আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন : জৈন ও বৌদ্ধধর্ম” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন : জৈন ও বৌদ্ধধর্ম
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে ভারতবর্ষে ধর্মীয় ও দার্শনিক ক্ষেত্রে অসংখ্য মত ও ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতক ভারতবর্ষে মগধকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময়কাল বলে অভিহিত হয়। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শহরের বিকাশ, বাণিজ্য বৃদ্ধি, মানুষের সচলতা (mobility) ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক উপাদানগুলির ভিত্তি লাভ করতে থাকে। ভারতীয় সমাজের এই বস্তুগত পরিবর্তন (material change) বৌদ্ধিক রূপান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দেয়। নানা কারণে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এই সময় তার পূর্ব গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। পুরাতন ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে নতুন চিন্তা-চেতনা সঞ্চারিত হতে থাকে। পরবর্তী বৈদিক যুগে উপনিষদের মুক্ত চিন্তার প্রসার সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং যাগ-যজ্ঞ, বলিদান ইত্যাদি জটিল ধর্মাচরণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে লোকায়ত বিশ্বাস সমাজের প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর সমর্থন লাভ করে। মানুষের অধ্যাত্মজীবনে নেতৃত্ব দানের অধিকার থেকে ব্রাহ্মণ শ্রেণী ক্রমশ বিচ্যুত হন। তাদের স্থান দখল করেন শ্রমণ, পরিব্রাজকবৃন্দ। এঁরা যাগযজ্ঞ ইত্যাদি ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার নিয়ন্ত্রণ, কামনা-বাসনা, হিংসা ইত্যাদি বিলুপ্তিকেই মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করেন।
এই পর্বে ধর্ম চিন্তার ক্ষেত্রে দুটি তত্ত্ব বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। এগুলি হল ‘সংসার’ ও ‘কর্ম’। ‘সংসার’ হল জন্মমৃত্যুর চক্রবত্ আসা-যাওয়া। আর ‘কর্মবাদ’ হল ইহজীবনে কৃত কর্ম অনুসারে পরজন্মে ফল ভোগ করার অনিবার্যতা। ‘বাসুদেবক’ বা ‘ভাগবত সম্প্রদায়’ উত্তর-পশ্চিম ভারতে আচার বর্জিত সপ্রেম ভক্তি দ্বারা ঈশ্বরের করুণা (প্রসাদ) লাভের তত্ত্ব প্রচার করেন। মহাভারতের ঘটনা ভিত্তিক ধর্মশিক্ষা ও তত্ত্বমূলক ‘ভগবৎগীতা’য় সেই নিস্কাম কর্ম এবং একমাত্র ঈশ্বরে আস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। পূর্ব ভারতে একদল পরিব্রাজক প্রচারক ‘সংস্কার’ ও ‘কর্মতত্ত্বে’ আস্থা রেখে বৈদিক ঈশ্বরতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বের প্রায় বিপরীত এক নতুন ধর্মদর্শন প্রচার করেন। উল্লেখ্য যে, ভাগবতীয়দের ইষ্টদেবতা ভগবান কৃষ্ণের মতই এই পরিব্রাজক ধর্ম প্রচারকরা ছিলেন স্বাধীন ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই পর্বের ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান ছিলেন মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ। মহাবীর ও গৌতমবুদ্ধ প্রচলিত বৈদিক ধ্যান-ধারণার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং বহুলাংশে বিপরীত ধর্ম ও জীবন-দর্শন প্রচার করে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এঁদের বাস্তববাদী চিন্তা-চেতনা এবং জীবনমুখী ধর্মাচরণ পদ্ধতি দ্রুত অসংখ্য মানুষকে আকৃষ্ট করে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ভাবনা দ্বারা গঠিত গৌতমবুদ্ধের শিক্ষা দেশের গণ্ডী অতিক্রম করে বিদেশের মানুষকেও মুক্তির পথ দেখায়। সমাজ ও ধর্মজীবনে পরিবর্তনকামী একটা দৃঢ় মানসিকতা সৃষ্টির কাজে মহাবীর ও গৌতমবুদ্ধের আহ্বান বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।
ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক বৈদিক সভ্যতা ও দর্শন সবসময় এক ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ অব্দ এবং এরপর থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বৈদিক ধর্মে দেবদেবীর অবস্থান, ধর্মাচরণ পদ্ধতির নানা পরিবর্তন ও সংযোজন ঘটেছিল। কিন্তু তার মৌল কাঠামো ছিল অপরিবর্তিত। এই ধর্ম ও সমাজের কেন্দ্রে ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণদের সহযোগী হিসেবে ক্ষত্রিয়শ্রেণীও সামাজিক উচ্চক্রমে অবস্থান করেছিল। এখানে অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অস্তিত্ব ছিল অবহেলিত। বস্তুগত পরিবর্তন ঘটলেও বৈদিক ধর্ম ও সমাজ-জীবনে তাকে অস্বীকার করার প্রবণতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে নতুন দর্শনের অনুসন্ধান-ক্রিয়া শুরু হয়েছিল আদি-বৈদিক যুগের শেষ লগ্ন থেকেই। ওল্ডেনবার্গ লিখেছেন যে, বুদ্ধের জন্মের শত শত বছর আগে থেকেই ভারতের চিন্তা-জগতে নতুন পথের সন্ধান শুরু হয়েছিল। মহাবীর এবং বিশেষ করে গৌতমবুদ্ধের মাধ্যমে সেই পথ-সন্ধান চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল। এঁদের নির্দেশিত পথ কেবল বৈদিক ধারণা থেকে পৃথক ছিল না; অনেকাংশে ছিল বৈদিক ধর্মভাবনায় বিরোধীও। বৈদিক ধর্মের প্রায় সবকটি আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস-ভাবনার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ শোনা যায় জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনে। এছাড়াও চার্বাক, লোকায়ত, আজীবক প্রভৃতি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। জৈন গ্রন্থগুলিতে মহাবীরের সমকালীন ৩৬৩টি দার্শনিক মতবাদের কথা বলা হয়েছে। এই সংখ্যার অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। তবে এই উল্লেখ থেকে স্পষ্ট হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে দার্শনিক ভাবনা ও ধর্মীয় ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে বৈদিক ধর্মভাবনার একচেটিয়া কর্তৃত্বের ধারণা শিথিল হয়ে চেতনার জগতে বৈচিত্র্য এসেছিল। এই সকল ধর্মমতের মধ্যেকার কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল অভিন্ন। মহাবীর, বুদ্ধ, গোসাল প্রমুখ সবাই ব্যাপক মানসিক ও শারীরিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সত্য উপলব্ধি করতে সচেষ্ট ছিলেন। এঁরা বিশ্বাস করতেন যে, ‘কর্ম’ জীবনের গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নির্ণয় পালন করে, কিন্তু কর্ম থেকে কেবল আপতিক ফলই লাভ হতে পারে। তাই এঁরা কৃচ্ছসাধন, অধ্যয়ন ও আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।