আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বঙ্কিমচন্দ্র ‘কমলাকান্তের মাধ্যমে যে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বঙ্কিমচন্দ্র ‘কমলাকান্তের মাধ্যমে যে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করো
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বাংলা সাহিত্যে, হাস্যরস সৃষ্টিতে এক নিখুঁত সৃষ্টি। সাধারণভাবে এটিকে ‘প্রবন্ধ’ মূলক রচনা বললেও এটি অনেকটা ইংরাজি সাহিত্যের ‘ব্যক্তিগত রচনা’ বলতে যা বোঝায় অনেকটা সে রকমের। কিন্তু এ রচনাগুলি তথ্যবির্জত বা অন্তঃসারশূণ্য নয়। এখানে রয়েছে বিরাট জ্ঞানের কথা। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারার হাস্যরস তাঁর হাতেই যথার্থ সাহিত্যিক সম্মান লাভ করে। কমলাকান্তের রচনাগুলির মধ্যে যে তত্ত্ব, যে আদর্শ বা যে জীবন দর্শনই প্রচ্ছন্ন থাকুক না কেন, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ পূর্ণ হাস্যরসই এর প্রধান রস। বঙ্কিমচন্দ্রের ছদ্ম গাম্ভীর্যের আড়ালে এক জীবন রসিক সত্তা ‘লোকরহস্য’ এবং ‘কমলাকান্তের’ এই ব্যক্তিগত প্রবন্ধগুলির মধ্যে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে নিয়েছে। এখন এই হাস্যরসের প্রকৃতি অনুসন্ধান করা যাক।
বাংলায় যেমন হাস্যরসকে রঙ্গ, ব্যঙ্গ, কৌতুক ইত্যাদি নানা অলংকার দেওয়া যায়— তেমনি ইংরেজিতেও উইট, স্যাটায়ার, হিউমার, আয়রনি; ফার্স, কমেডি, ফান ইত্যাদি নানা নামের মধ্যে এই শিল্পের সূক্ষ্ম তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায়। উটই এবং হিউমার উভয় ক্ষেত্রেই বুদ্ধিবৃত্তির তীক্ষ্ণ উপস্থিতি প্রয়োজন। তুলনামূলকভাবে হিউমারের শিল্প সাফল্য বেশি। কেননা শাণিত বুদ্ধি সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। “কমলাকান্তের” হাস্যরস এই হিউমারের শ্রেণির।
হাস্যরসের সৃষ্টি হয় সাধারণত নিয়মের ব্যতিরেকে। জীবনের নানা অসঙ্গতি, ভ্রান্তি, মোহমুগ্ধতা, মূর্খতা, বাতিগ্রস্থতা ইত্যাদি নানা কারণ থেকে হাস্যরস সৃষ্টির পেছনে। আফিম সেবক কমলাকান্তের দিব্যদৃষ্টির সামনে প্রতি মুহূর্তে চতুর্দিকের সামাজিক ঘটনা চরিত্র, প্রথা ও মূল্যবোধের আচরণ খ’সে পড়েছে আর হাস্যরসের উদ্রেক ঘটেছে পাঠকের মনে।
কমলাকান্তের সংসার বন্ধনহীন দুরাচারী, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ রয়েছে এই সংসারেরই নানা অসঙ্গতির মধ্যে বিশেষ করে পতঙ্গ, মনুষ্য ফল ইউটিলিটি বা উদারদর্শন ; কমলাকান্তের জোবানবন্দি, বড়োবাজার, পলিটিকস, ঢেঁকি, বিড়াল ইত্যাদি রচনায় হাস্যকর অথচ গম্ভীর অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন কল্পনার মধ্য দিয়ে কমলাকান্তের মনসুতার আত্মপ্রকাশ করেছে অজস্র ধারায়। ‘বড়েবাজার’ এবং ‘মনুষ ফল’ রচনাদুটি প্রকৃতির দিক থেকে কিছুটা কাছাকাছি। উভয়তঃই কমলাকান্ত তাঁর অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ এবং সাহিত্য-শিল্পের অন্তঃসারশূন্যতা প্রদর্শন করে পাঠকের হাস্যরসের খোরাক যুগিয়েছেন। ‘পলিটিকস’ রচনায় বাঙালির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মধ্যে যে অন্তঃসারশূন্যতা আছে তার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। আংশিক গল্পের ছাঁচে “কুক্কুর জাতীয়” এবং “বিষ-জাতীয়” পলিটিকস প্রদর্শন ক’রে এখানে হাস্যরস প্রদর্শিত হয়েছে। “বিড়াল” এবং ‘ঢেঁকি’ রচনা দুটির মধ্যেও চেতনার ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। সংসারের বৃহৎ ঢেঁকিশালায় সমাজের স্তরের মানুষই পিষ্ট হচ্ছে। এই সাম্যের একান্ত অভাবের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে ‘বিড়াল’ রচনাটিতে। একটি বিড়ালের মধ্যে সোস্যালিস্ট চিন্তা আরোপ নিঃসন্দেহে মজার।
স্বভাব-ধর্মেই বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন হাস্যরসিক। আলোচনার বিষয় যাই হোক না কেন প্রকাশ ভঙ্গির সরসতার গুণে “কমলাকান্তের” সমস্ত রচনাই এক নতুন মাত্রা পেয়ে আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা উল্লেখযোগ্য : প্রধানত উপন্যাসিক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর এই আঙ্গিকের মধ্যেও হাস্যরসের উপস্থাপন আছে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ প্রকাশ প্রবন্ধ সাহিত্যে—এই কমলাকান্তে।
শেকপিয়রের ফলষ্টাফ চরিত্রের সঙ্গে কমলাকান্তের তুলনা করেছেন কোনো কোনো সমালোচক। বর্তমানকালের ফরমাইসী সাহিত্যকে ব্যঙ্গ করে কমলাকান্ত যে পত্র লিখেছেন তাতে জীবনের অসঙ্গতি এবং হাস্যরস দুইই আছে—“এ কমলাকান্তি কলমে ফরমাসের মতো সকল রকমের রচনা প্রস্তুত হয়—নাটক-নভেল চাই, না পলিটিকসের দরকার। কিন্তু ঐতিহাসিক গবেষণা পাঠাইব, না সংক্ষিপ্ত সমালোচনার বাহার দিব। বিজ্ঞানশাস্ত্রে আপনার আসক্তি, না ভৌগোলিকত্ব রসে আপনি সুরসিক।” “মনুষ্য ফল”-এ নারী জাতিকে নারিকেলের সঙ্গে তুলনা করে কমলাকান্ত বলেছেন—“নারিকেল গাছে না উঠিলে পাড়া যায় না। গাছে উঠিতে গেলেও হয় নিজের পায়ে দড়ি বাঁধিতে হইবে, না হয় ডোমের খোষামোদ করিতে হইবে’। এই রকম অসংখ্য উক্তির মাধ্যমে কমলাকান্তের হাস্যরস মূর্ত হয়েছে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।