আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুলতানি আমলে প্রযুক্তি ও অ-কৃষি উৎপাদন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুলতানি আমলে প্রযুক্তি ও অ-কৃষি উৎপাদন
সুলতানি আমলে কৃষিকার্য ও কৃষি-উৎপাদন ভারতবাসীর প্রধান জীবিকা ও ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ভিত্তি ছিল। তবে অ-কৃষি উৎপাদনের কাজেও যে ভারতীয়রা দক্ষ ও উৎসাহী ছিলেন, এমন বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে নগরায়ণ ও নগরের বিকাশের অনুসঙ্গ হিসেবে অ-কৃষি উৎপাদনের বিষয়টি অনেকটাই সম্পর্কিত। নগরের উত্থান ও অস্তিত্বের সাথে সাথে হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটে। এই বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তুলনামূলকভাবে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ। সুলতানি আমলে ভারতে হস্তশিল্প উৎপাদনের গুণমান উন্নত করার পেছনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের অবদান অনস্বীকার্য। অধ্যাপক ইরফান হাবিব সুলতানি আমলে হস্তশিল্পের বিকাশের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রযুক্তির পরিবর্তন বা আধুনিকীকরণের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “The increase in craft production that accompanied urban growth also reinforced by a number of changes or improvements in technology which can be ascribed to the period of the Sultanate. “
সুতিবস্ত্র শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল উন্নতমানের সুতো এবং যা অল্প সময়ের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব। সুলতানি যুগে চরকা’র আগমনের ফলে সেই কাজটি সম্ভব হয়। ঐতিহাসিক ইসামী তাঁর ‘ফুতুহ্-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে (১৩৫০ খ্রিঃ) এই যন্ত্রটির কথা প্রথম উল্লেখ করেন। তিনি এই যন্ত্রটিকে (চরকা) মহিলাদের পক্ষে ব্যবহারের উপযোগী বলেও মন্তব্য করেছেন। লিন হোয়াইট জুনিয়ার (Lynn white junior) 2 মন্তব্য করেছেন যে, প্রাচীন ভারতে চরকার ব্যবহার জানা ছিল না। প্রাচীনকালে চিনদেশে চরকার প্রচলন ছিল। পারসিক কবিদের রচনা থেকে জানা যায় দ্বাদশ শতকে ইরানে চরকার আবির্ভাব ঘটেছিল। ইরফান হাবিবের মতে, চিনদেশ থেকে ইরান বা মধ্য-এশিয়া হয়ে ত্রয়োদশ শতকে ভারতবর্ষে চরকার প্রথম আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর এদেশে চরকার ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বস্ত্রবয়ন শিল্পের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ‘পাদানি যন্ত্র’ (treadle machine) -এর সাথেও প্রাচীন ভারতের পরিচিতি ছিল না। প্রাচীন সংস্কৃত অভিধানগুলিতে তাঁতের নানা অংশের উল্লেখ থাকলেও পাদানি যন্ত্রের কোনো উল্লেখ নেই। দ্বাদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপে পাদানি-যন্ত্রের প্রথম প্রয়োগ দেখা যায়। মহম্মদ শাদিয়াবাদীর গ্রন্থ “মিতা-উল-ফুজালা’-এর ভিত্তিতে ইরফান হাবিব বলেছেন যে, ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাদানি-যন্ত্রের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায়। অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ভারতে বয়ন শিল্পের সাথে পাদানি-যন্ত্রের সংযোজন ঘটেছিল। এইভাবে ‘চরকা’ উদ্ভবের ফলে অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ উন্নতমানের সুতো বোনা সম্ভব হয় এবং পাদানি যন্ত্র ব্যবহারের ফলে অল্প সময়ে অধিক কাপড় বোনা সম্ভব হলে সুলতানি আমলে বস্ত্র শিল্পের বিকাশ দ্রুততর হয়।
সুলতানি আমলে প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণেই বিলাস সামগ্রী হিসেবে রেশমবস্ত্র-বয়ন শুরু হয়েছিল বলে ইরফান হাবিব মনে করেন। তাঁর মতে, সুলতানি যুগের আগে ভারতবর্ষে রেশম গুটি বা তুঁত পোকার চাষ অজানা ছিল। মা হুয়ান-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় প্রথম গুটি চাষের সূচনা হয়। মীর্জা হায়দার দৌলত-এর ‘তারিখ-ই-রশিদি’গ্রন্থের বয়ান অনুযায়ী বাংলার পরে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাশ্মীরে গুটিপোকার চাষের প্রচলন হয়। অধ্যাপক হাবিবের মতে, এর আগে ভারতে রেশমবস্ত্র বয়নের জন্য প্রধানত আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভর করা হত। এখন পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে গুটি চাষের প্রক্রিয়া ভারতের দখলে এলে রেশমবস্ত্র উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পঞ্চদশ শতকের পূর্বে ভারতে রেশম গুটির চাষ আদৌ হত না, অধ্যাপক হাবিবের এই মন্তব্যের যথার্থতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অধ্যাপক এস. কে. মাইতি তাঁর গবেষণাপত্র ‘ইকনমিক লাইফ অফ ইন্ডিয়া ইন গুপ্ত পিরিয়ড’-এ লিখেছেন যে, গুপ্ত শাসনকালে ভারতে রেশম-গুটি চাষের প্রচলন ছিল। ‘অমরকোষ’ গ্রন্থে রেশম-বয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা আছে। ‘মান্দাসোর লেখ’ থেকে জানা যায় যে, তখন বহু কারিগর রেশম শিল্পে নিয়োজিত ছিল এবং তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য রেশমশিল্পীদের সমবায় বা ‘গিল্ড’ গঠিত হয়েছিল। সম্ভবত, গুপ্তদের পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বাণিজ্যে মন্দার ফলে রেশম উৎপাদনে গভীর মন্দা দেখা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে মুসলমানদের শাসন সুদৃঢ় হলে নতুন উদ্যমে রেশম চাষ শুরু হয়েছিল। সম্ভবত, পারস্য থেকে উল্লম্ব তাঁতে (vertical loom) কার্পেট বোনার প্রযুক্তিও সুলতানি আমলে ভারতে এসেছিল। অবশ্য এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য মুঘল যুগের আগে পাওয়া যায় না।
সুলতানি আমলে গৃহনির্মাণশিল্পে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময় গাঁথুনির কাজে চুনের ব্যবহার ঘটে। ফলে খিলান ও গম্বুজ শোভিত গৃহনির্মাণ সম্ভব হয়। ইতিপূর্বে কাঠ ও খড় বা গোলপাতা দিয়ে গৃহাদি নির্মিত হত। সুলতানি যুগে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বিশালাকার সুদৃশ্য প্রাসাদ নির্মাণ শুরু হয়। তুঘলকাবাদের ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন তার সাক্ষ্য বহন করে। আলাউদ্দিন গৃহনির্মাণ কাজে প্রায় ৭০ হাজার কারিগর নিযুক্ত করেছিলেন বলে বারাণী উল্লেখ করেছেন। এই বক্তব্যে কিছুটা অতিরঞ্জন থাকলেও, খলজি ও তুঘলক বংশের শাসনকালে যে বহু বিশালাকার খিলান ও গম্বুজ যুক্ত প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
মধ্যযুগের ভারতে হস্তশিল্পের এক নতুন সংযোজন হল কাগজ তৈরি। দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন যে, ভারতে প্রাচীনতম কাগজের নিদর্শন পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতকে গুজরাট রাজ্যে। ইরফান হাবিবও মনে করেন, ত্রয়োদশ শতকে ভারতে প্রথম কাগজ উৎপাদন শুরু হয়। চতুর্দশ শতকের মধ্যেই উন্নতমানের কাগজ তৈরি করা সম্ভব হয়। এই সময় কাগজের উৎপাদন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, মিষ্টান্ন বিক্রেতারা কাগজের প্যাকেটে মিষ্টান্ন বিক্রয় করতে পারত।
ধাতু শিল্পের ক্ষেত্রেও সুলতানি আমলে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। সম্ভবত, দশম শতকে চিনে পাতন প্রক্রিয়া দ্বারা দস্তাশোধন শুরু হয়েছিল। ভারতে এই প্রক্রিয়া প্রবেশ করে চতুর্দশ শতকে। রাজস্থানের মেবারের খনিতে দস্তা শোধনক্রিয়ার প্রমাণ সমকালীন প্রত্নলেখ থেকে জানা যায়। গৃহস্থালির বাসনপত্রাদি নির্মাণের জন্য পেতল সংগ্রহের জন্য দস্তা শোধন প্রক্রিয়ার জ্ঞান জরুরি ছিল।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।