আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘পয়োমুখম’ গল্পের কৃষ্ণকান্ত চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘পয়োমুখম’ গল্পের কৃষ্ণকান্ত চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো
জগদীশ গুপ্তের ‘পয়োমুখম’ গল্পটি চরিত্রপ্রধান ছোটোগল্প। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণকান্ত একটি বিশেষ বিকৃত মানসিকতার অধিকারী। তার চরিত্রই ‘বিষকুম্ভং পয়োমুখম্’ অর্থাৎ বিষপূর্ণ কলসের মুখে ক্ষীর। সহজ বাংলায় বলা যায় কৃষ্ণকান্তের ‘মুখে মধু বুকে বিষ’। গল্পটির নামকরণেই গল্পকার কৃষ্ণকান্তের চরিত্রধর্মের বৈশিষ্ট্যটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
গল্পের সূচনায় কৃষ্ণকান্তকে দেখা যায় সে পূর্ণ বিষয়ী এবং অত্যন্ত ধূর্ত। তখন থেকেই তার চরিত্র পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জ্যেষ্ঠপুত্র ভূতনাথের বুদ্ধিহীনতা সম্পর্কে কৃষ্ণকান্ত যেসব গল্প স্ত্রী মাতঙ্গিনীকে শোনায় তা থেকে তার প্রখর বিষয়বুদ্ধি এবং হৃদয়ের স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতির চেয়েও আর্থিক স্বার্থ যে তার কাছে বড়ো তা সহজেই বোঝা যায়। সর্বকালেই এমন অনেক অর্থলোভী নীতিজ্ঞানহীন পিতাকে দেখা যায় পুত্রের বিবাহ দেওয়া যাদের কাছে একটা ব্যবসায়িক লেনদেনের ব্যাপার। এদিক থেকে বিচার করলে কৃষ্ণকান্তকে একটি টাইপ চরিত্র বলতে হয়।
পুত্রকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে পারদর্শী করতে কৃষ্ণকান্ত কলাপ ও মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ শেখায়। আর বিবাহকালে পুত্রের এই সামান্য জ্ঞানকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বহুগুণ বাড়িয়ে বলে এবং পুত্র কলকাতার বিখ্যাত কবিরাজের প্রিয় ছাত্র বলে মিথ্যাভাষণ করে ছেলের বাজারদর বাড়িয়ে পণের পরিমাণ বাড়াবার চেষ্টা করে। কৃষ্ণকান্তের এই অর্থলোলুপতা পৈশাচিক পর্যায়ে পৌঁছয় এক একজন পুত্রবধূর জীবননাশের মধ্য দিয়ে। অর্থই তার কাছে সর্বস্ব, তার জন্য ঠান্ডা মাথায় কিশোরী পুত্র-বধূদের হত্যা করার পর বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না।
‘পয়োমুখম্’ গল্পের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণকান্তকে অবলম্বন করে লেখক জগদীশ গুপ্ত তাঁর জীবনব্যাখ্যাকে উপস্থিত করেছেন। কৃষ্ণকান্তের কাছে মানুষ ও মানবিক সম্পর্কের কোনও মূল্য নেই। দ্বিতীয়া স্ত্রী অনুপমার মৃত্যুর পর ভূতনাথ আবার বিবাহ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে কৃষ্ণকান্ত যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছে, “স্ত্রীই হইয়াছে আজকালের লোকের যেন মহাগুরুর সেবা ; একটির নিপাতেই সে-সম্পর্কে আর কাহাকেও যেন গ্রহণ করা যাইতে পারে না।” কৃষ্ণকান্ত ছেলেকে ভালোবেসে তার জীবনের সার্থকতার জন্য বিয়ে করতে বলে না। তার যুক্তি হচ্ছে স্ত্রীর মৃত্যুতে এই দুঃখ সৌখীন সন্ন্যাস মাত্র। মৃতা স্ত্রীর জন্য স্বামীর যে মমতাবোধ তা অর্থহীন—এ জাতীয় আধুনিকতার বিরোধী কৃষ্ণকান্ত।
মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, মৃত্যুতে তার পরিণতি অবশ্যম্ভাবী, সুতরাং সে বিষয়ে ভাবনা না করে নিরাসক্ত চিত্তে সংসারযাত্রা নির্বাহ করা উচিত। কৃষ্ণকান্তে উচ্চারিত জীবনদর্শন এরূপ, কিন্তু নিজের আচরণ ঠিক তার বিপরীত—পার্থিব বিষয়ের প্রতি তার আসক্তি প্রবল।
কৃষ্ণকান্তের মতো অর্থগৃধ্ন মানুষের সমাজে অভাব নেই। তারা অর্থের জন্য মৌলিক মানবিক মূল্যবোধও বিসর্জন দিতে পারে। পারিবারিক সম্পর্কগুলিকেও এরা অর্থের সম্পর্ক বলে ভাবে। কৃষ্মকান্ত ইচ্ছে করেই কালো মেয়েকে নির্বাচন করে গোপনে বৈবাহিকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে থাকে।
কিন্তু কৃষ্ণকান্তের জীবনে চরম আঘাত আসে তার পুত্রের কাছ থেকেই। ভূতনাথ তাকে শুধু অপমান করে না, নিজের হাতে তারই দেওয়া যন্ত্রণাদায়ক বিষ তারই হাতে তুলে দিয়ে বলে, “পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।” অর্থের জন্য কৃষ্ণকান্ত দুটি পুত্রবধূকে ঠান্ডা মাথায় বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে এবং তৃতীয় পুত্রবধূকেও হত্যা করতে চেয়েছে। তার চরিত্রের মূল উপাদান বিষয়-কামনা, বিকট অর্থলিপ্সা—অন্য সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছ। তার চাতুরি ও শয়তানি ধরে ফেলে পুত্র ভূতনাথ যখন তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তখন এই ভয়ংকর হত্যাকারী ভীত হয়ে কাঁপতে থাকে। স্পষ্টই বোঝা যায় আত্মহননের পথে না গেলে এই ঘৃণা ও তিরস্কারের মধ্যেই বাকি জীবন তাকে বেঁচে থাকতে হবে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।