স্পষ্টভাষী শত্ৰু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালাে – ভাবসম্প্রসারণ

প্রিয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছো আশা করি ভালো আছো, আজকে তোমাদের জন্য আমরা নিয়ে এসেছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভাবসম্প্রসারণ “স্পষ্টভাষী শত্ৰু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালাে ”। চলো এই ভাবসম্প্রসারণটি পড়ে নেয়।

স্পষ্টভাষী শত্ৰু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালাে - ভাবসম্প্রসারণ

স্পষ্টভাষী শত্ৰু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালাে ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব : নির্বাক ব্যক্তি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু স্পষ্টভাষী মানুষকে সহজেই বোঝা যায়। সুতরাং নির্বাক বন্ধুর চেয়ে স্পষ্টভাষী শত্রুও অনেক ভাল।

সম্প্রারিত ভাব : পার্থিক জীবনে মানুষের শত্রু-মিত্র উভয়ই থাকে। শত্রু মানুষের অনিষ্ট সাধন করে। পক্ষান্তরে, মিত্রের শুভকামনায় সে আত্মশক্তির বা মনোবল অর্জন করে। ব্যক্তিজীবনে মিত্রের প্রভাব খুব বেশি। প্রকৃত বন্ধুর পরামর্শে, সুবুদ্ধি, সক্রিয়তা, শুভাকাঙ্খা ব্যক্তিজীবনকে সামনে চলার শক্তি দান করে। বন্ধুর বন্ধুত্বের সুশীতল ছায়ায় মানুষ তার অসহায় মুহূর্তগুলো কাটিয়ে দেয়। তাই এক প্রখ্যাত মনীষি বলেছেন, বন্ধুত্ব হচ্ছে ছায়াদানকারী বৃক্ষের মতো। কিন্তু যে মিত্রতা শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে স্থাপিত হয় সেটি কল্যাণের প্রতীক নয়। যে বন্ধু শুধু সুশীতল ছায়া দান করে, কিন্তু প্রয়োজনে অলস বন্ধুকে রৌদ্রের খরতাপে দগ্ধ করে খুঁটি করে না তার চেয়ে শত্রুর স্পষ্টভাষণ অনেক গুণে শ্রেয়। ব্যক্তি জীবনে নির্বাক মিত্রের উপস্থিতি নিক্রিয়, নিষ্প্রাণ।

শত্রু মানুষকে আক্রমণের সুযোগ খোঁজে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে আক্রমণ ব্যক্তির কর্মের কড়া সমালোচনার মাধ্যমে আসে। চারিত্রিক ক্রটিসমূহ চিহ্নিত করে শত্রু তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিতে চায। শত্রুর এ প্রচেষ্টা মানুষের জন্য কল্যাণকর। কারণ, এতে নিজের চারিত্রিক দুর্বলতাসমূহ অবহিত হয়ে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করতে পারেন। একজন মানুষের চরিত্রে ভালো-মন্দ দু’টি দিকই থাকে। নির্বাক মিত্র ব্যক্তির চরিত্রের অসৎ দিকগুলোর এড়িয়ে সৎ গুণাবলির সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। অন্যদিকে, শত্রু ব্যক্তির সৎ গুণাবলিকে উপেক্ষা করে অসৎ দিকগুলোর সমালোচনা করে। এতে সে শত্রুর স্পষ্ট ভাষণ থেকে অসৎ দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারে এবং সংশোধনের চেষ্টা করে। স্পষ্টভাষী শত্রু অবচেতনভাবে ব্যক্তির চারিত্রিক উত্তরণের পথ তৈরি করে দেয়। সে কারণে, নির্বাক মিত্রে চেয়ে স্পষ্টভাষী শত্রু ভাল।

স্পষ্টভাষী শত্রুর সমালোচনা মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথে পরিচালনা করে। এজন্য স্পষ্টভাষী শত্রুকে বন্ধুর মর্যাদা দেওয়া ‍উচিৎ এবং নির্বাক বন্ধুর সাহচার্য ত্যাগ করা উত্তম।

একদম সহজভাবে বললে

শত্রু স্পষ্টভাষী হলে সতর্ক হওয়া যায় কিন্তু বন্ধু যদি তার মনোবাসনা তুলে না ধরে তাহলে বন্ধুত্বের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। শত্রু বলতে আমরা প্রতিপক্ষকে এবং মিত্র বলতে বন্ধুকে বুঝি। বন্ধুতো একনিষ্ঠ সুহৃদকেই বলা যায়। যে অশনে বসনে, শ্মশানে মশানে সাথী হয়, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বিপদে সহমর্মী, সহগামী, সমব্যথী হয়, তাকে মিত্র বলা যায়। শত্রুকে চেনা কষ্টকর বটে। কখন শত্রুতা করে বসে তা জানাও বড় সহজ হয়। কিন্তু যে শত্রু স্পষ্টভাষী, খোলাখুলি, বলে-কয়ে শত্রুতা করে, তাকে চিনতে কষ্ট হয় না। কিংবা তার শত্রুতার প্রতিরোধ করতেও পারা যায়। বন্ধু যদি নির্বাক থাকে অর্থাৎ কোনো সৎ পরামর্শ বা সুবুদ্ধি দান না করে, তাহলে সে বন্ধু জীবনের কোনো কল্যাণমূলক কাজে লাগে না। স্পষ্টভাষী শত্রু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অন্যের দোষত্রুটি বলে দেয়। সে কারো দোষত্রুটি এড়িয়ে যায় না। ফলশ্রুতিতে শত্রুর বক্র সমালোচনায় সে নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ পায়। রবি ঠাকুর তাই নিন্দুককে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যুগজনমের বন্ধু ও আঁধার ঘরের আলো হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। স্পষ্টভাদিতাই সব সমাধান আনতে পারে। কিন্তু ধুয়াসার মাঝে বিচরণ করে সমস্যা সমাধান হয় না। বরং সমস্যার পাল্লা ভারি হয়।

বিকল্প ১

মূলভাব : যে ব্যক্তি সত্য প্রকাশ করতে সাহস পায় না সে বন্ধু হলেও প্রকৃত বন্ধু নয়। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সত্য কথা বলতে দ্বিধাবােধ করে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার ও প্রতিবাদী, সে বন্ধু না হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা অনেক ভালাে।

সম্প্রসারিত ভাব: মিত্ৰতা দুটি দেহের মধ্যে অভিন্ন এক হৃদয় সৃষ্টি করে। দৃষ্টিভঙ্গির সমতার মাধ্যমে মিত্রতা গড়ে ওঠে। একজন সৎ বন্ধু প্রত্যেকের জীবনে অপরিহার্য। কিন্তু কোনাে ব্যক্তি যদি তার বন্ধুর বিপদে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে, তাহলে এমন মিত্র থাকা না থাকা সমার্থক। মানুষের জীবনে এক মহৎ গুণ স্পষ্টবাদিতা। স্পষ্টভাষী লােক শত্রু হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা সহস্র গুণ শ্রেয়। আমাদের সমাজে এমন অনেক লােক আছেন যারা বন্ধুর বিপদে বন্ধুর পাশে থেকেও কোনাে প্রকার সাহায্য বা সহানুভূতি প্রকাশ না করে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তারা সযত্নে সকল প্রকার ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চান। অন্যায়কে অন্যায় বলার মতাে সৎ সাহসও তাদের থাকে না। এমন প্রকৃতির ব্যক্তি বন্ধু হলেও তাকে পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। অপরদিকে স্পষ্টবাদী ব্যক্তি সব সময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার ও প্রতিবাদী। তার। সম্মুখে ঘটে যাওয়া অন্যায়কে সে অন্যায় বলে প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠাবােধ করে না। তাই এমন ব্যক্তি শত্রু হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা অনেক ভালাে। সে শত্রু হলেও স্পষ্টবাদিতার গুণে মহৎ বন্ধু। হযরত ওমর (রা) এর ভাষায়-

“যে তােমার দোষ ধরে বন্ধু সেই জন।”

বিকল্প ২

মূলভাব: মানব চরিত্রের অসাধারণ একটি গুণ হল—সত্য বলার সাহস রাখা। যে ব্যক্তি সত্যের পক্ষে আপসহীন, অন্যায়ের কালিমা তাকে কখনােই স্পর্শ করতে পারে না। এমন ব্যক্তির শত্রুতা নির্বাক বন্ধুর বন্ধুত্বের তুলনায় অনেক বেশি প্রশংসার দাবিদার।

ভাবসম্প্রসারণ: মানুষ একা পথ চলতে পারে না। সে অন্যের সঙ্গ কামনা করে, চায় প্রকৃত বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্ব সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় তথা জীবনের প্রতি মুহূর্তে নিঃস্বার্থ সঙ্গ প্রদান করবে। কিন্তু বন্ধু যদি সময়ে-অসময়ে বন্ধুর পাশে এসে না দাঁড়ায়, নির্বাক থাকে, প্রয়ােজনে সুপরামর্শ দান না করে তবে সে বন্ধুত্বের কোনাে মূল্য নেই। বন্ধু যদি বন্ধুর ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্দেশ করে সংশােধনের পথ বাতলে না দেয় তবে সে বন্ধু কোনাে মঙ্গলজনক কাজে লাগে না। বরং প্রয়ােজনে সত্য উচ্চারণ থেকে যে বন্ধু নিজেকে বিরত রাখে সে বন্ধুর ভূমিকা নেতিবাচক বলেই গণ্য হয়। অন্যদিকে স্পষ্টবাদী শত্রু অনেক সময় মানুষের জীবনে পালন করে উপকারীর ভূমিকা, শত্রু যদি স্পষ্টভাষী হয় তাহলে সে অকপটে অন্যের দোষত্রুটি সামনে তুলে ধরে। এতে একদিকে শত্রু সম্পর্কে যেমন সতর্ক হওয়া যায়, তেমনি নিজেকে সংশােধন করার পথও খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ নির্বাক বন্ধুর তুলনায় স্পষ্টভাষী শত্রুই পালন করে প্রকৃত সুহৃদের ভূমিকা। তাই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা নির্বাক বন্ধুর তুলনায় স্পষ্টবাদী শত্রুকেই জীবনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা তারাই দিয়ে থাকে সঠিক পথের সন্ধান।

মানুষের জীবনে প্রকৃত বন্ধুর ভূমিকা অনন্য, যদি সে বন্ধু সত্য প্রকাশে অকপট হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনে তার স্পষ্টবাদী গুণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। কেননা, তবেই বন্ধু বন্ধুর জন্যে মালজনক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বিকল্প ৩

মূলভাব: মানুষের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া প্রকৃত বন্ধুর কাজ। অথচ নির্বাক বন্ধু এ থেকে বিরত থাকে আর স্পষ্টবাদী শত্রু ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে প্রকৃত বন্ধুর মতােই কাজ করে।

সম্প্রসারিত ভাব: প্রতিটি মানুষেরই শত্রু-মিত্র উভয়ই আছে। শত্রুরা মানুষের অনিষ্ট সাধনে লিপ্ত থাকে, আর মিত্র বুদ্ধি, পরামর্শ ও শক্তি দিয়ে সাহায্য করে। মনীষীরা বলে থাকেন মিত্র হচ্ছে ছায়াদানকারী বৃক্ষের মতাে, যার ওপর একজন মানুষ অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকে। এক্ষেত্রে মিত্রের কাজ শুধু আশ্রয় বা সমর্থন দান নয়, ভুল-ত্রুটিও ধরিয়ে দেওয়া। আসলে ভুল করাটা মানুষের এ জন্য স্বাভাবিক। মানুষমাত্রই ভুল করে থাকে। মানুষের ভুলটা যদি ধরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সে সংশােধন হওয়ার সুযোেগ পায়। পক্ষান্তরে, ভুল ধরিয়ে না দিলে সে বারবার ভুল করতে থাকে। তাই যারা প্রকৃত বন্ধু তারা ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়। কিন্তু অনেক বন্ধু আছে যারা বন্ধুর ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে না দিয়ে নির্বাক থাকে।

তাছাড়া জীবন চলার পথে মানুষকে অসংখ্য কাজ করতে হয়। আর কাজ করতে গেলে, সকল মানুষের পক্ষে সকল কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও অনেক ভুল-ত্রুটি সংঘটিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রকৃত বন্ধুর কাজ সংঘটিত ভুল-ত্রুটিগুলাে ধরিয়ে দেওয়া। কিন্তু নির্বাক বন্ধুরা তা করে মৌনতা করে। একে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার কাজের ভালাে-মন্দ কোনােটাই জানতে পারে না। ফলে সংশােধনও হতে পারে । কিন্তু স্পষ্টবাদী শত্রু নির্বাক বন্ধুর মতাে কখনই নির্বাক থাকে না। বরং শত্রুতার জন্য হলেও ভুল-ত্রুটিগুলাে ধরিয়ে দেয়। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার কৃতকর্ম সংশােধন করার সুযােগ পায়।

তাছাড়া স্পষ্টবাদী শত্রুর কথা মাথায় রেখে প্রত্যেকেই তাদের কাজ-কর্ম যথাসাধ্য ত্রুটিমুক্তভাবে সম্পন্ন করতে সচেষ্ট থাকে। এতেও কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। আর এজন্যই মনীষীরা নির্বাক বন্ধুর চেয়ে স্পষ্টবাদী শত্ৰকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

মন্তব্য: শত্রুর শত্রুতার আশঙ্কায় মানুষ সবসময় সচেতন থাকে। এতে কল্যাণ বৈ অকল্যাণ হয় না। কিন্তু বন্ধু যদি বন্ধুর গঠনমূলক সমালােচনা থেকে বিরত থাকে, তাহলে সীমাহীন অকল্যাণ সাধিত হয়।

আরো পড়ুন: প্রাণ থাকলে প্রাণি হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না

আশা করি তোমরা এই ভাবসম্প্রসারণটি বুঝতে পেরেছো। আমাদের সাথেই থাকো।

Leave a Comment