মগধ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ও মহাজনপদগুলির প্রকৃতি, মহাজনপদের যুগে শাসন ব্যবস্থা

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মগধ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ও মহাজনপদগুলির প্রকৃতি, মহাজনপদের যুগে শাসন ব্যবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মহাজনপদগুলির প্রকৃতি

সাম্রাজ্যগঠন প্রক্রিয়ার প্রাক্কালে মহাজনপদগুলির ভৌগলিক অবস্থান খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনের কিছু আভাস দেয়। প্রথমত, মহাজনপদগুলি অধিকাংশ গড়ে উঠেছিল বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে। পশ্চিম প্রান্তে পাঞ্জাব অঞ্চলে ছিল দুটি মহাজনপদ —পাঞ্চাল ও কুরু। আর দক্ষিণে ছিল মাত্র একটি অর্থাৎ অস্মক। লক্ষণীয় যে, বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা বা গুজরাট অঞ্চলে কোন মহাজন পদের আবির্ভাব ঘটেনি। অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনার উর্বর উপত্যকাই ছিল ভারতে রাজ্যগঠন প্রক্রিয়ার আঁতুড়ঘর। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ মহাজনপদই ছিল রাজতান্ত্রিক। মাত্র দু’টি বৃজি (বা বজ্জি) ও মল্ল ছিল গণরাজ্য। পরবর্তীকালে কম্বোজ রাজতন্ত্র থেকে গণরাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। এছাড়া কপিলাবস্তু, সুমসুমারগিরি, অম্লকপপা, কেশপুত্ত, পিপ্পলিবন প্রভৃতি অঞ্চলে বসবসাকারী শাক্য, কলয়, ভগ, বুলি, কালামা, মোরিয় প্রভৃতি উপজাতীয় গোষ্ঠি নিজ নিজ এলাকায় প্রজাতান্ত্রিক শাসন বলবৎ করেছিল। এদের মধ্যে ইতিহাসখ্যাত শাক্যজাতির রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু। এটি নেপালের তরাই অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। গৌতম বুদ্ধ এই শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। রাজা ও পুরোহিত (ব্রাহ্মণ) শ্রেণীর কঠোর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থাকার ফলে গণরাজ্য থেকেই বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি উদার ধর্মমতের উৎসরণ সম্ভব হয়েছিল। তৃতীয়ত, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় ভারতে কোনরকম রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। গোটা উত্তর ভারত বিভক্ত ছিল ছোট ছোট রাজ্যে এবং এদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত ছিল নিত্য ঘটনা। এইভাবে সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত মগধে সাম্রাজ্যবাদের বিজয় ঘোষিত হয়েছিল।

রাজতান্ত্রিক মহাজনপদগুলির অবস্থান ছিল মূখ্যত গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে। কৃষি অর্থনীতির বিকাশ এবং উপজাতীয় আনুগত্যের ক্ষয় রাজার আর্থিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল। উপজাতীয় আনুগত্যের পরিধি ছিল সীমিত। কিন্তু এর পরিবর্তে বর্ণগত আনুগত্য অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর পরিধিতে সক্রিয় হলে রাজতন্ত্র শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পায়। কাশী, কোশল, বৎস, অবন্তী, মগধ ইত্যাদি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের কেন্দ্র ছিল। রাজারা অধিকাংশই ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত। তবে অন্য বর্ণের সীমিত অস্তিত্বও দেখা যায়। দুটি উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জোটবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য সুদৃঢ়করণের কাজে লিপ্ত হতেন। ব্রাক্ষ্মণ ধর্মাচারের মাধ্যমে রাজার ওপর দেবত্ব আরোপ করে রাজা ও রাজপদকে ঈশ্বর অনুমোদিত ইহজাগতিক ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা দিতেন। এই ধারণাকে দৃঢ়ভিত্তি দেবার জন্য রাজা বলিদান ও রাজসূয়, অশ্বমেধ ইত্যাদি যজ্ঞের আয়োজন করতেন। এই কাজে রাজার প্রধান সহযোগী ছিল পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ। রাজসূয় যজ্ঞের মাধ্যমে পুরোহিত রাজাকে দৈব-ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রতিপন্ন করতেন। অন্যদিকে অশ্বমেধ যজ্ঞের মাধ্যমে রাজা তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জারী করতেন। যজ্ঞের অঙ্গ হিসেবে মন্ত্রপূত অশ্বকে বিচরণের জন্য ছেড়ে দেওয়া হত। ঘোড়াকে অনুসরণ করত সশস্ত্র সেনাদল। উক্ত ঘোড়ার পরিভ্রমণকৃত এলাকা রাজার আনুগত্যাধীন বলে প্রতিপন্ন হত। অবশ্য অশ্বমেধ যজ্ঞটি কেবল পরম শক্তিশালী রাজাই সম্পন্ন করতে উদ্যোগী হতেন। রাজপদ ছিল সম্ভবত বংশানুক্রমিক।

রাজারা স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তবে সম্ভবত স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। ইতিমধ্যে সভা-সমিতি’র মত গণপরিষদের অস্তিত্ব ও ক্ষমতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল। তবে রাজকার্যে পুরোহিত শ্রেণী ও রাজকর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাস্ত্রীয় বিধানের প্রতি রাজাকে আনুগত্যের শপথ নিতে হত। পুরোহিত শ্রেণী সেই শাস্ত্রীয় বিধানের রক্ষক বলে বিবেচিত হতেন। স্বভাবতই শাসন কাজে রাজ্য ও রাজ্যবাসীর মঙ্গল বিধানের নৈতিক দায়িত্ব রাজা অস্বীকার করতেন না।

গণরাজ্যগুলির অস্তিত্ব ছিল মূলত হিমালয়ের পাদদেশ এবং গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে। বর্তমান পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিম ভাগ এবং উপত্যকা অঞ্চলে শক্তিশালী গণরাজ্যের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। গণরাজ্যগুলির ভৌগোলিক অবস্থান প্রসঙ্গে রোমিলা থাপার দুটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। এমন হতে পারে যে গাঙ্গেয় সমভূমির জলা-জঙ্গল পরিস্কার করে বাসযোগ্য করে তোলা অধিক কষ্টকর ভেবে শুষ্ক পার্বত্য উপত্যকা অঞ্চলে গণরাজ্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে রাজ্যগুলিতে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের যৌথ প্রয়াসে যে রক্ষণশীল সমাজ কায়েম করা হয়েছিল, তা থেকে মুক্ত থাকার জন্য দূরবর্তী পাহাড়ী অঞ্চল বেছে নিয়ে গণরাজ্য স্থাপন করা হয়েছিল। গণরাজ্য প্রতিষ্ঠার কারণটিও খুব পরিষ্কার নয়। অধিকাংশ পণ্ডিতের অনুমান যে, বৈদিক রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে উদার ও মানববাদী এক ধরনের জীবন ধারা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য বিশেষ সক্রিয় ছিল। প্রচলিত বৈদিক ধর্মাচার ও জাতি-বর্ণ বিভক্ত সমাজব্যবস্থা পরিবর্তে এক ধরনের সাম্যবাদী সমাজ ও গণসমর্থন ভিত্তিক রাজনীতি গড়ে তোলার কাজে গণরাজ্যগুলির আন্তরিকতার প্রেক্ষিতে উপরোক্ত অভিমত সত্য বলেই মনে হয়। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী (D. D. Kosambi) লিখেছেন যে, মল্ল ও লিচ্ছবি, গণরাজ্যভুক্ত দুটি জাতিগোষ্ঠীকেই নীচ ও মিশ্রজাত বলে গণ্য করা হত। উভয়েই ‘ব্রাত্য’ ক্ষত্রিয়দের শাখা। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচার মানত না। শাক্যরা (গৌতম বুদ্ধতেই বংশের অন্তর্ভুক্ত) সাধারণ ক্ষত্রিয় হিসেবে নিজেদের গন্ডির মধ্যে বসবাস করত। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ-এর অধীনে থাকা কালেও তারা উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম ছিল। ভিনসেন্ট স্মিথ (V. S. Smith) শাক্যদের অনার্য ও বলিষ্ঠ পাহাড়ী মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ড. কোসাম্বী মনে করেন এমন ধারণা সত্য নয়। শাক্যরা আর্য ভাষায় কথা বলত এবং আর্যদের জীবন ধারা অনুসরণ করত।

মহাজনপদের যুগে শাসন ব্যবস্থা

গণরাজ্য বা গণসংঘগুলিতে যৌথ প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন উপজাতির প্রতিনিধিরা প্রশাসনিক কেন্দ্রে (রাজধানী) সমবেত হয়ে আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচী গ্রহণ করতেন। গণরাজ্যগুলির পরিধি ছোট থাকার কারণে প্রান্তিক এলাকার প্রতিনিধিরাও স্বচ্ছন্দে কেন্দ্রীয় আলোচনায় যোগ দিতে পারতেন। উপজাতীয় প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে মনোনীত একজন সভাপতির দায়িত্ব পেতেন। তাঁকেই বলা হত ‘রাজা’। সভাপতি বা রাজপদ অবশ্যই বংশানুক্রমিক ছিল না।

সাধারণভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করা হত। অন্যথায় ভোটাভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতটি গ্রহণ করা হত। শাসনকাজ পরিচালনার জন্য নানাশ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করা হত। স্তরভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা ছিল একটু জটিল ও দীর্ঘসূত্রী। আগেই দেখেছি যে, গণরাজ্যগুলি বৈদিক রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত থাকতে আগ্রহী ছিল। স্বভাবতই এগুলিতে ব্রাহ্মণদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ধারণা গুরুত্ব পায়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল এদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাই দেখা গেছে যে, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্ম দর্শনগুলি কোন না কোন গণ রাজ্য থেকে প্রচারিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক পর্যন্ত গণ রাজ্যগুলি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক ধারণা মত খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ—৪র্থ শতকের প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় গণ অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। সেকালে উপজাতীয় পরিষদ একক স্বৈরাচারী শাসকের পরিবর্তে ‘গণ-শাসক’ (multiruler janapades) ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল, যাকে সীমিত প্রজাতান্ত্রিক (Limited Republican system) ব্যবস্থা বলা যায়।

রাজন্য শাসিত জনপদগুলিতে রাজাই ছিলেন প্রধান শাসক। সাধারণত রাজা বংশানুক্রমিক ভাবে শাসন কর্তৃত্ব ভোগ করতে পারতেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিজয়ের মাধ্যমে রাজার গৌরব বৃদ্ধির রীতি জনপ্রিয় ছিল। তাই খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে সাম্রাজ্যগঠন প্রক্রিয়ার সূচনালগ্নে রাজদ্বন্দু ছিল নিয়মিত ঘটনা। সাধারণভাবে সশস্ত্র-উপজাতি ভিত্তিক সেনা বাহিনী গঠন করা হত। পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যগঠন প্রক্রিয়া জোরালো হলে ‘উপজাতি ভিত্তি বর্জিত এক নতুন ধরনের সেনাবাহিনী’ গঠন করা শুরু হয়। এরা কেবল রাজার প্রতি অনুগত ছিল। এইভাবে আলোচ্য শতকের শেষদিকে রাজার সর্বময় কর্তৃত্বের ভিত্তি জোরালো করা সম্ভব হয়। মহাজনপদের যুগের রাজ্যভিষেকের সময় উপজাতিক নির্বাচন বা গোষ্ঠী অনুমোদনের প্রচলিত রীতির বিলোপ ঘটতে থাকে। তবে রাজন্যবর্গের একক স্বৈরাচার যাতে না স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়ে সেজন্য বেশ কিছু ব্যবস্থাও ছিল। এই যুগে সভা-সমিতির মত কোন গণ-পরিষদ না থাকলেও, রাজারা ব্রাহ্মণদের পরামর্শে ও রাজকর্মচারীদের সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তাঁরা সর্বদাই শাস্ত্রের বিধান মেনে চলতেন। ঐ যুগে প্রজাকল্যাণকারী রাজতন্ত্রের আদর্শ মেনে প্রজার ও রাজ্যের কল্যাণই রাজার প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত হত।

ষোড়শ মহাজনপদে চারটি বৃহৎ রাজ্যের উদ্ভব

ষোড়শ মহাজনপদের ষোলটি রাজ্যের মধ্যে ক্রমশ চারটি রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এগুলি হল কোশল, বৎস, অবন্তী ও মগধ। এদের মধ্যে প্রথমেই কোশল রাজ্যটি সম্পর্কে আলোচনা করা যায়। রামায়ণ ও পুরাণে ইক্ষবাকু থেকে প্রসেনজিৎ পর্যন্ত রাজাদের নামের তালিকা পাওয়া যায়। এই প্রসেনজিৎ ছিলেন মগধের হর্যঙ্কবংশীয় বিম্বিসারের সমসাময়িক। এই সময়ে কৌশল রাজ্যের রাজধানী ছিল শ্রাবন্তী। ইক্ষবাকুবংশীয় রাজাগণকে দিগ্বিজয়ী ও যজ্ঞকার রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাকাব্য অনুযায়ী তাঁরা দণ্ডকারণ্য থেকে তুঙ্গভদ্রার তীর, এমনকি শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিজয়াভিযান প্রেরণ করেছিলেন। সম্ভবত এর ফলেই কোশল রাজ্যের সীমা বর্ধিত হয় ও পার্শ্ববর্তী কাশী রাজ্যের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের সূত্রপাত হয়। এরই পরিণতিতে কাশী রাজ্য একসময় বিজয়ী কোশল রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়।

এরপর প্রসেনজিৎ নেপালের শাক্যগণের বশ্যতা আদায়ে সচেষ্ট হন, ও তা লাভও করেন। মগধরাজ বিম্বিসার তাঁর ভগিনী কোশলদেবীকে বিবাহ করলে প্রসেনজিৎ যৌতুক-স্বরূপ কালীগ্রাম বিম্বিসারকে দান করেন। পরবর্তীকালে বিম্বিসার পুত্র অজাতশত্রু নিজ পিতাকে হত্যা করলে ও সেই শোকে কোশলদেবী সহমৃতা হলে ক্রুদ্ধ প্রসেনজিৎ কাশী ফেরৎ নিতে মনস্থ করেন। ফলে অজাতশত্রু ও প্রসেনজিতের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ চলতে থাকে। শেষে প্রসেনজিৎ নিজ কন্যা বজিরার সাথে অজাতশত্রুর বিবাহ দিয়ে পুনরায় কাশীগ্রাম যৌতুক রূপে প্রত্যপর্ণ করেন। কিন্তু এ শান্তি ছিল সাময়িক। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই কোশলরাজ, লিচ্ছবি-প্রধান চেতকের নেতৃত্বে গঠিত মগধবিরোধী শক্তিজোটে যোগদান করেন। এই শক্তিশালী জোটের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ষোলো বছর কঠিন সংগ্রাম করার পর অজাতশত্রু জয়ী হন। সম্ভবত এই সময়েই বা তার আগেই কোশল রাজ্যের পতন ঘটে। কেননা প্রসেনজিতের পর একমাত্র বিবাহ ভিন্ন অপর কোন কোশলরাজের নাম জানা যায় না। আবার অনেকে মনে করেন, শেষোক্ত যুদ্ধ শুরু হবার আগেই প্রসেনজিতের মৃত্যু হয়েছিল। যাই হোক্ না কেন, কোশলের উপর শেষ পর্যন্ত মগধের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এই সময় অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন মহাপরাক্রমশালী চণ্ড প্রদ্যোৎ মহাসেন। তিনি বৎস, মগধ ও কোশলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর আক্রমণ আশঙ্কায় অজাতশত্রু পর্যন্ত রাজগৃহকে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টন করে সুরক্ষিত করেন। বৌদ্ধগ্রন্থ ও পুরাণ অনুযায়ী প্রদ্যোৎ পরাক্রমশালী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সুনীতির দ্বারা পরিচালিত হতেন না। তাঁর পরে পালক, বিশাখসূপ, আর্থক ও নন্দীবর্ধন অবন্তীর সিংহাসনে বসেন। অবন্তীর সঙ্গে মগধের সংঘর্ষ অজাতশত্রুর সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। উদয়নের সময়ে তা তীব্র আকার নেয়। পরিশেষে শিশুনাগ অন্তর্দ্বন্দ্বে দুর্বল অবশ্তী দখল করে তা মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। চারটি রাজ্যের মধ্যে তৃতীয় রাজ্যটি ছিল বৎস। এই রাজ্যের রাজা উদয়ন ছিলেন বিম্বিসারের সমসাময়িক। এই রাজ্যটিও সম্ভবত শিশুনাগের সময়ে মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সুতরাং মগধ রাজ্যই শেষ পর্যন্ত বাকি সকল রাজ্যকে পরাস্ত করে এক সুবৃহৎ সাম্রাজ্য গঠনে সক্ষম হয়।

মগধ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান

ষোড়শ মহাজনপদের পরবর্তী যুগে মগধের নেতৃত্বে একক বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু কোন্ রাজবংশের সময় থেকে মগধ সাম্রাজ্যের উত্থানের সূচনা ঘটে, বা কোন্ রাজবংশের পর কোন্ রাজবংশ মগধে রাজত্ব করে সেই বিষয়ে কিছু বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। এ বিষয়ে মহাভারত, পুরাণ ও বৌদ্ধগ্রন্থ প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে কিছু অমিল লক্ষ্য করা যায়। ঋগ্বেদে মগধকে ‘কৈকত’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে জনৈক পরমগন্ড শাসন করতেন। রামায়ণ কাব্যে গিরিব্রজ বা বসুমতি নামক ব্যক্তিকে মগধ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাত বলা হয়েছে। পুরাণ অনুযায়ী খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় বরাহদ্রথ বংশ মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল। এরপর সেখানে রাজত্ব করত প্রদ্যোতগণ। অবশেষে শিশুনাগ মগধের সিংহাসন অধিকার করে শিশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন ও এই সময় থেকেই মগধ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয়। পুরাণে এও বলা হয়েছে যে, বিম্বিসার ছিলেন শিশুনাগবংশীয়। অন্যদিকে অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত, মহাবংশ ইত্যাদি গ্রন্থ অনুযায়ী বিম্বিসার ছিলেন হর্ষকবংশীয় নৃপতি। হর্ষবংশের শাসন শেষ হবার পরেই মগধের সিংহাসনে শিশুনাগ অধিষ্ঠিত হন। অর্থাৎ শিশুনাগ বিম্বিসারের বহু পরবর্তী রাজা ছিলেন। অধিকাংশ পণ্ডিতই এই মত মেনে নিয়েছেন। কারণ পুরাণের প্রদত্ত তথ্যে বেশ কিছু পরস্পর-বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়।

প্রথমত, শিশুনাগ প্রদ্যোতগণের গর্ব খর্ব করেছিলেন বলে পুরাণে বলা হয়েছে। এখানে প্রদ্যোতগণ বলতে অবন্তীরাজ প্রদ্যোতের বংশধরদের বোঝায়। যে প্রদ্যোত আবার বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সমসাময়িক ছিলেন বলে সংস্কৃত কাব্য, নাটক ও পালিগ্রন্থাদি থেকে জানা যায়। শিশুনাগ যদি বিম্বিসারের পূর্বরপুরুষ হতেন, তাহলে তাঁর পক্ষে প্রদ্যোত-এর বংশধরদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত হওয়া ছিল নিতান্তই অবাস্তব ব্যাপার। এক্ষেত্রে শিশুনাগকে অবশ্যই বিম্বিসারের পরবর্তী সময়ের লোক হতে হবে। তাই বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে যেরূপ বলা হয়েছে, অর্থাৎ হর্ষঙ্ক বংশের পর শিশুনাগ বংশ মগধের সিংহাসনে বসেছিল, সেই মতই সত্য বলে মনে হয়, দ্বিতীয়ত, পুরাণ অনুযায়ী বারাণসী ও বৈশালী ছিল শিশুনাগের রাজ্যভুক্ত। কিন্তু বিম্বিসার কোশল রাজকন্যাকে বিবাহ করে যৌতুকস্বরূপ কাশী লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ বিম্বিসারের পূর্বে কাশী মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়নি। তাই কাশী শিশুনাগের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল, একথা যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে বিম্বিসারকে অবশ্যই শিশুনাগের পূর্ববর্তী হতে হয়। আবার শিশুনাগ কর্তৃক বৈশালীতে রাজধানী স্থাপনের পর পূর্বতন রাজধানী রাজগৃহ তার পূর্ব গৌরব হারায়। এই রাজগৃহ ছিল বিম্বিসার-অজাতশত্রুর সময়ে মগধের রাজধানী এবং এঁদের শাসনকালকেই রাজগৃহের সমৃদ্ধির যুগ বলা যায়। তাই শিশুনাগ যদি বিম্বিসারের পরবর্তী না হন, তাহলে রাজগৃহের গৌরব অস্তমিত হবার পর তাঁর রাজধানী হিসেবে বৈশালীর উত্থানের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এই সমস্ত দিক বিচার করে পণ্ডিতগণ বিম্বিসারের পরবর্তীকালীন ব্যক্তি হিসেবেই শিশুনাগের স্থান নির্দিষ্ট করেছেন। সেক্ষেত্রে বিম্বিসারের পক্ষে শিশুনাগ বংশোদ্ভূত হবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই প্রথমে হর্যঙ্কবংশীয় বিম্বিসার-অজাতশত্রু ইত্যাদিরা মগধে রাজত্ব করেছিলেন ও তার পরবর্তীকালে শিশুনাগ মগধের সিংহাসন দখল করে শিশুনাগ বংশ প্রতিষ্ঠিত করেন—এই মতই যুক্তিগ্রাহ্য। এই কারণে ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বলেছেন যে, ‘মগধে রাজবংশগুলির আদি ইতিহাস অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। রাজা হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায় তাঁদের কেউ কেউ সফল সামরিক নেতা। কারও কারও নাম নিছক কল্পনাশ্রয়ী। হর্ষঙ্ক বংশীয় বিম্বিসারের আমল থেকেই ঐতিহাসিক রাজতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল।’

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment