আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বালুচিস্তান থেকে গুজরাট গ্রাম-সমাজের সূচনা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বালুচিস্তান থেকে গুজরাট গ্রাম-সমাজের সূচনা
মানবসভ্যতার আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের প্রাচীনতম নিদর্শন মেহেরগড়ে পাওয়া গেলেও, এটিই একমাত্র প্রত্নস্থল নয়। গ্রাম-সমাজ গড়ে ওঠার যে প্রাচীনতম ক্রমবিন্যাস এখানে দেখা যায় তা অবশ্যই ব্যতিক্রমী। তবে মেহেরগড় ছাড়াও বালুচিস্তানে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে গড়ে ওঠা আরো কয়েকটি বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের অন্যতম হল বালুচিস্তানের উত্তর-পূর্বে আবিস্কৃত ঝোব উপত্যকার ‘রানা ঘুনডাই’ কেন্দ্রটি। এটিও প্রাথমিকভাবে কৃষিভিত্তিক বসতি। পাথর ও ধাতুর ব্যবহার সমান্তরালভাবেই করা হত। সর্ব নিম্নস্তরে গৃহপালিত গোরু, ভেড়া, ছাগল এবং সম্ভবত ঘোড়ার অস্তিত্ব ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে কারিগরি দক্ষতার নিদর্শন হিসেবে চিত্রিত মৃৎপাত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের গায়ের রঙ কালচে ও হলদেটে এবং তার ওপর কালো রঙের কিছু সরলরেখা। এর মাঝে কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়ের জ্যামিতিক চিত্ররেখা। সম্ভবত এই অলংকরণের উৎস পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব ইরান। সেখানে ‘আইবেকস্’ নামক হরিণ জাতীয় পশুর অনুরূপ চিত্রাঙ্কন পাওয়া যায়। অনুরূপ আর একটি নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল কোয়েটা উপত্যকার (মধ্য বালুচিস্তান) ‘কিলি-গুল-মহম্মদ’ ও ‘দাম্ব-সাদাত’। এখানে প্রথম পর্যায়ে গৃহপালিত পশু, ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ, মসৃণ পাথরের কুড়াল পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হাতে বানানো মৃৎপাত্র, কিছু হাড়ের হাতিয়ার দেখা যায়। পরবর্তী পর্যায়গুলিতে জ্যামিতিক কালো নক্শা বিশিষ্ট রঙ্গীন মৃৎপাত্র, ধূসর রঙের চিত্রিত মৃৎপাত্র, মাটির সিলমোহর দেখা যায়। কোয়ের্টার দক্ষিণে কালাত অধিত্যকার প্রায় সমসাময়িক দু’টি কেন্দ্র আন্জিরা ও দিয়া-দাম্ব থেকেও কিলি-গুল-মহম্মদের মত পর্যায়ভিত্তিক নব্যপ্রস্তর ও তাম্রশ্মীয় সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
বালুচিস্তানে ‘নাল’ ও ‘কুল্লি’ নামক দু’টি আঞ্চলিক সংস্কৃতির ধারার সন্ধান পাওয়া গেছে। কালাতের দক্ষিণাংশে গড়ে ওঠা নাল সংস্কৃতির সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দের শেষভাগ থেকে ৪০০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়। এখানে খননকার্যের ফলে কিছু সমাধির চিহ্ন পাওয়া গেছে। কিছু সমাধিতে পুরো শরীর আছে। আবার কিছুতে পাওয়া গেছে শুধুই দেহাস্থি। একইসঙ্গে পাওয়া গেছে লাল, হলুদ, সাদা রঙের মৃৎপাত্র, ষাঁড়, মূর্তি এবং নানা ধরনের ধাতুখণ্ড যেমন, রুপো, তামার হাতিয়ার, চুনাপাথর ও মার্বেল পাথর ইত্যাদি। কুল্লি সংস্কৃতির কেন্দ্রটিও দক্ষিণ বালুচিস্তানে। বালুচিস্তান থেকে সিন্ধু উপত্যকার কোহিস্তান পর্যন্ত এলাকাতেও সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। কুল্লি সংস্কৃতির সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত। এখানে ছোট পাথরের খণ্ড দিয়ে কাদামাটির সাহায্যে তৈরী বহু কক্ষবিশিষ্ট বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। সোনা, তামার ব্যবহার, পাথরের পুঁতি এবং চিত্রিত মৃৎপাত্রের অবস্থান দেখা যায়। মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য হল লাল রঙের ওপর কালো রঙে লতাপাতা, পশু মূর্তির বলিষ্ঠ উপস্থাপন। কুল্লি সংস্কৃতির আরো কয়েকটি কেন্দ্র ছিল পোরালি নদীর তীরভূমি, নিন্দোয়ারি, নিয়াইবুথি ইত্যাদি। বালুচিস্তানেরই কেজ উপত্যকায় (মাকরান উপকূল) মিরি কালাত, বালাকোট প্রভৃতি অঞ্চলেও কুল্লি সংস্কৃতির অনুরূপ ও প্রায় সমকালীন সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। রঙ্গীন মৃৎপাত্র, বহু কক্ষবিশিষ্ট গৃহ, জীবজন্তুর প্রতিকৃতি, পোড়ামাটির অলংকার ইত্যাদির অবশেষ এই সকল স্থানে পাওয়া গেছে। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পোড়ামাটির গবাদি পশু ও নারীমূর্তি।
বালুচিস্তানের পূর্বদিকে সিন্ধুনগরে সমতল অঞ্চলে আর একটি প্রাক্-হরপ্পা গ্রামীণ সংস্কৃতির কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি ‘আমরি’ সংস্কৃতি নামে পরিচিত। আমরি সংস্কৃতির সূচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। এর প্রথম পর্যায়ে কাঁচা ইটের বাড়ি ছিল। হালকা লাল রঙের ওপর কালচে বা খয়েরি রঙের জ্যামিতিক নক্শাবিশিষ্ট মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। পরবর্তী পর্যায়ে মৃৎপাত্রের গায়ে পশুর চিত্রাঙ্কন দেখা যায়। তামা ধাতুর অস্তিত্ব ছিল। আমরি সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র গাজিশা অঞ্চলে বাঁধ দিয়ে জমিতে জলসেচ ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানেও মাটি ও পাথর দিয়ে পিরামিড সদৃশ উঁচু নির্মাণ কাজের রেওয়াজ ছিল। এছাড়া তামা, ঝিনুক, লাপিস লাজুলি, কর্ণেলিয়াম ইত্যাদি পাথরের পুঁতি, হাড় ও পাথরের হাতিয়ার, গুলতি, তুরপুন জাতীয় ক্ষেপনাস্ত্র সেকালে ব্যবহার করা হত। আমরি সংস্কৃতির মৃৎপাত্রে পশু, পাখির চিত্রাঙ্কন অনুপস্থিত। কিন্তু নাল-এর মৃৎপাত্রে তা ছিল। তবে উভয়ক্ষেত্রেই লাল রঙটি ‘অপ্রধান’ (Secondary) হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। লালের সাথে হলুদ ও নীল রঙের মিশ্রণ স্পষ্ট।
সিন্ধু উপত্যকায় (বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত) খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে ওঠা একটি বসতির সন্ধান পাওয়া যায়। এটিকে ‘কোট ডিজি সংস্কৃতি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে মজবুত দূর্গ নির্মাণের নিদর্শন পাওয়া যায়। দূর্গের দেওয়াল পাথরের ভিতের ওপর রোদে শুকানো ইট গেঁথে করা হয়েছে। দূর্গের ভেতরের বাড়িগুলিও টুকরো পাথরের ভিতের ওপর কাঁচা ইট গেঁথে তৈরী করা হয়েছিল। কোট ডিজি সংস্কৃতির মৃৎপাত্রগুলি সাধারণত গোলাকার ভাঁড়ের মত। লাল রঙের ওপর কালো রঙের জ্যামিতিক নকশা দ্বারা এগুলি অলংকৃত। নক্শার মধ্যে মোষের শিং-এর মতো একটি নক্শার নিচে ছোট্ট মানুষের মুখমণ্ডল। মাছের আঁশজাতীয় বা পিপল পাতার মতন কিছু চিত্রাঙ্কণ দেখা যায়। এছাড়া পাওয়া গেছে ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ, ঝিনুক, ঝিনুকের মালা, পুঁতি ইত্যাদি। পাকিস্তানের প্রত্নবিদ এফ. এ. খান তাঁর ‘Excavation at Kot Digi’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, কোটডিজি সংস্কৃতিকে ‘প্রাক্ হরপ্পা সংস্কৃতি’ বলা যেতে পারে। হরপ্পা সভ্যতায় কোটডিজি সংস্কৃতির পরিণত রূপ দেখা যায়। মুলতানে রাভি নদীর উপত্যকায় জলিলপুর এবং রাওলপিণ্ডির কাছে সরাইখোল বসতি দুটি থেকেও কোটডিজি সংস্কৃতির অনুরূপ বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে।
উত্তর-পূর্ব দিকের মরু অঞ্চল (থর/চোলিস্তান) থেকে হরিয়ানা, উত্তর রাজস্থান ও পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরের মধ্য দিয়ে নিম্ন-সিন্ধু এলাকা পর্যন্ত একটি প্রাচীন নদীর প্রবাহ ছিল। নদীর শুষ্ক খাতটি এখানো বর্তমান। উৎপত্তিস্থলে এটি সরসুতি বা সরস্বতী নামে অভিহিত হত। রাজস্থানে ঢোকার আগে দৃষদ্বতী নামে একটি উপনদী এর সাথে যুক্ত হয়েছিল। যাই হোক, এই শুষ্ক নদীখাতটি ভারতে ‘খগ্গর’ নামে এবং নিচের দিকে পাকিস্তানে ‘হাক্রা’ নামে পরিচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক বিবরণে এটিকে ‘খগর-হাক্রা’ প্রবাহ বলা হয়। খগর হাকরা প্রবাহের পাশে কয়েকটি ঘনবসতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। এর প্রথম পর্যায়ের সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের। চোলিস্তান মরু অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রথম পর্যায়ের মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য হল-পাত্রের গাত্রে কাদা-মাটির প্রবেশ এবং অন্যটিতে লাল রঙের গায়ের ওপর কালো রঙের প্রলেপ দেওয়া। ভারতের অংশ থর মরু অঞ্চলেও অনুরূপ মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। খননকার্যে প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে ছিল ছোট পাথরের হাতিয়ার, পাথরের শিল-নোড়া, পোড়ামাটির বালা, ছোট ছোট পশুমূর্তি, তামা ইত্যাদি। স্থানীয়ভাবে হাতিয়ার নির্মাণের উপযোগী পাথর বা তামা পাওয়া যেত না। অনুমিত হয় যে, এগুলি বাণিজ্যিক সূত্রে আনা হত। এই অঞ্চলে একাধিক স্থায়ী বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য যে, হাক্রার প্রবাহ ধরে সিন্ধুনদের দিকে এগোলে হরপ্পা সভ্যতার সাথে ভীষণভাবে সাদৃশ্যযুক্ত সংস্কৃতিগুলির অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।