লোদী বংশ (১৪৫১ – ১৫২৬ খ্রি:) : ইব্রাহিম লোদী, সিকন্দর লোদী, বহলুল লোদী

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “লোদী বংশ (১৪৫১ – ১৫২৬ খ্রি:) : ইব্রাহিম লোদী, সিকন্দর লোদী, বহলুল লোদী” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

লোদী বংশ (১৪৫১ – ১৫২৬ খ্রি:) :

‘লোদী’-রা ছিল আফগানিস্তানের অধিবাসী। আফগান ‘লোদী’ উপজাতির ‘শাহু খেল’ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মালিক বাহরাম সুলতান ফিরোজ তুঘলকের আমলে মুলতানে আসেন এবং সেখানকার গভর্নর মর্দান দৌলতের অধীনে চাকুরি নেন। বাহরামের এক পুত্র সুলতান শাহ শিরহিন্দের শাসক নিযুক্ত হন এবং খিজির খাঁ কর্তৃক ইসলাম খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত হন। বাহরামের অপর পুত্র মালিক কারার পুত্র ছিলেন বহলুল। বহলুল তাঁর কাকা ইসলাম খাঁ-র খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। আরবি ও ফারসিতে তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। সামরিক শিক্ষাতেও তিনি পারদর্শিতা দেখান। সুলতান শাহ’র ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মৃত্যুর পর বহলুল লোদী শিরহিন্দের গভর্নর নিযুক্ত হন। দিল্লির সুলতান মহম্মদ শাহের স্বপক্ষে যুদ্ধ করে মালবের শাসক মহম্মদ খলজিকে বহলুল পরাজিত করে পুরস্কার হিসেবে লাহোরের শাসক পদ পান। অতঃপর দিল্লির উজির হামিদ খাঁকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। সেই সময় সুলতান আলম শাহ বদাউনে অবস্থান করছিলেন। বহলুল লোদী সুলতানকে দিল্লি এসে সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আলম শাহ স্বেচ্ছায় সিংহাসন বহলুলকে সমর্পণ করে ‘বদাউনে’ থাকার সিদ্ধান্ত নেন। আঞ্চলিক শাসক রূপেই তিনি জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়ে দেন। বহলুল সিংহাসনে বসে ‘লোদী বংশের’ শাসনের সূচনা করেন (১৪৫১ খ্রিঃ)।

বহলুল লোদী (১৪৫১-৮৯ খ্রি:) :

বহলুল লোদী ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল ‘সুলতান আবুল মুজাফর বহলুল শাহ গাজি উপাধি নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। সাম্রাজ্যের সংগঠক ও সামরিক নেতা হিসেবে বহলুল যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় সুলতানি রাজ্য দিল্লিও সন্নিহিত ক্ষুদ্র অংশে সীমিত হয়ে পড়েছিল। দরবারী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তেরও অভাব ছিল না। বহলুল অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এই সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মুখোমুখি হন। বহলুল উপলব্ধি করেন যে, আলাউদ্দিন খলজির আমলের রাষ্ট্রনীতি এই মুহূর্তে অচল। আফগান সর্দারদের স্বাধীনতাস্পৃহা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাও তাঁর অজানা ছিল না। তাই সুলতানের চূড়ান্ত স্বৈর শাসন প্রবর্তনের পরিবর্তে তিনি সুলতান ও অভিজাতদের ‘যৌথ দায়িত্ব’-মূলক শাসননীতি গ্রহণ করেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আফগান-সর্দারদের জায়গির ও উচ্চপদ প্রদান করেন। বিদ্রোহী অভিজাতদের দমন করার জন্য সামরিক শক্তিপ্রয়োগেও তিনি দৃঢ়তা দেখান। মেওয়াট, সম্বল, কোয়েল, রেওয়ারী, চান্দেরী, গোয়ালিয়র প্রভৃতি স্থানের আঞ্চলিক শাসকদের দমন করে দিল্লির আনুগত্য স্বীকারে ও করপ্রদানে বাধ্য করেন।

লোদী শাসনের পক্ষে সম্ভবত সবথেকে বড়ো বিপদ ছিল মালবের শাসক মামুদ শাহ শার্কী’র উচ্চাশা। সৈয়দবংশীয় শেষ সুলতান আলম শাহের জামাতা মামুদ শার্কী মনে করতেন, দিল্লির সিংহাসনের বৈধ দাবিদার তিনিই। এই যুক্তিতে মামুদ দিল্লি আক্রমণ করেন (১৪৫১ খ্রিঃ)। বহলুল তখন ছিলেন শিরহিন্দ-এ। মামুদ বহলুলের জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা বায়াজিদকে পরাজিত করেন। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র বহলুল দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। দিল্লির সন্নিকটে নারেলা নামক স্থানে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়। জৌনপুরের সৈন্যাধ্যক্ষ দারিয়া খাঁ লোদীকে বশীভূত করে বহলুল মামুদ শার্কীর বাহিনীর মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে দেন এবং বিভ্রান্ত শার্কীকে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেন। মামুদ শার্কীর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র ও পৌত্রের আমলেও দিল্লির সাথে জৌনপুরের বিরোধ ও সংঘাত অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত হুসেন শাহ শার্কীকে বিতাড়িত করে বহলুল জৌনপুর দখল করতে সক্ষম হন (১৪৮৬ খ্রিঃ)। জৌনপুরের শাসক হন বহলুলের পুত্র বরবক। বস্তুত, রাজনৈতিক প্রতিপত্তির বিচারে জৌনপুর দিল্লি থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বভাবতই এই রাজ্য দখল করার ফলে দিল্লির প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। কালপি, ঢোলপুর, গোয়ালিয়র-সহ বহু অঞ্চল দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করে। গোয়ালিয়র অভিযানের পরে বহলুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছুদিনের মধ্যে মারা যান (১৪৮৯ খ্রিঃ)।

সাম্রাজ্যের সংগঠক ও সমরনায়ক হিসেবে বহলুল লোদী দক্ষতার পরিচয় দেন। দিল্লিতে লোদীবংশের শাসনপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে দৃঢ়ভিত্তি দেবার জন্যও তিনি উদ্যেগী হন। জৌনপুর, গোয়ালিয়র-সহ বহু অঞ্চলকে দিল্লির আনুগত্যাধীনে স্থাপন করে দিল্লির কর্তৃত্ব পানিপথ থেকে বিহার সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন। বাস্তববাদী বহলুল অবশ্য দক্ষিণ ভারত, বাংলাদেশ বা মালব, রাজস্থান প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর আধিপত্য স্থাপনের প্রয়াস নেননি। কারণ সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সে কাজে সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। বেসামরিক প্রশাসনের উন্নয়নেও তিনি মন দিতে পারেননি। কারণ সামরিক কাজেই তাঁর অধিকাংশ উদ্যম ব্যয়িত হয়েছিল। তথাপি ফিরোজ তুঘলক ও সৈয়দবংশীয় আলাউদ্দিন আলম শাহের মধ্যবর্তীকালীন সুলতানদের মধ্যে বহলুলই ছিলেন সর্বাধিক সফল। ড. শ্রীবাস্তবের ভাষায় : “both as a military leader and as an administrator he was superior to his immediate predecessors, from the death of Firuz to that of Alauddin Alam Shah. “

আফগান সর্দারদের সাথে বহলুল বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন। জাতি-বৈশিষ্ট্য হিসেবে আফগানগণ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত। একজন আফগান হিসেবে বহলুল লোদী সেই জাতিগত বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। অভিজাতদের গৃহে উপস্থিত হয়ে একাসনে বসে আহার করা বা ক্ষুব্ধ অভিজাতকে সন্তুষ্ট করার জন্য সনম্র জবাবদিহি করাকে তিনি কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেন। অনেকের মতে, বহলুল লোদীর এই তোষণনীতি সুলতানি এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে দুর্বল করেছিল। তিনি সুলতানের মর্যাদাকে ‘সমকক্ষদের নেতা’ (chief among equals) এই পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন। অভিজাতদের এই সমমর্যাদাবোধ সম্ভবত পরবর্তীকালে সুলতানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে প্ররোচিত করেছিল। এই অভিযোগ নীতিগত দিক থেকে সত্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। বহলুল বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই তোষণ নীতি অনুসরণ করেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলও হন। ড. ইক্তিদার হুসেন সিদ্দিকি লিখেছেন : “Bahlul himself believed in a despotic monarchy like the Turks but he had to compromise his principle with the independent tribal institutes of the Afgan nobels.”

ধর্মনিরপেক্ষতা এবং উদারতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপ্রাণ এই মুসলিম শাসক হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী প্রজাদের প্রতি যথেষ্ট উদারতা দেখান। বহু হিন্দু সামন্ত যেমন— রাজা করণ, রাজা প্রতাপ, রাজা ভির সিং, রাজা ত্রিলোকচাঁদ প্রমুখ সুলতানের সেবায় আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর মধ্যে মানবিক গুণেরও অভাব ছিল না। দরিদ্র ও অসহায়ের প্রতি তিনি ছিলেন দয়াবান ও সহানুভূতিশীল। বহলুলের প্রশংসা করে এ. বি. পাণ্ডে যথার্থই লিখেছেনঃ “…a man of human spirit and wanted to promote public welfare by ensuring law and order, administering justice and refraining from burdening his people with insupportable taxes.”

সিকন্দর লোদী (১৪৮৯-১৫১৭ খ্রি:) :

বহলুল লোদী তাঁর পুত্র নিজাম খাঁকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত সমস্ত আমির ও মালিকদের মনঃপূত ছিল না। কয়েকজন অভিজাত ও আত্মীয় ক্ষুব্ধ হয়ে নিজামের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হন। এই সময় বহলুলের দ্বিতীয় পুত্র বরবক শাহ এবং পরলোকগত খাজা বায়াজিদের পুত্র আজম হুমায়ুনকে দিল্লির সিংহাসনে বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত সিকন্দর শাহ প্রভাবশালী পাঠান সর্দারদের স্বপক্ষে এনে নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। নিজাম খাঁ ‘সিকন্দর শাহ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। প্রথমেই তিনি বিদ্রোহী অভিজাত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়দের দমন করার উদ্যোগ নেন। একে একে পিতৃব্য আলম খাঁ, ভ্রাতুষ্পুত্র আজম হুমায়ুন এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বরবক শাহকে সুলতানের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। আত্মীয়দের আনুগত্যের বিনিময়ে সিকন্দর তাদের প্রতি যথেষ্ট উদার ও সহনশীল আচরণ করেন। প্রভাবশালী জায়গিরদার ও জমিদারদের দমন করার জন্য তিনি দ্বিমুখী ব্যবস্থা নেন—–(১) সমস্ত জায়গিরের হিসেবপত্র কঠোরভাবে পরীক্ষার নির্দেশ দেন এবং (২) দক্ষ গুপ্তচরবাহিনীর মাধ্যমে তাদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার ব্যবস্থা করেন।

বলা বাহুল্য, সুলতানের কাজে অসন্তুষ্ট জায়িগরদাররা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হন। সিকন্দর সঙ্গে সঙ্গে কঠোর হাতে তাদের দমন করেন। বিহার ও ত্রিহুতে বিদ্রোহী জায়গিরদারদের সুলতান সামরিক অভিযানে পাঠান। বিহারকে তিনি সুলতানির অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং দরিয়া খাঁকে বিহারের শাসক নিযুক্ত করেন। ত্রিহৃত বিনাযুদ্ধে দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করে কর প্রদানে রাজি হয়। বিহার দিল্লির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সাথে দিল্লির সংঘাত সম্ভাবনা প্রবল হয়। বিচক্ষণ সিকন্দর বাংলার সুলতানের সাথে এক অনাক্রমণ-চুক্তি স্বাক্ষর করে সীমান্তে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করেন। রাজপুত রাজ্যগুলিকেও তিনি দমন করেন। ধোলপুর, নারওয়ার, মাদ্রাইল, নাগাউর প্রভৃতি অঞ্চল তিনি জয় করেন। গোয়ালিয়রের শাসককেও সিকন্দর শাহ পরাজিত করেন, তবে বার্ষিক করপ্রদানের শর্তে ওই রাজ্য গ্রাস করা থেকে বিরত থাকেন।

সমসাময়িক ও আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মোটামুটি একমত যে, লোদীবংশীয় সুলতানদের মধ্যে সিকন্দর ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। মধ্যযুগীয় শাসকদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গুণাবলির অধিকাংশই তাঁর চরিত্রে ছিল। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন দৃঢ়মনা ও কঠোর। মানবিক গুণাবলিরও অভাব ছিল না। অসহায় ও জ্ঞানীগুণীদের প্রতি তাঁর করুণা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল যথেষ্ট। স্যার উলসী হেগ্‌ লিখেছেনঃ “তিন লোদীবংশীয় নৃপতির মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম, যিনি পিতার অসমাপ্ত কাজ সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছিলেন।” সিকন্দরের অন্যতম কৃতিত্ব হল যে, তিনি ক্ষমতালোভী ও স্বার্থান্ধ আফগান অভিজাতদের করুণা থেকে সুলতানির কর্তৃত্বকে উদ্ধার করে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বহলুলের আপসনীতি সিকন্দর বর্জন করেন এবং এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেন যে, “সুলতানই সমস্ত কর্তৃত্বের আধার”। দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। বাণিজ্যশুষ্ক রহিত করে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেন। মূল্যমান নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজেও তিনি সজাগ ছিলেন। দরিদ্র ও অনাথদের প্রতি তাঁর গভীর করুণা ছিল। প্রতিবছর তিনি দরিদ্র ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তাদের অন্তত ছয় মাসের রেশন দেবার ব্যবস্থা করেন। কথিত আছে, তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং কয়েকটি ফারসি কবিতা রচনা করেছিলেন।

শাসক ও মানুষ হিসেবে তাঁর প্রশংসা করে ড. এস. লাল লিখেছেন : “Sikander Shah had ruled for twenty nine years full of glory and distinction. He was the greatest ruler of the Lodi dynasty and outshone both his father Bahlol and his son Ibrahim.” মানবিক গুণাবলি তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আচ্ছন্ন করেছে। যেমন— বরবক শাহের অপদার্থতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে অবহিত হয়েও তিনি ভ্রাতার বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যোদ্ধা হিসেবেও তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়।

ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও অনুদার নীতি সিকন্দর শাহের চরিত্রে কিছুটা কালো দাগ লেপন করেছে। সমকালীন লেখক নিজামউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন যে, সিকন্দর লোদীর ধর্মীয় গোঁড়ামি অন্ধত্বের শেষ পর্যায়কেও অতিক্রম করেছিল। নগরকোটের ‘জাভালামুখি’ মন্দির ধ্বংস করে দেবমূর্তিগুলিকে তিনি টুকরো টুকরো করে কসাইখানায় বাটখারা হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দেন। হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর ও তীর্থ কর আরোপ করেন। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্যও চাপ দেন। সাধারণভাবে তাঁর এই সংকীর্ণতা হিন্দুপ্রধান ভারতবর্ষের রাজনীতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। অবশ্য ড. কে. এস. লাল ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, পঞ্চদশ শতকের ভক্তিবাদী আন্দোলন তথা কবীর ও শ্রীচৈতন্য প্রমুখের উদারতাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে সিকন্দর লোদীর ধর্মনীতি অসহনীয় ও সংকীর্ণ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু চতুর্দশ শতকে এহেন ধর্মীয় আচরণ স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হত। ড. লালের বিশ্লেষণে আবেগপ্রবণতার আধিক্য লক্ষণীয়। পঞ্চদশ শতকের মরমিয়া ভক্তি-সাধকদের উদারতাবাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ব্যর্থতার দায় সিকন্দর শাহ কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না।

উল্লিখিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘সিকন্দর শাহকে লোদীবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি’ বলে অধিকাংশ পণ্ডিত স্বীকার করেছেন। আফগান সর্দারদের গোষ্ঠীপ্রাধান্যের দাপট থেকে তিনি সুলতানি শাসনকে মুক্ত করেন। সাম্রাজ্যের সংহতি ও প্রসারের কাজে সাফল্য দেখান। উলেমাতন্ত্রের নির্দেশে চালিত না হয়ে তিনিই উলেমাদের পরিচালনা করতে সক্ষম হন। জনহিতকর কাজেও তিনি কিছু কিছু সাফল্য দেখান। তাই ড. পাওে (A. B. Pandey) যথার্থই লিখেছেন : “With all his faults and failings, Sikandar was undoubtedly the greatest ruler of Lodi dynasty.”

ইব্রাহিম লোদী (১৫১৭-‘২৬ খ্রি:) :

সিকন্দরের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ্যপুত্র ইব্রাহিম লোদী সিংহাসনে বসেন। এই সময় অভিজাতদের একাংশ সুলতানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জালাল খাঁ’কে জৌনপুরে স্বাধীন শাসকরূপে ঘোষণা করে সুলতানিকে দু-ভাগে ভাগ করার উদ্যোগ নেন। এই প্রচেষ্টার ভয়ংকর পরিণতি ইব্রাহিমের অজানা ছিল না। তাই জালাল খাঁ’র ক্ষমতাবৃদ্ধির আগেই তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন এবং দিল্লিতে ডেকে পাঠান। কিন্তু জালাল খাঁ সুলতানের আদেশ অমান্য করলে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। ইব্রাহিমের বাহিনী দ্বারা তাড়িত হয়ে জালাল জৌনপুর ছেড়ে কালপি, আগ্রা, গোয়ালিয়র, মালব হয়ে গোল্ডপ্রদেশে উপস্থিত হন। গোগুরা বিশ্বাসঘাতকতা করে জালালকে সুলতানের হাতে তুলে দেয়। ইব্রাহিম তাঁকে হত্যা করে বিপন্মুক্ত হন।

বিদ্রোহী জালালকে আশ্রয় দেবার অপরাধে ইব্রাহিম গোয়ালিয়র রাজ্য আক্রমণ করে রাজা বিক্রমজিৎকে পরাজিত করেন ও দিল্লির বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। টড (Tod)-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, রাজপুত শৌর্যের প্রতীক মেবার রাজ্যকেও দখল করার চেষ্টা ইব্রাহিম করেছিলেন। এই সূত্রে রানা সংগ্রাম সিংহের (বা রানা সংঘ) সাথে ইব্রাহিম লোদীর একাধিক সংঘর্ষ হয়। রানা বীরত্বের সাথে সুলতানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। এই যুদ্ধে রানার একটি পা ও বাম হাত নষ্ট হয়ে যায়। তথাপি তিনি সাহসিকতার সাথে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত নিজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখেন। অবশ্য কেউ কেউ এই যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এঁদের মতে, এত বড়ো একটা ঘটনা সত্য হলে, বদাউনি বা ফেরিস্তা অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু তাঁদের লেখায় এই বিবরণী অনুপস্থিত।

সামরিক নেতা হিসেবে ইব্রাহিম লোদী মোটামুটি কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও সাম্রাজ্যের সংগঠক ও কূটনীতিক হিসেবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সিংহাসনে বসেই তিনি সুলতানের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। অভিজাতরা যে মর্যাদা ও ক্ষমতা ভোগ করত, তা তিনি সংকুচিত করার উদ্যোগ নেন। দরবারে আফগান সর্দারদের আচার-আচরণ সম্পর্কে কিছু কঠোর নিয়মাবলি চালু করেন। সুলতানের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ ছিল; কিন্তু তা আদৌ যুগোপযোগী ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে ইব্রাহিম ছিলেন হঠকারী ও বদমেজাজী। আফগান অভিজাতদের কাছ থেকে তুর্কি অভিজাতদের সম-আনুগত্য আশা করেছিলেন। তিনি ভুলে যান যে, আফগানদের জীবনধারা অনুযায়ী অভিজাতরা রাজাকে একজন নেতৃস্থানীয় সহকর্মী বলেই গণ্য করত। তাদের জাতিতত্ত্ব অনুসারে রাজা সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন না। অথচ সুলতান ইব্রাহিম অতি দ্রুত এবং অত্যন্ত রূঢ়তার সাথে আফগান সর্দারদের ওপর সুলতানের সর্বময় কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। প্রকাশ্য দরবারে আফগান-অভিজাতদের সহবৎ প্রসঙ্গেও তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও তিরস্কার করেন। সুলতানের ব্যবহারে আফগান সর্দাররা ক্ষুব্ধ হন এবং সুলতানের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হন। তাঁর পিতা সিকন্দর লোদীও আফগান অভিজাতদের স্বাধীনতাস্পৃহা কমাতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন খুব ধীরে এবং সাবধানতার সাথে।

ইব্রাহিম অকারণে আজম হুমায়ুন শেরওয়ানীকে কারারুদ্ধ করেন। অথচ জালাল খাঁ’র বিদ্রোহদমনে শেরওয়ানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সুলতানের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন শেরওয়ানীর পুত্র ইসলাম খাঁ। কারাপ্রদেশে তিনি বিক্ষুব্ধ আফগানদের সংগঠিত করেন। ইব্রাহিম শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের দমন করেন এবং ইসলাম খাঁকে হত্যা করেন। মিঞা ভূওয়া এবং হুমায়ুন শেরওয়ানীকেও কারাগারে হত্যা করা হয়। সুলতানের নির্দেশে প্রবীণ হুসেন ফরমুলীকে হত্যা করা হয়। হঠকারী আচরণে অন্যান্য অভিজাতরা ভীত না হয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে লোদী ও ফরমুলী আমিররা নিজ নিজ নিরাপত্তার কারণে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। দরিয়া খাঁ’র পুত্র বাহার খাঁ লোহানী বিহারে নিজেকে ‘স্বাধীন সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। ফৎ খাঁ, শের খাঁ (পরবর্তীকালে শের শাহ) প্রমুখ অনেকেই বাহার খাঁ’র পক্ষে যোগ দেন।

পূর্ব ভারতের অভিজাতদের সাথে ইব্রাহিমের সংঘাত পশ্চিম প্রান্তেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তখন পাঞ্জাবের গভর্নর ছিলেন দৌলত খাঁ লোদী। কার্যত তিনি স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতেন। দৌলতের পুত্র দিলওয়ার খাঁ দিল্লিতে গিয়ে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন সুলতান কী নির্মম আচরণ করেন বন্দি অভিজাত ও তাদের পরিবারের সাথে। স্বভাবতই দৌলত খাঁ ইব্রাহিমের হাত থেকে স্থায়িভাবে মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। ঠিক তখনই তৈমুরের বংশধর রাজ্যচ্যুত জহিরুদ্দিন বাবর কাবুলের অনিশ্চিত আশ্রয় থেকে হিন্দুস্তানের সমৃদ্ধ ও সহজ ভূমিতে অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন। দৌলত খাঁ বাবরকে দিয়ে ইব্রাহিমকে জব্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এ কাজে তিনি সিংহাসনের আর এক দাবিদার আলম খাঁ (ইব্রাহিমের কাকা) -এর মদত পান। বিচক্ষণ বাবর সানন্দে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। পানিপথের প্রান্তরে মুঘল-বাহিনীর সাথে ইব্রাহিম লোদীর চূড়ান্ত সংঘর্ষ হয়। অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ সুলতানি-বাহিনী শক্তিশালী মুঘলদের হাতে বিধ্বস্ত হয় (১৫২৬ খ্রিঃ)। পানিপথের প্রান্তরে সূচিত হয় ভারত-ইতিহাসের এক নবতম অধ্যায়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment