আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থার স্বরূপ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থার স্বরূপ
যে-কোনো সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য ক্ষাত্রশক্তিই যথেষ্ট নয়। সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থার ওপর তা বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিজয়নগর রাজ্যের ক্ষেত্রে একথা আরও বেশিভাবে প্রযোজ্য। কারণ দিল্লি-সুলতানির ধ্বংসস্তূপের ওপরে গড়ে ওঠা এই রাজ্যে কোনো প্রাচীন রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল না। তাই অল্পকালের সময়সীমায় ওই রাজ্যে চারটি বংশকে রাজত্ব করতে দেখা যায়। পরন্তু দক্ষিণ ভারতের প্রতিবেশী বাহমনী রাজ্য সদাসর্বদা বিজয়নগরকে গ্রাস করতে উদ্যত ছিল। অবশ্য বিজয়নগরের শাসকেরা রাজ্যের এইসব বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং সুনিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শাসনের প্রয়োগ দ্বারা এই সীমাবদ্ধতার মোকাবিলা করেছিলেন।
মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ী রাজা ছিলেন সমস্ত ক্ষমতার আধার। তিনি ছিলেন প্রধান শাসক, প্রধান আইন-প্রণেতা ও প্রধান বিচারক। রাজাই ছিলেন প্রধান সেনাপতি। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাজা স্বেচ্ছাচারী বা অত্যাচারী ছিলেন না। বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থা প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারিতার আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল। বিজয়নগরের তথা দক্ষিণ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের ‘আমুক্ত মাল্যদা’ গ্রন্থ থেকে সেখানকার শাসনের প্রকৃতি বোঝা সম্ভব। তিনি লিখেছেন : “সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজা সর্বদা ধর্মের দিকে চোখ রেখে রাজ্যশাসন করবেন।” রাজকর্তব্য সম্পর্কে তিনি উপদেশ দিয়েছেন যে, রাজা অতি সতর্কতার সঙ্গে এবং নিজের শক্তি অনুযায়ী দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবেন। তিনি লিখেছেন : “রাজা কূটনীতিতে পারদর্শী ব্যক্তিদের সংগঠিত করে শাসন পরিচালনা করবেন।”
একটি মন্ত্রীপরিষদের সাহায্যে রাজ্যশাসন পরিচালনা করতেন। এই পরিষদে সম্ভবত ছয় থেকে আটজন মন্ত্রী থাকতেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হত। অনেক ক্ষেত্রেই, প্রধানত উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-পদ বংশানুক্রমিক ছিল। মন্ত্রীগণকে দপ্তর পরিচালনায় সাহায্য করতেন একদল দায়িত্বশীল কর্মী। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন খাজাঞ্চি বাণিজ্য-অধিকর্তা, পুলিশ-অধিকর্তা, পরিবহণ-অধিকর্তা প্রমুখ। রাজপ্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত। রাজসভাটি ছিল খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। কবি, সাহিত্যিক, পুরোহিত, জোতিষী, সংগীতজ্ঞ ইত্যাদি বিভিন্ন শাখার জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা সর্বদা রাজসভার মর্যাদা বৃদ্ধি করতেন। বিজয়নগর রাজসভার চাকচিক্য ও আড়ম্বর দেখে প্রায় অধিকাংশ বিদেশি পর্যটক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বিজয়নগর রাজ্যটি কয়েকটি মণ্ডলম্ বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এগুলি আবার ‘জেলা’ (নাড়ু), ‘মহকুমা’ (স্থল), ‘গ্রাম’ প্রভৃতি ছোটো ছোটো এককে বিভক্ত ছিল। পায়েজ ভ্রান্তিবশত তখন ২০০টি প্রদেশের অস্তিত্বের কথা লিখেছেন। সম্ভবত প্রদেশের সাথে সামন্ত, উপসামন্ত প্রমুখকে এক করে দেখার ফলে এই ভ্রান্তি হয়েছে। ড. কৃষ্ণ শাস্ত্রীর মতে, বিজয়নগরে ছয়টি প্রদেশ ছিল। প্রদেশের শাসনদায়িত্বে থাকতেন একজন করে গভর্নর। সাধারণত রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে গভর্নরদের নিয়োগ করা হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজা দায়িত্ববান অভিজাতদেরও এই পদে নিযুক্ত করতেন। কেন্দ্রের মতো প্রাদেশিক শাসকরাও (গভর্নর) সামরিক, অসামরিক ও বিচারবিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রাদেশিক শাসকরা কেন্দ্রে আয়ব্যয়ের হিসেব পেশ করতে বাধ্য ছিলেন। রাজার প্রয়োজনে গভর্নররা সামরিক বাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেন। আইনত রাজার অধীনস্থ হলেও প্রাদেশিক শাসকরাও প্রচুর পরিমাণে স্বাধীনতা ভোগ করতেন। তাঁদের নিজস্ব দরবার ছিল, নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল। প্রদেশের কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদচ্যুতি গভর্নর-এর ইচ্ছাধীন ছিল। এ ব্যাপারে রাজা হস্তক্ষেপ করতেন না। এমনকি গভর্নররা নিজ নামে মুদ্রাও প্রচলন করতে পারতেন। গভর্নরদের কার্যকালের কোনো নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। রাজার ইচ্ছা এবং গভর্নরের সামর্থ্য ও শক্তির ওপর তার কার্যকাল নির্ভর করত। রাজা সেনাপতিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের শর্তে ভূমিদান করতেন। একে বলা হত ‘অমরম্’। এই সেনাপ্রধানদের ‘পলিগর’ বা ‘নায়ক’ বলা হত। রাজার প্রয়োজনে এরা রাজাকে অর্থ, সৈন্য, ঘোড়া, হাতি দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য ছিলেন। ফানাও নুনিজ বিজয়নগরে প্রায় দুইশত ‘নায়ক’-এর অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। কানাড়ি-তেলেগুভাষী এই নায়করা ছিলেন মূলত কর্ণাটক-অন্ধ্র অঞ্চলের লোক। ক্রমে এই নায়করা খুবই শক্তিশালী ও স্বাধীনতাকামী হয়ে উঠেছিলেন। কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে নায়কদের কেউ কেউ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সাম্রাজ্যের ভাঙন ত্বরান্বিত করেন।
বিজয়নগরের সর্বনিম্ন বা ক্ষুদ্রতম শাসনবিভাগ ছিল ‘গ্রাম’। চোলদের গ্রাম্য স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহ্য এখানেও বর্তমান ছিল। উত্তর ভারতের পঞ্চায়েত-এর মতো দক্ষিণে ‘গ্রাম্য সভা’ শাসন পরিচালনা করত। গ্রামীণ প্রশাসনিক কর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেনাতোভা বা হিসাবরক্ষক, তলরা বা পরিদর্শক, বেগারা ইত্যাদি। এই সকল কর্মচারী তাদের বেতন হিসেবে জমি ভোগ করতেন। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে গ্রামীণ প্রশাসনের সংযোগ রক্ষা করতেন ‘মহানায়কাচার্য” নামক কর্মচারী। পূর্বের তুলনায় পরবর্তীকালে গ্রামগুলির স্বশাসন-ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল এবং এর মূলে ছিল ‘নায়ক’দের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রসার।
বিজয়নগর রাজ্যকে প্রতিনিয়ত বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হত। তাই দক্ষ বাহিনী গঠনে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে সাত লক্ষ পদাতিক, সাড়ে তিন হাজার অশ্বারোহী এবং সাড়ে ছয় শত রণহস্তী ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একটি কামান বাহিনী। উন্নতমানের অশ্বসংগ্রহের জন্য বিজয়নগরের রাজারা পোর্তুগীজ বণিকদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করতেন। সেনাবিভাগের তত্ত্বাবধান করত ‘কাণ্ডাচার’ নামক একটি দপ্তর। এই দপ্তরের প্রধান ছিলেন ‘প্রধান সেনানায়ক’ বা ‘দণ্ডুপতি’। এ ছাড়া প্রাদেশিক গভর্নরদের বা সামন্তদের কাছ থেকেও রাজা সেনা-সাহায্য পেতেন। তখন সম্ভবত নৌবাহিনী গড়ার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। দক্ষিণ-ভারতের নদীপ্রধান অঞ্চলে স্থাপিত এই রাজ্যে নৌবাহিনীর প্রতি উদাসীনতা পরিণামে ক্ষতির কারণ হয়েছিল।
অন্যান্য বিষয়ের মতো রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। তবে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বিচারালয়ের মাধ্যমে বিচারকার্য নিষ্পত্তি হত। গ্রামীণ বিরোধ গ্রাম পঞ্চায়েতে নিষ্পত্তি করা হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার-নিযুক্ত বিচারক স্থানীয় সভার সাথে আলোচনা করে গ্রামীণ বিরোধের মীমাংসা করতেন। সাধারণভাবে দেশের প্রচলিত রীতিনীতি প্রথাপ্রকরণ ও আচার-ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে বিচারকার্য সম্পন্ন করা হত। ফৌজদারি দণ্ডবিধির যথেষ্ট কঠোরতা ছিল। চুরি, নৈতিক ব্যভিচার, দেশদ্রোহিতা প্রভৃতির অপরাধে কঠোর শারীরিক নির্যাতন বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। সাধারণ অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ ইত্যাদি শাস্তি দেওয়া হত।
সামগ্রিকভাবে বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থা ছিল সুসংগঠিত ও কার্যকর। তবে এরও কতকগুলি সহজাত ত্রুটি ছিল। যেমন (১) প্রাদেশিক শাসক বা সামন্তদের ক্ষমতা-নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক সংহতি শিথিল হয়েছিল। (২) সামরিকব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বনির্ভর ছিল না। বাহমনী রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত এই রাজ্যের সামরিক শক্তি স্থানীয় সামন্ত বা প্রাদেশিক গভর্নরদের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল থাকার ফলে, এর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। (৩) রাজ্যের পূর্ব-উপকূলে পোর্তুগীজ বণিকদের অবস্থান ও ক্ষমতাবৃদ্ধির ব্যাপারে উদাসীনতা বিজয়নগরের পক্ষে শুভ হয়নি। (৪) প্রজাবর্গের ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবণতা রোধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে জাতীয়তাবোধ শিথিল হয়ে পড়েছিল। (৫) সমুদ্র ও নদীবেষ্টিত হওয়ার ফলে বিজয়নগরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কিন্তু উপযোগী উপাদানের প্রতুলতা সত্ত্বেও রাজারা ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য কখনোই সুপরিকল্পিত কর্মসূচি নেননি।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।