অন্যতম প্রধান কর্তব্য।
এ. এল. শ্রীবাস্তব লিখেছেন যে, ফিরোজের মা ছিলেন হিন্দু রমণী। তাই হিন্দুদের বিরুদ্ধাচরণ, গোঁড়া সুন্নি মুসলমানদের তোষণ এবং কোরান ও শরিয়তের পথে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, বিশুদ্ধ তুর্কি মুসলমানদের থেকে তিনি কোনো অংশে কম নন। ধর্ম এবং প্রশাসনে উলেমা, মাশাইক প্রমুখের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার অনিবার্য ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়। ড. মেহদী হোসেন লিখেছেন যে, এই উলেমারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হন এবং সংকীর্ণতা ও অনুদারতা দ্বারা অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়কে আহত করেন।
সমকালীন গ্রন্থে উল্লিখিত কয়েকটি ঘটনা ফিরোজ শাহের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। হিন্দুদের ওপর ‘জিজিয়া কর আরোপের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণদেরও তিনি এই কর প্রদানে বাধ্য করেন, যদিও ইতিপূর্বে ব্রাহ্মণদের কখনোই এই কর দিতে হত না। এর প্রতিবাদে ব্রাহ্মণদের একটি প্রতিনিধিদল আত্মহত্যার হুমকি দিলে সুলতান সানন্দে তা পালন করতে বলেন। অবশ্য পরে তিনি এই আদেশ সামান্য সংশোধন করেন। ব্রাহ্মণদের পরিবার এবং বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের প্রদেয় জিজিয়ার হার কমিয়ে বার্ষিক দশ তংকা ৫০ জিতল করেন। ফিরোজ হিন্দুদের নবনির্মিত বহু মন্দির ভেঙে দেন এবং সংগঠকদের কঠোর শাস্তি দেন। হিন্দুদের ধর্মীয় মেলা উপলক্ষ্যে সমবেত মুসলমান ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি, এমনকি প্রাণদণ্ডেরও আদেশ দেন। ফিরোজ নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, মন্দির নির্মাণের অপরাধে তিনি কয়েকজন সংগঠককে মন্দিরের সামনেই হত্যা করেন। কারণ একটি মুসলমান রাষ্ট্রে কোনো ‘জিম্মি’ যাতে মন্দিরনির্মাণ ও মূর্তিপূজার দুঃসাহস । দেখায়। আফিফ একটি ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন যে, মূর্তিপূজার প্রচার ও মুসলমান মহিলাদের মূর্তিপূজায় আকৃষ্ট করার অভিযোগে জনৈক ব্রাহ্মণকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুলতান ওই ব্রাহ্মণকে শাস্তি হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ অথবা অগ্নিদগ্ধ করে হত্যার নির্দেশ দেন। ওই ব্রাহ্মণ ধর্মত্যাগে অস্বীকৃত হলে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। লক্ষণীয় যে, কাউকে পুড়িয়ে হত্যা করা ইসলামধর্মের বিরোধী। অথচ ধর্মান্ধ ফিরোজ কোরানের একটি নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আর একটি নির্দেশ অমান্য করেন।
অ-মুসলমানদের নানাভাবে দমনের সাথে সাথে ফিরোজ শাহ তাদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রসারের কাজেও হাত দেন। তিনি লিখেছেন যে, “আমি আমার পৌত্তলিক প্রজাদের নবির ধর্মগ্রহণে উৎসাহিত করি এবং নির্দেশ দিই যে, যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে, তাদের ‘জিজিয়া’ প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এই সংবাদে বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তাদের জিজিয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হয়।” ভারতে মুসলমান আক্রমণের পর ফিরোজ শাহই প্রথম রাষ্ট্রকে ধর্মান্তরিত করার সংস্থায় পরিণত করার দুঃসাহস দেখান।
ফিরোজের সংকীর্ণ ধর্মচিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর অভিযানের মধ্যেও। বাংলাদেশ আক্রমণের সময় তিনি মুসলমানের রক্তপাত’ হবে এই অজুহাত দেখিয়ে অবরোধ তুলে নেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করে জগন্নাথদেবের নাসিকা ছেদন করে মূর্তিকে ভুলুণ্ঠিত করেন। নগরকোট আক্রমণকালে জাভালামুখী মন্দির ধ্বংস করেন ও মূর্তিকে অপবিত্র করেন। ফেরিস্তার বিবরণ থেকে এই মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায়। জাভালামুখীর মূর্তিগুলি টুকরো টুকরো করে গো-মাংসের সাথে মিশিয়ে কাপড়ে বেঁধে ব্রাহ্মণদের নাকের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ফিরোজ শাহের এই সকল কাজ নিঃসন্দেহে বিকৃত চিন্তার ফল। ধর্মের প্রতি আনুগত্যকে তিনি নগ্ন প্রতিহিংসার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন বলা যায়। তবে তাঁর এই আচরণের কারণ বা প্রেরণা সম্পর্কে বিতর্ক আছে। অনেকের মতে, ফিরোজ ছিলেন ধর্মান্ধ। কিন্তু সতীশ চন্দ্র এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ফিরোজ জানতেন যে, আলাউদ্দিন বা মহম্মদ তুঘলক উলেমাদের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন। ফলে এই সম্প্রদায় সর্বদা তাঁদের বিরোধিতা করে গেছেন। আলাউদ্দিন তাঁর সাহস ও শক্তির দ্বারা এই বিরোধিতাকে নস্যাৎ করেছিলেন। মহম্মদ তা হয়তো পারেননি। কিন্তু তাঁর যুক্তিবাদী মন কোনো অবস্থাতেই আপসের পথে অগ্রসর হয়নি। আলাউদ্দিনের মতো সামরিক শক্তি বা মহম্মদ তুঘলকের মতো যুক্তিবোধ ফিরোজ শাহের ছিল না। তাই তিনি আপসের পথ বেছে নেন।
সতীশ চন্দ্র লিখেছেন: “ফিরোজ রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে উলেমা ও মোল্লাদের নির্দেশ দেবার অধিকার সম্ভবত দেননি। তবে তাদের কতকগুলি বিশেষ অধিকার তিনি মেনে নিয়েছিলেন। উলেমাদের ইচ্ছানুযায়ী মুসলিম মহিলাদের সাধুসন্তদের কবরে পূজা দিতে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেন, অ-সুন্নিদের ইসলামবিরোধী বলে ঘোষণা করেন, ব্রাহ্মণদের ওপর জিজিয়া আরোপ করেন ইত্যাদি।”তবে সুলতানের এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যে সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল, তা সতীশ চন্দ্রও স্বীকার করেছেন। ড. মেহদী হোসেন মনে করেন, রাজত্বের শেষ পনেরো বছরে ফিরোজের ধর্মনীতি অতিরিক্ত অনুদার, সংকীর্ণ ও অত্যাচারমূলক হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সাচ্চা ইসলাম প্রতিপন্ন করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু কাজ করেছিলেন—যা তাঁর প্রজাকল্যাণমূলক সংস্কার কর্মসূচির সাথে আদৌ খাপ খায় না।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।