আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ভক্তি-আন্দোলনের ধারা : ভক্তিবাদের উদ্ভব, ভক্তিবাদের আদর্শ, ভক্তিবাদের প্রভাব” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ভক্তিবাদের উদ্ভব
প্রাথমিকভাবে ‘ভক্তি’ বলতে বোঝায় ভাগাভাগি। ড. রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন যে, ভাতকেও ‘ভক্তি’ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সমাজে প্রথম ভক্তির উদ্ভবের ক্ষেত্রে রাজা ও কর্মচারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মধ্যযুগে ভূস্বামীদের ওপর প্রজা বা আধা-ভূমিদাসদের সম্পূর্ণ নির্ভরতার মধ্যে ভক্তিবাদ প্রতিবিম্বিত হয়েছে। তবে ধর্মের ক্ষেত্রে ভক্তিবাদের সূচনা, বিকাশের সংজ্ঞা ও পটভূমি স্বতন্ত্র। ভারতে আদি-মধ্যযুগের সূচনায় সপ্তম শতকে দক্ষিণ ভারতে ধর্মে ভক্তিভাবের প্রকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে ‘ভক্তি’ বলতে বোঝায় ঈশ্বরের কাছে ভক্তের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এয়োদশ শতকের মধ্যে ধর্মীয় ভক্তিবাদের ধারা দক্ষিণ থেকে উত্তর ভারতে সম্প্রসারিত হয়। ষোড়শ শতক পর্যন্ত ভক্তিবাদের রেশ ভারতে ধর্মাচরণের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে সক্রিয় ছিল। দিল্লি-সুলতানির আমল ছিল ভক্তিবাদী ধারার চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার কাল। ব্যাপক জনপ্রিয়তার বিচারে কেউ কেউ একে আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছেন। বস্তুত, ভক্তিবাদী তত্ত্ব ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মাচরণ প্রক্রিয়ার যে বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিল, তাকে ‘‘নীরব বিপ্লব’ আখ্যা দেওয়া যায়। সহজ, সরল এবং একান্তভাবে মানবিক ভক্তিবাদী তত্ত্ব সমাজের বৃহত্তর অংশে যে আন্তরিকতার সাথে গৃহীত হয় এবং তৎকালীন সমাজ চিন্তা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ওপর যে প্রভাব ফেলে, তার বিচারে একে যথার্থই একটি আন্দোলন বলা চলে। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব (A. L. Srivastava) বলেছেন যে, “বৌদ্ধধর্মের পতনের পর আমাদের দেশে ভক্তিবাদী আন্দোলনের মতো এক ব্যাপক ও জনপ্রিয় আন্দোলন আর সংঘটিত হয়নি” (“Perhasps after the decline of Buddhism, there has never been a more widespread and popular movement in our Country than the Bhakti Movement. “)
প্রাচীন ভারতীয় ধর্মসাহিত্যে ভক্তিবাদের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণের প্রেমের বাণী ভক্তিভাবনাকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত হয়েছে। পুরাণ গ্রন্থে জীবন উপাখ্যানে ভক্তিভাবনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভগবদ্গীতার বাণীকে উপজীব্য করেই প্রথমে কৃষ্ণ ও পরবর্তীকালে রামকে কেন্দ্র করে সপ্তম শতকে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে ভক্তিবাদের প্রসার ঘটে। দেবলোকের অধিবাসী ‘কৃষ্ণ’ ক্রমে বৃন্দাবনের ‘কানু’তে পরিণত হন। মানুষের জীবনের সাথে তাঁর জীবনকে একাত্ম করার প্রয়াস শুরু হয়। দেবতার গুণসম্পন্ন কৃষ্ণ ও রাম মানুষের রূপে মানুষের মাঝে আবির্ভূত হয়ে লীলাখেলার মধ্য দিয়ে মানুষকে সত্যের পথপ্রদর্শন করেন। এই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় অবতারবাদ। দেবতা, অবতার ও গুরু একই আধারে একাকার হয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। জাঁকজমকপূর্ণ পূজার্চনার পরিবর্তে ভক্তের আবেগ, প্রেম ও একান্ত ভালোবাসার মাধ্যমে অবতারের তথা ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করা সম্ভব—এই প্রত্যয় দ্রুত প্রসারিত হয়।
সপ্তম শতকে তামিলনাডুতে ভক্তিবাদের সূচনা হয়। আদি-তামিল সাহিত্যে প্রেম ও ভক্তিভিত্তিক সম্পর্ককে উপজীব্য করে কাব্যসাহিত্য রচনার প্রচলন ছিল। অতীন্দ্রিয়বাদের (Mysticism) সংস্পর্শে এসে তামিল ভক্তিভাবের ধারা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। চতুর্দশ শতকে উত্তর ভারতেও ভক্তিবাদের প্রাবল্য ঘটে। তবে দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের মৌল চরিত্র এবং উত্তর ভারতে ভক্তিবাদের প্রেক্ষাপট ও চরিত্র অভিন্ন ছিল না। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির তারতম্য-হেতু ভারতের দু-প্রান্তে ভক্তিবাদের স্বতন্ত্র চরিত্রভাতি দৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতে সামাজিক ভেদাভেদের তীব্রতা ছিল খুবই কম। আর্য-সংস্কৃতির বিলম্বিত বিস্তারের ফলে দক্ষিণে উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সেখানে ক্ষত্রিয় নামক বর্ণের অস্তিত্ব ছিল না। ব্রাহ্মণদের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলকভাবে খুব নগণ্য। উত্তর ভারতে প্রচলিত বর্ণাশ্রম প্রথার প্রবক্তা এবং পরিস্থিতির অনুপস্থিতির ফলে দক্ষিণে ব্রাহ্মণ্যবাদ ছিল দুর্বল। পক্ষান্তরে, সমাজ ও রাজনীতিতে বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল প্রথর। রাজতন্ত্রের ওপর বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। তাই সেখানে মূলত বৌদ্ধ ও জৈনদের ধর্মীয় আচরণের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ভক্তিবাদের প্রসার ঘটে। বৈষ্ণব আলবার ও শৈব নায়নার সাধকদের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের সূচনা ও প্রসার ঘটে। এ কারণে কেউ কেউ দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের উদ্ভবকে ‘হিন্দুত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেন। সারা দক্ষিণ ভারতে ছড়ানো অসংখ্য মন্দিরকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের ধর্মাচরণ নতুন গণভিত্তি খুঁজে পায়। তবে দক্ষিণের মন্দিরকেন্দ্রিক হিন্দুত্ব কখনোই উত্তরের ব্রাহ্মণ্যবাদের মতো হিন্দু-সমাজব্যবস্থায় ভেদাভেদ ও কর্তৃত্ববাদের পর্যায়ে যায়নি।
দক্ষিণ ভারতের পরিস্থিতি ছিল স্বতন্ত্র। সেখানে আর্য-সংস্কৃতির প্রবল প্রতিপত্তির সূত্রে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ছিল রক্ষণশীল এবং কর্তৃত্বকারী। সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে রাজপুত জাতির উত্থান সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন সমীকরণ ঘটায়। প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন ও ইসলাম ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব ব্রাহ্মণ্যবাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, রাজপুতদের উত্থানের ফলে তা অনেকটাই কেটে যায়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, গুপ্তযুগের শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চতুর্বর্ণ মডেলটির ওপর নির্ভর করে সমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধিনিয়ম গড়ে উঠেছিল। আদি-মধ্যযুগে ক্ষত্রিয়দের স্থান নেয় রাজপুতগোষ্ঠী। মনে করা হয় যে, একটি বর্ণসংকর বা উপবর্ণ হিসেবে রাজপুত জাতির আবির্ভাব ঘটেছে। এরা বৃত্তি হিসেবে যুদ্ধকে বেছে নেয় এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জনের জন্য ও জমির স্বত্বলাভের জন্য তৎপরতা দেখায়। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে রাজপুতদের সম্যক ধারণা ছিল। তাই নিজেদের সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য রাজপুতরা ব্রাহ্মণদের প্রতি প্রয়োজনভিত্তিক আনুগত্য প্রদর্শন করতে থাকে। তারা নিজেদের ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ হিসেবে তুলে ধরে। অন্যদিকে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ‘বর্ণাশ্রম প্রথা’ এবং ব্রাহ্মণদের ‘সামাজিক কর্তৃত্ব’ রক্ষা করার তাগিদে বর্ণবহির্ভূত হলেও সামরিক শক্তির অধিকারী ও ভূস্বামী শ্রেণির রাজপুতদের ক্ষত্রিয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বর্ণব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এইভাবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের বোঝাপড়ায় গড়ে ওঠা সমাজে অ-বর্ণ বা নিম্নবর্ণের মানুষদের ওপর ধর্মীয় ও সামাজিক নানা বিধিনিষেধের বোঝা ক্রমে ক্রমে অত্যাচারের পর্যায়ে নেমে আসে। এমতাবস্থায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বা হিন্দু বঙ্গীশ্বরবাদের প্রতিবাদে অব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে ভক্তিবাদে ধারা জনপ্রিয়তা পায়। একই সময়ে ভারতে মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠা ও দ্রুত প্রসার পরোক্ষভাবে ভক্তিবাদের উত্থান ত্বরান্বিত করে। হিন্দুত্ববাদে মন্দির ও দেবমূর্তি ঈশ্বর আরাধনার প্রায় অপরিহার্য দুটি বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। এদের সামনে রেখে নানা ধরনের আচারবিচার, শক্তিতত্ত্ব, অধিকার-অনধিকারের প্রশ্ন ইত্যাদি বিষয়ক অলৌকিক বা অতি-লৌকিক তত্ত্ব মানুষের সামনে উপস্থিত করে কৃত্রিম ভীতি ও শ্রদ্ধা জাগ্রত করা হত। সাধারণ মানুষ তা মেনে নিতে বাধ্য হত। কিন্তু তুর্কি যোদ্ধারা নির্বিচারে মন্দির ধ্বংস করে, মূর্তি ভেঙে বা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের হত্যা করে ক্ষমতা বিস্তার করে। এত ধ্বংসলীলার পরেও মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই ঘটনা একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের ধর্মপ্রচার সম্পর্কে মানুষের ভীতি ও মোহভঙ্গ ঘটায়। অন্যদিকে মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠার ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে গড়ে তোলা বর্ণব্যবস্থার প্রাচীরে ফাটল ধরে। বলা বাহুল্য, ভারতের এই রাজনৈতিক রূপান্তর সামাজিক পরিবর্তনের পথ খুলে দেয়। সেই পথে ভক্তিবাদ ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে।
ভক্তিবাদের আদর্শ :
ভক্তিবাদের মূল কথা হল আত্মার সাথে পরমাত্মার তথা ভক্তের সাথে ভগবানের রহস্যময় বা অতীন্দ্রিয় মিলন। ভক্তিবাদী সাধকেরা প্রথাগতভাবে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না কিংবা তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে কোনো গোষ্ঠী গড়ে তোলার কথা চিন্তা করেননি। কোনো বিশেষ ধর্মমতের বন্ধনে তাঁরা আবদ্ধ ছিলেন না, কিংবা কোনো ধর্মশাস্ত্রের প্রতিও তাঁদের অন্ধ আনুগত্য ছিল না। চিন্তার স্বাধীনতা এবং একান্ত অধ্যাত্মচর্চার মাধ্যমে তাঁরা সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য অনুসন্ধান করতেন। সত্যের আলোক দর্শনের জন্য ভক্তিবাদীরা কোনোরূপ আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন না। কোনো অপরিবর্তনীয় বা দুঃষ্পরিবর্তনীয় মতবাদ—যা কিনা যুক্তিতর্ক দ্বারা সমর্থিত নয়, তার প্রতি এঁদের কোনো আস্থা ছিল না। ঈশ্বরের একত্বে (Unity of God) ছিল তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস। কৃষ্ণ, শিব, রাম, আল্লাহ্—সকলেই ভক্তিবাদীদের হৃদয়মন্দিরে একাকার হয়ে বিরাজ করতেন। অধিকাংশ ভক্তিবাদী সাধক পৌত্তলিকতার বিরোধী ছিলেন। ভক্তিবাদী সাধকেরা প্রচার করেন ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। সকল ধর্মে নানা নামে একই ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা বলেন যে, আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনেই ঘটে মোক্ষলাভ বা মুক্তি। নিষ্কাম কর্মের দ্বারা মোক্ষলাভ সম্ভব। কিন্তু নিষ্কাম কর্মের সাধনা খুব দুরূহ কাজ। বস্তুত, বেদ ও উপনিষদে ভক্তিযোগের নির্দেশ বর্তমান। কিন্তু সেখানে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভক্তিবাদীরা অন্য দুটি পথ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভক্তিযোগের ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁরা দৃঢ়তার সাথে প্রচার করেন যে, একমাত্র ভক্তি এবং আত্মনিবেদনের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায় ভক্তি হলঃ “Single-minded, uniterrupted and extreme devotion to God without any ultimate motive (ahaituki), growing gradually into an intense love. ” ভক্তিবাদীরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি থেকে গভীর ভালোবাসায় উত্তরণের কথা বলেছেন। এই ভালোবাসা হবে প্রভুর প্রতি অনুগত ভৃত্যের, দয়িতার প্রতি প্রেমিকের, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার মতো গভীর, একান্ত এবং প্রশ্নহীন। এঁদের মতে, ধর্মীয় সত্য এবং বিশ্বাস সর্বদা যুক্তিনির্ভর হতে পারে না। এক্ষেত্রে মানুষের আবেগ এবং ইচ্ছার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। ভক্তিবাদীদের ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার এই তত্ত্বটিকে ড. মজুমদার ভারতের ধর্মভাবনার ইতিহাসে ‘ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রধান ও স্থায়ী অবদান’ বলে উল্লেখ করেছেন। ভক্তিবাদী সাধকেরা মনে করেন, ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং একান্ত ভক্তিমার্গের সাধনার পথ কঠিন। তাই এই কাজে ভক্তের প্রয়োজন একজন গুরুর সান্নিধ্য। গুরু ভক্তকে সঠিক পথের নির্দেশ দেন। অন্ধকার থেকে আলোকে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের জন্য গুরুর পথনির্দেশিকা আবশ্যিক।
অধিকাংশ ভক্তিবাদী সাধক ও দার্শনিক জাতিভেদ, বর্ণভেদ প্রভৃতি সামাজিক বিভেদ-বৈষম্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এঁরা উচ্চনীচ ভেদাভেদের পরিবর্তে মানুষের মধ্যে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব প্রচার করেছেন। তাঁদের মতে, যে-কোনো জাতি বা বর্ণের মানুষ একান্ত ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে সক্ষম। মূর্তি-পূজার বিরোধিতা করে তাঁরা প্রচার করেন যে, ঈশ্বর নিরাকার এবং বর্ণহীন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব মনের গভীরে। দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত ভক্তিবাদী সাধক নামদেব বলতেন, “পাথরের দেবতা এবং মিথ্যা ভক্তি পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে না। তুর্কিরা পাথরের দেবদেবীকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেও তাদের আর্তনাদ শোনা যায়নি।”একইভাব কবীর বলেছিলেন, “পাথরের মূর্তির মধ্যেই যদি ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, তাহলে আমি সুবিশাল পর্বতকেই দেবতা হিসেবে পূজা করার পক্ষপাতী।”তাঁদের যুক্তিবাদী দর্শন খুব স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে ভক্তিবাদের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। ভক্তিবাদী সাধকেরা দেবার্চনার কাজে সংস্কৃত ভাষার একাধিপত্যের অবসান ঘটান। তাঁরা প্রচার করেন যে, “ঈশ্বর অন্য কোনো ভাষা বোঝেন না; তারা বোঝেন ভক্তের অন্তরের ভাষা, অর্থাৎ একাত্ম আহ্বান।” যে কোনো ভক্ত তার মনের ভাষাতেই ঈশ্বরকে আহ্বান করতে পারে। এজন্য কোনো বিশেষ ভাষা, স্তোত্র বা ভজনের প্রয়োজন নেই। ভক্তিবাদী দার্শনিকরা সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে স্থানীয় কথ্য ভাষায় তাঁদের মতাদর্শ প্রচার করেছেন। ফলে তাঁদের বক্তব্য খুব সহজেই সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। জটিল দার্শনিক তত্ত্বের প্রচার এঁরা করেননি। পরন্তু সহজ-সরল ভাবে কখনো রূপকের সাহায্যে, কখনো আকর্ষক প্রবচন প্রয়োগ করে এঁদের কথা প্ররোচিত হওয়ার ফলে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজেই এঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভক্তিবাদে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বর্ণপ্রথাকে আক্রমণ করার ফলে নিম্নবর্ণের বহু মানুষ ভক্তিবাদের অনুগামী হয়। ভক্তিমার্গী উপাসকদের মতো ভক্তিবাদের প্রচারকরা বেশির ভাগ ছিলেন নিম্নবর্ণের মানুষ।
ভক্তিবাদী আন্দোলনে ইসলাম ধর্মের প্রভাব :
হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক বিবর্তনের একটা স্তরে ‘ভক্তিবাদী’ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে, নাকি সমকালীন অন্যান্য ধর্মমতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্মসংস্কারকগণ ভক্তিবাদ প্রচার করেছেন—এ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইউরোপের প্রখ্যাত পণ্ডিত ওয়েবার (Weber) মনে করেন, “মোক্ষলাভের পথ হিসেবে ভক্তিমার্গের ধারণা খ্রিস্টধর্ম থেকেই নেওয়া হয়েছে।” একইভাবে ঐতিহাসিক গ্রীয়ারসন (Grierson)-এর মতে, খ্রিস্টধর্মেই প্রথম একেশ্বরবাদ তত্ত্ব প্রচারিত হয়। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা ইউরোপীয়দের এই দাবিকে অযৌক্তিক এবং প্রমাণের অযোগ্য বলে বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু ভক্তিবাদের উত্থানে ইসলামের প্রভাব-সংক্রান্ত বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক ইউসুফ হুসেন তাঁর ‘Glimpses of Medieval Indian culture’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রেরণা এসেছিল ইসলাম ধর্মের নীতি ও আদর্শ থেকে। তিনি মনে করেন যে, “মধ্যযুগে অতীন্দ্রিয়বাদের প্রধান ও প্রথম প্রবক্তা রামানন্দ ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং সম্ভবত তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভক্তিবাদ প্রচার করেছিলেন।” অধ্যাপক হুসেন বিশ্বাস করেন যে, ‘ভক্তিমার্গ’ ভারতীয় ঐতিহ্যর সাথে সুপ্রাচীনকাল থেকেই জড়িত। কিন্তু মধ্যযুগের ভক্তিবাদ ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা ধারণা—যাকে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মভাবনার সাথে সম্পর্কিত করা যাবে না। মধ্যযুগের ভক্তিবাদে যে ‘বিশ্বভ্রাতৃত্ব’ ও ‘সামাজিক সাম্যে’র কথা বলা হয়েছে, তা ইসলামধর্মের প্রভাবের ফল।
অধ্যাপক হুসেন ভক্তি-আন্দোলনকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রথম পর্যায়টির পরিধি শ্রীমদ্ভাগবতগীতার সময় থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত। এই পর্যায়ে ভারতের ধর্মভাবনায় মুষ্টিমেয় একেশ্বরবাদের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বহু ঈশ্বরবাদের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিধি ত্রয়োদশ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত। এই সময়ে ভারতের অভ্যন্তরে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ঘটে গিয়েছিল। তাই ইসলামের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রে হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদ তত্ত্বের প্রাধান্য ঘটে এবং ভক্তিবাদী আন্দোলনে নতুন জোয়ার আসে। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতাবাদ ও সামাজিক সাম্যের তত্ত্ব দ্বারা ভক্তিবাদীরা প্রভাবিত হন এবং ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ দ্বারা মুক্তির সন্ধানে ব্রতী হন। ড. রোমিলা থাপার ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তারা, যাঁরা ধর্মীয় চিন্তার চেয়ে সামাজিক ধারণার ওপরই বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন, তাঁরা সকলেই ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষত, সুফিদের শিক্ষার প্রভাব তাঁদের ওপর বিশেষভাবে পড়েছিল।”
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ. এল. শ্রীবাস্তব প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ উপরিলিখিত মতের বিরোধিতা করেছেন। এঁদের মতে, ইসলাম ধর্মতত্ত্বে অবিশ্বাসী বা কাফেরদের বিশ্বাসী বা ইসলামীদের সমমর্যাদা বা সম-অধিকার দেওয়া হয়নি। মধ্যযুগের ভক্তিবাদী সাধকদের দৃষ্টিতে গোঁড়া ইসলাম ও গোঁড়া হিন্দুধর্মের মধ্যে বিশেষ প্রভেদ ছিল না। ড. মজুমদার লিখেছেন : “ইসলামের সৌভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব “শুধুমাত্র ইসলামের অনুগামীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত, হিন্দুদের জন্য ইসলামের তত্ত্ব কোনো সার্বিক সাম্যের বাণী বহন করে আনেনি” (“…..neither the theory of Islam, nor its practice, as regards the Hindus, could appeal to the later as bringing a new message of equality of man.”)।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক ভক্তিবাদের প্রসারে ইসলামের পরোক্ষ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতে ইসলামধর্মের প্রসার এবং বহু হিন্দুর ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা হিন্দুধর্মের সামনে এক সংকট সৃষ্টি করেছিল। এই অবস্থায় হিন্দু-সংস্কারকদের একাংশ হিন্দুধর্মের ভাবাদর্শের মধ্যেই সর্বজনগ্রাহ্য ও সহজে বোধগম্য ধর্মভাবনা খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হন। এবং এঁরাই ভক্তিবাদের বিকাশে ইসলামের এহেন পরোক্ষ অবদানের কথা স্বীকার করে নিলেও স্মরণে রাখা দরকার যে, ভক্তিবাদের তত্ত্ব হিন্দুধর্মাদর্শের মৌলিক কাঠামোর মধ্য থেকেই সংগৃহীত হয়েছিল, অন্য কোনো ধর্মের আদর্শকে ভিত্তি করে নয়। যেমন ঊনবিংশ শতকে রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ পাশ্চাত্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েও ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্য থেকেই সমাজ-সংস্কারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এই বিচারে ভক্তিবাদের ওপর সুফিবাদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। দশম শতকে সুফিরা পারস্যের জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ক্রমে ভারতেও সুফিসাধকদের উত্থান ঘটে। এঁরাও আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণকে মুক্তির পথ হিসেবে প্রচার করেন। গোঁড়া উলেমাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুফিসন্তরা উদারতা ও ধর্মসমন্বয়ের বাণী প্রচার করেন। একইভাবে ভক্তিবাদের উৎসও ছিল রক্ষণশীল হিন্দুধর্ম এবং বর্ণভেদ-জর্জরিত হিন্দু সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদবিশেষ। সুফিবাদ ও ভক্তিবাদ উভয় আন্দোলনের পশ্চাৎপট ছিল প্রায় এক। দুটি আন্দোলনই ছিল প্রচলিত দুটি বিশিষ্ট ধর্মের গতিপথ পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং উভয় ক্ষেত্রেই সমাজপতি ও ধর্মবিদদের মানবতাবাদ-বিবর্জিত সমাজ ও ধর্মজীবন পরিচালনার বিরুদ্ধে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে সুফিবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে বহু মিল লক্ষ্য করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই ঈশ্বর ও মানুষের প্রেমময় সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়। দুই মতবাদই গুরু বা পির-এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। উভয় ক্ষেত্রেই সমাজের নিচুতলার অধিকাংশ মানুষের যোগদান ঘটেছিল। ভক্তিবাদের ওপর সুফিবাদের একপাক্ষিক প্রভাব পড়েছিল তা নয়, সম্ভবত উভয়েই পরস্পরের দ্বারা পুষ্ট হয়েছিল।
বস্তুত, বৈদিক হিন্দুধর্মের মধ্যেই ভক্তিবাদের তত্ত্ব নিহিত ছিল। বেদে ব্রহ্মাকেই ‘সৃষ্টির সূত্র’ এবং ‘আনন্দের উৎস’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের (প্রপত্তি) কথা বলা হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবতগীতায়। সেখানে কৃষ্ণ বলেছেন : “সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করে আমাকে অনুসরণ করো, আমিই মুক্তির পথ নির্দেশ করব।” বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মে জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করা হয়েছে এবং স্থানীয় ভাষায় প্রচার করা হয়েছে ধর্মের বাণী। হিন্দুধর্মশাস্ত্রে মুক্তির পথ হিসেবে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে ভক্তিযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বৌদ্ধধর্মের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সূত্রে ভগবানের ওপর ভক্তির তত্ত্ব বিকশিত হয়। হিন্দুধর্মের প্রখ্যাত সংস্কারক শংকরাচার্য অদ্বৈত মতবাদের কথা প্রচার করেন। তবে তিনি জ্ঞানযোগের ওপর বেশি গুরুত্ব দেবার ফলে তা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে আকর্ষিত করতে ব্যর্থ হয়। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদ প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে। শৈব ‘নায়নার এবং বৈষ্ণব ‘আলওয়ার’ সম্প্রদায়ের স্তবগানের মধ্যে ভক্তিবাদ বিকশিত হত। তামিল ভক্তিবাদে সর্বপ্রথম ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভালোবাসার সম্পর্কের কথা উচ্চারিত হয়। তামিল সাধকদের ভক্তিবাদের কাছে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। দক্ষিণ ভারত থেকে ভক্তিবাদের ঢেউ উত্তর ভারতে আছড়ে পড়ে। তবে এজন্য অপেক্ষা করতে হয় ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত। কারণ নায়নার ও আলওয়ার সম্প্রদায় তামিল ভাষায় তাদের মতবাদ প্রচার করায় ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ড. ক্ষেত্র গুপ্ত লিখেছেন: “এদেশে ভক্তিবাদী আন্দোলন প্রায় জন্মকালেই শাস্ত্রীয় ধর্মানুশীলনের কঠোরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতো হিন্দুধর্মশাসিত ও ব্রাহ্মণ্য নিয়ন্ত্রিত ধর্মের বিধিবিধানের বিরুদ্ধে মধ্যযুগে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ভক্তি আন্দোলন বিচিত্র রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করে।” ড. গুপ্তের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলনের উদ্ভব সমাজে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের মধ্য থেকেই ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত পণ্ডিত ও সাধকদের মাধ্যমে ভক্তিবাদ উত্তর ভারতে প্রসারিত হয়েছে এবং একটা ধর্ম-আন্দোলনের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
ভক্তিবাদী সাধকগণ :
মধ্যযুগে ভারতে বহু ভক্তিবাদী সাধকের আবির্ভাব ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে স্মরণীয় কয়েকজন হলেন রামানুজ, নিম্বার্ক, বল্লভাচার্য, নামদেব, কবীর, নানক, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ। ভক্তিবাদের আদি প্রবক্তাদের অন্যতম ছিলেন রামানুজ। দক্ষিণ ভারতের শ্রীপেরামপুদুরে ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে রামানুজের জন্ম হয়। বৈষ্ণবসাধক যমুনামুনির কাছে তিনি দীক্ষা নেন। শংকরাচার্য বলেছিলেন, “মুক্তির একমাত্র পথ হল “জ্ঞান’।” রামানুজ শংকরের মতের বিরোধিতা করে বলেন, “জ্ঞান মুক্তির একমাত্র পথ নয়, অন্যতম পথ।” তিনি মুক্তির জন্য জ্ঞানের পরিবর্তে ‘ভক্তি’র ওপর বেশি জোর দেন। রামানুজ হিন্দুদর্শন ও ভক্তিবাদের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছিলেন। রামানুজের সমসাময়িক ছিলেন নিম্বার্ক। ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা করে তিনি ‘বেদান্ত-পারিজাত-সৌরভ’ রচনা করেন। নিম্বার্ক অদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেন। ড. রমা চৌধুরী লিখেছেন: “He did a great service to mankind by pointing, to a path which satistifed both intellect and feeling, head and heart, without overemphasizing the one at the expense of the other.”
দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারতে ভক্তিবাদের বাণী বহন করে আনেন রামানন্দ। তিনি রামানুজের ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ প্রচার করেন। বস্তুত, রামানন্দ বর্ণভেদ প্রথা নির্মূল করার কথা বলেননি। ব্রাহ্মণ ও শূদ্রকে একাসনে অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তাঁর দ্বিধা ছিল। তবুও একথা সত্য যে, তিনি বর্ণভেদ-প্রথার কঠোরতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে সমস্ত জাতির মানুষই ছিলেন। তিনি হিন্দি ভাষায় কবিতা রচনা করে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তির বাণী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। রামানন্দের বড়ো কৃতিত্ব হল যে, তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে গড়ে তোলা এমন অসংখ্য শিষ্য রেখে যান, যাঁরা ভক্তিবাদকে দ্রুত দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এই কারণে বলা হয়, মধ্যযুগে ভক্তিবাদী আন্দোলন রামানন্দের সাথেই সুচিত হয়েছিল।’
ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন, “ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যযুগের ভক্তি-আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি দান এসেছিল কবীর ও নানক এর কাছ থেকে।”কথিত আছে যে, কবীর (১৪৪০-১৫১৮ খ্রিঃ) এক ব্রাহ্মণ-বিধবার সন্তান ছিলেন। মা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে তিনি এক মুসলমান তাঁতির ঘরে পালিত হন। প্রথম জীবনে কবীর রামানন্দের ভক্ত ছিলেন। পরে তিনি নিজস্ব ধারণা প্রচার করতে শুরু করেন। ইসলামীয় চিন্তাধারার সংস্পর্শে থাকার ফলে তাঁর চিন্তাভাবনায় কিছুটা নতুনত্ব ছিল। তিনি ধর্মীয় উদারতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন দাবি করেন। কবীর বলতেন: “ঈশ্বর এক, কেবল নামে ভিন্ন। তাঁর মতে, আল্লাহ্ ও রাম একই ঈশ্বরের আলাদা নাম।” কবীর বিভিন্ন ধর্মের স্বাতন্ত্র্য ও বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে বলতেন: “ঈশ্বর মসজিদে নেই; মন্দিরেও নেই; কাবাতেও নেই, কৈলাসেও নেই; আচারেও নেই, অনুষ্ঠানেও নেই; যোগেও নেই, ত্যাগেও নেই।” তাঁর মতে, ঈশ্বরের অধিষ্ঠান মানুষের হৃদয়ের মধ্যে। ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের জন্য গার্হস্থ্যধর্ম পরিত্যাগেরও তিনি বিরোধী ছিলেন। ঐতিহাসিক তারাচাঁদ এর মতে, “সর্বধর্ম-বর্ণ-সমন্বয়ী প্রেমের ধর্মপ্রচার করাই ছিল কবীরের লক্ষ্য।”দু-লাইনের এক-একটি শ্লোকের (দোহা) মধ্য দিয়ে কবীর অত্যন্ত সহজ-সরল ভাবে তাঁর বক্তব্য প্রচার করতেন। ফলে এগুলি সহজেই সাধারণ মানুষের বোধগম্য হত।
নানক জন্মেছিলেন (১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিঃ) পাঞ্জাবের গ্রাম তালবন্দীতে। এক মুসলমান বন্ধুর উদারতায় তিনি শিক্ষালাভের সুযোগ পান। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মন আচ্ছন্ন করে রাখত অতীন্দ্ৰিয় জগৎ। অল্পবয়সে সংসার ত্যাগ করে তিনি সুফিসস্তদের সঙ্গে যোগ দেন। কিছুকাল পরে সুফিদের ত্যাগ করে দেশের নানা স্থান পরিভ্রমণ করেন। কথিত আছে —নানক মক্কা, মদিনা ও সিংহল দ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর উপদেশাবলী ‘আদিগ্রন্থ’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা আছে। কবীরের মতো ইনিও একেশ্বরবাদ-তত্ত্ব প্রচার করেন। তিনি বলেন যে, মানুষ পুরস্কার ও তিরস্কার দুই-ই পায় ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুয়ায়ী। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে যে কেউ প্রেম ও ভক্তিসহযোগে বারবার ঈশ্বরের নাম জপলে মোক্ষলাভ করবে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ-লাভের জন্য তিনি চরিত্র ও আচরণের পবিত্রতা এবং গুরুর সান্নিধ্যলাভের ওপর জোর দেন।
ড. থাপার লিখেছেন যে, কবীর ও নানক কেউই সচেতনভাবে ধর্মসমন্বয়ের চেষ্টা করেননি। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ভাবধারা গ্রহণ করে দুই ধর্মের পার্থক্য দূর করার বা কোনো নতুন সমন্নয়বাদী ধর্মমত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা এঁদের ছিল না। তবে উভয়ের বক্তব্যই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশেষত কারিগর ও কৃষকশ্রেণির মধ্যে এই দুই প্রচারক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার প্রধান কারণ এঁদের মতবাদ ছিল সহজবোধ্য এবং বাস্তবজীবনের সঙ্গে সংযুক্ত। এঁরা উভয়েই সামাজিক সমস্যার কথা অনুভব করেছিলেন এবং তা দূরীকরণে সচেষ্ট ছিলেন। জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করে সামাজিক সাম্যের ভিত্তিতে এঁরা সমাজকে পুনর্গঠিত করার আহ্বান জানান। কবীর ও নানক কোনো নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুগামীরা যথাক্রমে ‘কবীর পন্থী’ ও ‘শিখ-সম্প্রদায়’ নামে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হন।
ষোড়শ শতকে বালাদেশে ভক্তিবাদের জোয়ার নিয়ে আসেন শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিঃ)। চৈতন্যদেব নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তাঁর বিদ্যাচর্চা হয়। সমকালীন বাংলায় সামাজিক অচলতা, মানসিক জড়তা এবং ব্যবহারিক জীবনযাপনে উদ্দেশ্যহীনতার প্রতিবাদে শ্রীচৈতন্য এক হৃদয়ধর্মী, মানবতাবাদী প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। চৈতন্যদেবের আন্দোলনের পশ্চাদপটে সমকালীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। সেন রাজারা পৌরাণিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আতি আগ্রহ দেখালে, সামাজিক সমীকরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্মার্তবাদীদের দাপটে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য বর্ণভূক্তদের সামাজিক অস্তিত্ব প্রায় অগ্রাহ্য হতে থাকে। শূদ্রদের দুরবস্থা তো বৃদ্ধি পায়ই, এমনকি শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থের অধিকারী কায়স্থ, বৈদ্য প্রমুখেরও সামাজিক স্বাধীনতা ও মর্যাদা ধর্মের নামে স্মৃতিকারদের কঠোর বিধানে অস্বীকৃত হয়। একই সঙ্গে উচ্চবর্ণের মধ্যে তান্ত্রিক ধর্মাচারের জনপ্রিয়তা উচ্চবর্ণের জীবনে যে দ্বৈতাচার প্রকট করেছিল (পৌরাণিক ধর্ম ও তন্ত্রাচার পরস্পরবিরোধী) তা সামাজিক মূল্যবোধের অধোগতি অনিবার্য করে।
পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে এবং শ্রীচৈতন্যের জন্মের বেশ কয়েক বছর আগেই ভাগবতের কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবাহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। মাধবেন্দ্রপুরীর প্রভাবে অনুপ্রাণিত ব্রাহ্মণদের একটি অংশ এবং মুসলমান সরকারের অধীনে কর্মরত কায়স্থ ও বৈদ্যদের একাংশ ভাগবতধর্ম প্রচারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। অদ্বৈতাচার্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপে একটি বৈষ্ণব পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। তবে এঁরা স্মার্ত-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেন নি। স্মার্ত ক্রিয়াকাণ্ডকে বজায় রেখে তার উপরে ভক্তিকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এঁদের লক্ষ্য। এঁদের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ বৈষ্ণব মতাদর্শের জাতি বর্ণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা ভাষলেও, বিশেষ এগোতে পারেন নি। গৃহ প্রাঙ্গনে গোষ্ঠীকীর্তন ও আলোচনার মধ্যেই এঁদের ক্রিয়াকর্ম সীমাবদ্ধ ছিল। শ্রীচৈতন্য গৃহাঙ্গনের রূদ্ধদ্বারের গোষ্ঠী-কীর্তনকে রাজপথের জন-সংকীর্তনে রূপান্তরিত করেন। সামাজিক বিভেদ (বর্ণগত) ও বৈষম্যের সামগ্রিক কাঠামোকেই তিনি ভাঙতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর প্রচারের কেন্দ্রে ছিলেন হীনবর্ণের সমাজ। নবদ্বীপের যে নগরিয়াদের সাথে চৈতন্যের হার্দ্য সম্পর্ক ছিল তারা মূলত হীনবর্ণভূক্ত মানুষজন (চণ্ডালাদি নাচয়ে প্রভুর গুণগানে)।
চৈতন্যের নবদ্বীপ লীলায় ‘কাজিদলন’-এর ঘটনাটি তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রক্ষণশীল হিন্দুরা কাজিসাহেবের কাছে শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে জনকীর্তনকে ‘অপধর্ম’ এবং ‘প্রকাশ্য উৎপাত’ (Public nuisance) বলে অভিযোগ জানান এবং প্রকাশ্য কীর্তন বন্ধের দাবি তোলেন। কাজির কাছে অভিযোগকারীদের মধ্যে মুসলমানরাও ছিলেন। এঁদের ভীতির কারণ ছিল শ্রীচৈতন্য ও তাঁর সামাজিক আন্দোলনের প্রতি দেশীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ। কাজি পদাধিকার বলে কেবল ‘সম্মিলিত কীর্তনের’ (সংকীর্তন) উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। চৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং শোভাযাত্রা করে কাজির দরবারে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জোরালো গণদাবী তোলেন। পরিস্থিতি গুরুত্ব বুঝে কাজি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। এই ঘটনাকে ব্রাহ্মণ সমাজ কথিত চৈতন্য ভক্তিবাদকে ‘অপধর্ম’ অপবাদ থেকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির নিদর্শন রূপে চিহ্নিত করা যায়। যদিও এর পরে রক্ষণশীল হিন্দুদের বিরোধিতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
এতকাল চৈতন্য নবদ্বীপকে কেন্দ্র করে এবং প্রতিবাদের প্রতিরোধ করে ভক্তিবাদ প্রচার করতে প্রয়ার্সী ছিলেন। কিন্তু একই সাথে রক্ষণশীল গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ বিরোধীতার প্রেক্ষিতে নিজ কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের চিন্তা করেন। এই ভাবনারই পরিণতি ছিল, (১) সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিজ মতাদর্শকে সামাজিকভাবে বেশী গ্রহণযোগ্য করা এবং (২) স্মার্ত বিরোধীতার দূর্গ নবদ্বীপ পরিত্যাগ করে নতুন কর্মকেন্দ্র গড়ে তোলা। অর্থাৎ চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণ আকস্মিক ভাবাবেগের ফল নয়। এটি ছিল এক প্রচণ্ড নৈতিক সাহসের দৃষ্টান্ত। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে মায়ের অনুমতি নিয়েছিলেন। নিত্যানন্দ সহ অন্তরঙ্গদের সাথে আলোচনাও করেছিলেন। স্মার্ত সমাজ চৈতন্য ও বৈষ্ণবদের ‘একঘরে’ করে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন করার যে পরিকল্পনা করেছিল, তারই প্রতিবাদ ছিল তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণ ও পরবর্তী কর্মসূচীর রূপরেখা প্রবর্তন।
সন্ন্যাসের পরবর্তী প্রথম বারো বছর চৈতন্যের প্রধান কর্মসূচী ছিল—(১) ব্রাহ্মণ্যবাদী ও স্মৃতিশাস্ত্র ভিত্তিক সমাজের একটি কার্যকরী বিকল্প গড়ে তোলার জন্য ভক্তিবাদের তত্ত্বদর্শন ও কর্মসূচীকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা এবং (২) নতুন ক্ষেত্র থেকে নতুন উদ্যমে ভক্তি ধর্ম প্রচার করা। প্রথম কাজের জন্য তিনি বিশিষ্ট পণ্ডিত রূপ-সনাতন ও গোপাল ভট্টকে দায়িত্ব দেন। কৃষ্ণলীলার সাথে যুক্ত ব্রজধাম বৃন্দাবনে থেকে এঁদের ভক্তিধর্মের দর্শনতত্ত্ব সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পরামর্শ দেন। বস্তুত সেই সময় বৃন্দাবনের লীলা মাহাত্ম্য প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। মথুরা তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারলেও, বৃন্দাবন কার্যত এক জঙ্গলাকীর্ণ জনবিরল ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছিল। চৈতন্যের উদ্যোগে বৃন্দাবনের মুছে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। বৃন্দাবন পরিক্রমা দ্বারা চৈতন্য কৃষ্ণের ব্রজলীলার সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি তীর্থ চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশে নবপর্যায়ে ভক্তিধর্ম প্রচারের দায়িত্ব তিনি দেন অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দকে দেন। অদ্বৈত ও নিত্যানন্দের মধ্যে ভক্তিবাদ সম্পর্কে নীতিগত পার্থক্য ছিল। অদ্বৈত ভক্তিবাদের নামে জ্ঞানকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে চান নি। তিনি জ্ঞান ও ভক্তিকে সমগুরুত্ব সহ গ্রহণ করার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু নিত্যানন্দ ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে ‘সখ্যভাব’ গড়ে তোলার কথা বলেন। প্রচলিত বর্ণভিত্তিক সমজে ভগবানের সাথে ভক্তের সখ্যের দর্শন উদারতার পদযাত্রা, সংকীর্তন, নৃত্য-গীত এবং প্রবল ভক্তির উচ্ছাসে তিনি জনচিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। মহোৎসব ও পঙ্ক্তিভোজন কর্মসূচী রূপায়ণ করে নিত্যানন্দ জাতিবর্ণভেদের গণ্ডি ভেঙে দিতে সক্ষম হন। তাই বলা যায় যে, গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের যা কিছু সাম্য ও ভ্রাতৃত্বমূলক ভাব ও আচরণগত প্রেরণা তা মূলত নিত্যানন্দের অবদান। তাই দেখা গেছে শ্রচৈতন্যর জীবিতাবস্থাতেই বাংলাদেশে চৈতন্য-নিত্যানন্দের যুগল মূর্তির পূজা শুরু হয়েছিল। পুরীতে অবস্থানরত চৈতন্য দূরে থেকে ভক্তদের তাত্ত্বিক পরামর্শ দিতেন। বিভিন্ন সমস্যাসার সমাধানের চেষ্টা করতেন। তবে তাঁর জীবত্কালেই নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, নরহরি প্রমুখের অনুগামীদের মধ্যে মতান্তর স্পষ্ট হয়েছিল। আক্ষরিক অর্থে বাংলার শহর থেকে গ্রামগঞ্জে জনপ্রিয় ও প্রায় সামাজিক ঢেউ তুলে দেওয়া বৈষ্ণবদের মধ্যে কোন সংগঠনগত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
চৈতন্যদেব স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন যে, জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। একান্তচিত্তে ভক্তিভাব জাগরণের মাধ্যমে সেই আধ্যাত্মিক শক্তির স্পর্শ পাওয়া সম্ভব। এই অধ্যাত্মভাব জাগরণের জন্য শ্রীচৈতন্যদের সমবেত সঙ্গীত বা কীর্তনের ওপর জোর দেন। তাঁর মতে, কীর্তন হল এক বিশেষ ধরনের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা যেখানে ভগবানের নামসংকীর্তনে বাইরের পার্থিব জগৎ শূন্য হয়ে যায়। জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি এবং ভক্তিভাব জাগরণের জন্য নামসংকীর্তন—এই ছিল চৈতন্যের মূল বাণী। তিনি জাতিভেদের অবসান এবং সমস্ত মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। সারা দেশ ভ্রমণ করে তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। মুসলমান ও নিম্নবর্ণের মানুষ-সহ অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। চৈতন্যদেব নিজে কোনো স্বতন্ত্র ধর্মসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে তাঁর শিষ্যরা পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব নামে পৃথক একটি সম্প্রদায় সংগঠিত হয়। এ ছাড়াও বহু ভক্তিবাদী সাধক ও প্রচারক ভক্তিবাদের সহনশীল ও সাম্যবাদী তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। পঞ্চদশ শতকের ভক্তিদর্শন পরবর্তীকালেও নানা মুখে প্রচারিত হয়েছে। এঁদের বক্তব্যেও ভক্তিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির প্রাধান্য ছিল।
ভক্তিবাদের প্রভাব :
ভারতীয় ধর্ম ও সমাজের ওপর ভক্তিবাদের প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কষ্টকর। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সমালোচক মনে করেন যে, ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রেরিত বার্তা ধর্ম ও সমাজজীবনে পবিবর্তনের আহ্বান জানালেও এর পরিণতি সম্পূর্ণ ছিল না। তার অন্যতম কারণ হল খুব কমসংখ্যক মানুষ আন্তরিকভাবে এই ভাবধারার সাথে যুক্ত হতে পেরেছিলেন। ধর্মসংস্কারের মধ্য দিয়ে সমাজসংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন ভক্তিবাদীরা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সামাজিক অসাম্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই একদল মানুষ ভক্তিমার্গের অনুগামী হয়েছিলেন। তাই দেখা যায়, সমাজের নিচুতলায় বা নিম্নবর্ণের মানুষরাই মূলত ভক্তিবাদের অনুগামী হয়েছিলেন। বাস্তবক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন তাঁদের সাধ্যাতীত ছিল। তা ছাড়া, ভক্তিবাদী সাধকেরা যে আন্তরিকতার সাথে ভক্তির বাণী প্রচার করেছিলেন, অনুগামীদের মধ্যে সেই ত্যাগ ও উদারতা ছিল না। তাই দেখা যায়, ভক্তিবাদ প্রচারিত হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই বিভিন্ন সাধকের অনুগামীরা স্বতন্ত্রগোষ্ঠী গঠন করে আর এক ধরনের সামাজিক বিভেদ ও বিরোধের জন্ম দিয়েছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, ভক্তিবাদী আন্দোলন প্রচলিত হিন্দুসমাজে ও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেননি। তিনি লিখেছেন : “they failed to modify either the religious ideas and practices or the outword structure of the Hindu Society to any appreciable extent.”
ড. এ. এল. শ্রীবাস্তব কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ভক্তিবাদী আন্দোলনের দুটি লক্ষ্য ছিল। একটি হল, হিন্দুধর্মের সংস্কার করে তাকে একটি সহজ-সরল রূপ দেওয়া—যাতে ইসলামধর্মের সাম্যবাদী আদর্শের আহ্বান থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সরিয়ে আনা যায়। অপর লক্ষ্যটি হল, হিন্দু ও ইসলামধর্মের বিরোধ কমিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসা। ভক্তিবাদ প্রথম লক্ষ্যটি পুরণে সফল ছিল। বর্ণভেদ-প্রথার বিরোধিতা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তে সাধনপথে ঈশ্বরলাভের তত্ত্ব প্রচার করে ভক্তিবাদীরা নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে হিন্দুধর্মের জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় লক্ষ্যপূরণে তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভক্তিবাদীদের বক্তব্য সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের কাছে আদৃত হয়নি। শ্রীবাস্তবের ভাষায় : “Neither the Turko Afgan rulers nor the Muslim public accepted the Rama-Sita creed. They refused to believe that Rama and Rohim. Iswara and Allah were the name of the same God.”
সমাজ ও সংস্কৃতির নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ভক্তি-আন্দোলনের ইতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করা কঠিন। অধ্যাপক সুকুমার সেন চৈতন্যদেবের মতাদর্শকে কোনো বিশেষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে সামাজিক উপযোগিতার দিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। চৈতন্যদেবের আন্দোলন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাপ্রসারের মাধ্যমে একটি সমাজ-বিপ্লবের সূচনা করেছিল বলে তিনি মনে করেন। পূর্ব ভারতে এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশ শ্রীচৈতন্যের আহ্বানে অসংখ্য মানুষের সক্রিয় যোগদানের প্রেক্ষিতে ড. সেন লিখেছেন, “তাঁর (শ্রীচৈতন্য) অপূর্ব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হইয়া বাঙালির প্রতিভা কী ধর্মে, কী দার্শনিক চিন্তায়, কী সাহিত্যে, কী সংগীতকলায় সর্বত্র বিচিত্রভাবে স্ফুর্ত হইতে থাতে। ইহাই বাঙালি জাতির প্রথম জাগরণ।” সমকালীন সমাজের ওপর ভক্তি-আন্দোলনের প্রভাব বর্ণনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “The Chaitanya Vaishnave movement added a new strand of morality and goodness to the Indian character: “বিশেষত সাংস্কৃতিক জীবনে এই আন্দোলন একটা পরিবর্তনের ঢেউ আনতে পেরেছিল। ভক্তিবাদী সাধকেরা তাঁদের বাণী প্রচার করতেন আঞ্চলিক ভাষায়। এতদিন শাস্ত্রপুরাণ সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে ছিল। কারণ তা রচিত ছিল সংস্কৃত ভাষায়, যা সাধারণ মানুষ বুঝত না। এখন ভক্তিবাদীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় প্রাচীন গ্রন্থ অনুবাদ শুরু হয়। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, গীতা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়ে ওঠে। এইভাবে আঞ্চলিক ভাষা— যেমন হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, মৈথিলি ইত্যাদির বিপুল চর্চা শুরু হয়। বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্যদেবের জীবনভিত্তিক রচনাগুলি বাংলা ভাষাকে আধুনিকতার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। তাই ড. শ্রীবাস্তব লিখেছেন, “The period of Bhakti movement proved to be a golden period in the history of the growth of our vernacular literature.”
সামাজিক সাম্য ও সহনশীল সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের পথে হিন্দু-সমাজকে কিছুটা এগিয়ে দেওয়ার কাজে ভক্তিবাদী-আন্দোলনের ইতিবাচক ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। শিক্ষা চেতনা আনে—একথা যদি সত্য হয়, তাহলে ভক্তিবাদী আন্দোলন নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে সাম্যবোধের চেতনাসৃষ্টির কাজ নিশ্চয় কিছুটা সম্পন্ন করেছিল। জাতপাতের ভেদাভেদকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে ভক্তিবাদী সাধক ও দার্শনিকরা হিন্দু সমাজব্যবস্থার মর্মমূলে আঘাত করেছিলেন। ফলে বিভিন্ন সামাজিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন-সম্ভাবনা প্রশস্ত হয়েছিল। অধ্যাপক ইউসুফ হুসেন লিখেছেন: “It sought to refashion the collective life on a new basis, envisaging a society in which there shall be justice and equality for all and in which men of all creeds shall be able to develope to their full moral and spiritual stature.”
স্থাণুবৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু-সমাজব্যবস্থায় গতিশীলতা (mobility) আনার দিক থেকেও ভক্তি আন্দোলনের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ভারতে ইসলাম ধর্মের প্রসার রক্ষশীল হিন্দু-সমাজকে আরও বেশি রক্ষণশীল করে তুলেছিল। বর্ণভেদ ও নতুন নতুন স্মৃতিশাস্ত্রের কঠোর বিধান দ্বারা সমাজপতিরা হিন্দু-সমাজকে এক অচলায়তনে রূপান্তরিত করে ইসলামধর্মের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে তৎপর হয়েছিলেন। রোমিলা থাপার লিখেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে এই নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট না হলে হয়তো এই কঠোর লক্ষণরেখা গড়তে হত না। কিন্তু রক্ষণশীলদের এই কঠোরতা পরিণামে আহত করেছিল অসংখ্য অবহেলিত ও অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষকেই। ভক্তিবাদী আন্দোলন সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়ে সেই রুদ্ধ মানবগোষ্ঠীকে স্বধর্মে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। কবির, নানক, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ অসংখ্য মানুষের মনে সামাজিক প্রতিষ্ঠার আশা সঞ্চার করে তাদের নব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ভক্তিবাদের এই সামাজিক সচলতাকে, সুলতানি আমলের অনন্য অবদান বলা যায়।
ভক্তিবাদ পরোক্ষভাবে হলেও ধর্মীয় সহনশীলতার একটা বাতাবরণ তৈরি করেছিল। ভক্তিবাদী আন্দোলন গোঁড়া মুসলমান বা গোঁড়া হিন্দুদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু ইসলামের উদারতাবাদী সম্প্রদায় সুফিসস্তদের সাথে ভক্তিবাদী সাধকদের অনেক ক্ষেত্রেই মিল ছিল। এই দুটি অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলন হিন্দু ও ইসলাম-সংস্কৃতির সেতুবন্ধনের কাজে অনেকটা সফল হয়েছিল। অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : “Sufism and Bhakti which constitute the mystical core or essence of Islam and Hinduism, have been firm and essential binders of the two cultures. ‘ ‘ইউসুফ হুসেন লিখেছেন : “ইউরোপের সংস্কার-আন্দোলনের মতো মধ্যযুগে হিন্দুধর্মের সংস্কার-আন্দোলনও সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বার্তা বয়ে আনে এবং ভক্তিবাদের ওপর ভিত্তি করে হিন্দু দর্শনকে নতুন সমাজ গঠন ও আধ্যাত্মিকতা বিকাশের উপযোগী করে তোলে।”
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।