ফসিল গল্পটি সমাপ্তিতে পৌঁছে আর বিশেষ কোনো স্থান কালের সীমায় আবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রতিভূ-আলোচনা করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ফসিল গল্পটি সমাপ্তিতে পৌঁছে আর বিশেষ কোনো স্থান কালের সীমায় আবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রতিভূ-আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

ফসিল গল্পটি সমাপ্তিতে পৌঁছে আর বিশেষ কোনো স্থান কালের সীমায় আবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রতিভূ-আলোচনা করো

ফসিল গল্পটির কাহিনি বেশি দীর্ঘ না হলেও গল্পের বিষয়বস্তু বা থীম অত্যন্ত জটিল। সামন্ততন্ত্রের অবসান ও ধনতন্ত্রে সমৃদ্ধির এক সংকটময় মুহূর্তকে এই গল্পের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে লেখক গল্পটিকে বিস্তৃত কালের পটভূমিতে মুক্তি দিয়েছেন। ফসিল গল্পটিতে দেখানো হয়েছে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সামন্ততন্ত্রের মরিয়া প্রয়াস অন্যদিকে প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য ধনতন্ত্রের মরিয়া প্রচেষ্টা। সামাজিক প্রভুত্বলাভের তাগিদে এই উভয় শ্রেণির অনিবার্য সংঘাতে বিপন্ন অসহায় হয়ে পড়েছে কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী, আবার স্বীয় স্বার্থরক্ষার তাগিদে পরস্পর যুযুধান দুই পক্ষ গোপন সমঝোতায় মিলিত হয়েছে। তাদের অশুভ আঁতাতের ফলশ্রুত নির্মমতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে শোষিত নিপীড়িত মানুষের বিদ্রোহের প্রয়াস। অবশেষে গল্পের নির্মম পরিণতিটিকে গল্পকার স্থাপিত করেছেন মানব সভ্যতার চিরন্তন পটভূমিকায়।

গল্পের শুরুতে লেখক বিবৃতিমূলক কয়েকটি বাক্যে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়িত রূপটিকে তুলে ধরেছেন। নেটিভস্টেট অঞ্জনগড় বর্তমানে ইংরেজ প্রভুদের দয়ায় পুষ্ট। স্টেটের আড়ম্বরের সীমা নেই কিন্তু রাজকোষ শূন্য। এমনকি রাজার এক কুড়ি উপাধি আছে তবু সব আড়ম্বরই বাহ্যাড়ম্বর মাত্র। গল্পের পরবর্তী অনুচ্ছেদে লেখক রাজদরবারের শ্রীহীনতাকে প্রকট করেছেন। রাজদরবারের সকল গৌরব আজ লুপ্তপ্রায় কেবল তার বাহ্যিক কাঠামোটাই অটুট আছে। সামন্ততন্ত্রের ক্রমাবলুপ্তির চিত্রই পরিস্ফুট হয়েছে এই অংশে। গল্পের তৃতীয় অনুচ্ছেদে আছে সামন্ত শাসন ব্যবস্থার অবক্ষয়। লেখকের বর্ণনায় পাই—“সচিব আছে, সেরেস্তাদারও আছে। ক্ষত্রিয় তিলক আর মোগল তকমায় অদ্ভুত মিলন দেখা যায় দপ্তরে। যেন দুই যুগের দুই জাতের আমলাদের যৌথ প্রতিভার সাহায্যে মহারাজা প্রজারঞ্জন করেন।” গল্পকারের বিদ্রূপ আরও তীক্ষ্ণ হয় পরবর্তী অংশে—“সেই অপূর্ব অদ্ভুত শাসনের তাপে উত্যক্ত হয়ে রাজ্যের অর্ধেক প্রজা সরে পড়েছে দূর মরিসাসে চিনির কারখানায় কুলির কাজ নিয়ে।” বাক্যটির মধ্যে কেবল বিদ্রূপ নয়, সামন্ততান্ত্রিক ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষ কৃষিজীবন ছেড়ে কেমন শ্রমজীবী শ্রেণিতে রূপান্তরিত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক প্রবণতায় ধনতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে—এই সত্যটিও লেখক প্রকাশ করেছেন। অঞ্জনগড় রাজ্যে প্রজা নিপীড়নের অন্ত নেই। সব বিষয়েই প্রজাদের জন্য বরাদ্ধ থাকে লাঠির ঘা। তবু রাজদরবার থেকে মাঝে মাঝে চিঁড়ে গুড় বিতরণ করা হয় এবং রাজার জন্মদিনে প্রজারা নিমন্ত্রণ পায়।

কেবল সামন্ততন্ত্র নয় ধনতন্ত্রের নির্মমতাকেও লেখক ফসিল গল্পে ব্যঙ্গ বিদ্রূপে বিশ্ব করেছেন। ধনতন্ত্রের শ্রমিক শোষণের নির্মমতা, হৃদয়হীনতা প্রকট হয় বৃদ্ধ দুলাল মাহাতোর‌ অবসর জীবনের দুর্গতির মধ্যে। দীর্ঘদিন মরিসাসে চিনিকলে কাজ করে মাহাতো গ্রামে ফিরেছে কিন্তু বাঁচার রসদ হিসেবে তার অবশিষ্ট আছে নগদ সাতটি টাকা এবং বুক ভরা‌ হাঁপানি। ধনতন্ত্রের নির্মম শোষণে মাহাতোর মতো শ্রমিকরা যেভাবে ব্যবহৃত হতে হতে ছিবড়ে হয়ে যায়—লেখক সে কথাই এখানে জানিয়ে দেন। ধনতন্ত্রের শোষণ সামন্ততন্ত্রের মতো নগ্ন নয়। মানব কল্যাণের মুখোশের আড়ালে ধনতান্ত্রিক প্রভুরা অমানবিক শোষণ চালায়। ‘ফসিল গল্পে সিন্ডিকেটের চেয়ারম্যান গিবসনের উক্তির মধ্যে ধনতন্ত্রের মুখোশপরা রূপটি প্রকট হয়—“মিষ্টার মুখার্জি, আমরা মানিমেকার নই, আমাদের একটা মিশনও আছে।” কিন্তু পরবর্তী অংশে পাঠক দেখতে পান গিবসন মুখার্জির ইরিগেশন স্কীম ভণ্ডুল করে দেবার পরিকল্পনা আঁটে। ম্যাককেনা সাহেবকে গিবসন বলে—“কোনো চিন্তা নেই, পোষা পিড়াল মাহাতো রয়েছে আমাদের হাতে ওকে দিয়েই স্টেটের সব ডিজাইন ভণ্ডুল করবো।”

ফসিল গল্পে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিরোধ উপস্থাপিত করেই গল্পকার যবনিকা টানেননি। গল্পের অস্তিমে দেখা যায় নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে দুই প্রবল প্রতিপক্ষ হাতে হাত মিলিয়েছে। প্যালেসের একটি প্রকোষ্ঠে উজ্জ্বল বিজলী বাতির আলোর বন্যায় ভাসতে ভাসতে, সুদীর্ঘ মেহগনি টেবিলে উপছে পড়া পানীয়ের রসাবেশে ডুব দিতে দিতে মহারাজা, সচিবোত্তম ফৌজদার আর গিবসন, ম্যাককেনা, মুর, প্যাটার্সন গোপন সমঝোতায় মিলিত হয়ে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। সেদিনই ঘটে গেছে দুটি ঘটনা। সিন্ডিকেটের অসাবধানতায় ১৪নং পীট ধসেছে, বহু শ্রমিক চাপা পড়েছে আর অন্যদিকে ফৌজদারের গুলিতে জঙ্গলে লকড়ি কাটতে গিয়ে মারা পড়েছে বেশ কয়েকজন প্রজা। সামন্তরাজা আর সিন্ডিকেটের প্রভুরা উভয়ের নরহত্যা জনিত অপরাধ লুকোতে উভয়পক্ষ একই অবস্থানে নেমে এসেছে। মহারাজের অপরাধ চাপা দিতে ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে টেনে নিয়ে আসা কুর্মী প্রজাদের লাশগুলোকে ১৪নং পীটের খনি গহ্বরে ফলে দেওয়া হয়েছে আর মহারাজাও খনি দুর্ঘটনার পিছনে সিন্ডিকেটের গাফিলতিকে নীরবে হজম করে নিয়েছেন। আর এ গল্পের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চরিত্র সমাজ শাসকদের পাপের একমাত্র সাক্ষী দুলাল মাহাতোর অস্তিম পরিণতি ওই খনি গহ্বরের মৃত্যুলীলায় নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।

সামস্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও অস্তিত্বরক্ষার তীব্র প্রয়াস, ধনতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি ও নির্মম আগ্রাসন, শ্রেণিদ্বন্দ্বের নিষ্ঠুর চিত্র, কৃষিজীবীর শ্রমজীবীতে রূপান্তর, শ্রমজীবী মানুষের মর্মান্তিক পরিণতি, মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ ও বিবেকবর্জিত আপোষ—ইত্যাদি নানা চিত্র ফসিল গল্পে অতি সু কৌশলে অঙ্কিত করে লেখক গল্পটিকে স্থাপন করেছেন বৃহত্তর ইতিহাসের পটে। ফলত শোষক আর শোষিতের লড়াইয়ে মানুষের যে পরাভব এ গল্পে খণ্ডচিত্র রূপে আভাসিত ছিল তা অন্তহীন চিরন্তনতায় ব্যাপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতের সমাজ বদলে গেলেও শাসকের শোষণের যে কোনো সমাপ্তি নেই—এই নির্মম সত্যটি গল্পের অস্তিমে পরিস্ফুট হয়েছে। মানুষের সভ্যতার নিরক্ত অর্থহীনতাকে প্রকট করেছে মুখার্জির ছলছল চোখ আর দূরগামী ভাবনা। এক বিশেষ কালের শ্রেণিদ্বন্দ্বের চিত্র থেকে লেখক পৌঁছে যেতে চেয়েছেন মানবসভ্যতার ঐতিহাসিক তাৎপর্যে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment