আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ছিন্নপত্রে পদ্মাতীরের প্রকৃতির অনুপম চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। উদাহরণসহ আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ছিন্নপত্রে পদ্মাতীরের প্রকৃতির অনুপম চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। উদাহরণসহ আলোচনা করো
পূর্ব বাহিনী গঙ্গা বাংলাদেশ প্রবেশ করে কিছুদূর অগ্রসর হবার পর দক্ষিণ বাহিনী রূপ ধরে ভাগীরথী নামে নিয়ে বয়ে গিয়ে পড়েছে সমুদ্রে। কিন্তু গঙ্গার দক্ষিণ পন্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রবল বিক্রমে পূর্বদিকে তার যে প্রবাহ প্রবাহিত গেছে তারই নাম পদ্মা। জমিদারি কার্যোপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথকে সুদীর্ঘকাল নদীবিধৌত পল্লিবাংলায় পরিভ্রমণ করতে হয়েছিল। শিলাইদহ, সাজাদপুর পতিসর প্রভৃতি অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁর শিলাইদহ ও ইসবসাহী পরগনার সদর কাছারি সাজাদপুর একান্তভাবেই ছিল পদ্মাতীরবর্তী। পদ্মার তীরে তীরে ভ্রমণ করে পদ্মাতীরে বোট লাগিয়ে বা পানসি নিয়ে জল ভ্রমণ করে এ সময় দীর্ঘকাল ধরে দুই পাড়ের সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথের অন্তর্গত রক্তপ্রবাহে মিশ্রিত হবার অবকাশ পেয়েছিল, পারের নির্জন চর, নদী তীরবর্তী মানুষ ও তাদের মিলিত কলতান— এ সবই রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী বৃহৎ জীবন-পটভূমিকা নির্মাণে বিপুল সাহায্য করেছিল।
“পদ্মাকে যে দেখেনি বাংলাদেশকে দেখেনি সে ; পদ্মাকে যে জানে না বাংলাদেশকে জানে না সে ; পদ্মাকে যে বোঝেনি, বাংলাদেশকে বোঝেনি সে, যা কিছু দেখা, জানা বোঝা সংহত তা এই নদীটির মধ্যে ।” রবীন্দ্র প্রসঙ্গে পদ্মার আলোচনায় সমালোচকের (প্রমথনাথ বিশী, শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ) প্রশংসা যেন বাঁধন ছাড়া। ছিন্নপত্রের বা তার পূর্ণতর সংস্করণ ছিন্নপত্রাবলির গভীর পাঠ বলতে আমরা বুঝি পদ্মাকে রবীন্দ্রনাথের মতো মহাকবির দৃষ্টিতে আর কেউ দেখেননি। দিনের পর দিন পদ্মার দুর্নিবার আকর্ষণে তার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কবির বাস্তব দৃষ্টি থেকে আরও গভীর উপলব্ধিতে পদ্মা তাঁর দিব্য দৃষ্টির সামনে অপরূপ মহিমায় নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। যেমন কখনো পদ্মার নির্জনতা কবির চোখে মায়া অঞ্জন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই নির্জতার মধ্যে পদ্মার সৌন্দর্য সম্ভোগ করতে করতে এক গভীর দার্শনিকতায় মগ্ন হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ—“নদী আর এই দিগন্ত বিস্তৃত চর আর ওই ছবির মতন পর পার ধরণির এই উপলব্ধির প্রান্তভাগ—কী বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালা।” (ছিন্নপত্র—১০) পদ্মা নদী রবীন্দ্রমননে চেতনায় এমন গভীরভাবে মিশ্রিত হয়েছিল যাতে কবির মনে হয়েছিল যেন পদ্মার সাথে তাঁর জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক— “আমাদের দুজনকার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে।” (ছিন্নপত্র—৬৭)
পদ্মাকে ভালোবাসার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি মেলে ছিন্নপত্রের ৭৯ সংখ্যক পত্রে— “বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি, ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত, আমার তেমনি পদ্মা-যথার্থ বাহন……।”
পদ্মার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিকে দার্শনিকতার এক নন্দনলোকে পৌঁছে দেয়। পদ্মার জলে কবি পৃথিবীর ছবি দেখেন—হিল্লোলিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি—৩ ভাদ্র ১৮৯২ তারিখে শিলাইদহ থেকে লেখা একটি পত্রে সেকথাই জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ— “এমন সুন্দর শরতের সকালবেলা চোখের ওপর যে কী সুধা বর্ষণ করেছে, সে আর কী বলব। তেমনি সুন্দর বাতাস দিচ্ছে ও পাখি ডাকছে। এই ভরা নদীর ধারে, বর্ষার জলে প্রফুল্ল নবীন পৃথিবীর ওপর, শরতের সোনালি আলো দেখে মনে হয় আমাদের এই নব যৌবনা ধরণি সুন্দরীর সঙ্গে কোনো এক জ্যোতির্ময় দেবতার ভালোবাসাবাসি চলছে।”—–(ছিন্নপত্র—৬৩)
উপসংহারের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়ে প্রমথনাথ বিশীর ভাষায় বলা যায় ‘বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথের মতো মহাকবির দৃষ্টিতে পদ্মাকে আর কেউ দেখেনি। পদ্মা কখনো অলৌকিক রূপে, কখনো ও লৌকিক রূপে কবির কাছে ধরা দিয়েছে। কখনো পদ্মা ছিপছিপে মেয়ে, কখনো বা তার জ্যোতির্ময় রূপ। পদ্মার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আকর্ষণ করতে করতে কবি এক স্বতন্ত্র জগতের অধিবাসী হয়ে যান। বাস্তবিকই পদ্মাকে কবি ভালোবাসা জানিয়ে বলেছেন—’হে পদ্মা আমার/তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।’
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।