আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর: মহাযানবাদের উদ্ভব” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর: মহাযানবাদের উদ্ভব
গৌতম বুদ্ধের দেহাবসানের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে মতভেদ দানা বাঁধতে থাকে। আদর্শগত মতভেদ দূর করা এবং সর্বজনীন আচরণবিধি তৈরি করার লক্ষ্যে চারটি বৌদ্ধ সঙ্গীতি (মহাসম্মেলন) আহ্বান করা হয়েছিল। বুদ্ধ পরবর্তী বৌদ্ধধর্মের রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই মহাসঙ্গীতিগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধের পরিনির্বাণের অল্পকাল পরে মগধের রাজা অজাতশত্রুর উদ্যোগে রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ)। বুদ্ধের বিশিষ্ট শিষ্য মহাকাশ্যপ বুদ্ধের বাণীসমূহ সংকলন করার উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। মহাকাশ্যপ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দ ও উপালি এখানে যথাক্রমে ‘ধর্ম ও ‘বিনয়’ বিষয়ে বুদ্ধের বাণীগুলি আবৃতি করেন। এইভাবে ‘সুওপিটক’ ও ‘বিনয়পিটক’ সংকলন শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ এই ঘটনা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেও প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির ঐতিহাসিকতা বিষয়ে সংশয়ের কারণ নেই।
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতির পরবর্তী একশতক বৌদ্ধ সংঘে কোনও বিরোধ প্রকট হয়নি। ভিক্ষুদের মধ্যে ছোটখাটো মতভেদ থাকলেও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পর মগধের রাজা কালাশোকের আমলে বৈশালীতে ‘দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি’ আহ্বান করা হয়েছিল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৬ অব্দ)। এই অধিবেশনে পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী (ভিক্ষু) দের মধ্যে মতভেদ প্রকট হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলীয় ভিক্ষুরা বাস করতেন মূলত বৈশালী ও পাটলিপুত্রে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয়দের বাসস্থান ছিল কৌশাম্বী ও অবন্তী অঞ্চলে। এঁদের মতভেদের কারণ ছিল মূলত বিনয় বা ভিক্ষুদের বিহার জীবনে পালনীয় দশটি নিয়ম সম্পর্কে। পূর্বাঞ্চলীয় ভিক্ষুরা দশটি নিয়ম মানতেন, যা গোঁড়ামি মুক্ত। যেমন, লবণ সঞ্চয় করে রাখা, সূর্যাস্তের পর আহার গ্রহণ করা, মূল্যবান ধাতু (সোনা, রূপা) গ্রহণ করা ইত্যাদি। পশ্চিমাঞ্চলীয়রা এই সকল কাজকে আদর্শ বিরোধী মনে করতেন। পূর্বাঞ্চলীয়রা ‘মহাসঙ্ঘিক’ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয়রা ‘স্থবিরবাদী’ নামে পরিচিত হন। এইভাবে বৌদ্ধসংঘে ভাঙনের সূচনা হয়েছিল, যা ক্রমে আরো ছোট ছোট অংশে ভেঙে পড়েছিল। স্থবিরবাদীরা পালি ভাষায় ‘থেরবাদী’ নামে অভিহিত হতেন। পরবর্তী সময়ে থেরবাদীরা এগারোটি সম্প্রদায়ে এবং মহাসংঘিকরা সাতটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছিলেন। এরা ছিলেন হীনযানপন্থী। এই আঠারোটি সম্প্রদায়ই বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বকে মান্যতা দিতেন। এই হীনযানীদের প্রাধান্য ছিল ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), শ্রীলঙ্কা (সিংহল) ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে।
থেরবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ‘সর্বাস্তিবাদ’। তিব্বতী ঐতিহ্য মতে এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাহুল ভদ্র। সর্বাস্তিবাদীদের মূলকথা ‘সর্বমঅস্তি’, শুধু বর্তমান নয়, অতীত ও ভবিষ্যতেরও অস্তিত্ব নিশ্চিত বলেই এঁরা বিশ্বাস করতেন। সম্রাট কনিষ্ক এই মতের সমর্থক ছিলেন। বৌদ্ধ সংঘের দ্বিতীয় অধিবেশনেই ‘মহাসঙ্ঘিক’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। ঐতিহ্য অনুসারে এর প্রতিষ্ঠাতা মহাকাশ্যপ। তত্ত্বগতভাবে থেরবাদীদের থেকে মহাসঙ্ঘিকদের তিনটি বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। যেমন (১) তাঁরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসান, (২) বুদ্ধ লোকত্তর একটি চরিত্র। অর্থাৎ বুদ্ধরূপে যিনি পরিচিত তিনি প্রকৃত বা আদি বুদ্ধ নন এবং (৩) তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, ‘অর্হৎ’ (যোগ্য) হওয়া জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ অর্হৎ অর্জন করতে পারলে জীবনচক্র থেকে মুক্তি আসে এবং ‘নির্বাণ’ লাভ করা যায়। ‘মহাসঘিক দের শাখাগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পূর্বশৈল, অপর শৈল, উত্তর শৈল, চৈত্যক ইত্যাদি। নাগার্জুনিকোণ্ড ও অমরাবতী লেখ থেকে এদের কথা জানা যায়। বুদ্ধত্ব এবং অর্হৎদের সম্পর্কে এই শাখাগুলি মহাসঙ্ঘিকদের অনুরূপ বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন। তবে দুটি দর্শনতত্ত্বে এঁরা মহাসঙ্ঘিকদের তুলনায় অগ্রণী ছিলেন। এঁরা বুদ্ধের মতই বোধিসত্ত্বদেরও লোকোত্তর মনে করতেন। এছাড়া এঁদের কাছে মনের পবিত্রতা হল একটি সহজাত বৃত্তি। কেবল অপবিত্র বস্তুর সংস্পর্শে এলে মন অপবিত্র হতে পারে।
এমন বহুত্ববাদী আদর্শের অবসান করে বৌদ্ধদর্শনকে সঠিক পথে চালনার উদ্দেশ্যে মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে পাটলিপুত্র নগরীতে ‘তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি’ আহ্বান করা হয় (আনুঃ খ্রিষ্টপূর্ব ২৫১ অব্দ)। সম্ভবত এখানে কেবল থেরবাদীদের আহ্বান করা হয়েছিল। থেরবাদ-বিরোধী সকল মতামত এখানে অগ্রাহ্য করা হয়। তবে এই অধিবেশনের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে। কারণ সম্রাট অশোকের কোন লেখতে এর উল্লেখ নেই। সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্য বা চৈনিক পর্যটকদের বিবরণেও এই সমাবেশের উল্লেখ নেই।
মহাযানবাদ :
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের আগে বৌদ্ধসংঘে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলেও, তাদের অন্তর্বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেনি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা একই বিহারে বাস করতেন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে ‘মহাযানবাদ’ দর্শনের উদ্ভব ঘটলে বৌদ্ধধর্মের দর্শনতত্ত্বে লম্বালম্বি ফাটলের সৃষ্টি হয়। হীনযান দর্শনে গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত ধর্মভাবনার কিছুটা হলেও বজায় ছিল, কিন্তু মহাযানবাদে তা প্রায় মুছে যায়। ঐতিহ্য অনুসারে প্রথম কনিষ্কের আমলে কাশ্মীরে চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতির আয়োজন করা হয়েছিল (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক)। বিশিষ্ট বৌদ্ধপণ্ডিত বসুমিত্র এই অধিবেশনে পৌরহিত্য করেন। এই অধিবেশনে ধর্ম বিষয়ক আলোচনাগুলি ‘বিভাষা শাস্ত্র’ নামে সংকলিত হয়েছিল। গুপ্তযুগের লেখক পরমার্থ-এর বিবরণ অনুসারে, এই অধিবেশনের প্রধান পরিচালক ছিলেন সর্বাস্তিবাদী লেখক কাত্যায়নীপুত্র। লামা তারানাথের মতে, থেরবাদী ও সর্বাস্তিবাদীভুক্ত আঠারোটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যাকেই এই অধিবেশনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
সাহিত্যগত প্রমাণের ভিত্তিতে মনে করা হয় যে, মহাযানবাদের উদ্ভব ঘটেছে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের দর্শনের উল্লেখ সমন্বিত প্রাচীনতম পুঁথিটি হল ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। এতে ‘জাগতিক বস্তুর অনস্তিত্ব’ (ধর্মশূন্যতা), ‘আত্মার অনস্তিত্ব’ (পুদ্গলশূন্যতা) এবং অসংখ্য বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের উল্লেখ আছে। এগুলি মহাযানবাদের মূল বৈশিষ্ট্য। এই পুঁথির চৈনিক অনুবাদ করেছিলেন লোকরক্ষ ১৪৮ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে, মূল পুঁথিটি আরও আগে লেখা হয়েছিল। মহাযানবাদী দর্শনের অন্যতম ব্যাখ্যাকার নাগার্জুন খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের মানুষ ছিলেন। লেখমালা সূত্রেও মহাযানবাদের আবির্ভাব প্রথম শতক বলে জানা যায়।
মহাযান মতবাদের ধারণা বুদ্ধের মূল উপদেশগুলির মধ্যেই যুগ্মভাবে নিহিত ছিল। তিনি নির্বাণ বা মুক্তিলাভের তিনটি পথের কথা বলেছিলেন—১. ‘অহ্যান’ বা ব্যক্তিগত মুক্তিলাভের চেষ্টা, ২. ‘প্রত্যেক বুদ্ধযান’ বা ব্যক্তিগত মুক্তিলাভের চেষ্টার পাশাপাশি অপরের মুক্তির চেষ্টা করা, ৩. ‘বুদ্ধযান’ অর্থাৎ নিজের মুক্তির সংকীর্ণ চিন্তা মুক্ত হয়ে অপরের মুক্তির জন্য প্রয়াসী হওয়া। এক্ষেত্রে প্রথম দুটি পথ হীনযানীরা গ্রহণ ও অনুসরণ করতেন। অন্যদিকে মহাযানবাদীরা কেবল তৃতীয় পথটিকে গুরুত্ব দিতেন। হীনযানী মহাসংঘিকদের সাথে মহাযানবাদীদের বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু মিল দেখা যায়। মহাসংঘিকরা স্থবিরবাদীদের অধিকাংশ তত্ত্ব যেমন চতুরার্ফমত, অষ্টাঙ্গিকমার্গ, প্রতীত্য সমুৎপাদ ইত্যাদি মেনে নিলেও, বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের লোকত্তর সত্ত্বা বলে মনে করতেন। এই শেষ তত্ত্বটি মহাযানবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মহাযানবাদের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বুদ্ধকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা, শূন্যবাদ ও বোধিসত্ত্ববাদ। মহাযানীদের মতে, বুদ্ধ কোন সাধারণ মানুষ নন। তাঁকে প্রথমে লোকত্তর পরে দেবতা এবং সবশেষে সর্বোচ্চ দেবতার আসন দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধ অনত্ত, সৃষ্টি ও লয়বিহীন, পরমসত্য, সমস্ত বর্ণনার অতীত। বুদ্ধের তিনটি কায় (ত্রিকায়) ধর্মকায়, সম্ভোগকায় এবং নির্মাণকায়। বুদ্ধের নিরাকার, অনন্ত, বিশ্বচরাচরব্যাপী আসল দেহ বা রূপটি হল ধর্মকায়। তবে উচ্চমার্গের বৌদ্ধসাধকদের প্রয়োজনে বুদ্ধ মাঝে মধ্যে দেবতার আকারে মহাপুরুষের চিহ্নসহ দেখা দেন। অতি উচ্চমার্গের সাধকরা এই রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। এটি হল তাঁর সম্ভোগকায়। আবার সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য বুদ্ধ মাঝে মাঝে মানব রূপ ধারণ করে লৌকিক জগতে আবির্ভূত হন। এটি বুদ্ধের ‘নির্মাণকায়। এই পর্যায়ে বুদ্ধ জন্ম-মৃত্যুর আধীন। মানবহিতার্থে বুদ্ধ যুগে যুগে আবির্ভূত হতে পারেন। যেমন গৌতম বুদ্ধ আমাদের এই জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অর্থাৎ বুদ্ধ জন্মেছেন, জন্মাচ্ছেন এবং জন্মাবেন। এইভাবে অসংখ্য বুদ্ধের কল্পনা ভিত্তি পেয়েছে।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বোধিসত্ত্বের কল্পনা। তত্ত্বগতভাবে প্রত্যেক মহাযানী-ই বোধিসত্ত্ব হতে পারেন। গভীর সাধনার মধ্য দিয়ে বোধিচিত্তের বিকাশ দ্বারা ব্যক্তি বোধিসত্ত্ব রূপের অধিকারী হতে পারেন। তবে তিনি কেবল নিজের ‘মোক্ষ’ বা নির্বাণ-এর চিন্তা না করে, সকল মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়াসী হবেন। যতক্ষণ সকল মানুষের মুক্তি আসন্ন না হচ্ছে, ততক্ষণ বোধিসত্ত্ব নিজের মুক্তির জন্য প্রয়াসী হবেন না। জনহিতে বোধিসত্ত্বের এক সাধনা ও ত্যাগ বোধিসত্ত্বের ধারণাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিয়েছে। কালক্রমে বোধিসত্ত্বকেও দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। এই সকল দেব-বোধিসত্ত্বের আরাধনা করলে প্রার্থিত ফল পাওয়া সম্ভব। এই ধরনের আরাধ্য বোধিসত্ত্বদের অগ্রগণ্য হলেন অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, বজ্রপানি, আকাশগর্ভ, মৈত্রেয় প্রমুখ। অবলোকিতেশ্বর করুণার প্রতিমূর্তি। তাঁর সঙ্গিনী তারা প্রজ্ঞার আধার যিনি মানুষকে দুঃখ জয় করতে সাহায্য করেন। মঞ্জুশ্রী জ্ঞানের দেবতা ও চিরনবীন। তিনি মানুষকে ধর্মশিক্ষা দেন। ইতি ভাবীবুদ্ধ মৈত্রেয়র শিক্ষক। মহাযান মতে বলা হয় যে, দশটি সদগুণ বা ‘পারমিতা’ (দান, শীল, কান্তি, বীর্য, ধ্যান, প্রজ্ঞা, উপায় কৌশল্যা, প্রনিধান, বল ও জ্ঞান) অর্জন করে প্রতিটি মানুষের উচিত বোধিসত্ত্ব হওয়ায় আকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত। এ. এল. ব্যাসাম-এর মতে, বোধিসত্ত্বের ধারণার সাথে খ্রিষ্টধর্মের দুঃখ ব্রতী ত্রাণকর্তা যিশুর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে পারস্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রীক, শক, কুষাণ শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে পশ্চিমের সাথে ভারতের যোগ স্থাপিত হয় এবং পারস্য ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাবধারা ভারতে প্রবেশ করে। তাই খ্রিষ্টীয় আদর্শ দ্বারা বোধিসত্ত্ব কল্পনায় প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা অসম্ভব বা অবাস্তব নাও হতে পারে। মহাযানবাদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল শূন্যবাদ। বুদ্ধের বাণীর কেন্দ্রে ছিল দুঃখবাদ। মহাযান বৌদ্ধধর্মে সেই দুঃখকে অস্বীকার করা হয়েছে। জগতের ঐতিহ্য মহাযানবাদে অস্বীকৃত। এই জগতের অস্তিত্বশূন্যতার বোধ সক্রিয় হলেই প্রমাণিত হবে যে, দুঃখের অস্তিত্ব নেই। এই অনস্তিত্ববোধ বা শূন্যতার ধারণাই হল নির্বাণ বা মুক্তি। শূন্যতার শাশ্বত রূপ উপলব্ধ হলে জন্ম-মৃত্যু পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি ঘটবে।
বস্তুত বৌদ্ধধর্মে দু’ধরনের এবং প্রায় বিপরীত চিন্তাধারার সংমিশ্রণ দেখা যায়। একটি হল ভাববাদী চেতনা এবং অন্যটি লৌকিক চাহিদা। ভাববাদী বৈশিষ্ট্য খুবই উচ্চমার্গের যেখানে বস্তুজগৎ মিথ্যা। জগৎ নিজেই অস্তিত্বশূন্য। অন্যদিকে লৌকিক চেতনার কেন্দ্রে আছে সাধারণ মানুষের চাহিদা এবং তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ইচ্ছা। গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ভাবনায় গৃহী মানুষদের কার্যত কোনও স্থান ছিল না। বুদ্ধের বাণীর সারকথা হল জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে সংঘের সাথে যুক্ত থেকে ধর্মাচার করা। বৌদ্ধধর্ম মূলত সংসারত্যাগীদের ধর্ম। তাই বুদ্ধের সমালোচকদের অভিযোগ ছিল যে, শ্রমণ গৌতম পত্নীদের পতিহারা, মাতাকে সন্তানহারা করেছেন। তাঁর অনুগামীরা নিজ নিজ গৃহকে নিরানন্দ করে তুলেছেন। সাধারণ গৃহী মানুষ বড়জোর ‘ত্রিশরণ’ নিয়ে (বুদ্ধং শরনম্ গচ্ছামি, সংঘং শরনম্ গচ্ছামি, ধর্ম শরনম্ গচ্ছমি’ উচ্চারণ করা) আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন। বুদ্ধের ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ অনুসরণ করাও সাধারণ গৃহী মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই মহাযানীরা ‘পারমিতা’ নামক দশটি আদর্শ উপস্থাপন করে সাধারণ গৃহী মানুষকে বুদ্ধত্ব লাভের সম্ভাবনার সুযোগ এনে দেন। ইতিমধ্যে বৈষুব, শৈব ইত্যাদি ধর্ম সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এগুলিতে ভক্তি ও পুজাপাঠের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। তাই মহাযানীরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে পূজাপাঠের ব্যবস্থা করে দেন। বলা বাহুল্য এই দুটি বিরোধী আদর্শের সমন্বয় চূড়ান্ত পরিণামে বৌদ্ধধর্মের পক্ষে শুভ হয়নি। ভাববাদী উপাদানের সাথে লৌকিক উপাদানের সমন্বয়ের চেষ্টাকে ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন ‘তেলের সাথে জলের মিশ্রণের’ চেষ্টা মাত্র। পরবর্তীকালে ভাববাদী ধ্যানধারণা দুর্বল হয়ে গেলে, লৌকিক আদর্শ তার শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। উপরন্তু লৌকিক ভাবনাগুলি প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের অনুসঙ্গ হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছিল।
মহাযানবাদের সাথে হীনযানের তুলনামূলক আলোচনা করলে উভয় মতাদর্শের পার্থক্য যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি হীনযানী আদর্শের তুলনায় মহাযানবাদের উদারতার স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। প্রথমত, হীনযান ধর্মতত্ত্বে কেবল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের স্থান ছিল। জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে বৌদ্ধ সংঘের আশ্রয়ে থেকে হীনযান ধর্মাচরণ করা যেত। কিন্তু মহাযানবাদ বৌদ্ধধর্মকে জনমুখী করে। এখানে গৃহী ভক্তদের পালন যোগ্য ধর্মাচার নির্দিষ্ট করা হয়। তাই তুলনামূলক বিচারে মহাযানবাদের আবেদন ছিল ব্যাপক ও প্রসারিত। দ্বিতীয়ত, হীনযান মূলত আত্মকেন্দ্রিক। এই মতবাদ অনুসারে প্রত্যেককে তার নিজ চেষ্টায় মুক্তি অর্জন করতে হবে, অর্থাৎ ‘আত্মদীপ’ হতে হবে। অন্যের সাহায্যে একজনের মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। কিন্তু মহাযানবাদে সেই সুযোগ ছিল। এই মতানুসারে একজন সাধক নিজ মুক্তির পাশাপাশি অন্যের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে পারেন। অর্থাৎ মহাযান মতে, একজনের পূণ্যের ফল অন্যজন ভোগ করতে সক্ষম। মহাযানীদের লক্ষ্য ব্যক্তির মুক্তি নয়, গণমুক্তি। তাই একে মহৎ + যান বা মহাযান বলা হয়। তৃতীয়ত, বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি দুঃখবাদ। হীনযানীরাও দুঃখবাদ নিরসনের মাধ্যমে নির্বাণের পথ অনুসন্ধান করেন। কিন্তু মহাযানবাদে সেই দুঃখকে অস্বীকার করা হয়েছে। মহাযানবাদে জগতের অস্তিত্বই শূন্য। তাই দুঃখেরও কোন অস্তিত্ব নেই। চতুর্থত, হীনযান বৌদ্ধধর্মে অর্হৎ-এর ধারণা আছে। অর্হৎ হলেন আদর্শ মানুষ, জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত সাধক। ‘অর্হৎ’ (যোগ্য হওয়া) লাভের জন্য ব্যক্তি একান্তভাবে নিজের ইচ্ছায় অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করে নিজের মুক্তির পথ অনুসন্ধান করবেন। অর্হৎ-এর সাধনা একান্তই ব্যক্তিগত। মহাযানবাদে এই অর্হৎ তত্ত্ব প্রত্যাঘ্যাত হয়েছে। মহাযানবাদে আছে বোধিসত্ত্বের তত্ত্ব। এই বোধিসত্ত্ব গৃহী বা সন্ন্যাসী বা দেবতা হতে পারেন। এঁদের কাজ হল মানুষের মুক্তির পথ খোঁজায় সাহায্য করা। এমনকি, কোন ব্যক্তি নিজ থেকে মুক্তির প্রত্যাশী না হলেও একজন বোধিসত্ত্ব তার মুক্তির জন্য সাধনা করতে পারেন। পঞ্চমত, হীনযানী ও মহাযানীরা বুদ্ধ সম্পর্কেও স্বতন্ত্র ধারণা পোষণ করতেন। হীনযানীদের কাছে বুদ্ধ প্রথম দিকে ছিলেন একজন সর্বজ্ঞ পুরুষ। পরবর্তীকালে তাঁর উপর অতিমানবিক ও অতিদৈবিক গুণাবলী আরোপ করা হয়। হীনযানীরা বুদ্ধের স্মৃতিযুক্ত স্থান এবং বুদ্ধের প্রতীককে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন। কিন্তু মহাযানীদের কাছে বুদ্ধ ছিলেন চিরন্তন, অজর, অক্ষয়, অমর। পরবর্তীকালে বুদ্ধের ‘ত্রিকায়’ ধারণা যুক্ত করা হয় এবং বুদ্ধের মূর্তি পুজা শুরু করা হয়। ষষ্ঠত, হীনযানীরা অভিধর্ম পিটকের টিকাভাষ্য ‘বিভাষাসূত্র’কে দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ভিত্তি রূপে গ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে মহাযানীদের কাছে সূত্রপিটকের অন্তর্গত সূত্রগুলিই বুদ্ধের দর্শনতত্ত্ব হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে।
বিশিষ্ট দার্শনিক ও দর্শনতত্ত্ব :
মহাযান মতবাদকে কেন্দ্র করে দুটি দার্শনিক মতবাদ গরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল—মাধ্যমিক বা শূন্যবাদ এবং যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ। কনিষ্কের সমসাময়িক বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন মাধ্যমিক বা শূন্যবাদতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বিদর্ভের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তিনি যখন নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন, তখনই শূন্যতার তত্ত্ব প্রচার করেন। এই মতবাদ বিষয়ে তাঁর মৌলিক রচনা ‘মাধ্যমিক কারিক’। নাগার্জুন সর্বাস্তিবাদের কঠোর বাস্তববাদ এবং যোগাচারের আদর্শবাদ কোনটিকেই গ্রহণ করেন নি। তিনি বাস্তববাদ ও আদর্শবাদের মধ্যপথ অনুসরণ করেছিলেন। তাই তাঁর মতবাদ ‘মাধ্যমিক দর্শন’ নামে অভিহিত হয়। গৌতম বুদ্ধ জাগতিক নিরন্তর পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। নাগার্জুনের মতে, এই পরিবর্তনের কোন অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বের সত্তাসমূহ, যাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় আছে আমাদের ধারণা, তা আসলে অলীক, ভ্রান্ত এবং শূন্য। কারণ কোন সত্তার মধ্যে একই সাথে সৃষ্টি-স্থিতি-লয় থাকতে পারে না। একটি বস্তু তার গুণাবলী দ্বারা পরিচিত হয়। সেই হিসেবে আমরা মাটি, জল, পাথর ইত্যাদি উপাদানগুলির কল্পনা করি। কিন্তু গুণাবলী নিজেই অস্তিত্বহীন। যেমন চক্ষু ছাড়া রং-এর কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আপেক্ষিকভাবে দ্রব্য ও গুণ থাকতে পারে, কিন্তু পারমার্থিকভাবে দুটিই অলীক। শূন্যবাদ অনুসারে জগতের কোন প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। বস্তুসমূহ চিরন্তনও নয়, ক্ষণস্থায়ীও নয়, এরা পৃথক নয়, এদের সৃষ্টিও হয়নি, তাই বিলয় প্রাপ্তও হয় না। এই শূন্যতার শাশ্বত রূপ অনুধাবন করতে পারলে জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের নিরবচ্ছিন্ন পৌনঃপুনিকতার ধারণা থেকে মুক্তি ঘটে। একেই বলা হয় নির্বাণ।
নাগার্জুনের পর নালন্দার অধ্যক্ষ এবং মাধ্যমিক দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন, নাগার্জুনের শিষ্য আর্যদের। আর্যদেবের পর যথাক্রমে রাহুল ভদ্র, রাহুল মিত্র, সংঘরক্ষিত, কুমারজীব, বুদ্ধপালিত, ভাব বিবেক, চন্দ্রকীর্তি প্রমুখ মাধ্যমিক দর্শন প্রচার করেন। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে কুমারজীব চীনদেশে মাধ্যমিক দর্শন প্রচার করেছিলেন। পঞ্চম শতকের শেষদিকে ভাব বিবেকের সময়কালে মাধ্যমিক দর্শনের প্রতিবাদ হিসেবে যোগাচার দর্শন জনপ্রিয় হয়। এর ফলে মহাযান মতের অনুগামীরা দর্শনতত্ত্বের দিক থেকে দুটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
নাগার্জুন যখন নালন্দার অধ্যক্ষ ছিলেন, তখনই তাঁর অনুচরদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় এবং যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ দর্শনের উদ্ভব ঘটে। যোগাচার দর্শনের প্রথম ও প্রধান ব্যাখ্যাকার ছিলেন আসঙ্গ। যোগাচার দর্শন হীনযানীদের বাস্তববাদ এবং মাধ্যমিক দর্শনের সীমিত বাস্তববাদকে অস্বীকার করে। যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ একান্তভাবে আদর্শবাদী। যোগাচার দর্শনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল আসঙ্গ রচিত ‘সূত্রালঙ্কার’। যোগাচার দর্শন মতে, চৈতন্য বা বিজ্ঞান স্বয়ং ক্রিয়াশীল। চৈতন্য সর্ব-স্রষ্টা এবং পরম সত্য। চৈতন্য ছাড়া কোন বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব নেই। এই চৈতন্য বা বিজ্ঞান বিশ্বজগত সৃষ্টি করে। এই সত্ত্বাসমূহ মানসজাত, কোন বস্তু বা রূপযুক্ত উপাদান নয়। অর্থাৎ চৈতন্য বা বিজ্ঞানই পরমসত্য। সকল বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব চৈতন্য বা বিজ্ঞানে নিহিত। চৈতন্য ছাড়া অন্য কোন মাধ্যম জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে ভেদ করতে পারে। উল্লেখ্য যে, শূন্যবাদে এই চৈতন্যকেই অস্বীকার করা হয়েছে। আসঙ্গ পণ্ডিত বসুবন্ধুকে যোগাচার দর্শনে দীক্ষা দেন। যোগাচার বা বিজ্ঞানপদের প্রচারে বসুবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা সিদ্ধান্ত”। তিনিও দীর্ঘদিন নালন্দা বিহারে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্য ক্রমপরম্পরায় গুণমতি, স্থিরমতি, দিঙনাগ, সঙ্ঘদাস, ধর্মদাস, বিমুক্ত সেন প্রমুখ বিজ্ঞানবাদ প্রচার করেছিলেন।
মহাযানবাদের উদ্ভবের ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বহির্ভারতের নানাদেশে বৌদ্ধদর্শন জনপ্রিয় হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতকে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অংশে বৌদ্ধধর্ম প্রসারিত হয়েছিল। চীন দেশে বৌদ্ধধর্ম বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। বৌদ্ধধর্ম প্রসারের কাজে প্রাথমিক ভূমিকা নেন সম্রাট অশোক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আফগানিস্তান ও বালুচিস্তানে বৌদ্ধধর্মের বিশেষ প্রভাব ছিল। মধ্য এশিয়ার কাশগড়, ঘোটান, ইয়ারকন্দ, কুচি প্রভৃতি অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ছিল লক্ষণীয়। খোটানের গোমতি-বিহার গোটা মধ্য এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও বৃহৎ বৌদ্ধদর্শন চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হীনযান ও মহাযান উভয় মতবাদই এই সকল স্থানে জনপ্রিয় ছিল। মধ্য এশিয়ার তুলনায় চীনে বৌদ্ধধর্মের প্রসার কিছুটা কম ছিল। তবে বহু চীনা পণ্ডিত বৌদ্ধদর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ভারতে ছুটে এসেছিলেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় চীনা সন্ন্যাসী চু সে-হিং ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে খোটানে পৌঁছেছিলেন। সেখানের বৌদ্ধদর্শন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান পিপাসা নিবারিত হয়। গুপ্তযুগে আগত ইৎ-সিং লিখেছেন যে, তাঁর আগে অন্তত ২০ জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী চীন থেকে ভারতে এসেছিলেন। গুপ্ত রাজারা চীনা পণ্ডিতদের জন্য মৃগশিখাবনে একটি মন্দির গড়ে দেন এবং তার পরিচালনার জন্য কুড়িটি গ্রাম দান করেছিলেন। চীনদেশ থেকে ধীরে ধীরে কোরিয়া, জাপান, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশেও বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল।
ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে অনুমিত হয় যে, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকেও উত্তর ভারতে হীনযান মতবাদের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। ক্রমে মহাযানবাদ প্রচারিত হলে হীনযানী মতাদর্শ পিছু হটতে থাকে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে মথুরা ও সারনাথের শিল্পকলায় মহাযানবাদের অধিক প্রভাব দেখা যায়। হিউয়েন সাঙ-এর রচনা থেকে বোঝা যায় যে, সপ্তম শতকে ভারতের অভ্যন্তরে হীনযানী আদর্শ খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।