বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

ভারতে প্রবেশের সময় আর্যরা ছিল অর্ধযাযাবর জনগোষ্ঠী। তাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল পশুপালন। ঋগ্বৈদিক যুগে আর্য জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্রে ছিল পশুপালন। তবে কৃষিকাজ সম্পূর্ণ অজানা ছিল না। ঋগ্বেদের বিভিন্ন সুক্তে গবাদি পশুপালন সংক্রান্ত শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে প্রায় ১৭৬ বার। আবার সামান্য হলেও কৃষিকাজ সংক্রান্ত শব্দের প্রয়োগ ২১টি ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। ইরফান হাবিব ও বিজয়কুমার ঠাকুর মনে করেন যে, ঋগ্বৈদিক যুগে গবাদি পশুর প্রতিপালন গুরুত্ব পেলেও ঋগ্বেদের বহু স্থানে কৃষিকেন্দ্রিক যে উল্লেখ আছে, তা থেকে এমন অনুমান করা ভুল হবে না যে ঋগ্বৈদিক আর্যদের কাজে কৃষিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আদিবৈদিক পর্বে গবাদিপশু ছিল আর্যদের সব চাইতে মূল্যবান সম্পত্তি। গো-সম্পদের পরিমাণের নিরিখেই একজন ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা বিবেচিত হত। ঋগ্বেদে রাজা বা গোষ্ঠীপতির অভিধা ছিল ‘গোপতি’ বা গবাদি পশুর অধিকারী। আর্যরা নিজেদের মধ্যে যে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন তাকে ‘গোবিষ্ট’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ গো-সম্পদ দখল করাই ছিল এই সকল যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। আবার একজন বিত্তমান ব্যক্তিকে বলা হয়েছে ‘গোমৎ’। গবাদিপশু বৃদ্ধির কামনা করে দেবতা সোম-এর কাছে প্রার্থনাও করা হত। বিনিময়ের মাধ্যমে ছিল গরু। যজ্ঞানুষ্ঠানে দক্ষিণা হিসেবে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতকে গবাদি পশু দান করা হত। অর্থাৎ আদি পর্বে আর্যদের অর্থনীতিতে গবাদি পশু এবং নির্দিষ্টভাবে গোরু প্রধান চালিকা শক্তির কাজ করত। গবাদি পশুর ওপর গোষ্ঠীর সকল সদস্যের যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাখালের দল একই সাথে গোষ্ঠীর সকল পশুকে চারণক্ষেত্রে নিয়ে যেত। এবং একই গো-শালায় সকল গোরু বদ্ধ করে রাখা হোত। তাই এরা সবাই একই গোত্র ভুক্ত বলে বিবেচিত হত। পরবর্তীকালে গোত্র শব্দটি একই পূর্ব পুরুষের উত্তর পুরুষদের নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কন্যাসন্তানের আর এক নাম দুহিতা (দুহিতৃ), যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল যে নারী গাভী দোহন করে। ঋগ্বেদে অঘ্ন শব্দটির ব্যবহার গো সম্পদের গুরুত্ব নির্দেশ করে। ঋগ্বেদে ‘অঘ্ন’ অর্থাৎ গাভীকে হত্যা না করার বিধান দেওয়া হয়েছে। কারণ আদি পর্বে গোরুকে দেবতা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হত না। যজ্ঞানুষ্ঠান সহ অতিথি সৎকারের প্রয়োজনে গবাদি পশু হত্যা করা হত। সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে গোরু নিধনের ব্যপকতা অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর, এমন উপলব্ধি থেকে গো-হত্যাকে নিরুৎসাহিত করার প্রবণতা ঋগ্বেদে দেখা যায়। অধ্যাপক হাবিব মনে করেন যে, কৃষি কাজের প্রয়োজন থেকে গোরু হত্যা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ ঋগ্বেদের যুগেই শুরু হয়েছিল। গোরু ছাড়া ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি ঋগ্বৈদিক আর্যদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। শেষ পর্যায়ে গোরুর সাথে অশ্ব ও উট পালন শুরু হলে সম্পূর্ণ পশুপালন অর্থনীতি আর্যদের করায়ত্ত্ব হয়।

ঐতিহ্য ও প্রাচীন রীতি অনুযায়ী পশুপালন ঋগ্বেদিক আর্যদের অর্থ ভিত্তি হলেও, কৃষিকাজের সাথে তাদের পরিচয় এবং কৃষি উৎপাদনে অংশগ্রহণের প্রমাণও পাওয়া গেছে। ঋগ্বেদের পরবর্তী অংশগুলিতে কৃষিকর্মের সাথে সম্পর্কিত নানা বিষয়ের উল্লেখ দেখা যায়। হলো, ক্ষেত্র, সিরা, ফলা এবং বিভিন্ন শস্য দানার উল্লেখ ঋগ্বেদে ছড়িয়ে আছে। ‘হলো’ বলতে লাঙ্গলকে বোঝানো হয়েছে। ‘সিরা’ শব্দটিও লাঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত। ‘ফলা’ হল লাঙ্গলের সূঁচালো অগ্রভাগ। যা মাটি কর্ষণ করতে সক্ষম। জমিতে লাঙ্গল চালানোর ফলে যে সকল সরু সরু চ্যানেল তৈরী হয়েছে তাকে বলা হয়েছে ‘সীতা’। হলো টানা বলদকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হলোকারীর (কৃষক) অস্ত্রের উল্লেখও ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক হাবিব ও ঠাকুর পাকিস্তানের সোয়াট অঞ্চলে একাদশ শতকের একটি লাঙল কথিত ক্ষেত্র আবিষ্কার করে ঋগ্বৈদিক যুগে কৃষিকর্মের ধারণাকে সুদৃঢ় করেছেন। ঋগ্বেদের প্রথম ও দশম মণ্ডলে লাঙল চালনা, বীজ বপন, শস্য ঝাড়াই ইত্যাদি কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৃষিকাজ না করার জন্য অনার্যদের অনুন্নত রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, যা কৃষিকর্মে আর্যদের মনোনিবেশের সাক্ষ্য দেয়। আগুন দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করার কাহিনী বিদেঘ মাথব-এর পূর্ব মুখী যাত্রার বিবরণ থেকে জানা যায়। রামশরণ শর্মার মতে, ঋগ্বৈদিক যুগের শেষ দিকে কৃষি-অর্থনীতি পূর্বাপেক্ষা অনেকখানি স্থিতিশীল রূপ নিয়েছিল। তবে শস্য হিসেবে ঋগ্বৈদিক আর্যরা কেবল যব-এর সাথে পরিচিত ছিলেন বলে অনুমিত হয়। যব বলতে আকরিক অর্থে বার্লি বোঝায়। তবে এটিকে একাধিক শস্যের বর্ণনাম হিসেবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে। তবে ঋগ্বেদে গম-এর কোন উল্লেখ নেই। তবে আবেস্তায় উল্লিখিত গানতুমা শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃত গোধূম শব্দটি প্রয়োগ হতে পারে। তাই পূর্ব ইরান বা আফগাস্তিানে ‘গম’ পরিচিত হলে, ঋগ্বেদের আমলে ভারতেও গমের চাষ থাকা অসম্ভব ছিল না। ঋগ্বেদে ব্রীহি শব্দটি ধান বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছিল, এমন প্রমাণ নেই। সম্ভবত যে কোন ফসল বোঝাতেই এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। আবার ঋগ্বেদে কার্পাস-এর কোন উল্লেখ নেই, অথচ হরপ্পা সভ্যতার আমল থেকেই এই শস্যের ধারাবাহিক উৎপাদন অব্যাহত ছিল। এমন ঘটনাকে হাবির ও ঠাকুর ‘আকস্মিক অনুল্লেখ বলে মনে করেন। সম্ভবত জলসেচ দ্বারা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে তাদের পরিচয় ছিল। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পাথরের কপিকল জাতীয় চক্রের কথা বলা হয়েছে। এমনকি কূপ থেকে বালতি জাতীয় সরঞ্জামের (কাষ্ট নির্মিত) মাধ্যমে জল তোলার কথাও আছে। হাবিব ও ঠাকুর লিখেছেন যে, জমিতে সেচের জন্য কূপের এমন ব্যবহার কেবল নদীর তীরে বরাবর প্লাবনভূমিতে ফসল ফলানোর বাধ্যবাধকতা থেকে কৃষিকে মুক্ত করে। ভূগর্ভের জলে কৃষিকাজ প্রসারিত হল। একে তাঁরা ‘স্বল্পমাত্রায় এক ধরনের কৃষি বিপ্লব’ বলে উল্লেখ করেছেন। ঋগ্বেদের যুগে জমির মালিকানার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। গো-সম্পদের মত জমিতে যৌথ মালিকানা ছিল, এমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ঋগ্বেদে জমি ও তার কর্তৃত্ব বিষয়ক কয়েকটি প্রতিশব্দ পাওয়া যায়, যেমন উর্বরাজিত অর্থাৎ যে জমি দখল হতে পারে কিংবা উর্বরাপতি অর্থাৎ জমির দখলদার। কিন্তু ঋগ্বেদের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে জমি বিক্রয়, দান বা উপহার, বন্ধক ইত্যাদির কোন উল্লেখ নেই। তাই অনুমিত হয় যে, জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাটি সে যুগে স্পষ্ট ও ক্রিয়াশীল ছিল না।

ব্যাপক আকারে না হলেও ঋগ্বেদের যুগে হস্তশিল্প বা কারিগরি বিদ্যার সাথে আর্যদের পরিচয়ের আভাস পাওয়া যায়। হস্ত শিল্পের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দারুশিল্প, চর্মশিল্প, বয়নশিল্প, ধাতুশিল্প ইতাদি। ঋগ্বেদে কাঠের কারিগরকে তক্ষক্ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাঠের আসবাব, ঘরবাড়ি, ইত্যাদি নির্মাণের কাজে এদের দক্ষতা ছিল। রথকার নামক কারিগরের উল্লেখ থেকে অনুমিত হয় যে যুদ্ধের রথ নির্মাণকারী শিল্পীরা বিশেষ মর্যাদা পেতেন। চর্মশিল্পীরা ঋগ্বেদে চৰ্ম্মন্ন নামে অভিহিত হয়েছেন। চামড়া থেকে জলাবহনের থলি, ঘোড়ার লাগাম, বক্ষবন্ধনী ইত্যাদি তৈরী করা হত। ঋগ্বেদে সুতীবস্ত্র তৈরীর কোন উল্লেখ নেই। তবে মেষলোম দিয়ে শীতের উপযোগী পোষাক বানানোর কথা আছে। পাঞ্জাবের তীব্র শীতের পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজটিকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। দশম মণ্ডলে শিরীষ এর উল্লেখ থেকে অনুমিত হয় যে মহিলারাই সুতো কাটার কাজ করতেন। ধাতুশিল্পের প্রধান উপাদান ছিল সোনা, ব্রোঞ্জ ও তামা ঋগ্বেদে অয়স শব্দটিকে অধ্যাপক বি. বি. লাল লৌহধাতু বলে সনাক্ত করেছেন। কিন্তু ইরফান হাবিব, রামশরণ শৰ্মা, ডি. এন. ঝা প্রমুখ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, সাহিত্য বা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে কোন ভাবেই প্রমাণ করা যায় না যে, ঋগ্বৈদিক আর্যদের কাছে লোহা পরিচিত ছিল। অলংকার, কৃষি সরঞ্জাম বা গৃহস্থালির তৈজস ইত্যাদি সোনা, তামা এবং ব্রোঞ্জ ধাতু থেকে নির্মিত হত। নিস্ক শব্দটিকে স্বর্ণ বা রৌপ্যলংকারের সাথে যুক্ত বলে মনে করা হয়। ঋগ্বেদে আশ্চর্যজনকভাবে কুম্ভকারের উল্লেখ নেই। অথচ একাধিক স্থানে মৃৎপাত্রের উল্লেখ আছে। সম্ভবত আর্যরা মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয় পরম্পরাকেই গ্রহণ করেছিল। কুলাল শব্দটিকে মৃৎশিল্পীর সাথে সম্পর্কিত বলে অধ্যাপক শর্মা মনে করেন।

সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি বা উন্নত কারিগরি শিল্পের অভাব ঋগ্বৈদিক যুগে বাণিজ্যের সম্ভাবনা শিথিল করেছিল। পশুপালন ও যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে বাণিজ্যে নিয়োজিত হবার মত পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত কিংবা সময় ঋগ্বৈদিক কালে ছিল না। ঋগ্বেদে পনিস শব্দটির উল্লেখ আছে। সম্ভবত বাট্টা বা পান থেকে এর উৎপত্তি। পনিদের প্রতি আর্যদের অনাস্থা প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত অনার্য ব্রাহ্মণদের প্রতি বিরূপ সম্পদশালী স্থানীয় অধিবাসীদের বোঝাতে শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া ঋগ্বেদে বনিজ শব্দটির উল্লেখ আছে। সম্ভবত একান্তভাবে স্থানীয় স্তরে পণ্য লেনদেনের সাথে যুক্ত বণিকদের বোঝাতে এই শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে শতারিত্রনৌ এবং সমুদ্র শব্দ দুটির উল্লেখ থেকে কেউ কেউ মনে করেন যে ঋগ্বেদিক আর্যদের সাথে সমুদ্রের পরিচয় ছিল এবং শতদাঁড়বিশিষ্ট নৌকা (শতারত্রি নৌ) সমুদ্র ছাড়া চালানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিত নানা কারণে এই মত সমর্থন করতে পারেন নি। এঁদের মতে, (ক) সমুদ্রপথে বহির্বাণিজ্য চালানোর মত নগদ অর্থের লেনদেন তখন অজ্ঞাত ছিল। (খ) ঋগ্বৈদিক অর্থনীতি ছিল বিনিময় নির্ভর এবং বিনিময়ের প্রধান উপাদান ছিল গবাদি পশু, (গ) শতদাঁড় বিশিষ্ট বৃহদাকার নৌকো নোঙর করার উপযোগী কোন বন্দর সেকালে আবিষ্কৃত হয়নি। সম্ভবত, শতদাঁড় বিশিষ্ট নৌকো ছিল কল্পনার কাব্যিক প্রকাশ এবং সমুদ্র বলতে ঋগ্বেদে সিন্ধুনদের মোহনায় সঞ্জিত বৃহৎ জলরাশিকে বোঝানো হয়েছে। কারিগরি শিল্পের অপ্রতুলতা, বাণিজ্যের অনুপস্থিতি ইত্যাদি আনুসাঙ্গিক উপাদানের অভাব হেতু ঋগ্বৈদিক সমাজে শহর বা নগরের অভ্যুদয় ঘটেনি। ঋগ্বেদের বিবরণে কেবল গ্রাম সমাজের ছবি ফুটে উঠেছে। আবেস্তীয় ইশ্টিয়া শব্দটিকে সংস্কৃত ইষ্টক বা ইঁট এর প্রতিশব্দ হিসেবে মেনে নিলেও তখন ইটের ব্যবহার এতটাই কম ছিল যে ঋগ্বেদে তার উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়নি। ড. হাবিব ও ঠাকুর-এর মতে, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট যে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পরে নগর সভ্যতার অবক্ষয় ঘটেছিল এবং ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পর নগরের কোন অস্তিত্ব ছিল না এবং এই নগর বিমুক্ত সমাজ অব্যাহত ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দের শেষ পর্যন্ত।

পরবর্তী বৈদিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল আদিপর্বের পশুচারণ অর্থনীতি থেকে কৃষি অর্থনীতিতে উত্তরণ। এই সময় (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০-৬০০ অব্দ) আর্যদের কর্মকেন্দ্র পাঞ্জাব থেকে গঙ্গা-যমুনা দোয়াবসহ বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশে সম্প্রসারিত হয়েছিল। পূর্বমুখী অভিপ্রয়াণের সময় অগ্নি-পরাশরকে অনুসরণ করে আর্যদের যাত্রার কাহিনীকে পশুচারণ থেকে কৃষি-অর্থনীতিতে রূপান্তরের প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখা যায়। ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুসারে নদীর পূর্ব প্রান্তের এলাকা ছিল ‘অতি অকর্ষিত এবং জলাভূমিতে পূর্ণ”। জলাভূমির জঙ্গলাকীর্ণ ভূমি স্বভাবতই কৃষিকাজের উপযোগী ছিল না। তাই অগ্নি দ্বারা ঐ অঞ্চলকে জঙ্গল মুক্ত এবং কৃষির উপযোগী করে তোলা সম্ভব হয়। হাবিব ও ঠাকুরের মতে, আর্যদের পূর্বমুখী অভিগমনের আর একটি সম্ভাব্য কারণ ছিল শতদ্রু ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পর্যাপ্ত জলের অভাব। সরস্বতী আর দৃশদ্বতীর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং পরিণামে ঘর্ঘর ও হাক্রা নদীতে জলের জোগানের অভাব ইত্যাদি ঐ সকল অঞ্চলকে বসতির অনুপযোগী করে তুলেছিল। তাই অথর্ববেদে জলের যোগান বৃদ্ধির কামনায় প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। এমতাবস্থায়, প্রচুর বৃষ্টিপাতযুক্ত গাঙ্গেয় উপত্যকায় সরে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই নদীগুলির জলের উৎস ছিল হিমালয়ের হিমবাহ। ফলে সারা বছর ধরে কমবেশী জলের যোগান থাকত। উপরন্তু গাঙ্গেয় উপত্যকার অন্তর্ভুক্ত বিস্তির্ণ সমতলভূমি পলিমাটি সমৃদ্ধ হওয়ায় কৃষি উপযোগী ছিল। তাই ঋগ্বেদের শেষ দিকে পশুচারণ থেকে কৃষিজীবী হিসেবে আর্যজনগোষ্ঠীর রূপান্তরের যে সম্ভাবনা বায়বীয় অবস্থায় ছিল, পরবর্তী বৈদিক যুগে তাতে নতুন গতিবেগ আসে।

কৃষি অর্থনীতি বিকাশের ধারায় কৃষি-সরঞ্জামের উপাদান ও প্রয়োগরীতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সূক্ষ্ম ও ধারালো লাঙ্গলের ফলা সম্পর্কে আর্যদের পরিচয়ের বিবরণ শতপথ ব্রাহ্মণের ভাষ্য থেকে জানা যায়। তবে লাঙ্গলের ফলা হিসেবে লোহার ব্যবহার ছিল কিনা, সে প্রসঙ্গে সংশয় আছে এবং লোহার ব্যবহার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সাধারণভাবে অতি শক্ত উদ্বুম্বর বৃক্ষের কাঠ দিয়ে লাঙ্গল এবং খদির কাঠের ফলা নির্মিত হত। পাথরের ফলার ব্যবহারও ছিল। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে লোহার ফলা ব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে প্রাপ্ত লৌহ নির্মিত উপকরণগুলি অধিকাংশই হাতিয়ার জাতীয়। লোহার তৈরী সর্বাধিক পুরানো হাতিয়ারটি পাওয়া গেছে উত্তরপ্রদেশের নোহংতে। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ থেকে ৯০০ অব্দের মধ্যে এগুলি নির্মিত হয়েছিল। তীরের ফলা, বর্শা ইত্যাদি পাওয়া গেলেও, লাঙ্গলের ফলাজাতীয় কিছু পাওয়া যায় নি। তবে লৌহ কুঠারের ব্যবহার সীমিত ভাবে হলেও শুরু হয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শ্যামায়স বা কৃয়ায়স-এর উল্লেখ আছে, যা লোহার সমার্থক। অত্রাवিখেড়াতে একটি হাতল বিহীন কুঠার পাওয়া গেছে। এটি ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগের অবশ্যই নয়। বাজমেনীয় সংহিতায় কুঠারকে শত শত শাখাবিশিষ্ট বৃক্ষের ছেদনকারী হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে। বনজঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে লৌহ কুঠারের ব্যবহার নিশ্চিতভাবেই কৃষি অর্থনীতির সহায়ক হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র নির্মিতির সময়কালকে পরবর্তী বৈদিকযুগের সমকালীন বলে মনে করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে অনুমান করা হয় যে, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের উদ্ভাবন ও ব্যবহার হরপ্পা সংস্কৃতির পরে এবং ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগে ঘটেছিল। আদি বৈদিক পর্বে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের কোন নিদর্শন মেলেনি। তাই এটিকে পরবর্তী বৈদিক যুগের সমকালীন হিসেবে গণ্য করা যায়।

কৃষি অর্থনীতির সাথে পরিচিত হবার ফলে পশুপালন জীবিকা সম্পর্কে আর্যদের অনীহা সৃষ্টি হওয়া ছিল স্বাভাবিক, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে (পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ) বলা হয়েছে—ব্রাত্যজনেরা কৃষি ও বাণিজ্যের সাথে রপ্ত হয়ে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ যারা কৃষিকাজ করে না তারা বৈদিক জীবনচর্চার বিরোধী এবং ভদ্র সমাজে গ্রহণযোগ্য নয় (ব্রাত্য)। নিঃসন্দেহে এমন বক্তব্য কৃষি কাজের প্রতি আর্যদের আন্তরিকতার প্রমাণ দেয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, পরবর্তী বৈদিক স্তোত্রগুলিতেও বার বার অধিক সংখ্যায় গবাদি পশু লাভের জন্য প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ গবাদি পশু প্রতিপালন তখনও আর্য সমাজে অব্যাহত ছিল, যদিও কৃষি ছিল প্রধান জীবিকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গবাদি পশু গণ্য হত। কৃষি ও পরিবহণের কাজে গবাদি পশুপালন প্রয়োজনীয় অনুভূত হয়। লাঙ্গল টানা, গাড়ি টানা ও জল টেনে কূপ বা নদী থেকে উত্তোলনের কাজে পশুশ্রম কাজে লাগানো হত। যজুর্বেদ এবং ব্রাহ্মণ সাহিত্যে ছয়, আট, বারো, এমনকি চব্বিশটি বলদে লাঙ্গল টানার কথা বলা হয়েছে। এ থেকে গভীরভাবে হল কর্ষণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জমির গভীরে থাকা গাছ-গাছালির মূল ও কাণ্ডের নিম্নাংশে সরানোর জন্য ভারী প্রস্তর নির্মিত ফলা ব্যবহার করার সম্ভাবনা ছিল এবং এই কাজের জন্য অনেক বলদ বিশিষ্ট লাঙ্গল চালানোর দরকার হয়েছিল। এই কারণে শতপথ ব্রাহ্মণে বলদ ও গাভীর মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করার আর্জি জানানো হয়েছে। তবে গবাদি পশুর মাংস ভক্ষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়েছিল কিনা, বলা কঠিন। কারণ একই অনুচ্ছেদে যাজ্ঞবলক বলেছেন, ‘আমি নিজের জন্য এটি খাব, যদি তা নরম হয়।’ অর্থাৎ কৃষিকাজে উপযোগিতার বিচারে গো-শক্তি সংরক্ষণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। গোহত্যা নিয়ন্ত্রিত হলেও, তখনই একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। কেউ কেউ মনে করেন যে, বৃহত্তর ভূমিখণ্ডের অধিকারী পরিবারগুলি দ্রুত কৃষিজমি তৈরীর জন্য বর্ধিত সংখ্যার বলদযুক্ত লাঙ্গল ব্যবহার করতেন। এ. বি. কীথ-এর মতে, ব্রাহ্মণ্য যুগে বৃহৎ ভূমিখণ্ডে কৃষিকাজে দাসদের শ্রম দিতে হত। কিন্তু রামশরণ শর্মার মতে, কর্মকর বা ভাড়াটে মজুর এমন শব্দ বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়নি। পারিবারিক শ্রম দিয়ে চাষ করা সম্ভব এমন পরিমাণ জমিই লোকের হাতে থাকত। তাঁর মতে, দাস শ্রমিক ও স্বাধীন মানুষের অবস্থান জাতীয় বৈষম্য তখনকার সমাজে ছিল না। তবে অসাম্য ছিল এবং তার কারণ ছিল রাজা ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ কর্তৃক কর ও উপঢৌকন বাবদ কৃষকের উৎপাদনের অংশ দখলের প্রবণতা।

কৃষিকাজ জনপ্রিয় হবার অনুসঙ্গ হিসেবে কৃষিজ পণ্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ঋগ্বেদের আমলের যব বা বার্লি চাষ একালেও ছিল। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল গম (গোধূম)-এর উৎপাদন। এখনও পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের প্রধান খাদ্য হিসেবে গম জনপ্রিয়। তবে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘ব্রীহি’র উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রীহি অর্থে ধানকেই বোঝনো হয়েছে। হস্তিনাপুরে ধানের যে অবশিষ্ট উদ্ধার করা হয়েছে, যেটিকে খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের বলে মনে করা হয়। অধ্যাপক শর্মার মতে, এই পর্যায়ে পুনর্বপন দ্বারা ধান উৎপাদন সম্ভবত হত না। ডি. এন. ঝাও মনে করেন যে তখন উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকায় ধানের বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। ধর্মানুষ্ঠানে ধান ব্যবহার করা হত। কালক্রমে তিল ধর্মাচারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। এছাড়া ডাল, মটরশুঁটি, আখ ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। আখ সম্ভবত একটি বনজ দ্রব্য হিসেবে বিবেচিত হত। আদিপর্বে তিনটি শস্য বাজরা, জোয়ার এবং রাগির উল্লেখ পরবর্তী সাহিত্যে নেই। হাবিব ও ঠাকুরের মতে, গাঙ্গেয় উপত্যকার গভীরে এই গ্রন্থ (বাজসেনীয় সংহিতা) রচিত হয়েছিল, সম্ভবত সেখানকার জনপ্রিয় শস্যের মধ্যে এদের স্থান ছিল না। সমকালে কার্পাস উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া যায় না।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য সমূহে কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত যে সকল পরামর্শ উল্লেখ করা হয়েছে, তা সেকালে অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে কৃষির গুরুত্ব সুদৃঢ় করে। ঋতু বৈচিত্র্য সম্পর্কে তাদের সচেতনতা নিঃসন্দেহে কৃষি-বিষয়ক গবেষণার পরিণতি। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছে যবের বীজ শীতকালে বপন করে গ্রীষ্মে শস্য লাভ করা যায়। ধানের বীজ বপনের সময় বর্ষাকাল এবং ফসল পাকে হেমন্ত কালে। আবার তিল বপনের উপযুক্ত সময় গ্রীষ্মকাল এবং ফসল তোলা যায় শীতকালে। সার প্রয়োগ করে সুউৎপাদন লাভের বিষয়টি তখন অজ্ঞাত ছিল না। দুপ্রকার সারের উল্লেখ আছে- সকৃৎ বা গোময় এবং করীষ বা শুষ্ক গোময়। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিচিত সমস্যা বা বাধাগুলি সম্পর্কের পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। পোকামাকড় কিংবা ইঁদুরের দৌরাত্মে ছোট ছোট চারাগাছের অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা উচ্চারিত হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির বিপদ সম্পর্কেও তাঁরা সচেতন ছিলেন। অথর্ববেদে এই দুটি বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য যাদুমন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। যাদুমন্ত্রে উচ্চারণ দ্বারা পর্জন্য দেবকে তুষ্ট রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

যাযাবর অর্থনীতি থেকে পশুপালন অর্থনীতিতে উত্তরণের অনুসঙ্গ হিসেবে পরবর্তী বৈদিক যুগে কলা ও কারিগরি শিল্পের বিকাশ ঘটে। যজুর্বেদের রাজসেনীয় সংহিতার ত্রিংশতম অধ্যায়ে কারিগরি শিল্পের বিস্তারিত তালিকা পাওয়া যায়। কারিগরি শিল্পের অন্যতম ছিল কুমোর (কৌলাল), কামার (কর্মার), ধাতু গলানকারী (ধাতু বিগলক), বস্ত্র রংকারী নারী (রঞ্জয়িত্রী), চর্মকার (চর্মন্নু), স্বর্ণকার (হিরণ্যকার), সুরা প্রস্তুতকারী (সুরাকার), ধনুক নির্মাতা (ধনুকার) ইত্যাদি। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ধাতু হিসেবে সোনা, ব্রোঞ্জ, লোহা, তামা, টিন, সিসা ইত্যাদির উল্লেখ আছে। সম্ভবত তখন লোহাকে হাতুড়ি পিটিয়ে একটা অর্ধ-কঠিন পদার্থে পরিণত করার বিদ্যা মানুষের করায়ত্ত হয়েছিল। তবে নির্দিষ্ট মাত্রায় লোহাকে গলিয়ে ইস্পাত তৈরীর কারিগরি বিদ্যা নিশ্চয় তখনও করায়ত্ত হয়নি। তবে ধাতুর ব্যবহারের ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে কাঠের বা পাথরের ব্যবহার কিছুটা কমে ছিল। সম্ভবত তামার ব্যবহারই ছিল সবথেকে বেশি। বস্ত্রবয়ন ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। পশমী সুতোর উল্লেখ থাকলেও আশ্চর্যজনকভাবে কার্পাসের কোনো উল্লেখ নেই। সুতোকাটা, রং করা এবং বস্ত্র বয়নের কাজে মুখ্য ভূমিকা ছিল নারীদের। শতপথ ব্রাক্ষ্মণ ও অথর্ববেদে বয়ন শিল্পে নারীর অগ্রণী ভূমিকার উল্লেখ আছে। মৃৎশিল্পের প্রচলন যথেষ্ট ছিল। উৎখননে প্রাপ্ত কাচ ও কাচের বালা প্রমাণ করে যে কাচের গয়না ইত্যাদির প্রচলন ছিল এবং কাচ শিল্পীদের বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। বাজসেনীয় সংহিতার পুরুষমেধ স্তোত্র থেকে অন্যান্য পেশা হিসেবে ছদ্মবেশকার, বেতচেরাই কাজে নিযুক্ত নারী, মলম প্রস্তুতকারী নারী, কাষ্ঠ বাহক, শিকারী, সূচিশিল্পী, গনৎকার চিকিৎসক, ধোপানী ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়।

পরবর্তী বৈদিক যুগে সমুদ্র ও সমুদ্রযাত্রার ইঙ্গিত আছে। এই সময় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অঙ্গ হিসেবে, সীমিত আকারে হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। যজুর্বেদে ‘বনিজ’ শব্দটির অর্থ হল ‘বণিকের পুত্র’। তাই অনুমান করা সম্ভব যে বাণিজ্য কর্ম সেকালে বংশানুক্রমিক বৃত্তি হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পৃথক জলরাশি হিসেবে ‘পূর্ব’ ও ‘পশ্চিম’ সাগরের উল্লেখ আছে। এই জলরাশি বলতে সম্ভবত বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরকে বোঝানো হয়েছে। বাণিজ্য চালাত মূলত বৈশ্যরা। ঋণ হিসেবে অর্থ লেনদেনের উল্লেখ পাওয়া যায় শতপথ ব্রাহ্মণে। সেখানে ‘কুসীদ’ ও ‘কুসীদিন’ কথা দুটি পাওয়া যায়। ঋণ গ্রহীতাকে কুসীদ এবং ঋণ দাতাকে কুসীদিন বলা হয়েছে। অবশ্য এই সময়কালে মুদ্রা ব্যবহৃত হত এমন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। ‘নিস্ক’, ‘কৃয়ল’, ‘শতমান’ প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। স্বর্ণখণ্ড ‘নিস্ক’ পারিশ্রমিক হিসেবে পুরোহিতদের দেওয়া হত এমন প্রমাণ আছে। সম্ভবত একটি নির্দিষ্ট ওজনের স্বর্ণখণ্ড হিসেবে ‘নিস্ক’ বিনিময় করা হত। কৃয়ল ও শতমান কেও বিনিময়ের ধাতু হিসেবে ব্যবহার করা হত বলে অনুমিত হয়।

পরবর্তী বৈদিক যুগেও নগরের প্রতিষ্ঠার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। আগের মতই ‘পুর’ বলতে দুর্গাকার বসতিকেই বোঝাত। ইরফান হাবিবের মতে, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে দোকান, মেলাজাতীয় জনসমাবেশ বিশিষ্ট কোন শহরের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘কাশী’ বলতে বোঝাত একটি জনগোষ্ঠী, কোন শহর নয়। রামশরণ শর্মা, ডি. এন. ঝী প্রমুখের মতে, পরবর্তী বৈদিক যুগের একেবারে অন্তিম পর্বে হস্তিনাপুর (মিরাট) কৌশাম্বী, অহিচ্ছত্র প্রভৃতি এলাকায় নগরের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছিল। তবে এদের উৎপত্তিকাল হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতককেই নির্দিষ্ট করা সঠিক।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment