মানুষ বাঁচে তাহার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নহে – ভাবসম্প্রসারণ

প্রিয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছো আশা করি ভালো আছো, আজকে তোমাদের জন্য আমরা নিয়ে এসেছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভাবসম্প্রসারণ “মানুষ বাঁচে তাহার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নহে ”। চলো এই ভাবসম্প্রসারণটি পড়ে নেয়।

মানুষ বাঁচে তাহার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নহে ভাবসম্প্রসারণ

মানুষ বাঁচে তাহার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নহে ভাবসম্প্রসারণ

ভাব-সম্প্রসারণ : মানবজীবনের সার্থকতা তার কর্মে প্রতিফলিত হয় । বয়স বা জীবনের স্থায়িত্ব দ্বারা মানুষের সাফল্য নির্ণীত হয় না।

সময়ের অনন্ত প্রবাহে মানবজীবনের স্থায়িত্ব বেশি নয়। মানুষ খুব অল্প সময়ের জন্যই পৃথিবীতে আসে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে জীবনের কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। আর এই সম্পাদিত কর্তব্য-কর্ম দ্বারাই নির্ণীত হয় জীবনের সার্থকতা কিংবা ব্যর্থতা। যারা সময়কে কাজে লাগিয়ে জীবনের স্বল্প পরিসরে মহৎ কর্ম সাধন করতে পারেন, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে। নিজেকে নিয়ােজিত রাখতে সমর্থ হন- তারা মৃত্যুর পরও মানুষের মন থেকে হারিয়ে যান না। তাঁদের কর্মের মাহাত্ম তাদের মানুষের মনে স্থায়ী আসন দান করে। যুগের পর যুগ মানুষ তাদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। মরণ তাঁদেরকে ছিনিয়ে নিলেও তাদের কর্ম-কীর্তিকে ছিনিয়ে নিতে পারে না। কৃতী মানুষেরা তাদের কর্মগুণে বেঁচে থাকেন। তাদের জীবনের সার্থকতা পরিমাপ করা হয় কর্ম দিয়ে। বয়সের হিসাবে তাঁদের জীবনের মেয়াদ নির্ণীত হয় না। পক্ষান্তরে, যারা দীর্ঘদিন বেঁচে থেকেও মহকর্ম সম্পাদন করতে পারেন না, তারা তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে চিরতরে হারিয়ে যান। পৃথিবীর মানুষ তাদের সহজেই ভুলে যায় । তাদের বাঁচার হিসাব বয়স দ্বারা নির্ধারিত হয়। এসব মানুষের জীবন সময়ের অনন্ত স্রোতে তলিয়ে যায় । তাই সংক্ষিপ্ত মানবজীবনকে দীর্ঘায়িত করতে প্রয়ােজন মহৎ কর্মসম্পাদন। কর্ম-গৌরব ছাড়া সংক্ষিপ্ত মানবজীবনকে প্রলম্বিত করার আর বিকল্প উপায় নেই। যে সকল মনীষীর নাম আজও মানুষের মুখে মুখে পৃথিবীর দিকে দিকে উচ্চারিত হয়, যাদের আমরা পরম শ্রদ্ধাভরে আজও স্মরণ করি তাঁরা ছিলেন মহান কর্মবীর। কর্মগুণেই তারা মানুষের মনে বেঁচে আছেন ও বেঁচে থাকবেন। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ মনীষীগণের দৈহিক মৃত্যুমৃত্যু তাঁদের মানুষের মন থেকে কেড়ে নিতে পারেনি। তারা তাদের জীবনের বয়সকে অতিক্রম করে আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছেন।

সংক্ষিপ্ত জীবনের অধিকারী মানুষ নিজ কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করতে পারে। সময়ের হিসাবে কে কত দিন বাঁচল তা দিয়ে জীবনের মেয়াদ নির্ণীত হয় না, বরং কে কতটুকু মহৎকর্ম সম্পাদন করতে পারল তা দিয়েই জীবনের হিসাব হয়।

বিকল্প ১

মানুষ মরণশীল হলেও কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। বেঁচে থাকার মানে জৈবিকভাবে বেঁচে থাকা নয়, অমরত্ব লাভ করা। সংক্ষিপ্ত মানবজীবনকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে হলে তথা স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতে হলে কল্যাণকর কর্মের কোনো বিকল্প নেই।

মৃত্যু অনিবার্য, এটি চিরন্তন সত্য। তবুও মানুষ তাঁর সৎকর্মের মাধ্যমে চিরকাল স্বরণীয় হয়ে থাকতে পারে। সেজন্য যাঁরা কীর্তিমান তাঁরা তাঁদের সেবামুলক কাজের মাধ্যমে মানবসমাজে বেঁচে থাকেন বহু যুগ ধরে। এ নশ্বর পৃথিবীতে সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ, কোনো মানুষই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না। সেজন্য দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা বড় কথা নয়, কারণ এতে তার অমরত্ব আসে না। মানুষ অমরত্ব পায় তার কর্মের মাধ্যমে। কর্ম তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে সাধারণ মানুষের অন্তরে চিরদিন। অর্থাৎ, যেসব মানুষ নিঃস্বার্থভাবে পরোপকারে আত্মনিয়োগ করেন, মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে বিলিয়ে দেন- মৃত্যুর পরেও তাঁরা অমর হয়ে থাকেন মানুষের মাঝে। এভাবে কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব তাঁদের সৎ কর্মের জন্য অমরত্ব প্রাপ্ত হন। এসব লোকের দৈহিক মৃত্যু হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অমর। সর্বদাই তাঁরা মানবের অন্তরে বিরাজ করেন। মানুষ তাঁদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনাদর্শই যুগ যুগ ঘরে মানুষের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকে। সুতরাং তাঁদের মৃত বলে মনে হয় না।

মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মাধ্যমে, তার বয়সের জন্য নয়। কত কোটি কোটি মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর কেউ তাদেরকে মনে রাখে নি। তারা ভেসে গিয়েছে কালস্রোতে। অথচ যেসব কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গ মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা অমর। তাই সক্রেটিস, প্লেটো, গ্যালিলিও প্রমুখ কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গের মৃত্যু হয়েছে বহুদিন পূর্বে কিন্তু তাঁরা আজও চির ভাস্বর মানুষের হৃদয়ে।

নশ্বর পৃথিবীতে মানুষ অবিনশ্বর হয় কর্মগুণে। মানবকল্যাণে ব্যয়িত জীবন মানুষের মনে বেঁচে থাকে অনন্ত কাল। বস্তুত জীবনের সার্থকতা এখানেই নিহিত।

সহজ ভাবে

কেবল দীর্ঘ জীবনের মধ্যেই মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে না; বরং মহৎ কার্যাবলির জন্যেই কিছু মানুষ জগতে চির অমর হয়। কর্মেই মানুষের যথার্থ পরিচয়। মানুষের জীবন সীমিত। এই সীমিত সময়ের মধ্যে মানুষ পৃথিবীতে যে ভূমিকা পালন করেন তার মধ্যেই ফুটে উঠে তার পরিচয়। ইংরেজিতে একটি কথা আছে,  “Man does not live in years but in deeds.” মানুষের জীবন স্বল্পস্থায়ী হতে পারে, হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী। জীবনের ব্যাপ্তিকাল দিয়ে মানুষের মূল্যায়ণ করা হয় না। মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় তার কর্ম দ্বারা। বয়স বেশি হলেই বাঁচা সার্থক হয় না। বরং যারা অমোঘ মৃত্যুর কথা জেনেও সংক্ষিপ্ত জীবনে মানব কল্যাণে সুকীর্তির স্বাক্ষর রেখে যান, তাঁরা মরে গিয়েও চিরকাল মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকেন। মানুষ তাঁদের সুকীর্তির কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে মাথা নোয়ায়। দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও মানুষের মাঝে তাঁরা বেঁচে থাকেন এমন লোকের সত্যিই মৃত্যু নেই। পৃথিবীর স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিগণ শুধু তাদের কর্মের মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে অমর, অক্ষয় ও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে আছেন। পৃথিবীতে বহু লোক অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেও তাদের কর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন। আবার কেউ দীর্ঘায়ু পেলেও তাদের নাম পরিচয় মিশে গেছে কালস্রোতে। বালক ক্ষুদিরাম দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে অমর হয়েছেন। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার বাংলা ভাষা আদায়ে অকালে মৃত্যুবরণ করলেও বাংলার মানুষ কোন দিন তাদেরকে ভুলবে না। মাত্র একুশ বছর বেঁচে থেকে প্রতিভাবান কবি সুকাšত ভট্টাচার্য আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স), সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, আব্রাহাম লিংকন, মাদার তেরেসা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম-এঁদের প্রত্যেকেই মৃত্যু বরন করেছেন। কিন্তু তাঁদের আদর্শ চিরকাল স্মরনীয় হয়ে থাকবে। কর্মই তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে-বয়স নয়।  বিশ্বজগতে অনন্ত কাল প্রবাহে মানুষের জীবন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। এ ক্ষণস্থায়ী জীবন ও মহিমা পেতে পারে মানুষের মহৎ কর্মে ও অবদানে। তখন মৃত্যুর পরও মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাই বয়স মানুষের জীবনের সার্থকতার মাপকাঠি নয়, মহৎ কীর্তির মাধ্যমেই মানুষের জীবন সফল ও সার্থক হয়।

আশা করি তোমরা এই ভাবসম্প্রসারণটি বুঝতে পেরেছো। আমাদের সাথেই থাকো।

Leave a Comment