আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘একা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের যে গভীর জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘একা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের যে গভীর জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করো
রসস্রষ্টা শিল্পী হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের দপ্তরে আবির্ভূত হলেও দপ্তরের বিভিন্ন রচনার মধ্যে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণাম সম্পর্কে তাঁর পরিপক্ক ও পরিণত মনের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। মানব জীবনের তাৎপর্য ও গূঢ় রহস্যের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিল তাঁর মন-কমলাকান্তের দপ্তরেই সেই অনুসন্ধান অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন জিজ্ঞাসার প্রকৃত পরিচয় বহন করছে এই কমলাকান্তের দপ্তরে।
প্রথম যৌবনে না হলেও বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সংসার ও বিশ্বজগৎ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন, বঙ্কিমের মনে উদিত হত। ‘এ জীবন লইয়া কি করিব’—এ চিন্তাও তাঁর মনকে আন্দোলিত করত। এ সম্পর্কে তাঁর জীবনীকার বলেছেন “যৌবনের উদ্দীপনায় ডেপুটি বঙ্কিমচন্দ্র চাকুরি ও সাহিত্য জীবনে সার্থকতা অর্জন করিয়া যশ মান অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তিমণ্ডিত হইয়া নির্বিঘ্নে চলিতেছিলেন, কিন্তু তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা ক্ষোভ ছিল। পরিণত বয়সের সঙ্গে তাহা আত্মপ্রকাশ করিতে থাকে। বাঁচিয়া থাকার অর্থাৎ জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁহার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন উঠিত, নিজেকে নিঃসঙ্গ একক মনে হইত। হালকা হাসির ঢেউ তুলিয়া চাকুরি ও সংসারের স্রোতে আর পাঁচ জনের মতো ভাসিয়া চলিবার মধ্যবিত্ত মনোভাব কোনোদিনই তিনি আয়ত্ত করিতে পারেন নাই।” ফলে যতই তিনি পরিণত বয়সের দিকে এগিয়েছেন ততই নানা প্রশ্নে ও নানা জটিল জিজ্ঞাসা তার মনকে আলোড়িত ও বিক্ষুদ্ধ করেছে।
ঈশ্বর, ধর্ম আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে খোলাখুলি মত প্রকাশ না করলেও এই পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালে এক অসীম ও অজ্ঞেয় সত্তা আছে একথা বঙ্কিম বিশ্বাস করতেন। ‘পতঙ্গ প্রবন্ধে বলেছেন ঈশ্বর কী ? ধর্ম কী ? জ্ঞান কী? স্নেহ কী ? তাহা কিছুজানি না। তবু সেই অলৌকিক অপরিজ্ঞাত পদার্থ বেড়িয়া বেড়িয়া ফিরি।” কিন্তু সেই অলৌকিক ও অপরিজ্ঞাত জগৎকে স্বীকার করে নিয়েও বঙ্কিম এই পার্থিব জগৎ সংসারের মধ্যে মানুষের সুখ কল্যাণ সমৃদ্ধির অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। তাঁর জীবনদর্শনের মূলকথাই হল পরহিত ব্রত বা মানব কল্যাণ। এখানেই তথা কথিত অধ্যাত্মপিপাসুদের সঙ্গে বঙ্কিমের পার্থক্য। জীবন বিমুখ অধ্যাত্মসাধনার পরিবর্তে মানবকল্যাণই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তাঁর সমস্ত জ্ঞান ও কর্মের মূল প্রেরণাই ছিল এই কল্যাণব্রত। “এই নিরন্দ্র অন্ধকারে, দিশাহীন ভবার্ণবে যে তত্ত্বকে আশ্রয় করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র পথ চলিতে চাহিয়াছেন, তাহা প্রীতি আত্মপর ভেদাভেদশূন্য হইয়া প্রেম, জীবে প্রেম—পরের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করা। ইহাই কমলাকান্তের দর্শন এবং সমগ্র কমলাকান্তে বারম্বার ফিরিয়া বঙ্কিমচন্দ্র এই মূল কথাই শুনাইয়াছেন।”
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন ‘পারোপকারই ধর্ম।’ পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মতো সুখ এ জগতে আর কিছুই নাই। ধন, যশ, অর্থ, মান কিছু দিনের জন্য সুখ আনতে পারে, কিন্তু চিরস্থায়ী সুখ অর্জন করতে হলে নিজেকে পরের জন্যে বিলিয়ে দিতে হবে।
‘একা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমের জীবনদর্শনের মূল সুরটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রবন্ধটি আরম্ভ হয়েছে অচেনা পথিকের গাওয়া একটি সংগীতকে অবলম্বন করে। এক জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে নির্জন পথে একজন অপরিচিত পথিক মনের আনন্দে তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে একটি গান গাইতে গাইতে চলে গেল। সেই গানের সুর লেখকের কাছে হারিয়ে যাওয়া সুখ স্বপ্নের মতো মনে হল। কিন্তু তা ক্ষণকালের জন্য, পরমুহূর্তেই সেই গান তাঁর মনকে এক বিষণ্ণ বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তুলল। তাঁর মনে হল প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যে বিশ্বচরাচরে সকলেই যখন মুগ্ধ এবং আনন্দ বিহ্বল তখন তিনি কেন নিরানন্দ ? সকলেই যখন আনন্দ সমুদ্রে ভাসমান তখন তিনি কেন সেই আনন্দ স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারছেন না। কারণ তিনি একা। এই পৃথিবীতে যে একা থাকে সেই নিঃসঙ্গ সেই দুঃখী। আর যে সকলের মধ্যে থেকে সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মহানন্দময় প্রীতির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে তার মতো সুখী কেউ নেই। এই উপলব্ধি থেকেই বঙ্কিমের নির্দেশ—“কেহ একা থাকিও না। যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয়ভাগী না হইল, তবে তোমার মানুষ্যজন্ম বৃথা ….পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।” একাকীত্বের বেদনা থেকে উদ্ভূত এই বাণী বঙ্কিমের জীবনদৃষ্টি ও পরহিতব্রতের আদর্শ কে প্রমাণ করছে।
মানুষের যৌবনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে। মানুষ তার প্রথম যৌবনে পৃথিবীকে সুন্দর দেখে—বঙ্কিমও দেখেছিলেন। তখন প্রতিটি পুষ্পের সৌরভে, পত্রমর্মরের মধুর ধ্বনিতে নক্ষত্র খচিত আকাশের শোভায় তার মন মুগ্ধ হত। কিন্তু বান্ধকে উপনীত হয়ে তিনি তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। তখন তিনি দেখলেন যে কুসুমে কীট আছে, ফলে বিষ আছে, উদ্যানে সৰ্প আছে, মনুষ্য হৃদয়ে আত্মদর আছে। সেজন্য বার্ধক্যের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ বঙ্কিম বলেছেন, ‘এখন জানিয়াছি যে এ অরণ্যে পথ নাই, এ প্রান্তরে জলাশয় নাই এ নদীর পার নাই, এ সাগরে দ্বীপ নাই, এ অন্ধকারে নক্ষত্র নাই।”
তবে বঙ্কিমের জীবন দর্শন নৈরাশ্যসূচক নয়। তিনি সর্বদাই উত্তীর্ণ হতে চেয়েছেন সুস্থ বলিষ্ঠ জীবনাদর্শে। সেজন্য তিনি এই অন্ধকার ভব সংসার থেকে, এই জগৎ পারাবার থেকে বাঁচার উপায় অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন অন্বেষণ করতে চেয়েছেন স্থায়ী সুখের উৎস কি ? এর উত্তর তিনি দিয়েছেন কমলাকান্তের মাধ্যমে “আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছি” পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল্য নাই।” এই আত্মবিসর্জন, এই পরোপকার প্রবৃত্তির জন্ম হয় চিরন্তন মানবপ্রীতি থেকে। আর এই মানবপ্রীতিকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে বলেছেন “প্রীতি সংসারে সর্ববাপিনী—ঈশ্বরের প্রীতি।” প্রবন্ধের শেষ অংশে বঙ্কিম তার জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন মনুষ্য জাতির ওপর যদি আবার প্রীতি থাকে তবে অন্য সুখ চাই না। অর্থাৎ মানব-প্রীতি ও মানবকল্যাণই তাঁর মূল লক্ষ্য। হিংসা দ্বেষে পরিপূর্ণ আত্মকলহে মত্ত, চরম স্বার্থপরতায় নিমজ্জিত অনুদার মানুষকে আস্ফালন করো, সকলে মিলিয়া দেখ, পরসুখবর্ধন ভিন্ন মানুষ্যের অন্যে সুখের মূল আছে কিনা ? নাই। আমি মুক্ত কণ্ঠে বলিতেছি, একদিন মনুষ্যমাত্রেই আমার এই কথা বুঝিবে যে মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল নাই।” বঙ্কিম—আশাবাদী, তাই তার কণ্ঠে এই দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে “একদিন মানুষ নিশ্চয়ই পরের সুখের প্রতি ধাবমান হইবে।”
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।