মৌর্যযুগের সমাজব্যবস্থা : বর্ণপ্রথার স্বরূপ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সমাজব্যবস্থা

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগের সমাজব্যবস্থা : বর্ণপ্রথার স্বরূপ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সমাজব্যবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্যযুগের সমাজব্যবস্থা : বর্ণপ্রথার স্বরূপ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সমাজব্যবস্থা

বেদ-পরবর্তী সমাজব্যবস্থা:

বেদ-পরবর্তী সমাজব্যবস্থা, রীতিনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে রামায়ণ ও মহাভারত এই দুটি মহাকাব্য যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করে। তবে মহাকাব্য দুটি বহু অংশ পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত হওয়ায় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এদের মূল্য তর্কাতীত নয়। বৈদিক যুগের মতই এ যুগেও সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার। নারীরা সাধারণত বহু স্বামী গ্রহণ করত না। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী গ্রহণের ঘটনাকে ব্যতিক্রম বলা যায়। এ যুগে নারীর মর্যাদা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। সতীদাহ প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। তবে কন্যাদের পরিণত বয়সে বিবাহ দেওয়া হত। যেমন—কুস্তী, দ্রৌপদী, উত্তরা প্রভৃতির বিবাহ পরিণত বয়সেই হয়েছিল। কন্যারা পিতৃগৃহে অধ্যয়নের সুযোগও পেত। মহাকাব্যের নারীদের দৃপ্ত চরিত্রের উদাহরণ বেশ কয়েক ক্ষেত্রে দেখা যায়। স্বয়ংবর সভাও তাদের আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় দেয়। সাধারণত প্রাজাপত্য বিবাহই কাম্য ছিল, কিন্তু আসুর বিবাহ বা রাক্ষস বিবাহেরও প্রচলন ছিল। পর্দাপ্রথার প্রচলন থাকলেও তার কঠোরতা ছিল না। নারীরা স্বয়ংবর সভায়, উৎসবে ও শোকের সময় অন্তঃপুরের বাইরে আসতে পারতেন।

জাতিভেদ প্রথা সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। শান্তিপর্ব থেকে জানা যায় যে, বর্ণ ছিল কর্মভিত্তিক। তবে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল। তেমনি একবর্ণের লোক অন্য বর্ণের পেশা গ্রহণ করতে পারত। যেমন ক্ষত্রিয় হয়েও ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করার দৃষ্টান্ত আছে। আবার ব্রাহ্মণগণ সেনাপতির পদ গ্রহণ করতে পারতেন। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় এযুগে বর্ণসংস্কারের উদ্ভব ঘটেছিল। বৈশ্যদের বৃত্তি ছিল কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ইত্যাদি। করের বোঝাও তাদেরই বহন করতে হত। শূদ্রদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়, তাদের কাজ ছিল উচ্চতর তিনবর্ণের সেবা করা। অবশ্য পশুপালন, কৃষি বা বাণিজ্যেও তাদের অধিকার ছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় প্রয়োজন হলে বৈশ্য বা শূদ্রর বৃত্তি গ্রহণ করতে পারত, কিন্তু শূদ্ররা বা বৈশ্যরা ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি নিতে পারত না।

মৌর্যযুগের সমাজব্যবস্থা

মৌর্যযুগের সমাজব্যবস্থা কেমন ছিল, তা জানতে হলে আমাদের নির্ভর করতে হয় গ্রীকদূত মেগাস্থিনিসের বিবরণ, কোটিল্যের অর্থশাস্ত্র, অশোকের লেখ ইত্যাদির উপরে। এ যুগের সমাজের ভিত্তি বর্ণাশ্রম-প্রথা। সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—এই চারটি প্রধান বর্ণ ছাড়াও বহু মিশ্র বর্ণ ছিল।

মেগাস্থিনিসের দৃষ্টিতে সমাজ

মেগাস্থিনিস সম্ভবত ভারতীয় সমাজের এই বিন্যাসকে সম্যকভাবে বুঝতে পারেননি। তাঁর দৃষ্টিতে সমাজের বৃত্তিভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস ধরা পড়েছিল এবং সেইভাবেই তিনি ভারতীয় সমাজে সাতটি জাতির অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই সাতটি জাতি হল – দার্শনিক, কৃষক, শিকারী ও পশুপালক, কারিগর, সৈনিক, পরিদর্শক এবং সম্পত্তির মূল্য নির্ধারক। এদের মধ্যে প্রথমেই স্থান ছিল দার্শনিকদের। এঁদের শ্রমসাধ্য কোন কাজ করতে হত না। গৃহস্থদের যাগযজ্ঞে পথনির্দেশ করা। রাজকীয় যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন করা ইত্যাদি ছিল এদের কাজ। এদেরকে আবার ব্রাকমেনিস ও সারমেনিস নামে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ব্রাকমেনিসগণ জীবনের প্রথম পর্বে তপোবনবাসীর জীবন কাটাতেন। পরবর্তী পর্বে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে বিবাহাদি করে সুখী গার্হস্থ্য জীবনযাপন করতেন। সারমেনিসগণ আবার ছিল দু প্রকার, যথা— অরণ্যবাসী ও চিকিৎসক। এঁরা সকলেই সমাজের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত কৃষকগণ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী। তাদের প্রধান কাজ ছিল চাষ করে ফসল ফলানো ও ফসলের নির্দিষ্ট অংশ রাজকর হিসেবে জমা দেওয়া। নির্বিঘ্নে কৃষিকাজ করতে পারার জন্য তাদের যুদ্ধ ইত্যাদির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত। সমাজের উপকারী শ্রেণী হিসেবে তাদের সযত্নে রক্ষা করা হত। শিকারী ও পশুপালক জাতির তথা তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত জাতির বৃত্তি ছিল বনে বনে শিকার করা ও গৃহপালিত পশুর রক্ষণাবেক্ষণ করা। চতুর্থ শ্রেণীভুক্ত কারিগর ও শিল্পীরা বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত থাকত। এরা অস্ত্রশস্ত্র, কৃষিকাজের উপযোগী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরি করত। এদের মধ্যে একাংশকে কর দিতে হত না, উল্টে রাষ্ট্রই তাদের ভরণপোষণ করত। এই অংশ যুদ্ধাস্ত্র বা যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করত। আবার অনেক কারিগর স্বাধীনভাবে শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করে তা বিক্রি করে বেড়াতেন। সৈনিক বা যোদ্ধাশ্রেণী ছিল পঞ্চম স্থানাধিকারী। এরা ছিল কৃষকদের পরবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী। এদের কাজ ছিল যুদ্ধ করা। যুদ্ধ যখন থাকত না অর্থাৎ শান্তির সময়ে এরা আলস্যে দিন কাটাত। রাজা এদের ব্যয়ভার বহন করতেন। ষষ্ঠ বিভাগে ছিল পরিদর্শকগণ। তারা গুপ্তচর বৃত্তি করত। অর্থাৎ রাজ্যে কোথায় কি ঘটছে তার খবর রাখত ও গোপনে রাজার কাছে তা পেশ করত। সভাসদ বা অমাত্য এবং মূল্যনির্ধারকগণ ছিল সপ্তম শ্রেণিভুক্ত। রাজার বিশ্বাসভাজন লোকেরাই এই পদে অধিষ্ঠিত হতে পারত। এরা প্রশাসন ও বিচারবিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হত। সমাজে এদের স্থান ছিল অত্যন্ত উচ্চে।

মেগাস্থেনিসের বিবরণের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে ঐতিহাসিদের মধ্যে মতভেদ আছে। একমাত্র আরিয়ানই মেগাস্থেনিসকে ‘প্রামাণ্য ব্যক্তি’ বলে মন্তব্য করেছেন। অবশ্য সোয়েনকেও তাঁর বিবরণের আপাত নির্ভরযোগ্যতা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু প্লিনী, স্ট্র্যাবো প্রমুখ মেগাস্থেনিসের বিবরণকে ‘ভ্রান্ত ও অবিশ্বাস্য’, ‘পক্ষপাতদোষে দুষ্ট’, ‘ঘটনা ও গল্পের সংমিশ্রণ’ প্রভৃতি আখ্যায় ভূষিত করেছেন। যেমন তিনি একচক্ষুবিশিষ্ট মাকড়সার পা-যুক্ত মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যা কল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে সোয়েনবেক লিখেছেন যে, মেগাস্থেনিসের কাছাকাছি থাকত মূলত আর্যরা। তাঁরা ঘৃণাবশত এইসব কল্প কথা তাঁর কাছে পরিবেশন করেছেন। অবশ্য কিছু বিষয়ে তাঁর কোন ধারণা ছিল না, যেমন ধর্মসূত্রে ও অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ-সম্পর্ককে বৈধতা দান করা হয়েছে। কিন্তু মেগাস্থেনিস একবারও তার উল্লেখ করেননি। ধর্মশাস্ত্রে এও বলা হয়েছে যে, আপতকালীন অবস্থায় এক বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের পেশা গ্রহণ করতে পারবে। মেগাস্থেনিস এ সম্পর্কেও অজ্ঞ ছিলেন। তাছাড়া তিনি কিছু ভুল তথ্যও দিয়েছেন। যেমন ভারতীয়রা লিখতে জানত না, এদেশে ক্রীতদাস প্রথা ছিল না ইত্যাদি। আবার তিনি বলেছেন চুরি-ডাকাতি ছিল না, কিন্তু এও বলেছেন শাসনকার্যে প্রচুর গুপ্তচরের দরকার হত। এসব বৈপরীত্যের কারণ ছিল সম্ভবত তাঁর এদেশীয় ভাষাজ্ঞানের অভাব। অনেক ক্ষেত্রে তিনি অনুমান বা জনশ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন, তাই তাঁর বক্তব্যে কিছু বৈপরীত্য এসেছে। এসব ত্রুটি সত্ত্বেও তাঁর বিবরণীর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সমাজব্যবস্থা

কৌটিল্যের সমাজচিন্তার ভিত্তি ছিল রাষ্ট্র। তাঁর মধ্যে রাজার দণ্ডনীতির উপর সমাজব্যবস্থা নির্ভর করে। দণ্ডনীতির সঠিক প্রয়োগ আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সমর্থ হয়। সেই সুশৃঙ্খল অবস্থা চার বর্ণের মানুষ নিজ নিজ কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করতে পারে। কৌটিল্যের দৃষ্টিতে দণ্ডনীতিই হল সমাজের রক্ষক ও পালক। তিনি চারটি বর্ণের মানুষের কর্তব্যকর্মের তালিকাও প্রদান করেছেন। ব্রাহ্মণের কর্তব্যকর্ম হল অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন দান ও প্রতিগ্রহ। অর্থাৎ নিজে বিদ্যাভ্যাস করা, অন্যকে বিদ্যাভ্যাস করানো, নিজে হোম-যজ্ঞাদি করা, অন্যকে তা করানো ও দানগ্রহণ। ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য হল অধ্যয়ন, যজন, দান, অস্ত্রধারণের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ ইত্যাদি। বৈশ্যের কর্তব্য অধ্যয়ন, যজন, দান, কৃষি ও পশুপালন ও বাণিজ্য। শূদ্রের কর্তব্য ঊর্ধ্বতন তিন জাতির সেবা করা, বার্তা অর্থাৎ‍ কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্যের মাধ্যমে সামাজিক সম্পদ সৃষ্টি করা, শিল্পকাজ করা এবং কুশীলব কর্ম করা। একইভাবে তিনি চারটি আশ্রমে পালনীয় কর্তব্যসমূহও নির্দিষ্ট করেছেন।

কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন সংকর বর্ণের উদ্ভবের ব্যাখ্যা করেছেন। এই সকল সংকর বর্ণের সৃষ্টি অনুলোম বিবাহ অর্থাৎ উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে নিম্নবর্ণের স্ত্রীর বিবাহ ও প্রতিলোম বিবাহ অর্থাৎ নিম্নবর্ণের পুরুষের সাথে উচ্চবর্ণের নারীর বিবাহের মাধ্যমে। যেমন ব্রাহ্মণের বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্ররা হল যথাক্রমে অজুষ্ঠ ও নিষাদ। আবার শূদ্রের ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্র চণ্ডাল। তেমনি ক্ষত্রিয় পুরুষ ও শূদ্রা নারীর পুত্র উগ্র। শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয় নারীর সন্তান ক্ষত্ত ইত্যাদি। আবার এই সকল শংকর বর্ণের মিলনে আরো নানারকম বর্ণের উদ্ভব ঘটেছিল সমাজে। কৌটিল্যের এই বিধান থেকে একথা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সমাজে শূদ্রর সাথে বিবাহ সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল না।

বর্ণপ্রথার স্বরূপ: মৌর্যযুগ

খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দে চতুর্বর্ণ প্রথার নিরিখে বর্ণব্যবস্থার ব্যাখ্যা করা সঠিক হবে না। বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগে চতুর্বর্ণ প্রথার যে চরিত্র তা শ্রেণী বা জাতিপ্রথার বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি সাজুয্যপূর্ণ নয়। ঋগ্বেদের যুগে গায়ের রং-এর ভিত্তিতে দুটি বর্ণের যথা আর্যবর্ণ ও দাস্যুবর্ণ উল্লেখ আছে। এটিকে স্তরীকৃত সমাজ ব্যবস্থার দ্যোতক বলা যায় না। বর্ণ সমাজের জটিলতা এই সময় (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ) ছিল না। ঋগ্বেদের সমাজে সামাজিক ব্যবধান থাকলেও তাকে বর্ণভেদ ব্যবস্থা দ্বারা চিহ্নিত করা সঠিক নয়। এই সময় সমাজ সংগঠিত হত উপজাতীয় ভিত্তিতে। দাস বা দস্যু নামক সেবক শ্রেণির অস্তিত্ব থাকলেও শূদ্র নামক কোন সেবক শ্রেণির উল্লেখ পাওয়া যায় না। পরবর্তী বৈদিক যুগে (খ্রিঃ পূঃ ১০০০-৬০০ অব্দ) চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার সক্রিয়তা দেখা যায়। এখন গায়ের রং-এর বদলে ভোগ অধিকার ও সেবা দানের ভিত্তিতে সামাজিক বিন্যাস ঘটতে থাকে। প্রথম তিনটি বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) ‘দ্বিজত্বে’র অধিকারী হয়, যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। শূদ্রদের প্রধান বৃত্তি ছিল উচ্চ তিন বর্ণের সেবা করা। যাগযজ্ঞের কঠোরতা এবং যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনার কাজে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার উচ্চ দুই শ্রেণীর সামাজিক সুবিধাভোগীর বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে দেয়। তবে এই কালপর্বেই ব্রাহ্মণদের সাথে ক্ষত্রিয়দের বর্ণানুক্রমের প্রভেদ অনেকটাই শিথিল হতে শুরু করেছিল। কারণ রাজন্য তথা ক্ষত্রিয়দের রাজনৈতিক উত্থান এবং ব্রাহ্মণদের বৃত্তিগত সুযোগসুবিধা অর্জনের জন্য রাজার ওপর নির্ভরতা ক্ষত্রিয়দের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা স্পষ্ট করেছিল। এই সমাজ কৃষিসমাজ হলেও, কঠোরভাবে বর্ণবিভক্ত সমাজ ছিল না। বৈশ্য ও রাজন্যের মধ্যে খুব বেশী দূরত্ব গড়ে ওঠেনি। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ শতকে কৃষি ও কারিগরী শিল্পে লোহার ব্যাপক প্রচলন শুরু হলে উপজাতীয়, পশুচারী ও প্রায় সমতাবাদী বৈদিক সমাজে পরিবর্তন শুরু হয়। এখন উৎপাদনের উদ্বৃত্ত ভোগের সূত্রে শ্রেণী বিভক্ত সমাজ গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উপজাতীয় প্রধান বিশাল ভূখণ্ড দখল করে। ফলে কৃষিকাজের জন্য তাদের বহুসংখ্যক দাস ও ভাড়াটে মজুরের প্রয়োজন হয়। সম্পন্ন কৃষক এবং কারিগরী উৎপাদনের কাজে যুক্ত লোকেরাও ভাড়াটে মজুর নিয়োগ করতে শুরু করে। ফলে উচ্চতর তিনবর্ণের সাথে চতুর্থ বর্ণের সদস্যদের সামাজিক প্রভেদ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এই প্রেক্ষাপটে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দের বর্ণপ্রথার প্রকৃতি অনুধাবন করা যেতে পারে।

মৌর্যযুগের সমাজ বর্ণাশ্রম প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি প্রধান বর্ণের অস্তিত্ব যেমন ছিল, তেমনি অনেক নীচ বর্ণ বা সংকর বর্ণের সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের স্থান আগের মতই সর্বোচ্চে ছিল। তাঁরা পুরোহিত ও রাজার পরামর্শদাতা হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকেও প্রভাবিত করতে পারতেন। ব্রাহ্মণকে কোন কর দিতে হত না, ব্রাহ্মণের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা নিষিদ্ধ ছিল। শারীরিক নির্যাতন বা মৃত্যুদণ্ড ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত ছিল না। সমাজে এক বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে ব্রাহ্মণরা বসবাস করতেন। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজ্ঞ পরিচালনা, রাজার পরামর্শদাতা ইত্যাদি সম্মানজনক ও মহান বৃত্তির অধিকারী হিসেবে ব্রাক্ষ্মণের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল।

মেগাস্থিনিস, স্ট্র্যাবো প্রমুখের বিবরণীর নিরিখে মৌর্যযুগে চতুবর্ণ ব্যবস্থার যথার্থ বিচার করা কিছুটা কষ্টকর। কারণ বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ইত্যাদি তথাকথিত প্রতিবাদী ধর্মমতের উদ্ভব ও বিকাশ বৈদিক যুগের প্রচলিত সামাজিক বিন্যাসকে বিঘ্নিত করেছিল। তাই ভারতে আগত গ্রীক লেখক ভারতীয় সমাজের বিন্যাস সঠিক উপলব্ধি করতে পারেন নি। বলা যায় মেগাস্থিনিসের তেমন কোন বিশেষ উদ্দেশ্যও ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পাটলিপুত্রে অবস্থানকালে তিনি তাঁর চারপাশে কর্মভিত্তিক বিভিন্ন শ্রেণিকে ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তিতে নিযুক্ত থাকতে যেমনটি দেখেছিলেন, তারই প্রতিচ্ছবি ছিল মেগাস্থিনিসের বিবরণ। তবে বর্ণজাতি ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন, এমনটা হয়ত নয়। কারণ সমাজে সাতটি শ্রেণীর বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি শ্রেণিভিত্তিক বৃত্তিগ্রহণ, বৃত্তি বদলের নিষেধাজ্ঞা, এক শ্রেণীর সাথে অন্য শ্রেণীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা ইত্যাদি বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শ্রেণীবৈচিত্র্যকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নিরিখে। এক্ষেত্রে মেগাস্থিনিস বর্ণিত সামাজিক গোষ্ঠীগুলির অবস্থান অনেকাংশে আড়াআড়ি। অথচ ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থার অবস্থান উপর-নীচে। সম্রাট অশোকের বিভিন্ন লেখতে এই বিভাজিত সমাজের আভাস পাওয়া যায়। তিনি আর্য বা মর্যাদাবান বিশিষ্ট মানুষের পাশাপাশি সমাজে নিম্নক্রমের অন্তর্ভুক্ত দাস (দাসভটক) বা ভৃত্য শ্রেণীর উল্লেখ করেছেন। ক্ষমতাবান, সম্মানীয় (মহৎ) ব্যক্তির বিপরীতক্রমে তিনি নগণ্য (খুদক) মানুষের অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন।

গ্রীক লেখকগণ দার্শনিক বলতে মূলত ব্রাহ্মণদের বোঝাতে চেয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন বৌদ্ধ শ্রমণরাও মেগাস্থিনিস কথিত দার্শনিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তবে অনেকের মতে, বৌদ্ধ শ্রমণদের বৈশিষ্ট্য দার্শনিকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীদের সাথে তাদের একাংশের মিল আছে। মেগাস্থিনিসের বর্ণনার পঞ্চম স্থানাধিকারী সেনাদল ছিল সম্ভবত ক্ষত্রিয় শ্রেণী। গ্রীক বিবরণী থেকে অনুমিত হয় যে, তৎকালীন সমাজে বৈশ্য ও শূদ্রের ব্যবধান ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছিল এবং তাদের পরিবর্তে সমাজে কৃষক, ব্যবসায়ী, পশুপালক প্রভৃতি স্বতন্ত্র জাতির সৃষ্টি হয়েছিল। মেগাস্থিনিস তাঁর বর্ণনায় স্বজাতি বিবাহ এবং বংশানুক্রমিক বৃত্তি অবলম্বনের বিষয়ে জোর দিয়েছেন। অনুমিত হয় যে তিনি তথাকথিত জাতিভেদ ব্যবস্থাই উল্লেখ করতে প্রয়াসী ছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রে চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা এবং মিশ্র জাতিসমূহের যে বর্ণনা আছে, তিনি সম্ভবত তা অবহিত ছিলেন না। হুইলারের মতে, গ্রীক লেখকদের মধ্যে মিশরীয় সমাজ ব্যবস্থার সাথে ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে মিলিয়ে দেখার জোরালো প্রবণতা ছিল। হেরোডেটাস মিশরীয় জনগোষ্ঠীকে সাতটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন। তাই মেগাস্থিনিসও ভারতে সাতটি শ্রেণীর অস্তিত্ব স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলেন। জাতিভেদের এই ধারণা হয়ত সম্পূর্ণ অমূলক নয়। খ্রিষ্টপূর্ব শতকের অভিম পর্বে বর্ণাশ্রম প্রথার অস্তিত্ব যেমন ছিল, তেমনি সমাজে নিত্য নতুন বৃত্তির উদ্ভব ঘটছিল। বংশানুক্রমিক বৃত্তি গ্রহণের প্রবণতাকে ভিত্তি করে নতুন জাতিভেদ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে। বৌদ্ধজাতক গ্রন্থেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। মেগাস্থিনিসের দার্শনিকগণ ছিলেন জাতকে বর্ণিত ব্রাক্ষ্মণ ও শ্রমণ। একইভাবে কৃষকেরা ছিলেন জাতকের গহপতি ও কুটুম্বিক, পশুপালক ছিলেন পশুপাল ইত্যাদি।

বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যের বিবরণ এবং মেগাস্থিনিসের জাতিভেদ ব্যবস্থার বিবরণ কিছুটা স্বতন্ত্র। বৌদ্ধ, জৈন সাহিত্যে জাতিভেদ বা শ্রেণীভেদ মেনে নিলেও ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য মেনে নেওয়া হয় নি। সেক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়দের স্থান দেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মণের ওপরে। মহাভারতেও এই ছবি পাওয়া যায়। আসলে রাজশক্তির অধিকারী ক্ষত্রিয়দের সাথে একটা সমঝোতা করে ব্রাহ্মণ শ্রেণী এইসময় তাদের সামাজিক কর্তৃত্ব সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট ছিল। তাই নীতিগতভাবে ব্রাক্ষ্মণ বর্ণ বা জাতিশ্রেষ্ঠ বলে মানত্য পেলেও, তাঁদের সেই মর্যাদা রক্ষিত হত ক্ষত্রিয় শ্রেণীর আনুকূল্যে।

কোটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর কর্তব্য-কর্মের উল্লেখ করেছেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের প্রধান বৃত্তি হিসেবে তিনিও যথাক্রমে যজন যাজন; রাষ্ট্রকর্ম-যুদ্ধপরিচালনা ; কৃষিকর্ম ও প্রথম তিন শ্রেণীর সেবা করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি একাধিক মিশ্রজাতির অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহের ফলে এই সকল সংকর বর্ণের উদ্ভব ঘটেছিল। যেমন ব্রাহ্মণ পুরুষ ও বৈশ্য নারীর সন্তান ‘অন্বষ্ট’ নামে, কিংবা ব্রাক্ষ্মণ পুরুষ ও শূদ্র রমণীর সন্তান ‘নিষাদ’ নামে অভিহিত হত। আবার শূদ্র পুরুষ ও ব্রাহ্মণ রমণীর গর্ভজাত সন্তান ‘চণ্ডাল’ নামে পরিচিত হত। আবার এই সকল সংকর বর্ণের মিলনে আরও নানা ধরনের জাতিবর্ণ সৃষ্টি হত।

প্রথাগত জাতিবর্ণভেদের কথা অশোকের লেখমালায় অনুপস্থিত। তিনি ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সম্পর্কে নীরব। তাই মনে করা হয় যে তাত্ত্বিক আলোচনায় এই নামগুলি আলোচিত হলেও, বাস্তবে এদের অস্তিত্ব ছিল না। শ্রমণদের তিনি আচার-আচরণের বিচারে ব্রাহ্মণদের বিরোধ বলেছেন। আবার ‘পাষণ্ডদের তিনি একাধিক সামাজিক শ্রেণীর উপাধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, একজন ব্রাহ্মণ, শ্রমণ এবং ব্রাক্ষ্মণ বা শ্রমণ নয় এমন ব্যক্তিও ‘পাষণ্ড’ শ্রেণীভূক্ত হতে পারতেন। পঞ্চম শিলালেখতে অশোক ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ‘ইভ্য’দের নাম উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত ‘ইভ্য’ বলতে অশোক বৈশ্যদের অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ডি. আর. ভাণ্ডারকর মনে করেন যে এই ধারণা অমূলক। কারণ পালি গ্রন্থাদিতে একটি শ্রেণী বা জাতি হিসেবে বৈশ্যদের স্বীকার করা হয়নি। তবে অশোকের সমকালে ‘ইভ্য’ ও ‘গহপতি’ নামক সামাজিক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। সম্ভবত এঁরা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের নিম্নতর কোন সামাজিক গোষ্ঠী ছিলেন।

সাধারণভাবে বলা যায় যে, মৌর্যযুগে বৈদিক বর্ণভেদ প্রথার প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছিল। এই সময় সামাজিক বর্ণভেদ প্রথার পাশাপাশি আর্থ সামাজিক জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারিত হত জন্মসূত্রে তার বর্ণভূক্তির ভিত্তিতে। কিন্তু কৃষির বিস্তার, লৌহ সরঞ্জামের বহুল ব্যবহার ইত্যাদি ক্রমশ জন্ম পরিচয়ের পরিবর্তে ব্যক্তির বৃত্তিগত অবস্থা সামাজিকক্রম নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে গুরুত্ব পেতে থাকে। বৈশ্য এবং শূদ্রদের মধ্যে ব্যবধান যেমন কমেছিল, তেমনি বহুক্ষেত্রে ধনী বৈশ্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের নিকটতর হয়েছিলেন। আবার দরিদ্র বৈশ্য এবং শূদ্রকে একই পর্যায়ভূক্ত রূপে দেখা শুরু হয়েছিল। বৈশ্যবর্ণভুক্তরা ‘দ্বিজত্বে’র অধিকারী হলেও, কার্যক্ষেত্রে তাদের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের থেকে পৃথক করে দেখা হত। কৃষিকাজ, বাণিজ্য ইত্যাদি দ্বারা বৈশ্যরা অর্থবান হলেও, সমাজ সংগঠনে তাদের ভূমিকা স্বীকৃতি পেত না। এই বর্ণগত অবস্থান ও বৃত্তিগত (সম্পদ) অবস্থানের সংঘাত সমাজে অস্থিরতার সম্ভাবনা তৈরী করেছিল। সম্ভবত সেই সামাজিক উত্তেজনা ও সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে সম্রাট অশোক তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ তত্ত্ব প্রচার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

মৌর্য্যোত্তর যুগ (৩০০ খ্রিঃ পর্যন্ত) :

মৌর্য পরবর্তী যুগেও বর্ণাশ্রম প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে তার চরিত্রে নতুন ধরনের বৈচিত্র ও জটিলতা প্রবেশ করেছিল। মৌর্য পরবর্তীকাল এবং প্রাক্ গুপ্ত ভারতের সমাজ ও বর্ণ ব্যবস্থা জানার জন্য আমাদের প্রধান সূত্র হল মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি, মহাভারত, বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘মিলিন্দপঞহো, কামসূত্র, পতঞ্জলীর মহাভাষ্য এবং কয়েকটি লেখ। তবে এদের বক্তব্যে বহু অসংগতি বা বৈপরীত্য আছে। আবার মনুস্মৃতির নিজের বক্তব্যের মধ্যে বহুক্ষেত্রে স্ববিরোধ দেখা যায়।

চতুর্বর্ণ ব্যবস্থায় সমাজে ব্রাহ্মণের স্থান ছিল সবার উপরে। মনু, যাজ্ঞবল্ক উভয়েই ব্রাহ্মণদের বর্ণশ্রেষ্ঠ এবং সর্বজীবের উপর প্রাধান্যের অধিকারী বলেছেন। ব্রাহ্মণের প্রধান কাজ ছিল বেদ অধ্যয়ন ও যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা। অধ্যাপনা, দানগ্রহণ, দান করা ইত্যাদিও ব্রাহ্মণের কর্তব্যকর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে জীবন ধারণের প্রয়োজনে ব্রাহ্মণ অন্য বর্ণের জীবিকাও গ্রহণ করতে পারতেন। তবে আপদকাল শেষ হলে একটা প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে তাঁকে শুদ্ধ হতে হত। উচ্চ সরকারী পদেও ব্রাহ্মণগণ নিযুক্ত হতেন। যেমন শুঙ্গ শাসনের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্যমিত্র ছিলেন ব্রাহ্মণ। তিনি ইতিপূর্বে সেনাপদে কর্মরত ছিলেন। কান্ববংশের প্রতিষ্ঠাতা বাসুদেব ছিলেন অমাত্য। মহাক্ষত্রপ সোদাসের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন জনৈক ব্রাহ্মণ। কৃষিকাজ ব্ৰাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, যদিও অনেকে কৃষিকাজে লিপ্ত হতেন। এদের বলা হত বৈষয়িক ব্রাহ্মণ। তবে যাঁরা কেবল অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদের সৎ-ব্রাহ্মণ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হত। আত্মরক্ষা, নারীর সম্ভ্রম রক্ষার প্রয়োজনে ব্রাহ্মণ অস্ত্রধারণের অধিকারী ছিলেন। বাণিজ্যকর্মেও ব্রাহ্মণদের অংশগ্রহণ স্বীকৃত ছিল। তবে গবাদি পশু, মদ, ক্রীতদাস ইত্যাদির ব্যবসা এবং সুদে অর্থলগ্নী করা নিষিদ্ধ ছিল। স্মৃতিশাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের জন্য বিশেষ সামাজিক সুবিধার বিধান আছে। সাধারণভাবে ব্রাহ্মণকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত না। কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা ব্রাহ্মণের ছিল না। ব্রাহ্মণ হত্যাকে মহাপাতক-কর্ম বলে গণ্য করা হত। তবে মনু অন্যত্র ব্রাহ্মণের প্রাণদণ্ড দেওয়া যেত বলে উল্লেখ করেছেন।

বৌদ্ধসাহিত্যে ব্রাহ্মণের সামাজিক প্রাধান্য স্বীকার করা হয়নি। বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্মমতের বিকাশ ব্রাহ্মণের সামাজিক আধিপত্য যে ক্ষুণ্ণ করেছিল, তার আভাস সমকালীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। মিলিন্দ পঞহোতে ক্ষত্রিয়ের স্থান ব্রাহ্মণের উপরে। এমনকি, সংস্কৃত সাহিত্য ‘ললিত বিস্তার’ গ্রন্থের ক্ষত্রিয়কে সমাজে সর্বোচ্চে স্থান দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃত নাটকগুলিকে ব্রাহ্মণ চরিত্রকে সাধারণভাবে বিদুষক রূপেই উপস্থিত করা হয়েছে। মনু ব্রাহ্মণকে বর্ণশ্রেষ্ঠ আখ্যা দিলেও, একই সঙ্গে লিখেছেন যে, ব্রাক্ষ্মণ শাস্ত্র নির্দিষ্ট বৃত্তি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে তাকে শূদ্র বলেই গণ্য করা হবে।

মৌযোত্তর যুগে প্রথাগতভাবে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেও, কার্যক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়কে ব্রাহ্মণের সমকক্ষ বা ব্রাহ্মণের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করা হত। ক্ষত্রিয়ের প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধ করা। এখন মনু, যাজ্ঞবল্ক প্রমুখ বেদপাঠ, যজ্ঞানুষ্ঠান ও দান কার্যকেও ক্ষত্রিয়ের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মহাভারতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের পর গ্রীক, শক, পার্থিয় প্রমুখ বহিরাগতজাতির অনুপ্রবেশ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা সমাজব্যবস্থার উপরেও প্রভাব ফেলে। মনুস্মৃতিতে স্বীকার করা হয়েছে যে এঁরা শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না। কিন্তু তাদের সামাজিক অস্তিত্ব অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। তাই স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয় যে, প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে এঁরা হিন্দু সমাজের অংশ হতে পারবেন। এঁদের ‘ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়’ নাম দিয়ে সমাজের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়। প্রয়োজনে ক্ষত্রিয়রাও ব্রাহ্মণের অধীনে কাজ করতে পারবেন কিংবা আপদকালে ব্যবসা ও কারিগরীবৃত্তি গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ এই সময় ক্ষত্রিয়দের পূর্ব-মর্যাদা শিথিল হয়েছিল। মনু, যাজ্ঞবল্ক বৈশ্যদের কর্তব্য কর্ম বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন নি। ব্রাহ্মণদের সাথে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে তাদের আচার-আচরণ বর্ণিত হয়েছে। তাদের প্রধান কাজ ছিল গোপালন, কৃষি, বাণিজ্য ও ঋণদান। সাধারণভাবে প্রাচীন ভারতের প্রথম ব্যবসায়ী বলা যায় বৈশ্যদের। বৌদ্ধশাস্ত্রে এঁদের বিশিষ্টতা স্বীকার করা হয়েছে দাতা হিসেবে। স্মৃতিশাস্ত্রে বা মহাভারতে বৈশ্যদের কোন কোন ক্ষেত্রে, যেমন আত্মরক্ষা, গো-ব্রাহ্মণ রক্ষা ইত্যাদি, অস্ত্র ধারণের অধিকারের স্বীকার করা হয়েছে। তবে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বৈশ্যদের উল্লেখ নেই। সেক্ষেত্রে বৈশ্যর বৃত্তিসম্পন্ন গহপতি বা গৃহপতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের সমমর্যাদা সম্পন্ন গহপতিদের সম্পর্কে পালি সাহিত্যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে ‘গহপতি’ নামক কোন সামাজিক গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সংস্কৃত ‘গৃহপতি’ থেকে ‘গহপতি’ নামটি এসেছে। পালি গ্রন্থে এঁদের বিপুল বিত্তশালী বলা হয়েছে। জাতক থেকে জানা যায় যে তাঁরা ছিলেন পরিবারের প্রধান এবং সম্পত্তির মালিক। রিজ ডেভিড্স-এর মতে, এঁরা ছিলেন কৃষিজীবী পরিবারের প্রধান এবং কৃষি উৎপাদন ছিল এঁদের বিত্তের উৎস। এই উদ্বৃত্ত বৃত্তের একাংশ তাঁরা ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতেন। গহপতি বলতে কোন স্বতন্ত্র জাতিকে বোঝানো হয় নি। ‘সংযুক্ত-নিকায়’ গ্রন্থে একইসাথে রাজা উদয়ন, চিকিৎসক জীবক, বিশিষ্ট ধনী অনাথ পিণ্ডক ‘গহপতি’ বলে উল্লেখিত হয়েছেন। নরেন্দ্র ওয়াগলে এবং উমা চক্রবর্তীর মতে, ‘গৃহপতি’ একটি সম্ভ্রমবাচক উপাধি। যে কোন জাতি বর্ণের মানুষ ‘গহপতি’ পর্যায়ভুক্ত হতে পারতেন। রাজা, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রনীতিতেও গহপতিদের ভূমিকা ছিল বলে পালিগ্রন্থে বলা হয়েছে। ‘দীর্ঘনিকায়’ গ্রন্থে বর্ণিত গৃহপতি মেণ্ডক বিপুল সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন, ভাড়াটে মজুর দিয়ে জমি চাষ করাতেন, তিনি প্রয়োজনে রাজার সেনাবাহিনীর রসদ যোগাতে সক্ষম। বৌদ্ধ সংঘের সাথেও তাঁর ছিল গভীর সম্পর্ক। অনেকে জাতকে বর্ণিত গহপতি ও শেঠিকে অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। গহপতি কৃষক বিপুল সম্পদের অধিকারী। শেঠি বিপুল সম্পদের অধিকারী কিন্তু কৃষক নন। আইভো ফাইজার-এর মতে, শেঠি মূলত বিনিয়োগকারী। সম্ভবত বিত্তশালী গহপতি গোষ্ঠী থেকেই শেঠির উদ্ভব। তবে শেঠি কৃষিকাজ করেন না; অর্থলগ্নী করে বাণিজ্য থেকে মুনাফা অর্জনই তাঁর বৃত্তি।

বর্ণব্যবস্থার সর্বনিম্নে ছিল শূদ্র। শূদ্র দুই শ্রেণীর ‘অনিরবাসিত’ অর্থাৎ অ-পরিত্যক্ত এবং নিরবাসিত বা পরিত্যক্ত। দ্বিতীয় শ্রেণীকে সমাজ বহির্ভূত এবং অস্পৃশ্য মনে করা হত। শূদ্রের কাজ ছিল উচ্চবর্ণের সেবা করা। স্মৃতিশাস্ত্র বা মহাভারতে সেবক শ্রেণী হিসেবেই শূদ্রের স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে শূদ্রের সামাজিক অবস্থান বিষয়ে মনুর বক্তব্যে স্ববিরোধীতা আছে। একস্থানে বলেছেন যে, শূদ্রের নিজের সম্পত্তি বলে কিছু ছিল না। আবার অন্যত্র বলেছেন যে, শূদ্র তার সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারতেন। অর্থাৎ শূদ্রের সম্পত্তি ছিল এবং তা বণ্টন করার অধিকারও স্বীকৃত ছিল। শূদ্রের পক্ষে বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠান নিষিদ্ধ ছিল। তবে বিকল্প হিসেবে পূত ধর্মের দ্বারা যেমন, কুপ খনন, মন্দির নির্মাণ ইত্যাদি জনকল্যাণ কর্ম সম্পাদন করে তারা বৈদিক যজ্ঞের ফললাভের অধিকারী ছিলেন। উপনয়নের অধিকার নিষিদ্ধ ছিল। তবে ব্রত, উপবাস, মহাদান, প্রায়শ্চিত্ত করার অধিকার ছিল। তাছাড়া জাতকর্ম, নামকরণ, বিবাহ, অন্নপ্রাশন জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকার শূদ্রের ছিল, তবে বৈদিকমন্ত্র উচ্চারণ ছাড়াই তা করতে হত। অপরাধের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে শূদ্ররা বৈষম্যের শিকার হতেন।

নিয়মিত চারবর্ণ ছাড়াও সমাজে বহু সংকর বর্ণের (মিশ্র জাতি) উদ্ভব ঘটেছিল বলে মনুস্মৃতি (১০ম অধ্যায়) থেকে জানা যায়। স্মৃতিশাস্ত্র অনুসারে চারবর্ণের মধ্যে ‘অনুলোম’, ‘প্রতিলোম’ বিবাহের ফলে সংকর বর্ণের সৃষ্টি হয়েছিল। বর্ণসংকর সন্তানের সামাজিক পরিচয় ‘মিশ্র জাতি’ ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। অনুলোম বিবাহ (উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর বিবাহ) এবং প্রতিলোম বিবাহ (নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চতর বর্ণের নারীর বিবাহ) বৈদিক যুগের সাহিত্যেও উল্লেখিত হয়েছে। তখন অনুলোম বিবাহ অনুমোদিত হলেও, প্রতিলোম বিবাহ কঠোরভাবে নিন্দিত ছিল। মনু ও যাজ্ঞবল্ক এই মিশ্র জাতির সামাজিক অবস্থান নির্দিষ্ট করে দেন। বর্ণসংকর সন্তান পিতার পরিচয়ে চতুবর্ণসুলভ বৃত্তি গ্রহণের অধিকারী ছিল না। তাই স্মৃতিশাস্ত্রে তাদের জন্য পৃথক পৃথক বৃত্তি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। যেমন ব্রাহ্মণ পুরুষ ও বৈশ্য নারীর (অনুলোম) বিবাহজাত সন্তান ‘অন্বষ্ঠ’ নামে পরিচিত হয় এবং তার জন্য বৈদ্যবৃত্তি নির্দিষ্ট করা হয়। তবে ব্রাহ্মণ পুরুষ ও ক্ষত্রিয় নারীর বিবাহজাত সন্তান পিতার মর্যাদার যোগ্য ছিল। প্রতিলোম বিবাহের সবথেকে নিন্দিত ঘটনা ছিল শূদ্র পুরুষ ও ব্রাক্ষ্মণ নারীর বিবাহ। এই বিবাহজাত সন্তান ‘চণ্ডাল’ বলে অভিহিত হত। মনুস্মৃতিতে তারা কাক ও কুকুরের সমতুল্য এবং অস্পৃশ্য। তাদের বৃত্তি শবদাহ। তবে খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতকে ভারতীয় সমাজের জাতিবর্ণ ব্যবস্থাকে কেবল ‘মিশ্র জাতি’ তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। বহিরাগত শক, সাতবাহন প্রমুখকে ‘ব্রাত্য ক্ষত্রিয় পর্যায়ভুক্ত করে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গীভূত করার প্রবণতা ছিল। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রভাব, বহিরাগতদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিলোম বিবাহের প্রচলন জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় যে জটিলতা এনেছিল, আলোচ্যকালে সমাজ নানাভাবে তার সাথে সমন্বয় ও সহাবস্থানের পথ খুঁজে পেতেও আগ্রহী ছিল।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment