আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ গল্প অবলম্বনে মধ্যবিত্তের জীবনে মহানগরের যে রূঢ় চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ গল্প অবলম্বনে মধ্যবিত্তের জীবনে মহানগরের যে রূঢ় চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করো
“তোমাদের এই কলকাতা দিন দিন আধুনিক হচ্ছে, বর্বর হচ্ছে, সূক্ষ্ম তার নামে দরকাচা মেরে যাচ্ছে…। কিংবা—”কলকাতা রোজ পালটায় আমরা শুধু রাস্তা টুকুর খবর রাখি।”—বিশিষ্ট লেখকের কলকাতা সম্বন্ধে এই উক্তি সমর্থন জানায় মহানগরের রূঢ়তাকে, যার স্বরূপ ব্যাখ্যা প্রদানে সাহিত্যিক ও কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র কলম ধরেছেন, এবং লিখেছেন মহানগর নামক গল্পটি “আমার সঙ্গে এসো মহানগরের পথে, যে পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মতো, যে পথ অন্ধকার মানুষের মনের অরণ্যের মতো, আর যে পথ প্রশস্ত, আলোকোজ্জ্বল মানুষের বুদ্ধি, মানুষের অদম্য উৎসাহের মতো, এ মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত—ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত।”
একদা এই মহানগরের বুকে পা রেখেছে গ্রামের সহজ সরল বালক রতন। ব্যাবসা সূত্রে তার বারবার এই শহরে আসা যাওয়া আছে, রতনের বড়ো ইচ্ছা সেও একদিন এই শহরে আসবে। কারণ লোকমুখে সে জেনেছে কয়েক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তার দিদি এসে এই মহানগরের বুকে আত্মগোপন করে আছে। রতন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কোনোমতে যদি একটিবার সে এই শহরের বুকে পা রাখতে পারে, তাহলে অবশ্যই জনারণ্যের মধ্যে থেকে তার দিদিকে খুঁজে বার করবেই। কাজেই বহু ইনিয়ে বিনিয়ে আবদারে বাবাকে রাজি করিয়ে নৌকাযোগে এসেছে মহানগরের আঙিনায়।
পোনাঘাটে এসে নৌকা লাগতেই রতন তার বাবার নিকট মৃদু সমর্থন আদায় করেই এক লাফে নৌকা থেকে পাড়ে নেমেই দ্রুতপদে পাড়ে উঠে সম্মুখে এগোতেই থাকে। কিন্তু বাবার কাছে অজ্ঞাত থাকে ছেলের উদ্দেশ্য। তবে–“মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ আসে কত কিছুর খোঁজে—–কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ বা বিস্মৃতি। মৃত্তিকার স্নেহের মতো শ্যামল একটি অসহায় ছেলে সেখানে এসেছে কীসের খোঁজে ?” এসেছে দিদির খোঁজে। কারণ, “দিদিকে যে তার খুঁজে বার করতেই হবে, দিদি না হলে যে তার কিছু ভালো লাগে না, ছেলেবেলা থেকে সে তো মাকে দেখেনি, জেনেছে শুধু দিদিকে, দিদি তার মা, দিদিই তার খেলার সাথী।”
আজন্মের খেলার সাথী, ভালোবাসার জন এই দিদিকে একদিন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল, রতনের বালক মন এখনও সে স্মৃতি আগলে রেখেছে। সে খুব কেঁদে ছিল, কয়েকদিন দিদিকে না ছাড়তে পেরে তার শ্বশুরবাড়িতেও গিয়ে থেকেছিল। পরে ধীরে ধীরে যখন সমস্ত স্বাভাবিক হয়ে আসছিল—“একদিন তাদের বাড়িতে বিষম গণ্ডগোল। দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছে ভিড় করে, ভিড় করে এসেছে গাঁয়ের লোক। থানা থেকে চৌকিদার পর্যন্ত এসেছে। ছেলেমানুষ বলে তাকে কেউ কাছে ঘেঁসতে দেয় না। তবু সে শুনেছে—দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে। সেই থেকে রতন দিদিকে আর কখনো একটিবারের জন্য কাছে পায় নি, যতবার দিদির জন্য মন তাঁর কেঁদে উঠেছে বাবা মুকুন্দ তাকে শাসিয়েছে, কখনো যেন দিদির কথা সে মুখে না আনে। রতনও নীরব থেকেছে। অতঃপর—“একদিন সে শুনেছে দিদিকে নাকি পাওয়া গেছে। দারোগা পুলিশ নিয়ে গিয়ে তাকে নাকি কোন্ দূর দেশ থেকে খুঁজে বার করেছেন।” তবে দিদি যে এখন কোথায় আছে কেউ তাকে দয়া করে জানায় না, ক্রমেই রতনের মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে দিদির জন্য, তাই তো অদম্য ইচ্ছাকে পাথেয় করে একদিন বাবার সঙ্গে চুপি চুপি সে চলে আসে এই মহানগরের বুকে দিদিকে খুঁজতে।
মহানগরের বিস্তীর্ণ জনারণ্যের মাঝে বহু প্রচেষ্টার ফলে অবশেষে রতন স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। রতন সন্ধান পায় তার দিদিকে। তার দিদি যে এলাকাতে থাকে সে স্থান সম্পর্কে রতন সচেতন না হলেও সে জেনেই ফেলেছে, সেখানে তার দিদির মতো আরও অনেক দিদি আছে, একসাথে তারা বসবাস করে। রতন তার দিদিকে প্রথম দেখায় আবদার জানায়—”তোমায় কিন্তু বাড়ি যেতে হবে দিদি” সাময়িকের জন্য চপলা তার ছোট্ট ভাইকে আশ্বস্ত করলেও সে জানে এটা এ জীবনে হওয়া অসম্ভব। তাইতো ক্ষণিক পরে কাতর কণ্ঠে সে বলেই ফেলে—“আমার যে যাবার উপায় নেই ভাই।” দিদি তার সঙ্গে বাড়িতে ফিরতে পারবে না শুনে সে বেঁকে বসে—দিদির কাছে সেও থেকে যাবে। চপলা এবার ধরা গলায় বলে—“এখানে যে তোমার থাকতে নেই ভাই।” রতন কিছুতেই বুঝতে পারেনা, কেন তার দিদি যেতে পারবে না, আর কেনই বা তাকে এখানে থাকতে নেই?
সেদিন নিষ্ফল হয়ে রতনকে তার নতুন করে খুঁজে পাওয়া দিদির কাছ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। তবে শিশুসুলভ কণ্ঠে সে দিদিকে বলতে ভোলেনি—“বড়ো হয়ে আমি তোমায় নিয়ে যাব দিদি। কারুর কথা শুনবো না।” কিন্তু বালক রতন জানেই না পরবর্তী জীবনে সে যত বড়ই হোক না কেন, কোনো শক্তিবলে তার দিদিকে সে নিয়ে যেতে পারবে না। কারণ, মহানগরের নিষ্ঠুরতা অক্টোপাশের মতো তার দিদিকে বেঁধে ফেলেছে। তার দিদি এখন সমাজের অন্ধগলির অভিযাত্রিনী। আলোকোজ্জ্বল পথ দেখলে সে এখন শিউরে ওঠে। যে সমাজ তাকে এই অনাম্নী গলির করে দিয়েছে, এটাই মনুষ্য সমাজ ও জীবনের চরম ট্র্যাজেডি।
গল্পের একস্থানে লেখক নাটকীয় পটপরিবর্তনে রতন শহরে পৌঁছাল লিখেছেন—“রতনকে এখানে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। মহানগরে অনেকেই আসে অনেক কিছুর খোঁজে, কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ বিস্মৃতি….পথের অরণ্যে তারা হারিয়ে যায়…রতনও তেমনি হারিয়ে যাবে…।” কিন্তু এই মহানগরে রতনরা হারিয়ে গেলে চলবে না, তাদের তো খুঁজে বেড়াতে হবে দিদিরূপী স্বপ্নের মাধুরীকে। আর মহানগর বারে বারে তাদের ফিরিয়ে দেবে, গ্রাস করবে তাঁদের স্বপ্নকে। এটাই এগল্পের মর্মার্থ।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।