আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বঙ্কিমচন্দ্র ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ যে জীবনদর্শন এবং মানব প্রীতির পরিচয় দিয়েছেন তা বিশদ আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
কমলাকান্তের সমস্ত স্বপ্ন ও পাগলামির মধ্যে যে সত্য নিহিত রয়েছে তা হ’ল মানবপ্রীতি। ‘মনুষ্য জাতির ওপর যদি আমার প্রীতি থাকে, তবে আমি অন্য সুখ চাহি না। (একা) এই প্রীতিবোধ কখনও কবি কল্পনায় উচ্ছ্বসিত কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে সরস।
আমরা আগেই বলেছি, বঙ্কিমচন্দ্রের শিল্প জীবনের রসোৎকর্ষের কালে কমলাকান্তের প্রকাশ। তাই চন্দ্রশেখর’-এর সমকালীন সময়ে রচিত এই গ্রন্থের চিন্তাচেতনা বঙ্কিমসাহিত্যের কেন্দ্রীয়-ভাবনা রূপেই প্রতিভাত। ‘কমলাকান্তের’ বিভিন্ন রচনায় এমন কিছু উক্তি আছে যা চিরকালের সর্বমানুষের হৃদয়োৎসায়ী। যেমন “একা” রচনায় আছে—“প্রীতি সংসারে সর্বব্যাপিনী—ঈশ্বরই প্রীতি।” কিংবা “পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয়ে কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও”। “আমার মন” রচনায় ব্যথিত ক্ষুব্ধ চিত্তে প্রশ্ন তুলেছেন—“কবে মানুষ নিত্যসুখের একমাত্র মূল অনুসন্ধান করিয়া দেখিবে।” ইতিপূর্বেই সিদ্ধান্তে এসেছেন—“পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল্য নাই”। তারপর তাঁর বলিষ্ঠ ঘোষণা—“যদি বিবাহ বন্ধনে মনুষ্যচরিত্রের উৎকর্ষ সাধন না হইল তবে, বিবাহের প্রয়োজন নাই……যে বিবাহ প্রীতি শিক্ষা না হয় সে বিবাহ প্রয়োজন নাই”। “একটি গীত”-এ বঙ্কিমচন্দ্রের মানবপ্রীতি আরও বেশি আবেগ মধুর……“বুঝিতে পারি যে, মনুষ্য মনুষ্যের জন্য হইয়াছিল—এক হৃদয়ে অন্য হৃদয়ের জন্য হইয়াছিল…… ইহজন্মে – মনুষ্য হৃদয়ে একমাত্র তৃষা, অন্য হৃদয়ে কামনা”। “বিড়াল” প্রবন্ধে সেই সমাজতান্ত্রিক বিড়ালের কণ্ঠে প্রবচনের মতো ধ্বনিত হয়েছে—“ধর্ম কি ? পরোপকারই পরম ধর্ম”।
কমলাকান্তের এই প্রতিবাদী জীবনদর্শন নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের জগতে। প্রবন্ধের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই চেতনার প্রকাশ দুর্লভ নয়। “বিড়াল” এবং “সাম্য” প্রবন্ধ উভয়তঃই বঙ্কিমের সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। ধনের অসম বন্টনের প্রতি কটাক্ষ। “কমলাকান্তের জোবানবন্দিতেও” গোবৎসকে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত না করবার আবেদন আছে।
মানব-প্রীতির যে ধ্যান কমলাকান্তের প্রধান সুর “কপালকুণ্ডলা” উপন্যাসে নবকুমার তারই ধারক ও বাহক। মতিবিবিও সেই আদর্শেরই অনুবর্তিনী। “ধর্মতত্ত্বেও” বঙ্কিমের এই মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। কোনো কোনো উক্তি পূর্বোক্ত “আমার মন” রচনারই প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়—“যদি পারিবারিক স্নেহের গুণে তোমাদের আত্মপ্রিয়তা লুপ্ত না হইয়া থাকে যদি আত্মপরিবারকে ভালোবাসিয়া মনুষ্যজাতিকে ভালোবাসিতে না শিখিয়া থাক, তবে মিথ্যা বিবাহ করিয়াছ…।” এছাড়া “ধর্মতত্ত্বের” ২১-তম অধ্যায়ে রয়েছে সেই প্রাচীন সূত্র—“মনুষ্য প্রীতি ভিন্ন ঈশ্বরে ভক্তি নাই।”
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সমস্ত উপন্যাসেরই প্রধান অবলম্বিত বিষয় নরনারীর প্রেম। “বিষবৃক্ষ” উপন্যাসে এই প্রেম সম্পর্কে হরদেব ঘোষাল যে উক্তি করেছেন তা আসলে লেখকেরই আত্মকথনঃ “আত্মবিস্মৃত…ও আত্মবিসর্জন এই যথার্থ প্রণয়, শেকস্পিয়র, বাল্মীকি, শ্রীমদ্ভাগবতকার ইহার কবি। ইহা রূপে জন্মে না। প্রথমে বুদ্ধি দ্বারা গুণ গ্রহণ, গুণ গ্রহণের পর আসঙ্গলিপ্সা; আসঙ্গলিপ্সা সফল ইহার সংসর্গ, সংসর্গের ফলে প্রণয়, প্রণয়ে আত্মবিসর্জন : আমি ইহাকেই ভালোবাসা বলি।” এ যেন অনেকটা অলৌকিক বৈষ্ণবীয় প্রেমলীলার অনুবর্তন।
বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে প্রেম ও মানবধর্ম অভিন্ন। কামনাতাড়িত রূপমোহমুগ্ধ আকর্ষণ বা ভালোবাসা প্রকৃত প্রেম নয় এবং তা জগতের কোনো হিতসাধন করে না। ‘বিষবৃক্ষে নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীর প্রেম, ‘কপালকুণ্ডালায়’ নবকুমারের প্রতি তার মোহের একটি স্তর ; ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে প্রতাপের প্রতি ইন্দ্রিয়ানুরাগ, “কৃষ্ণকান্তের উইল”-এ রোহিণীর প্রতি গোবিন্দলালের রূপমোহ ইত্যাদি কখনই জয়ী হতে পারেনি। এইসব মোহগ্রস্ত মানুষই কমলাকান্তের কাছে পতঙ্গ। তাদের ধ্বংস সাধিত হচ্ছে রূপবহ্নি, ধনবহ্নি, ভোগবহ্নি, ঈষাবহ্নি, স্নেহবহ্নি ইত্যাদি নানা বহ্নিতে। পতঙ্গ প্রবন্ধের এই চিন্তাটি বঙ্কিমচন্দ্র তথা কমলাকান্তের জীবন দর্শনের অন্যতম প্রধান সূত্র।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।