আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ভারতে পুরা-প্রস্তরযুগ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ভারতে পুরা-প্রস্তরযুগ
পুরা-প্রস্তরযুগের সংস্কৃতিকে সূক্ষ্মতর তিনটি পর্বে বিভক্ত করা হয়েছে। মূলত প্রস্তর নির্মিত হাতিয়ার (আয়ুধ)-এর বৈশিষ্ট্য এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের নিরিখে এই বিভাজন করা হয়। এগুলি হল—নিম্ন-পুরাপ্রস্তর, মধ্য পুরাপ্রস্তর ও উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগ। নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের হাতিয়ারগুলির মধ্যে পর্যায় অনুসারে কিছু প্রভেদ অবশ্যই দেখা যায়। যেমন নিম্নপর্যায়ে প্রধান আয়ুধ ছিল হস্তকুঠার (hand axe) ও ছেদক (cleaver); পরবর্তী পর্যায় অর্থাৎ মধ্য-পুরাপ্রস্তর পর্বে ছোট ছিদ্র করার অস্ত্র (borer), চাঁছনি (Scraper) বা অধিক ছুঁচালো প্রস্তরখণ্ড দেখা যায়। আবার উচ্চ পর্যায়ে লম্বা চিলকা (blade) জাতীয় প্রস্তরায়ুধ মানুষের করায়ত্ব হয়েছিল। তবে কোন হাতিয়ারই নির্দিষ্টভাবে কেবল একটি পর্যায়েই ব্যবহৃত হত, এমন নয়। একই আয়ুধ কিছুটা স্বতন্ত্ররূপে পরবর্তী পর্যায়েও দেখা যায়। হাতিয়ারগুলি তৈরীর জন্য ব্যবহৃত পাথরগুলিও পর্যায় অনুযায়ী কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল। নিম্ন পর্যায়ে ‘কোয়ার্টজ’ বা ‘ব্যাসালট’ জাতীয় জমাট প্রস্তরখণ্ড ব্যবহার করা হত। পরবর্তী দু’টি পর্যায়ে ‘চিলকা’ তোলার কৌশল করায়ত্ত্ব হলে, সূক্ষ্মদানা বিশিষ্ট ‘কোয়ার্টজ বা ‘চার্ট’ জাতীয় পাথর ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়।
ভারতে নিম্ন-পুরাপ্রস্তরযুগের নির্ণীত তারিখের সংখ্যা যথেষ্ট কম। তবে প্রাচীনত্বের সঠিক কাল নির্ধারণ করা যায়নি। গবেষকদের অনুমান নিম্ন-পুরাপ্রস্তরযুগের সূচনা প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে হয়েছিল। এর অধিকাংশ অংশ ছিল হিমযুগের মধ্যে। তবে ভারতে নিম্ন-পুরাপ্রস্তরের সূচনাকাল ৪ থেকে ৬ লক্ষ বছর আগে ঘটেছিল মনে করা হয়। মহারাষ্ট্রের বোরি’তে নির্ধারিত তারিখ সংক্রান্ত মতভেদ থেকেই এই অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। যাইহোক, বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত অবশেষের ভিত্তিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই প্রাচীন সংস্কৃতির সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের গোদাবরী উপত্যকায় (নেভাসা) এবং কর্ণাটকের কৃয়া উপত্যকায় (ইয়েদুয়াড়ি) অঞ্চলে কমবেশী ৪ লক্ষ বছর আগে এর অস্তিত্ব ছিল। পশ্চিম রাজস্থানের দিদওয়ানে এর সময়কাল ছিল ৩ লক্ষ ৯০ হাজার বছর থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত। কর্ণাটকে হুনগি ও বৈচাবল উপত্যকায় যথাক্রমে ২ লক্ষ ৯০ হাজার ও ৩ লক্ষ ৫০ হাজার বছর থেকে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার বছর আগে। সৌরাষ্ট্রের জুনাগড় ও উমরেথি থেকে প্রাপ্ত তারিখ ১ লক্ষ ৯০ হাজার থেকে ৬৯ হাজার বছর আগে। নিম্ন-পুরাপ্রস্তর যুগের শেষ পর্বের তারিখ পাওয়া যায় পূর্ব-মধ্যপ্রদেশের শোন উপত্যকায়, যা ১ লক্ষ ৩ হাজার ৮০০ থেকে ১৯,৮০০ বছরের আগে বিকাশ লাভ করেছিল।
প্রস্তরযুগের হাতিয়ারগুলি মূলত প্রস্তর নির্মিত। হাতিয়ার নির্মাণের কাজে প্রাথমিকভাবে দু’ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। নিম্নপ্রস্তরযুগে প্রধানত হাতকুঠার, কোপানি, বাটালি জাতীয় হাতিয়ার নির্মাণ করা হত। প্রাথমিকপর্বে হাতিয়ারের মূল উপাদানগুলি নুড়ি পাথর বা কোয়ার্টজাইট পাথর। পাথরে মূল অংশটিকে (core) এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হত। তাই পুরাতত্ত্বের ভাষায় এগুলিকে ‘কোরটুল’ (core tool) বলা হয়। ইউরোপীয় পুরাতত্ত্বের বিচারে এই হাতকুঠারগুলি ‘আশুলীয়’ (Acheulian) পর্যায়ভূক্ত। এই হাত-কুঠারগুলির পাথরখণ্ডের দু’দিকেই ঢাল এবং দু মুখবিশিষ্ট হত যার একটা দিক ধারালো বা অমসৃণ। ফলে হাতে ধরতে বা কোন কিছুতে আঘাত দিয়ে খণ্ড খণ্ড করা সম্ভব হত। ভারতে নিম্ন-পুরাপ্রস্তরযুগের মানুষ এই জাতীয় অস্ত্র বহন করত। আনুমানিক ৭ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে তৈরী এই জাতীয় প্রস্তরায়ুধের নিদর্শন মহারাষ্ট্রের নেভাসা, কর্ণাটকের হুনসগি-বৈচবাল উপত্যকা, রাজস্থানের দিওয়ান অঞ্চলে পাওয়া গেছে। হুনগি উপত্যকায় সারাবছরব্যাপী বন্য জন্তু ও খাওয়ার উপযোগী উদ্ভিদ পদার্থ পাওয়া যেত। আশেপাশে ১০-১৫ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা Core tools-এর অস্তিত্ব থেকে প্রত্নবিদদের অনুমান যে, সম্ভবত গ্রীষ্মকালে এই এলাকার মানুষরা পার্শ্ববর্তী নদীনালার পাশে সরে যেত। আবার বন্যার জলে নিম্ন পুরাপ্রস্তর আয়ুধগুলি ভেসে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়াও অসম্ভব নয়।
গবেষক পি. সি. পন্থ ও বিদুলা জওসোয়াল তাদের গবেষণায় বিহারের মুঙ্গের জেলার পৈসরা, কান্দিনী ও বারিয়ারা গ্রামে নিম্ন-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির বিশেষ অবস্থান উল্লেখ করেছেন। বিন্ধ্য উপত্যকার একটি উপ-অংশে ৫-৭ কিলোমিটারের মধ্যে এই গ্রামগুলির অবস্থান। এদের মধ্যে কেবল পৈসরা থেকে বিশাল সংখ্যক আদি পাথুরে হাতিয়ার পাওয়া গেছে। তাই এই অঞ্চলে নিম্ন-পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষের বসবাসের সম্ভাবনা যথেষ্ট। বর্তমান ঐ অঞ্চলের অধিবাসী কোভা উপজাতির মানুষেরা চাষ-আবাদ করলেও, জঙ্গল থেকে পশু শিকার এবং ফল-মূল সংগ্রহ করার কাজে নিয়মিত লিপ্ত থাকে। এই কোভা উপজাতি আদি-মানবগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ কিনা বলা কঠিন, তবে এদের জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে নিম্ন-পুরাপ্রস্তর যুগীয় মানুষের খাদ্যসংগ্রহ পদ্ধতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের অসংখ্য হস্তকুঠার ও ছেদক জাতীয় হাতিয়ার পাওয়া গেছে মধ্যপ্রদেশে ভূপালের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ভীমবেঠকা অঞ্চলে। নিম্ন-প্রস্তর যুগের মানবগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় এই গুহাবাসটি ব্যবহার করেছিল। আদিম মানবগোষ্ঠী এই গুহায় বসে হাতিয়ার বানাতো। মূলত আশুলীয় পদ্ধতিতে নির্মিত হস্তকুঠার ও ছেদক এখানে পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান যে, ভীমবেঠকার গুহাশ্রয়ে প্রাপ্ত আদিম হাতিয়ারগুলি নিম্ন-পুরাপ্রস্তর যুগের একেবারে অন্তিমপর্বের হতে পারে। এছাড়া কাশ্মীর ও থর মরু অঞ্চলেও নিম্ন-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির কিছু কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দাক্ষিণাত্যের অন্ধপ্রদেশের নাগার্জুনাকোন্ড নিম্ন-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির কিছু সাক্ষ্য বহন করে। নিম্ন-পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষ মূলত ছিল খাদ্য-সংগ্রাহক। জঙ্গল থেকে ফল-মূল সংগ্রহ করেই তারা জীবনধার করতো। পরীক্ষামূলকভাবে বা খেলার ছলে তারা ছোট ছোট প্রাণী শিকার করতে শুরু করেছিল। মাছ ও পাখি শিকার করেই তারা এই নতুন বৃত্তিতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রাচীন প্রস্তরযুগের নির্মিত হাতিয়ারের উপাদান ও নির্মাণ কৌশল পরিবর্তনের ভিত্তিতে নিম্ন-প্রাচীন প্রস্তরযুগ থেকে মধ্য-নিম্নপ্রস্তরযুগে উত্তরণের সম্ভাবনা খোঁজা হয়। নিম্নপর্বের হাতিয়ারগুলির তুলনায় মধ্য পর্যায়ের হাতিয়ারগুলি অপেক্ষাকৃত হালকা, ছোট এবং ধারালো বা ছুঁচালো। মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগের এই সকল হাতিয়ার ‘ফ্লেক টুলস’ (Flake tools) নামে পরিচিত। নিম্ন-প্রস্তরযুগের শেষ দিকে এই নতুন হাতিয়ার নির্মাণ পদ্ধতি মানুষের হস্তগত হলেও, এর ব্যাপক ও দক্ষ ব্যবহার মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগে দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে মূল পাথরের গায়ে অন্য পাথরের আঘাত দিয়ে পাথরের কোণগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হত। এই ধারালো ও হালকা কোনাচ পাথরখণ্ডকে ‘ফ্লেক’ বলা হয়। মাদ্রাজ সংস্কৃতি (বা Hand-axe culture) এবং সোয়ান সংস্কৃতি (বা chopper-chopping culture) উভয় শিল্পেই ফ্লেক হাতিয়ার তৈরীর সময় পাথর ভাঙ্গার জন্য পাথরের হাতুড়ি ব্যবহার করা হত। ইতিপূর্বে Core হাতিয়ার তৈরীর জন্য সাধারণ কোয়ার্টজাইট পাথর ব্যবহার করা হত। এখন Flake blade তৈরীর জন্য সূক্ষ্ম দানাবিশিষ্ট কোয়ার্টজ়াইট, চার্ট বা চ্যালসিডেনী জাতীয় প্রস্তরখণ্ড ব্যবহার করা হয়। ফলে এগুলি আকারে ছোট ও হালকা যেমন হয়, তেমনি ধারালো ও মসৃণ হয়। এই অস্ত্রসমূহের মধ্যে ছিল ছুরি (Blade), চাছনি (Scrapper), গর্ত করার যন্ত্র (Burin) ইত্যাদি। নেভাসা সংস্কৃতির প্রযুক্তির প্রয়োগ ফ্লেক জাতীয় হাতিয়ারে দেখা যায়।
ভারতে নিম্ন-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির বহু কেন্দ্রেই উন্নততর মধ্য-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন প্রস্তরযুগের দ্বিতীয় পর্যায়ে (মধ্য-পুরাপ্রস্তর) রূপান্তরের চিহ্ন নর্মদা নদী উপত্যকা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণে নানাস্থানে পাওয়া গেছে। ভীমবেঠকা গুহাবাসে ফ্লেক জাতীয় সূক্ষ্ম হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এছাড়া মহারাষ্ট্রের নেভাসা ও রাজস্থানের দিওয়ান অঞ্চলেও নিম্ন ও মধ্য-পুরাপ্রস্তর হাতিয়ারের সমাবেশ দেখা যায়। বিন্ধ্যপর্বতের পাদদেশে বেলান উপত্যকায় প্রাপ্ত হাতিয়ার ও পশুর হাড়গোড় থেকে ঐ অঞ্চলে মধ্য-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভারতে উচ্চ-পুরাপ্রস্তরযুগের প্রায় ৫৭০টি কেন্দ্র আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এই পর্যায়টি প্রিস্টোসিন যুগের একেবারে অন্তিম সময়ের। এই পর্বে হাতিয়ারগুলিতেও অপেক্ষাকৃত উন্নত ও কার্যকরী বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। হাতিয়ারগুলির মধ্যে আছে পিঠওয়ালা ছুরির ফলা (backed blades), র্যাদা, তুরপুন ইত্যাদি। হাতিয়ারগুলি মূলত সূক্ষ্ম দানাবিশিষ্ট কোয়ার্টজাইট এবং চার্ট জাতীয় পাথর থেকে নির্মিত হত। একটি বর্তুলাকার পাথরখন্ড থেকে চারপাশে লম্বা চিলকা তুলে ধারালো হাতিয়ার তৈরীর বিদ্যা এই পর্যায়ে মানুষের আয়ত্বে এসেছিল। আগুনের চিহ্ন এবং বন্য জন্তুর হাড়গোড় থেকে অনুমিত হয় যে, নানা জাতীয় হরিণ, নীলগাই ইত্যাদির সহাবস্থান ঘটেছিল।
উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া যায় অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্ণল জেলার কয়েকটি গুহা থেকে এবং মধ্যপ্রদেশের পূর্বে শোন উপত্যকার সিধি জেলার অন্তর্গত বাঘোর গ্রাম থেকে। কুণ্ডুল অঞ্চলে পশুর হাড় থেকে বানানো হাতিয়ারের সন্ধান পাওয়া যায়। অনুমান করা হয় যে, বিভিন্ন ধরনের হরিণ ও গণ্ডারের দেহাংশ থেকে এগুলি তৈরী করা হয়েছিল। এখানে আগুনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অন্ধ্রেরই ছোট্ট নদী গুचনার উপত্যকায় ২ থেকে ৫ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলে উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগীয় অসংখ্য হাতিয়ার পাওয়া গেছে। গুঞ্জনার অদূরে আরো একটি ছোট্ট নদীর তীরে দশহাজার থেকে কুড়ি হাজার বর্গমিটার অঞ্চলে ছড়ানো উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগের প্রস্তরায়ুধ পাওয়া গেছে। পাথরের শিল-নোড়া জাতীয় প্রচুর অবশেষ এই অঞ্চলে পাওয়া যায়। ড. দিলীপ চক্রবর্তীর মতে, এই অঞ্চলে এক ধরনের বুনো ধান (নীবার) পাওয়া যেত এবং উচ্চ-পুরাপ্রস্তরযুগেই এগুলি তোলা হত। তাঁর মতে ‘ভোডিকালু’ অঞ্চলে সম্ভবত এক এক স্থানে এক বিশেষ ধরনের কাজ করা হত। যেমন কোথাও হাতিয়ার বানানো, কোথাও কাঠের কাজ, কোথাও খাদ্য প্রস্তুত করা ইত্যাদি। এক একটি পরিবার এক একটি বিশেষ ধরনের কাজে রপ্ত থাকত।
মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সিধি জেলার বাঘোর গ্রামে অনুসন্ধান চালিয়ে উচ্চ-পুরাপ্রস্তর যুগের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই অংশটিকে পুরাতাত্ত্বিক বিচারে ‘বাঘোর-১’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। শোন উপত্যকার মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত এই সংস্কৃতি ২৫,৫০০ থেকে ১০, ৫০০ বছরের প্রাচীন। প্রায় ২৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সংস্কৃতির অবশেষগুলির অস্তিত্ব দেখা যায়। হাতিয়ারগুলির অধিকাংশই লম্বা বা ছোট ছোট চিল্কা থেকে ছাড়ানো। পাথরের হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে পিঠওয়ালা ছুরির ফলা। তুরপুন, র্যাদা, ত্রিভূজাকৃতি খণ্ড ইত্যাদি। সম্ভবত এক একটি স্থানে এক এক ধরনের কাজ করা হত। যেমন এক জায়গায় পাথর জড়ো করা হত, এক জায়গায় চিল্কা ছাড়ানো হয়েছে ইত্যাদি। পেষাই করার উপযোগী শিল-নোড়া জাতীয় বহু প্রস্তরখণ্ড পাওয়া গেছে। এখানেই মাটির ওপর বালিপাথরে নির্মিত একটি চাতাল দেখা যায়, যার মধ্যস্থানে নানাবর্ণময় একটি দণ্ডায়মান প্রস্তরখণ্ড আছে। ঠিক যেন বেদিকার ওপর দেবমূর্তি। সম্ভবত এ-যুগেই মাতৃকা পূজা বা পাথর পূজার সূচনা হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের কুমিল্লার কাছে অবস্থিত ময়নামতী পাহাড়। এই পাহাড়ের দক্ষিণ অংশ ‘লালমাই পাহাড়’ নামে পরিচিত। এখানে পুরাপ্রস্তরযুগের কাঠের হাতিয়ারের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায় পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির বেশ কিছু নিদর্শন উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অযোধ্যা পাহাড়ের চতুর্দিকে উচ্চ-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত, বাঁকুড়ার খাতড়া-মুকুটমণিপুর, ঝাড়গ্রামে বেলপাহাড়ি-শিলদা, গোপিবল্লভপুর থেকে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ময়ূরভঞ্জ পর্যন্ত এলাকায় পুরাপ্রস্তরযুগের সংস্কৃতির অবস্থান স্পষ্ট। পাহাড়, জঙ্গল, নদীতে ঘেরা এই সকল স্থান খাদ্য সংগ্রহকারীদের জীবনযাপনের উপাদানে সমৃদ্ধ ছিল।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, পুরা-প্রস্তরযুগের বেশিরভাগটাই ছিল তুষারযুগের অন্তর্গত। বসবাসকারীরা ছিল মূলত হোমোহাবিলিস পর্যায়ভুক্ত। তারা বসবাস করত মাটির গর্ত, পাহাড়ের গুহায় বা পাথরের খাঁচের নিচে। পুরাপ্রস্তরযুগের শেষদিকে গুহাশ্রয়ে বসবাসের প্রবণতা বেড়েছিল বলে অনুমিত হয়। মধ্যপ্রদেশের ভীমবেঠকায় একটি পাহাড়শ্রেণীতে প্রায় সহস্রাধিক গুহাবাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের কুণ্ডুল জেলার একাধিক কেন্দ্রে গুহাবাসের চিহ্ন দেখা যায়। এরা ছিল অবশ্যই খাদ্য সংগ্রাহক শ্রেণীর মানুষ। গোরু, ছাগল, হরিণ, মাছ ইত্যাদি এবং জঙ্গলের ফলমূল সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবৃত্ত করত। আগুনের ব্যবহার রপ্ত করার ফলে বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে এরা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। পাথর, কাঠ ও হাড়ের হাতিয়ার এরা ব্যবহার করত। তবে প্রস্তরনির্মিত আয়ুধ ছিল প্রধান। হাতিয়ারগুলি ছিল ভারী ও ভোঁতা। তবে হাতিয়ারগুলিকে মসৃণ ও অধিক কার্যকরী করে তোলার প্রয়াস এ-যুগেই শুরু হয়েছিল। সভ্যতার প্রাথমিক পর্বে আদিম মানুষ কিভাবে ভাববিনিময় করত তা এখনও রহস্যাবৃত। ভাববিনিময়ের মাধ্যম হল ভাষা। সেকালে সম্ভবত মানুষের তা আয়ত্বাধীন ছিল না। কিন্তু যেহেতু তখন মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধজীবন কাটাতো, তাতে ভাববিনিময়ের প্রয়োজন ছিল জরুরী। নৃতাত্বিক ও ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, পুরাপ্রস্তরপর্বে মানুষ পরস্পরের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে মনের ভাব অন্যকে বোঝাতে পারত। পশুদের মত বা পাখির মত মুখে কিছু শব্দ সম্ভবত মানুষ করত। কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির বার্তা দিতে তারা সম্ভবত সক্ষম ছিল। অঙ্গভঙ্গি দ্বারাও মনের ভাব, যা পরবর্তীকালের ইশারা, কিছুটা বোঝানোর চেষ্টা তারা করত। কালক্রমে এই পদ্ধতিগুলিই পরিশীলিত হয়ে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম বা ভাষা হয়ে উঠেছে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।