আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “আফগান স্বৈরতন্ত্রের স্বরূপ : আফগান উপজাতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
আফগান স্বৈরতন্ত্র:
দিল্লি-সুলতানির অন্যান্য রাজবংশের তুলনায় সৈয়দবংশের কালসীমা ছিল খুবই সীমিত, মাত্র সাঁইত্রিশ বছর (১৪১৪-১৪৫১ খ্রিঃ)। অধ্যাপক নিজামীর মতে, সৈয়দবংশের রাজত্বকাল খলজিদের মতো সাম্রাজ্যবাদী সাফল্য কিংবা তুঘলকদের মতো শাসনতান্ত্রিক উদ্ভাবন কোনো কিছু দ্বারাই বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারেনি। ছোটো ছোটো আঞ্চলিক সর্দার ও জমিদারদের বিদ্রোহদমনের মধ্যেই সৈয়দদের কর্মসুচি সীমাবদ্ধ ছিল। কেন্দ্রীকরণ নীতির পরিবর্তে আঞ্চলিকতাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ এই শাসনকালে শক্তি সঞ্চয় করেছিল।
আফগান উপজাতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য:
দিল্লি-সুলতানির আমলে শেষ শাসকবংশ ছিল লোদীবংশ। নিজামীর ভাষায় : “খলজিদের থেকে লোদীবংশের রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘ; এবং পরবর্তী তুঘলক ও সৈয়দদের তুলনায় এদের কৃতিত্ব ছিল বেশি” (“It has a greater life span trhe Khaljis and had better achievements to its credit than the later Tughluas and the Saiyyds.”)। লোদীবংশের পঁচাত্তর বছরের (১৪৫১ ১৫২৬ খ্রিঃ) শাসনকালে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল—(ক) সুলতান ও অভিজাতদের দ্বন্দ্ব; (খ) ক্ষমতাবান ‘হাকিম’দের সাথে ক্ষুদ্র জমিদারদের সংঘাত, (গ) কেন্দ্রবিমুখ শক্তির সাথে কেন্দ্রমুখী প্রবণতার সংঘাত এবং (ঘ) রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার তত্ত্বের সাথে আফগান জাতির অংশীদারিসম্মত রাষ্ট্রনীতির সংঘাত।
বস্তুত, তুঘলক-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা তথা আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধের পাশাপাশি আফগানদের জাতিগত ও ঐতিহ্য অনুসারী জাত্যভিমান এই পর্যায়ের ভারতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। আখুন্দ দারওয়েজা (Akhund Darweza) বলেছেন যে, প্রাচীনকাল থেকেই একজন আফগান কাউকে রাজা বলে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে কিংবা ক্ষমতাসীন কোনো ব্যক্তির কাছে মাথানত করতে অভ্যস্ত ছিল না। তাই তারা সামাজিক সাম্যে বিশ্বাস করত। এবং এ কারণেই সকল আফগান ‘মালিক’ নামে সম্বোধিত হন। এমতাবস্থায় একজন আফগান সুলতানকে একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হত, অন্যদিকে তেমনি লড়াই চালাতে হত আফগানদের উপজাতীয় ঐতিহ্যের সাথেও। রাষ্ট্রের শত্রু ও ক্ষতিকারক শক্তিগুলিকে দমন করার জন্য আফগান সৈনিকদের সহায়তা ছিল জরুরি। কিন্তু আফগান সেনাদের ব্যক্তিগত মর্যাদা, উপজাতীয় আবেগ ও মর্যাদার প্রতিও শাসককে সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখতে হত। নিজামীর মতে, আফগান উপজাতির সহায়তা ছাড়া লোদীবংশ রাজত্ব চালাতে পারত না। তবে আফগান উপজাতীয় কর্তৃত্ববাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার কাজেও লোদী শাসকদের সদাসতর্ক থাকতে হত।
ভারতের সুলতানি শাসনের প্রথম থেকেই এদেশে আফগান যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা যায়। সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদের সেনাবহিনীতে বহু আফগান যোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের আমলে সীমান্তবর্তী চৌকিগুলিতে আফগান সেনাদের মোতায়েন করা হয়। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে আফগান যোদ্ধারা যথেষ্ট সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দেন। এই সময় থেকেই ভাগ্যান্বেষী আফগানরা ভারতীয় রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। ইখতিয়ারউদ্দিন-ইয়াল-আফগান, মালিক মাখ আফগান খলজি এবং তুঘলক বংশের রাজত্বকালে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ভারতে লোদী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বহলুল লোদীর পিতামহ মালিক বাহ্রাম একটি বাণিজ্যদলের সদস্য হিসেবে ভারতে প্রবেশ করেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর অন্যতম পুত্র মালিক কালা খিজির খান কর্তৃক দৌরালার গভর্নর নিযুক্ত হন। মালিক কালার পুত্র ছিলেন বহলুল। পিতামাতার অকালমৃত্যুর ফলে তিনি পিতৃব্য ইসলাম খানের (মালিক সুলতান শাহ) কাছে প্রতিপালিত হন। দক্ষ যোদ্ধা ও সংগঠক ইসলাম খান প্রায় বারো হাজার আফগান সেনার একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন তাঁর উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষ। তিনি আফগান উপজাতীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিজ সাবালক পুত্রের পরিবর্তে বহলুল’কেই নিজ উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।
এই প্রসঙ্গে আফগানদের উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ্য। একথা ঠিক যে, খলজি ও তুঘলকদের আমলে আফগান সর্দাররা সুলতানি বাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রাথমিক পর্যায়ে তারা সংখ্যাল্পতার কারণে তুর্কিরীতির ওপরে আফগান উপজাতীয় বৈশিষ্ট্য কায়েম করতে উদ্যোগী হননি। কিন্তু কালক্রমে এদেশে আফগান অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা ভারতীয় রাজনীতির ওপর উপজাতীয় ধ্যানধারণা প্রয়োগ করতে প্রয়াসী হন। অধ্যাপক নিজামী কম্প্রিহেনসিভ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া”। গ্রন্থে আফগান উপজাতির গণতান্ত্রিক প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমত, শাসনতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নে আফগান জাতি দক্ষতা ও উপযুক্ততাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। বংশগত অধিকার বা বর্তমানে শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা (মনোনয়ন) ছিল গুরুত্বহীন। এই নীতি অনুসারেই ইসলাম খাঁ নিজ পুত্রের পরিবর্তে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বহলুল লোদী’কে শিরহিন্দের পরবর্তী শাসক মনোনীত করেছিলেন। এই রীতির ভালো ও খারাপ দুটি দিকই ছিল। এর ফলে একদিকে যেমন সর্বোচ্চপদে দক্ষতা ও যোগ্যতা মর্যাদা পেত, তেমনি এই ব্যবস্থা থেকেই আফগানদের গোষ্ঠীগত বিভেদ দানা বাঁধত, যা শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের পক্ষেই ক্ষতিকর হত। যেমন—ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর আফগান সর্দাররা তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। ইসলাম শাহের ইচ্ছানুযায়ী একটি গোষ্ঠী সমর্থন করেন বহলুল লোদীকে। দ্বিতীয় গোষ্ঠী সমর্থন দেন ইসলাম খাঁ’র ভাই মালিক ফিরাজকে এবং তৃতীয় গোষ্ঠী ইসলাম খাঁনের পুত্র কুতুব খানকে সমর্থন জানান। বহলুল লোদী অবশ্য দক্ষতার সাথে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেন। সুলতান ইব্রাহিম লোদী বহলুলের মতো বিচক্ষণ ও সহনশীল ছিলেন না। তিনি উপজাতিভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের ওপরে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার আদর্শে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এ কারণে ক্ষুব্ধ আফগান সর্দাররা গুজরাটের শাসক আলম খানকে সামনে রেখে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা চালান। ড. নিজামী লিখেছেন: their ambition to maintain their personal freedom created a number of complication in the administration.”
আফগান শাসনকালে দিল্লি-সুলতানি সেনাবাহিনীর চরিত্র পরিবর্তিত হয় এবং ‘রাজার সেনাবাহিনী’ পরিবর্তে তা একটি ‘উপজাতীয় সমরগোষ্ঠী’তে রূপান্তরিত হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় বিভিন্ন আফগান মালিক নিজ নিজ গোষ্ঠীর সদস্যদের সমন্বয়ে ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলেন। কেন্দ্রীয়ভাবে সেনাবাহিনীর নিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় সেনাবাহিনীর সমসত্ত্বতা (Homogeneity) নষ্ট হয়। বলা বাহুল্য, ইতিপূর্বে সুলতানি বাহিনীর যে দক্ষতা ও কার্যকারিতা ছিল, আফগান উপজাতীয় প্রথার প্রচলনের ফলে তা ক্ষুণ্ণ হয়। এই কারণে সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্ত্বেও, আফগান-বাহিনী পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সংখ্যাল্প কিন্তু সুসংগঠিত মুঘল বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিল।
আফগান জাতির ঐতিহ্য অনুসারে এই সময় বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী সুলতানের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করতে থাকেন। যেমন—হাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও হস্তীপৃষ্ঠে ভ্রমণ এতকাল রাজকীয় মর্যাদা ও অধিকারের অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু আফগান শাসনকালে বহু উচ্চকর্মচারী ও অভিজাত নিজ নিজ হস্তীবাহিনী গঠন, পরিপোষণ করতে থাকেন এবং সংঘর্ষের সময় তা কাজেও লাগান।
আফগান শাসনাধীন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল সারা উত্তর ভারত জুড়ে অসংখ্য শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ জমিদারের অস্তিত্ব। লাহোর থেকে মানিকপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এই সকল আফগান জমিদারের শক্তি ও সম্পদ ছিল কল্পনারও অতীত। সাধারণ কৃষকদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সূত্রে এই সকল সামন্তপ্রভুর লোকবলও ছিল প্রবল। ড. নিজামী লিখেছেন যে, একধরনের অস্থিরতা, অ্যাডভেঞ্চারধর্মিতা এবং সাময়িক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমকালের সকল রাজনৈতিক ঘটনার মূল সুর ছিল ; কিন্তু কখনোই সেই কর্মধারা একটি নির্ভরযোগ্য কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য গঠনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়নি। আফগান সর্দারদের কর্মধারা ও কর্মসূচির প্রকৃতি ছিল স্থানীয়, উপজাতীয় অথবা গোষ্ঠীসর্বস্ব। নিজামীর ভাষায়: “Their activities were limited by local tribal or racial considerationms and could not pave the way for the emergence of a contralized empire.” তবে নিজামীও মনে করেন যে, আফগান উপজাতীয় গণতান্ত্রিক চেতনা তার অন্তর্নিহিত সারবত্তার জোরেই দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর ভারতীয় রাজনীতিতে লোদীবংশের শাসন কায়েম রাখতে সক্ষম হয়েছিল। উপরন্তু মুঘলবংশীয় বাবরের কাছে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়েছিলেন—একথা যেমন সত্য, তেমনি একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, আর এক আফগান যুবক শের খাঁ (শাহ) মুঘল শাসক হুমায়ুনকে বিতাড়িত করে ভারতে আফগান-কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অধ্যাপক ত্রিপাঠী (R, P. Tripathy) মনে করেন যে, বহলুল লোদী তাঁর সহনশীলতা এবং আফগান উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি আনুগত্য দ্বারা আফগান উপজাতি গোষ্ঠীর প্রধানদের আনুগত্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজকীয় স্বৈরতন্ত্রের ধারণাকে নমনীয় করে তিনি আফগান মালিকদের আবেগকে মর্যাদা দেন। আফগান-গোষ্ঠীসর্দার ও অভিজাতদের ওপর প্রশাসনিক দায়িত্ব ও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ স্বৈরতন্ত্র ও সংসদীয় রাজতন্ত্রের মধ্যে একটা যোগসূত্রের পথ তৈরি করে দেয়। ড. ত্রিপাঠীর মতে : এই পরিবর্তন ইসলামিক রাজতন্ত্রের ধারণাকে আরও উন্নত ও সংসদীয় প্রকৃতিবিশিষ্ট করার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু আফগান সর্দারদের বিভেদ, ঈর্ষা, সংকীর্ণ স্বার্থপরতা, পরিস্থিতির মূল্যায়নের ব্যর্থতা এবং সাধারণ মানুষের উদাসীনতা শেষ পর্যন্ত সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দেয়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।